হোলি আর্টিজান তখন সারাদেশে এক অপবিত্র লজ্জার নাম।ধর্মের নামে অধর্মের যে রক্তাক্ত এপিসোড তা তখনো সারা দেশ কে ঘৃণা ও লজ্জায় নুহ্য করে রেখেছে। ঠিক এমন একটি সময়ে আমি দেশত্যাগী হওয়ার চুড়ান্ত ধাপে উপনীত। মধ্যপ্রাচ্যের দেশ কাতারের দোহাতে নতুন কর্মস্থল। বউ আর নিকটাত্মীয়দের সাথে বিদায়ের পালা শেষ। জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ওয়েটিং লাউঞ্জে আনমনে বসে হৃদয়ের গহীনে বেজে উঠা বিরহ বেদনার করুন বিউগল নিজে নিজেই শুনছিলাম।
হঠাত মগ্ন চৈতন্যে শিষ দিয়ে, স্মীত হেসে, হেলো বলে পাশের সীটে এসে বসল এক স্বর্ণকেশী। তন্বী পশ্চিমা তরুনী। চাহনি কিছুটা ক্লান্ত ও পোশাকে একদম ক্যাজুয়েল। আসার পর থেকে তার ফোন, ঠোঁট , দাঁত কিছুরই বিরাম নেই। একের পর এক ফোন আসছে। আর সে কখনো বাংলা, কখনো ইংরজী, কখনো জার্মান ভাষায় কথা বলে যাচ্ছে। কথার ফাঁকেফাঁকে সে তার টিফিন বক্স খুলে বিচি কলা, পেঁয়াজু আর বেগুনি চিবিয়ে সাবাড় করছিল। বুঝলাম মেয়েটি জার্মান। আমি তার ভাষা প্রাচুর্যে এবং খাদ্যভ্যাসে বেশ অবাক হচ্ছিলাম ও কৌতুকবোধ করছিলাম, বিশেষ করে বিচি কলা! সে ফোনে যে কথা গুলো বলছিল তার বেশীরভাগের সারমর্ম হচ্ছে, সে নিরাপদে এসে ইমিগ্রেশান পাস করেছে, সে ভাল আছে, সে নিরাপদ। আমি মেয়েটার বিমর্ষ ও ক্লান্ত চেহারার হোলি কারনটা অনেকটা আচ করতে পারলাম এবং লজ্জিত হলাম। একটু আডমোড় দিয়ে নিজেকে পরখ করে নিলাম। আমার সাথে কোন চাপাতি বা বন্দুক নেইতো?
এর ফাঁকে আমি আরো কয়েকজন ক্রিষ্টিয়ান সাদাচর্মের লোক দেখলাম। তাদের মধ্যে একজন মধ্য বয়স্ক রমনীও ছিলেন। ওয়েটিং লাউঞ্জের পাশে কতগুলো দানবক্স রাখা। দেওয়ানভাগী বা কোন হুজুরে কেবলার দানবক্স নয়। দেশের সুপ্রতিষ্ঠিত কিছু মানবিক দাতব্য প্রতিষ্ঠানের দানবক্স। সাদা চামড়ার লোকগুলো দল বেধে সে বাক্সগুলোতে ডলার ফেলতে লাগলো আমেনা সখিনাদের জন্য। আমি আবারো লজ্জিত হলাম। কিজানি আমি কিংবা আমার আশেপাশের কেউ তাদের কল্লা ফেলে দিয়ে অশেষ নেকি হাসিলের কথা ভাবছে কিনা?
চুড়ান্ত ইমিগ্রেশান শেষ করে অনবোর্ড, অতঃপর আকাশে উড়াল দিলাম। তন্বী জার্মান স্বর্ণকেশী এর মধ্যে কোথায় হারিয়ে গেল জানিনা। আর যাই হোক সেতো আর আমার মত ইকনোমি ক্লাসের যাত্রী নয়।
প্রায় ছয় ঘন্টা যাত্রা শেষে ককপিটের ঘোষনা আসলো ' আমরা অল্প কিছুক্ষনের মধ্যে দুবাই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করবো। আমি অবাক হলাম এক যুগ আগেও এই বিমানবন্দরের নাম এটাই ছিল। এরা আমাদের চাইতে সব দিক দিয়ে এগিয়ে থাকলেও এদিক দিয়ে ব্যাকডেটেড। গত বার বছরে অন্তত একবার বিমানবন্দরের নাম আপডেট করা উচিত ছিল। এসব ভাবতে ভাবতে দুই থেকে তিন মিনিটের ব্যবধানে আবার ঘোষনা 'অনিবার্য কারণবশত আমরা দুবাই অবতরন করতে পারছিনা। আমরা চলে যাব প্রতিবেশী আল- আইন বিমানবন্দরে।" হেতু কি? হেতু কি? কেবিন ক্রুদের মুখে তালা। কেউ কিছু বলছেনা।তবে আল-আইন বিমানবন্দরে বিমানের পেটের ভিতর বসে বিবিসি লাইভে জানলাম এমিরেটস -এর ফ্লাইট গ্রাউন্ড এক্সিডেন্টের স্বীকার হয়েছে এবং ফলশ্রুতিতে বিমানবন্দর ক্লোজ।এক কান দু'কান করে সবাই জানল, হায় হুতাশ সংক্রমিত হল। কিন্তু তখনো কেবিন ক্রুরা জেনেও কিছুই না জানার ভান ধরলো! প্রফেশনালিজম কাকে বলে?
আল-আইনে ছয় ঘন্টার দুঃসহ বিরতি শেষে আবারো বিমান আকাশে উড়ল। ত্রিশ মিনিট পরে নামলাম দুবাই। স্থানীয় সময় রাত ন'টা। ততক্ষনে আমার দোহা ট্রানজিট ফ্লাইটের সময় সদ্যপ্রয়াত অতীত। আমি জানিনা আমাদের পরবর্তী ফ্লাইটের ভাগ্যে কি আছে। আমি একা নই। হাজার হাজার লোক। বহির্গমন, আগমনী সব জায়গায় জনস্রোত। চরম সিডিউল বিপর্যয়। বিশ্ব জাতিস্বত্তার এক অন্য রকম মিলনমেলা। বিশ্বের অধিকাংশ জাতির প্রতিনিধি আপাতত এইমুহুর্তে দুবাই বিমানবন্দরে উদগ্রীব হয়ে শুয়ে বসে আছে।সবার একি প্রশ্ন 'হোয়াট এবাউট মাই ফ্লাইট?' হুড়োহুড়ি, ছুটোছুটি ত্রাহি অবস্থা। যেন মোহনগঞ্জ স্টেশনে এসে থেমেছে ট্রেন।
একটা লম্বা লাইনে গিয়ে দাঁড়ালাম। পাশাপাশি তিনটা লাইন। রাত অনেক হয়েছে। এতক্ষনে দোহা পোঁছে বাড়িতে জানিয়ে দেওয়ার কথা।ওরা নিশ্চয় উদ্বিগ্ন। নিজের কাছেও অস্থীর লাগছিল। পকেট থেকে মোবাইল বের কিরে ওয়াইফাই কানেক্টের চেষ্টা করছি। হঠাত পাশ থেকে কেউ একজন আমাকে হেলো বল্ল। দেখি আমার পাশের লাইনে একি সামান্তরালে দাঁড়িয়ে আছে সেই স্বর্ণকেশী। আমি হেলো বললাম। এই প্রথম শুরু হল আমাদের কথা। বউকে ইমোতে কল দিয়ে পেয়ে গেলাম। মন কিছুটা শান্ত হল। আমার মোবাইলের স্ক্রীনে আমাদের যুগল ছবি। সে দেখে জিজ্ঞেস করলো কে, বললাম আমার স্ত্রী। খুব সুন্দর করে সে বললো," সী ইজ বিউটিফুল। তারপর বাংলায় বললো 'তিনি খুব সন্দর'। আমার মন ভাল লাগায় পরিপূর্ণ হল।
জানলাম ওর নাম আন্নালিসে। বাংলাদেশে আছে একটা এনজিওতে। থাকে মায়মেনসিং।সেখান থেকে এসেই বিমানে উঠেছে। পথের যাত্রা নিয়ে তার মা ও বন্ধুরা খুব ওয়ারিড ছিল। ৬ মাসের ছুটিতে যাচ্ছে একাডেমিক প্রয়োজনে(তার ভাষায় স্টাডি লাগবে)। জানতে চাইলাম তার বাংলা ভাষায় পারদর্শিতা নিয়ে। খুব সরল স্বীকারুক্তি, যাদের সাথে কাজ করি তারা গ্রামের খুব সাধারণ মানুষ।তাদের কে বুঝতে হলে, বুঝাতে হলে ইংরেজী অকার্যকর ও বিলাসীতা। তাই সে বাংলা শিখেছে। তার কোন শিক্ষক নেই। নিজের চেষ্টা ও মায়মেনসিংয়ের সাধারণ নারীদের সহযোগিতায় সে এখন বাংলা বলে। কথা হল বাংলাদেশের চলমান পরিস্থিতি নিয়ে। সে অবাক। হিসেব মিলাতে পারছেনা। বাংলাদেশের মানুষের মাঝে সে এমন টা কোনদিন দেখেনি।এমন কি অনেক দাড়িওয়ালা সেইন্ট ( হুজুর তার ভাষায় সেইন্ট) সাথে তার কথা হয়েছে। তারাও ভাল। কিন্তু হটাত কেন এমন হল। সামথিং রং। অথচ জাতি হিসেবে এই পর্দার আড়ালের রং সত্য আমরা বুঝলাম না।বুঝার প্রয়োজনও বোধ করলাম না!
উইল ইউ কামব্যাক এগেইন? জানতে চাইলাম। আন্না জানাল সে বাংলাদেশে আরো অনেকদিন থাকতে চায়। সে বাংলাদেশ কে ভালবাসে। কিন্তু এবার তার মা তাকে আসতে দেয় কিনা কে জানে। তবে সে সর্বোচ্চ চেষ্টা করবে।
একটা সময় ডাক আসলো। আমি আর আন্না পরস্পর বাই বলে দু'দিকে চলে গেলাম। সে চলে যাওয়ার পর আমার অসস্থি লাগছিল। মেয়েটা যে মন, মনন ও দর্শনে সুন্দর সেটা তাকে বলা উচিত ছিল। কিন্তু বলা হয়নি।
আমার ফ্লাইট ক্যন্সেল। পরেরদিন সকাল দশটায় নতুন সিডিউল। হোটেল ভাউচার নিয়ে রাত দুটায় এসে উঠলাম দুবাই পাম হোটেলে। ক্ষুধায় প্রান ওষ্ঠাগত। হাতে লোকাল কারেন্সি নাই। থেকেও কি হবে দোকান পাট বন্ধ। হোটেলের রেষ্টুরেন্ট ততক্ষনে ধুয়ে মুছে কাল সকালের জন্য সাজছে। রুম সার্ভিস ফ্রী পানি দিয়ে গেল। বল্লো টাকা দিলে খাবার দেওয়া যাবে। কিন্তু টাকাতো নাই। অগত্য পানি খেয়ে ঘুমানোর ব্যর্থ চেষ্টা করলাম। সকালে উঠেই রেডি হয়ে নিচে নেমে রেষ্টুরেন্টে গিয়ে পেট শান্তি করলাম। সাতটায় বের হয়ে যেতে হবে।রিসিপশানে রুম কি হ্যান্ডওভার করতে এসে দেখি লবিতে বসে আছে আন্না। হেলো আন্না ইউ অলসো হিয়ার। সে স্মীথ এসে উত্তর দিল ইয়া।মিউনিখ গামী ফ্লাইট এগারটায়। সে আমার এক ঘন্টা পরে বের হবে । শাটল বাসের ড্রাইভার ডাকাডাকি করছে। যেতে হবে। তবে এবার আর ভুল নয়। আন্নার কাছে এগিয়ে গেলাম। চোখের দিকে তাকিয়ে বললাম, " আন্না ইউ আর বিউটিফুল। স্মীত হেসে প্রশংসা গ্রহন করে ধন্যবাদ জানাল সে।
আন্নার কাছ থেকে ধন্যবাদ নিয়ে চলে আসলাম।সুসজ্জিত দুবাইয়ের মসৃন রাস্তায় সাঁই সাঁই করে ছুটলো শাটল। মরুভুমি থেকে ছুটে আসা সকালের উষ্ণ বাতাসে অন্যরকম এক মাদকতা। ভাল লাগার সৌরভে ভরে আছে চারপাশ। তবুও বুক ভেঙ্গে নামে দীর্ঘশ্বাস। এবারও আন্না কে একটা কথা বলা হয়নি।খুব ইচ্ছে করছিল বলি"আন্না ইউ আর অলওয়েজ ওয়েল্কাম টু বাংলাদেশ। বাংলাদেশ ইজ সেইফ ফর ইউ"। কিন্তু বলতে পারলাম কই?
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা অক্টোবর, ২০১৬ বিকাল ৪:২২