রাজধানী ঢাকার নাইটেঙ্গেল মোড়। গাড়ীর কাঁচ ভাঙ্গার শব্দ, দোকানের সাটার পতণের শব্দ ,ধর-ধর,মার-মার, পুলিশের রায়ট কারের আর্তনাদ ছাড়া আর কোন শব্দ শোনা যাচ্ছেনা। কয়েকটা গাড়ি পুড়ে চাই হয়ে যাচ্ছে। বোমার আওয়াজে আর মুহর্মুহু গুলির শব্দে কেঁপে উঠছে আশ পাশের দালান কোঠা। দুই দল মানুষ লাঠি সোটা আর আগ্নেয়াস্র নিয়ে ছুটাছুটি করছে। একদল জয় বাংলা আরেক দল জিন্দাবাদ ! অন্য একদল মানুষ প্রানভয়ে নেংটি ইঁদুরের মত দৌঁড়াচ্ছে। উর্দি পরা কিছু মানুষও ছুটছে। এরা আইনের লোক !
ভাঙ্গা কাঁচের গুঁড়ো , ব্যানার, ফেষ্টুন, কয়েকটা স্যান্ডেল, ছবির ফ্রেম ইতিউতি ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে । কিছু ফ্রেমে লেগে আছে মুজিবের ছবি, কিছু ফ্রেমে জিয়ার। এদের একজন বাংলাদেশ নামক কবিতার কবি আরেকজন ৭১ রনাঙ্গনের কবি। এরা দুজনে এক্ষনে একসাথে ভূপাতিত। পুলিশ, মারমুখো জনতা, পলায়নপর নেংটি ইঁদুর সবাই সমানে মুজিব-জিয়ার ছবি মাড়ি্যে যাচ্ছে। এদের কে কাকে ভালবাসে আর কে কাকে ঘৃণা করে বুঝার উপায় নাই।
তিন দিক থেকে তিনটা রাস্তা এসে মিসেছে এখানটায় । ঢাকা শহরের এই রকম জায়গাগুলো ফেরিওয়ালার হাঁকডাক, বাস কন্ডাকটরের ডান-বাম, যাত্রী-হেলপারের বচসা-খিস্তি খেউর, গাড়ির হর্ন,রিক্সার টুংটাং,ট্রাফিক পুলিশের হুইসেল, এম্বুলেন্সের আর্তনাদ ইত্যাকার নানা শব্দে ব্যাতিব্যাস্ত থাকে। রিক্সা, ঠেলা, ট্যাক্সি, বাস আর মানুষের গিট্টু লেগে থাকে সারাদিন।কিন্তু এখন সেখানে যুদ্ধের ডামাঢোল।
তোতা মিয়া এতক্ষন হোটেল বিজয় নগরের সামনে ফুটপাতে টং দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। ঢাকা শহরে তোতা মিয়ার কিছুই চেনা নাই। লামনিরহাটের হাতিবান্ধা থেকে নাইটকোচে চড়ে আজ সকালেই সে প্রথমবারের মত ঢাকা শহরে এসেছে। জীবনের চাকা ঘুরাতে দুবাই যাবে । কাল সকালেই তার আকাশে উড়ার কথা। আদমের লোক বিজয় নগরে হোটেলে থাকার ব্যাবস্থা করে দিয়ে গেছে। কাল সকালে এসে নিয়ে যাবে। সারাদিন ঘুমিয়ে ছিল। কিন্তু গ্রামের ছেলে বলে কথা , সারাদিন ঘুমিয়ে থাকতে পারেনা সে। তাই বিকেলের দিকে হোটেল কক্ষ ছেড়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে পান দোকানটার সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। ঢাকা শহরে কত মানুষ, কত গাড়িঘোড়া, কত বড় বড় দালান কোঠা এসব দেখতে তার ভালই লাগছিল।
টং দোকানটায় দশ কি বার বছরের একটা ছেলে টু টাং শব্দে চা বানিয়ে নানা রকম মানুষের হাতে তুলে দিচ্ছে। একজন মাঝ বয়সী মানুষ চা খেয়ে একশত টাকার একটা নোট ছেলেটার হাতে দিয়ে ফেরৎ টাকার জন্য দাঁড়িয়ে আছে। ছেলেটা টাকাটায় আঙ্গুল ঘসে কি যেন পরখ করে।
- কিরে কি দেখস?
- না টাকাটা জাল কিনা দেখলাম। কাউরেতো আজকাল বিশ্বাস করা যায়না মামা।
- তুই জাল টাকা চিনস?
- হ' চিনি ! চিনুম না ক্যান? ঢাকা শহরে থাকতে হলে কি আবুল হইলে চলে !
এসব কথোপকথের মধ্যে তোতা হঠাৎ খেয়াল করে আদুরে কয়েকটা মেয়ে সেজে গুঁজে দেয়ালে ঠেস দিয়ে কিছু দুর পর পর দাঁড়িয়ে আছে। যেন কারো জন্য অধীর অপেক্ষায় সময় পার করছে।। সবচেয়ে কাছের মেয়েটি তোতার দিকে অপলক চেয়ে আছে এবং গাড় লাল রঙয়ের লিপিষ্টিক মাখা ঠোঁট প্রসারিত করে এক অদ্বুত ভঙ্গিমায় হাসছে। তোতার এই বিষয়টা খুব ভালো লাগে। সে হারিয়ে যায় কল্পনায়। হনুফার কথা মনে পড়ে তার। পূর্ণ যৌবনে হনুফা কে সে ভালবাসে বিয়ে করেছিল। এমন করেই হাসতো হনুফা। কিন্তু তোতার গরিবের সংসারে এসে তার সব হাসি হারিয়ে গেছে। হাসবে কি করে হত দরিদ্র তোতা যে তাকে কোনদিন ভাল একটা শাড়ি, একটা স্নো, একটা লিপষ্টিক এনে দিতে পারেনি। জীবনের সব ব্যার্থতা মুছে দিতেই তো ভিটে বাড়ি বন্ধক রেখে, তার বিনিময়ে কাল সকালে সে আকাশে উড়বে।চলে যাবে দুর দেশে। গতরে খেটে টাকা কামাই করবে। ফিরিয়ে আনবে হনুফার মুখের হারানো হাসি... তার চোখে মুখে স্বপ্নের দ্যুতি ছড়িয়ে পড়ে,ঠোঁটের কোনে ধরা দেয় এক চিলতে নরম হাসি। শেষ বিকেলের আলোয় সে হাসি চিক চিক করে উঠে। ঠিক তখনই বেধে যায় বিজয় নগরের যুদ্ধ। আর তোতা মিয়া, খদ্দের প্রত্যাশী মেয়েটি, চা দোকানের চালাক ছেলেটি,আর কতগুলো মানুষ নেংটি ইদুঁর হয়ে দৌঁড়াতে শুরু করে....
মিনিট ত্রিশেক পরে আবার সরব হয়ে উঠেছে বিজয় নগর। একটা, দুটা করে দোকানের সাটার উঠানোর শব্দ শেষ বিকেলের মৌনতা উপেক্ষা করে কানে এসে লাগছে। যে মানুষগুলো পালিয়ে বেঁচেছিল তারা আবার ফিরে আসতে শুরু করেছে। বাদামওয়ালা, আমড়াওয়ালা, চাওয়ালা আবার হাঁক ডাক শুরু করে দিয়েছে। একটু আগে বিজয় নগরের যুদ্ধে কার বিজয় হয়েছে তা নিয়ে কারো মথা ব্যাথা নেই। যেন কিছুই হয়নি। চায়ের দোকানগুলোতে সরব হয়ে উঠেছে টেলিভিশনের পর্দা। সোনালী ব-দ্বীপের কোথাও স্বপ্নের ফানুস উড়ানোর মেলা বসেছে। সেখানে উচ্চস্বরে স্বপ্ন ফেরী করে ফিরছেন দুজন চিরচেনা ফেরীওয়ালা। হাজার হাজার তোতা আর হনুফা সেখানে মন্ত্রমুগ্ধের মত সব শুনছে আর করতালি দিয়ে মুখর করে তুলছে চারপাশ।
শুধু কাকরাইল মোড়ে পিচঢালা রাজপথে উপুড় হয়ে পড়ে আছে একজন তোতা। নিথর ও রক্তেভেজা। পুলিশ, সাংবাদিক ঘিরে আছে বেওয়ারিশ লাশ। ক্লিক! ক্লিক!! ক্লিক!!! ক্যামেরার ফ্ল্যাশ পড়ছে বিরামহীন। কাল সকালে সবকটি খবরের কাগজে তোতার ছবি ছাপাবে। বিখ্যাত হয়ে যাবে তোতা ! স্বপ্নের হাটে এই যে অপূর্ব বলিদান....
বিকেল গত হয়ে সন্ধ্যার আঁধার নামতে শুরু করেছে। সাদা রঙের একটা এম্বুল্যান্স তোতার লাশ পেটে নিয়ে আর্তনাদ করতে করতে ছুটে চলে গেল লাশ কাটা ঘরের দিকে। সে আর্তনাদ যেন অনাগত সকালের হনুফা নামের এক গ্রাম্য বধুর বুকফাটা কান্নারই আগাম বার্তা.....