তোমাকে সালাম
---------------- সেলিনা জাহান প্রিয়া -------------------------------
ইংরেজদের শোষণ এবং লুণ্ঠনের সহযোগী এবং গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস এর প্রিয়পাত্র দেবী সিংহের ভয়াবহ অত্যাচার এবং নির্যাতনে রংপুর এবং দিনাজপুর অঞ্চল মৃতপ্রায়। দেবী সিংহ ছিলেন ইংরেজ মনোনীত এই অঞ্চলের ইজারাদার। কিন্তু, তাঁর সীমাহীন লোভ লণ্ড-ভণ্ড করে দিয়েছিলো এই জনপদকে। শুধু এই অঞ্চলে নয়, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলা ও বিহারের দেওয়ানী লাভের পর সমগ্র বাংলাদেশ ও বিহারে যে অবর্ণনীয় অরাজকতা দেখা দিয়েছিলো, তার প্রধান কারণ ছিলো দেবী সিংহের লুণ্ঠন ও উৎপীড়ন। তাঁর অপরিসীম অত্যাচার ও অন্তহীন অবাধ লুন্ঠনে রংপুর এবং দিনাজপুর অঞ্চল পরিণত হয়েছিলো শ্মশানে। চারিদিকে ভেসে বেড়াচ্ছিলো অসহায় কৃষকদের হাহাকার আর গগনভেদী দীর্ঘশ্বাস।
দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে অসহায় হরিণও ঘুরে দাঁড়ায়, এই অঞ্চলের নিরীহ এবং নির্বিবাদী কৃষকেরাও তেমনি ঘুরে দাঁড়িয়েছিলো। এমনিতেই মৃত্যু হচ্ছে মহামারীর মতো, কাজেই মৃত্যুকে নিয়ে তাদের আর কোনো ভয় ডর ছিলো না। বরং পরম পরাক্রমশালী দেবী সিংহ এবং সীমাহীন শৌর্যবান ইংরেজদের বিরুদ্ধে বিপুল বিক্রমে বিদ্রোহ ঘোষণা করে তারা।
খনির ঘন অন্ধকার থেকে যেমন করে উঠে আসে উজ্জ্বল হীরকখণ্ড, তেমনি সাধারণ কৃষকদের মধ্য থেকে উঠে আসেন এক অসামান্য মানুষ, একজন অমিতবিক্রমশালী সিংহ-হৃদয় পুরুষ। নিপীড়িত জনগণকে সংঘবদ্ধ করে দেবী সিংহের বিরুদ্ধে প্রবল তেজে রুখে দাঁড়ান তিনি।
সেটি সতেরো শো তিরাশি সাল। এ বছরই এই অনন্য মানুষটি দেবী সিংহকে করে তোলেন নেংটি ইঁদুরের মতো ভীত এবং অসহায়। ইতর প্রাণীর মতো প্রাণভয়ে পলাতক হন দেবী সিংহ আর এই মুক্তিকামী মানুষটি কাঁপিয়ে দেন বাংলার বুকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনকে। একের পর এক যুদ্ধে বিজয়ী হয়ে বিপর্যস্ত করে তোলেন তাদের। তবে, শেষ রক্ষা হয় না। এরকমই এক যুদ্ধে আহত হয়ে বন্দি হন তিনি। তারপর মাত্র কয়েকদিনের মধ্যেই বন্দি দশায় মৃত্যু ঘটে তাঁর। কৃষকদের এই সর্বব্যাপী সশস্ত্র বিদ্রোহই রংপুর বিদ্রোহ নামে ইতিহাসে বিখ্যাত হয়ে আছে।
আর এই বিদ্রোহের যিনি নায়ক, জনগণের জন্য আত্মত্যাগকারী সেই বীরের নাম নূরুলউদ্দীন।
ইতিহাসে অন্ধকার পৃষ্ঠা থেকে নূরুলউদ্দিনের বিস্তারিত পরিচয় উদ্ধার করা যায় না। শুধু এইটুকুই জানা যায় যে, তিনিই প্রথম রংপুরের কৃষকদের সংঘবদ্ধ করেছিলেন। তিনি তাদের নিয়ে সশস্ত্র বিদ্রোহে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন নিরীহ কৃষকদের রক্তনালী থেকে রক্ত চুষে খাওয়া দূর্বৃত্তসম দেবী সিংহের হাত থেকে রক্ষা করতে।
রংপুরের বুকে নূরুলউদ্দিন যে বিপ্লবের লাল আগুন জ্বালিয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন, তাকে নির্বাপিত করতে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়েছিলো ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে। আর যাকে কেন্দ্র করে এই বিদ্রোহ, সেই দেবী সিংহকে রংপুর ছেড়ে পালাতে হয়েছিলো জান হাতে নিয়ে। জনগণের চুড়ান্ত জয় হয়তো হয় নি সেদিন, কিন্তু এই সাময়িক জয়ও ইতিহাসের পাতায় লিপিবদ্ধ হয়ে আছে সগৌরবে। আর সেটাই যুগে যুগে সাহস এবং প্রেরণা যুগিয়েছে ভবিষ্যতের গণ বিদ্রোহ এবং জন-আন্দোলনকে।
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে এপ্রিল, ২০১৭ দুপুর ২:৪০