গত দুইমাসে ভাতের চেহারা দেখিনি। ডাল চচ্চড়ি ভর্তা আর মাছের ঝোল তো স্বপ্নকেও পাশ কাটিয়ে যায়।ক্যান্টিনে বিশাল দেহী রাশিয়ান বাবুর্চি বেকুব মিশার(আমরা ডাকতাম তাকে মদনা বলে) কাপুস্তা;পাতা-কপির ঝোল।আহা!সেকি স্বাদ ক্যান্টিনে ঢোকার মুখে দোতলার সিঁড়িতে দাড়িয়েই যার মৌ মৌ বোটকা গন্ধে আমাদের গা গুলোতো।
কাটলেট সেদ্ধ-মাংসের কিমা নুন ঝাল ছাড়া দলা পাকিয়ে সেদ্ধ করে ভুট্টার আটার গোলায় ডুবানো সে সুস্বাদু খাবার খানি একবারই চেখেছিলাম।
গুলাইশ-আলুকে সেদ্ধ করে মেশিনে চটকানো। একটা প্লেটে এক চামচ গুলাইশ ঢেলে চামচের পেটটা দিয়ে একটুখানি চাপ দিয়ে একটা গর্তের মত বানিয়ে সেখানে একহাতা সেই কাটলেটের সালুন- স্যরি ঝোল!
হুমম! সত্যিকারে সবচেয়ে এখনো স্বাদের খাবার ছিল বটে সেইখানে আর সেটা হল সিদ্ধ ডিম। সিদ্ধ ডিম দেখে যে সকাল বিকাল জিভ দিয়ে লালা ঝড়তে পারে তা আগে বুঝিনি।প্রায় তিনমাস আমি শুধু সেইটে খেয়েই বেঁচে ছিলাম।আজ থাক এই প্যাঁচাল-রসনা বিষয়ে না হয় অন্য একদিন বলব।
ভাষা বুঝিনা। ওদের যে বলব একটু লঙ্কার গুড়ো হোক সেটা লাল সাদা কিংবা কালো মিশিয়ে একটু ভেজে কিংবা পুড়িয়ে দিতে সেটাও বলতে পারিনা।তখন আমাদের গণ্ডিতে রাশিয়ার সেই ছোট্ট শহরটাতে ইংরেজি বুঝনে-ওয়ালা মাত্র দুইজন পণ্ডিত ছিল- দুজনেই আবার মহিলা। তন্মধ্যে তাতিয়ানা পাবলানা যিনি ছিলেন আমাদের ডিপার্টমেন্টাল হেড তার ঝানু পন্ডিতপনার সামনে আমরা আমরা ইংরেজী বোল খুলতে ভয় পেতাম।অন্যজনও আমাদের মহামান্য শিক্ষিকা লারিসা আলেকজান্দ্রা। ভয়ঙ্কর সুন্দরী সেই মহিলাকে একটা ইংরেজি শব্দ বুঝাতে গিয়ে মাথার ঘাম যেন-পায়ের তালু স্পর্শ করত।
সারাদিন মিশা'র হাতের বিস্বাদ খাবার খেয়ে দেশী খাবারের কল্পনায় রাতভর জাবর কাটি।
রাশিয়ায় তখন শীতকাল। ভর দুপুরেও যেখানে পরিবেশ অন্ধকারাচ্ছন্ন।বিদেশী ছাত্রদের জন্য বরাদ্দ পঞ্চম তলায় কর্তৃপক্ষ কোন রান্না ঘরের এন্তেজাম করেনি। ভেবেছিলেন হয়ত বিদেশে পড়তে সব নবাব কিংবা শেখের পুত্ররা আসছেন তাদের কি আর নিজে রেঁধে খাওয়ার মত জঘন্য মনোবৃত্তি হবে?
চারতলায় রুশ ছেলেমেয়েরা সন্ধে হলেই হল্লা করে রান্না করে আর আমরা উপরে ওঠার সিঁড়ির মুখের দরজা খান দিয়ে জিরাফের মত গলা বাড়িয়ে জুল জুল চোখে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখি।আহারে আমরা যদি এমন করে রেঁধে খেতে পারতাম?
কোথায় বাজার-কোথায় হাট? কিস্যু চিনিনা।এসেছি পনের দিনও হয়নি।হোস্টেল থেকে দু'শ কদম দুরে ভার্সিটি আর দেড়’শ কদম দুরে ক্যান্টিন।আমাদের দৌড় সর্বোচ্চ সামনের ওই রাস্তাখানা পেরিয়ে টেলিফোন একচেঞ্জ পর্যন্ত। মাইনাস তিরিশ ডিগ্রী সেলসিয়াসে এর থেকে বেশিদূর যাওয়াটা দুঃসাহসিক অভিযানের মত ছিল।
অবশেষে কয়েকজন তরুণ একদিন পরিকল্পনা করলাম সেই দুঃসাহসিক অভিযানের।
হাটতে হাটতে যাব সোজা এক রাস্তা ধরে- কোন মতেই ডাইনে বায়ে নয়।দুচার মাইলের মধ্যে কোথাও না কোথাও দেখা মিলবেই আমাদের প্রত্যাশিত বাজারের। সেখান থেকে প্রয়োজনীয় কেনাকাটা সেরে ফিরে আসব সেই পথ ধরে। হোস্টেলের চারতলায় গিয়ে রুশ ছাত্রছাত্রীদের হাতে পায়ে ধরে একখানা ফ্রাইপ্যান নিয়ে আলু ভেজে খেলেও শান্তি।
ঢাউস বাঙলা টু রুশ ডিকশনারি ঘেঁটে বের করলাম মাত্র দুখানি শব্দ,একটা তেল যার রুশ প্রতিশব্দ ‘মাসলা’ আরেকখানা আলু যেটা লেখা আছে ‘কারতোফিল’। আজকের মত এ দুটোই থাক, একবার বাজার চিনে গেল তখন তখন না হয় স্বাদ পাল্টানো যাবে।লেখাটা তখনো ভাল করে শিখিনি। ডিকশনারিতে যেমন করে লেখা ছিল তেমনি করে লিখলাম একটা সাদা কাগজে।
লটবহর ঘেতে যতগুলো গরম জামা কাপড় ছিল সব কখানা গায়ে চড়ালাম। মোজা পড়লাম দুই জোড়া। অবশেষে সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বীর দর্পে এগিয়ে চললাম আমরা তিন দুঃসাহসী অভিযাত্রী।
বরফ মাড়িয়ে হাটছিতো হাঁটছিই। হাত পা ঠাণ্ডায় প্রায় অসাড় হয়ে গেল,তবু বাজারের দেখা নেই।চারিদিকে শুধু কংক্রিট পাথরের চারকোনা উঁচু উঁচু দালান কোঠা-ট্রিপিক্যালি রুশ স্টাইলের।
হতাশ ফিরে আসবার তোড়জোড় করছি যখন ঠিক তক্ষুনি দেখতে পেলাম তেমনি একখানা অট্টালিকা থেকে ভারি দরজা ঠেলে বাজারের থলে হাতে বেরিয়ে আসছেন এক রুশ বৃদ্ধা।খুশিতে লাফিয়ে উঠলাম সবাই! শীতের তীব্রতা আর ক্লান্তির কথা ভুলে একসাথে দৌড়ে গেলাম সেই বাড়ির দিকে।
ভিতরে ঢুকে চোখ ছানাবড়া। বাইরে থেকে এতটুকু বোঝার উপায় নেই-এ দেখি বেশ বড় সড় শপিং মল। দেখতে আমাদের এখনকার আঘোরা কিংবা নন্দনের মত কিন্তু কোন ট্রলি নেই –হাত দিয়েও কোন কিছু নেবার উপায় নেই।
কাউন্টারের ওপাশে বিক্রেতা রমণী-গন ক্রেতার ফরমায়েশ অনুযায়ী দ্রব্য গুলো প্যাকেট-জাত করে টাকা পয়সা গুনে নিয়ে হাতে ধরিয়ে দিচ্ছে।টাকা পয়সা হিসেব করার কৌশল তেমনি আদ্যিকালের। আমি বাপের জন্মে এমন ক্যালকুলেটর দেখিনি। কয়েকখানা লোহার দণ্ডের মাঝে গোল গোল কাঠের ঘুটি গুলো দ্রুত হাতে ডাইনে বায়ে চালান করে কি যে হিসেব করছে আল্লা মালুম!
ত্রস্ত পায়ে দুরু দুরু বুকে এগিয়ে গেলাম এক বিক্রেতা রমণীর কাছে।
মহিলা আমাদের দেখেই একগাল হেসে কলকলিয়ে বলল, স্দ্রাস্তেবিচে রিবিয়েতা!
প্রতিউত্তরে আমরাও সমস্বরে বললাম,স্দ্রাস্তেবিচে!
বলুন আপনাদের কিভাবে সাহায্য করতে পারি?(পুরোটা বুঝি নাই। শুধু পামাগিচ মানে যে সাহায্য এইটুকু বুঝেছিলাম।)
প্রতিউত্তরে এবার কিছু বলব যে জানি ছাই। খেই না পেয়ে চিরকুটখানা বাড়িয়ে ধরলাম তার চোখের সামনে;
মহিলা ততক্ষণে বুঝে গেছেন আমাদের ভাষার দৌড়! একটা কাগজের ঠোঙ্গায় এক দলা মাখন মেপে ঘুটি নেড়ে হিসেব করে কাগজে টাকার অঙ্ক লিখে আমাদের হাতে ধরিয়ে দিয়ে কারতোফিল লেখাটায় আঙ্গুলের পরশ বুলিয়ে চেহারায় দুঃখ দুঃখ ভাব এনে মাথা নেড়ে বললেন, 'এতা নিয়েতো!'
তার মানে নেই! হায় হায় কি বলে আলুর দেশ রাশিয়ার বাজারে আলু নেই-এইটে কেমন করে হয়।ইতি উতি চোখ বুলিয়ে মহার্ঘ্য আলুর দেখা না পেয়ে কপাল চাপড়াতে চাপড়াতে আমরা বেরিয়ে এলাম।
তিনজনের ছ’খানা দস্তানা পরা হাতে তখন মাত্র-একটা প্যাকেটে মোড়া আধা কেজি মাখনের ডেলা। এইটে নিয়ে কি করব বুঝে উঠতে পারছিনা।
প্রচণ্ড হতাশা নিয়ে কেতরে কেতরে হেটে আসছি হোস্টেল অভিমুখে।পথের শেষে এসে হোস্টেলের মুখে আমাদের মহিলা 'আখরান'(হোস্টেলের গার্ড) এর সাথে দেখা।মোটাসোটা গড়নের সেই প্রায় বৃদ্ধা মহিলা তার ন’দশ বছরের ফুটফুটে নাতনীকে নিয়ে বাইরে ঘুরতে যাচ্ছে।
আমাদের দেখে বরাবরের মত হেসে মমতা জড়ানো কণ্ঠে কি যেন বললেন?
প্রতিউত্তরে সম্ভাষণ জানাতে গিয়ে আমরা তখন কেঁদে ফেলি আরকি! মনে হল মায়ের দেখা পেয়েছি। কাঁদো স্বরে ভিন ভাষায় আলতু ফালতু বকে শেষমেশ দেখালাম তাকে চিরকুটখানা। মহিলা আবার চোখে কম দেখেন। কাগজখানা বাড়িয়ে দিলেন তার নাতনীর দিকে। বাচ্চা মেয়েটা চোখ বুলিয়ে একটু হেসে বুড়ির কানে কানে কি যেন বলল।বুড়িও কাগজখানা আমাদের দিকে ফিরিয়ে দিতে দিতে হাসতে হাসতে যা বললেন,তা বুঝেছি অনেকদিন বাদে।
'কারতোফিল' মানে আলু তবে একবচন। রুশরা 'কারতোফিল 'বলতে বোঝে আলু ভাজা বা পটেটো তখন-আর কাচা গোল গোল আস্ত আলু কিনতে গেলে বলতে হয় ‘কারতুসকা’!!!
এটা বুঝেছি তখন যখন আমরা সব খাওয়া শিখে গেছি।