-"হু নোজ ইংলিশ হিয়ার "
ইকোনমি ক্লাসের পাঁচমিশালী যাত্রীদের নানা গুঞ্জনের মাঝে একটা কিন্নর কন্ঠ আমার কানে আসল। আমি তখন বিশালাকার জাম্বু জেটের পেটের ভেতর বসে কয়েক হাজার ফুট উপর থেকে রাতের অন্ধকারে সুবিশাল রিয়াদ নগরীর আলো জ্বলমল সামগ্রীক রূপ অবলোকনে মগ্ন ছিলাম। মনে হচ্ছিল যেন রূপকথার স্বপ্নপূরী আমার চোখের সামনে নিজেকে মেলে ধরেছে।সহসা রমনী কন্ঠের মোহময় ঝংকার আমার মগ্ন চৈতন্য শিষ দিয়ে জাগিয়ে দিল। যুগে যুগে কত মুনি ঋসীর ধ্যান ভেঙ্গে গেছে রমণী কন্ঠের ঝংকারে আর আমার ভাঙবেনা তা কি করে হয় ! ঘাঁড় বাঁকিয়ে যেদিক থেকে কন্ঠটা ভেসে এসেছিল সেদিকে চোখ রাখলাম।
কিন্তু যা দেখলাম তা বর্ণনা করার মত যুতসই শব্দ যে আমার ভান্ডারে নেই। দেখলাম আমার তিন সিট সামনে করিডোরে দাঁড়িয়ে আছে এক অনিন্দ্য সুন্দরী এয়ার হষ্টেজ। ঠিক যেন স্বর্গের অপ্সরী কিংবা ডানাকাটা পরী। এত সুন্দর ললনা ইতপূর্বে আমি আর কোথাও দেখিনি।ইশ আমি রবিন্দ্রনাথ হলে নির্ঘাত এই মেয়েটির একটি সুন্দর উপমা খুঁজে বের করতে পারতাম। সবাই চুপ। কেউ কিছু বলছেনা।
- "হু নোজ ইংলিশ হিয়ার?" মেয়েটি আবার প্রশ্ন করল।
কি জানি কি বুঝে সেই প্রাইমারী স্কুলের সব জান্তা সুবোধ বালকটির মত নিজের হাতটা উঁচু করে ধরলাম।
-" ইউ নো ইংলিশ"
-" ইয়েস; আই ক্যান ট্রাই।"
- " ভেরি গুড। কাম হিয়ার"
ধীর পায়ে মেয়েটির দিকে এগিয়ে গেলাম। ভাবলাম অপ্সরী মনে হয় ইংরেজী খুব একটা ভাল জানেনা তাই হয়ত আমার কোন সাহায্য নিবে। মনের ভেতরে কাঁপন শুরু হয়ে গিয়েছে। একেতো ইংরেজী পরীক্ষা তার উপর বুকের ভেতর ঝড় তোলা অপ্সরীর সান্নিধ্য। মনে মনে আল্লাহ কে স্বরণ করলাম।
-" বল, আমি তোমাকে কিভাবে সাহায্য করতে পারি?"
-" দেখো রিয়াদ থেকে ঢকা প্রায় ছয় ঘন্টার পথ। আমার যখন কাজ থাকবেনা আমি তখন সামনের এই সীটে বসব। কিন্তু পাশের সীটে যে আছে সে ইংরেজী জানেনা। এখন পাশের যাত্রীর সাথে গল্প করতে না পারলে আমার বোর লাগবে। তাই আমি চাই তুমি আমার পাশের সিটে বসো আর এই সিটের লোকটি তোমার সিটে গিয়ে বসুক।"
মেয়েটির কথা শুনে আমার ভেতরে আনন্দের জোয়ার ব্ইতে লাগল। একাবারে অপ্সরীর পাশে বসে আকাশ জার্নি! ভাবতেই শিহরিত হলাম। কিন্তু সেটা প্রকাশ না করে গম্ভীর ভাবে নিজের সৌজন্যবোধ তুলে ধরলাম।
- " দেখো আমি বসতে পারি। আমার কোন আপত্তি নাই। তবে সবার আগে তোমাকে ঐ ভদ্রলোক কে রাজী করাতে হবে"
-"ডন্ট ওয়ারী ! ওটা আমার উপর ছেড়ে দাও"
তারপর মেয়েটি ঐ সিটে বাসা ভদ্রলোকের সাথে আরবীতে কথা বললো । উনি বিনা বাক্যে রাজি হয়ে গেলেন। উনি উঠে আমার সীটে গিয়ে বসলেন, আমি বসলাম উনার সিটে।
অন্ধকার আকাশ বিদীর্ন করে বাংলাদেশের দিকে ছুটে চলছে সৌদি এরাবিয়ান এয়ার লাইন্সের বিশাল বিমানটি। মেয়েটি যাত্রীদের আপ্যা্য়ন পর্ব সেরে পাশের সীটে এসে বসল। জমে উঠল দুজনের গল্প।
-" তোমার দেশ কোথায়"
- " মরক্কো"
- " কোন শহর ? রাবাত না ক্যাসাবলাঙ্কা ( এমন ভাবে ভাব নিলাম যাতে মনে হল আমি এই শহর দুটি খুব ভাল করে চিনি)
- " আমার বাড়ি আগাদির। তবে আমি থাকি রাবাত।"
- " ও হ্যাঁ, রাবাত খুব সুন্দর ঐতিহাসিক শহর"
- " তুমি কি রাবাত কখনও গিয়েছো"
- " না আমি বইতে পড়েছি।"
- " ওহ ভেরি গুড। আচ্ছা তুমি কোথায় থাকো? ঢাকা?"
- " না আমি ঢাকা থেকে প্রায় ২৫০ কিমি দুরে আমর নিজের শহর ফেনী তে থাকি"
-" ফানী? আমি এই শহরের নাম শুনিনি। ইনফ্যাক্ট আমি ঢাকা এবং কক্সবাজার ছাড়াও আর কিছুই জানিনা"
- " ফানি নয় এটা ফেনী। তোমার চেনার কথা নয় কারণ এটা খুব ছোট শহর।"
-" ওহ ! আমি দুঃখিত। আজকে শুনলাম। এখন থেকে মনে রাখব। ইনফ্যাক্ট তোমাকে মনে রাখতে হলেতো তোমার শহরের কথা মনে রাখতে হবে।"
-" তুমি আমাকে মনে রাখবে?"
- " আলবৎ রাখবো"
- " কিন্তু কেন?"
- " কারন আজ থেকে তুমি আমার বন্ধু" রক্ত জবার মত লাল ঠোঁটের কোনে স্মিত হাসি ফুটিয়ে জবাব দিল মেয়েটি। তারপর আবার বলতে শুরু করল "আসলে হয়েছে কি আমি অনেকদিন যাবত তোমাদের বাংলাদেশ রুটে জব করছি। কিন্তু আজ প্রথমবারের মত কোন বাঙ্গালীর সাথে প্রাণ খুলে কথা বলছি। এই রুটের যাত্রীদের ডিমান্ড কম। তাই বেশীরভাগ সময় আমাদের কোন কাজ থাকেনা। বোর লাগে। তোমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষ ইংরেজী জানেনা তাই কথা বলার কাউকে পাইনা।"
তারপর সে উঠে চলে গেল।আমি আরব নিউজে চোখ বুলাতে বুলাতে তার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। পাঁচ মিনিট পর দু কাপ কফি হাতে সে ফিরে এল।তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে কফিতে চুমুক দিলাম । সেও কফিতে চুমুক দিতে দিতে আবার কথা শুরু করল।
- " তোমার নাম তো জানা হলনা। তোমার নাম কি?"
- " আমি ফরহাদ ।তোমার নাম?
-" তুমি গেস করো আমার নাম কি।" হাসতে হাসতে বললো সে
-"এটা কেমন কথা? আমি কিভাবে তোমার নাম গেস করব?আমি পারবনা"
কিন্তু সে নাছোড় বান্দা। আমাকেই গেস করতেই হবে। তার ভাষায় ইটস এ্যা ফান। অগত্য আমি কোন কিছু না ভেবে বললাম তোমার নাম "নোরা"
মেয়েটি আমার দিকে কয়েক মিনিট অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকল।
- "তুমি কিভাবে জানলে আমার নাম নোরা"
-" মানে কি তোমার নাম কি সত্যি নোরা"
-" হ্যাঁ আমার নাম সত্যি নোরা। কিন্তু আমি অবাক হচ্ছি তুমি কিভাবে জানলে"
-" আমি আন্দাজের উপর বলেছি। তবে আমি বিশ্বাস করিনা তোমার নাম নোরা । তুমি নিশ্চয় ঠাট্টা করছো"
আনোয়ার ! আনোয়ার ! এদিকে আসো। মেয়েটি কেউ একজন কে ডাকলো। কয়েক মিনিট পরেই সুদর্শন আনোয়ার এসে হাজির হল। সে নোরার সহকর্মী।
- " আনোয়ার এই হচ্ছে ফরহাদ। আমার বন্ধু। খুব মজার একটা মানুষ। এখন তুমি তাকে বল আমার নাম কি"
- " কেন তোমার নাম নোরা সেটা তুমি বল্লে সমস্যা কোথায়?" প্রশ্ন করল আনোয়ার।
- " আরে আর বলোনা । আমি ফরহাদ কে বলেছিলাম আমার নাম গেস করতে। সত্যি সত্যি সে আমার নাম গেস করে ফেল্লো। হি ইজ রিয়েলি এন এ্যামজিং গাই।"
-" না না নোরা, এটা সিম্পলি একটা কাকতালীয় ব্যাপার।"
-" নো আমার বন্ধু। তুমি সত্যি অসাধারণ।
এবার আনোয়ারও আমাদের সাথে আড্ডায় যোগ দিল। সদালাপী ও সুদর্শন যুবক। তিউনিসিয়ান। তার সাথে কথা বলে খুব ভাল লাগলো। তিন দেশের তিনজন মানুষ তোখোড় আড্ডায় মেতে উঠলাম। ধরণী থেকে কয়েক হাজার ফুট উপরে শুন্যে ভাসমান বিমানের পেটে বসে তিন ভীনদেশী অদ্ভুত এক অন্তরংগ বন্ধুত্বে হারিয়ে গেলাম। আমার সাথে আড্ডা দিতে পেরে নোরা অনেক খুশি। বার বার সে এই কথাই জানিয়ে দিচ্ছিলো। পরষ্পর অনেক কথা জানা হল। ওদের দেশের কথা। আমার দেশের কথা। কালচার,কুজিন, ন্যাচারাল বিউটি সব নিয়ে আলোচনা হল।কত দিন বিদেশে আছি। বাড়িতে কে কে আছে ইত্যাদি ইত্যাদি সব জিজ্ঞেস করল। এর মধ্যে আনোয়ার গিয়ে আরো একবার কফি নিয়ে আসল। কফি খেতে খতে কক্সবাজারের কথা আলাপ হল। বাদ যায়নি ঢাকার যনজটও। নোরা জানলো সে একবার কক্সবাজার গিয়েছে। সামনে আবার যাবে।
"সন্মানিত যাত্রীগন আমরা এখন থেকে অল্প কিছুক্ষনের মধ্যে জিয়া আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে অবতরন করতে যাচ্ছি। আপনার যার যার সিটে অবস্থান করুন এবং সিট বেল্ট বেঁধে রাখুন"- সহসা ককপিট থেকে ঘোষনা আসল। নোরা আর আনোয়ার দ্রুত চলে গেল তাদের কাজে। মুহুর্তে শুরু হয়ে গেল হৈ-হুল্লোড়। মার মার,কাট কাট। কার আগে কে নামবে? কার ব্যাগ কোথায়। টুস টাস শব্দে কেঁপে উঠল অবতরনোন্মুখ বিমান। ঠিক সদরঘাটে লঞ্চ এসে থামলে যেমনটা হয় তেমনি। বাঙ্গালীর কাছে হয়ত বিমান আর লঞ্চ কোন তফাৎ নাই। নোরা,আনোয়ার সহ কয়েকজন ক্রু চিৎকার করে সবাইকে বুঝাতে চেষ্ঠা করছে যে বিমান এখন অবতরণ করবে সবার উচিৎ সীটে বসে থাকা। কিন্তু কে শুনে কার কথা। ভাবটা এমন টাকা দিয়ে টিকেট কিনে বিমানে উঠেছি কন্ডাকটরের কথা শুনার জন্য নয়। একসময় বিমান ল্যান্ড করল। হুড়মুড় করে সবাই নেমে যাচ্ছে। আমি ঠাঁয় বসে থাকলাম। একজন আমাকে টিপ্পনি কেটে প্রশ্ন করল," কি ভাই ম্যাডাম কে সাথে নিয়ে যাবেন নাকি?" " হা হা হা চেষ্টা করব" আমিও হসে উত্তর দিলাম। সবাই নেমে গেছে। আমি তখনও বসে আছি। পিছনের দিক থেকে লাগেজ ক্যবিনেট গুলো একটা একটা করে চেক করে নোরা আমার সামনে এসে দাঁড়ালো:
- " হেয় ফরহাদ তুমি তোমার দেশে এসে গেছো। অনেকদিন পর দেশে এসেছো। নিশ্চয় তোমার খুব ভাল লাগছে।"
-" হ্যাঁ নোরা আমি খুব হ্যাপি।"
- " আমারো অনেক ভাল লাগছে ফরহাদ। তোমার সাথে অনেক সুন্দর সময় কেটেছে। তুমি সত্যি অনেক ভাল একটা বন্ধু।"
- " তোমাকে অনেক ধন্যবাদ নোরা। তুমিও অনেক ভাল বন্ধু"
- " আমি তোমাকে অনেকদিন মনে রাখব ফরহাদ"
- " আমিও তোমাকে অনেকদিন মনে রাখব নোরা"
এটা নাও। একটা কাগজে তার ফোন নম্বর লিখে আমাকে দিয়ে বল্ল, "রিয়াদে এসে আমাকে ফোন দেও। আর তুমি এখানে ফোন নিলে আমাকে নম্বর দিও। আমরা কক্সবাজার গেলে তোমাকে ডাকবো। তুমি থাকলে অনেক মজা হবে"
- "ওকে ফরহাদ। হ্যাভ এ নাইস ভ্যাকেসান। বাই।"
- "ওকে নোরা। ষ্টে ওয়েল। বাই"
নোরা কে বিদায় জানিয়ে বেরিয়ে আসলাম।
বাড়িতে এসে দুদিন পরেই আবহাওয়া জনিত কারনে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম। সেরে উঠতে অনেকদিন লেগেছিল। অনেকদিনপর দেশে যাওয়াতে সবাইকে নিয়ে ব্যাস্ত হয়ে পড়েছিলাম। বন্ধু বান্ধব আর আত্মিয় স্বজনের সান্নিধ্যে এবং পারিবারিক জুট ঝামেলায় ভূলে গিয়েছিলাম নোরার কথা। দেখতে দেখতে ছুটি শেষ হয়ে গেয়েছিল। এবার ফিরে আসার পালা। নির্দিষ্ট দিন জিয়ায় আসলাম। এখানে এসেই অন্য এয়ার হষ্টেজদের দেখে আচমকা আমার নোরার কথা মনে পড়ল। বুকের ভিতরে একটা ব্যাথা অনুভব করলাম।" আমার তো নোরাকে ফোন করার কথা ছিল।"কিন্তু আমি করিনি। একি করলাম আমি। আত্ম অনুশোচনায় ভুগতে ভুগতে ব্যাক পকেটে হাত দিয়ে পার্স বের করলাম। তন্ন তন্ন করে খুঁজলাম নোরার ফোন নম্বর। না কোথাও পেলাম না। " আমার কাজে নোরা নিশ্চয় অনেক আহত হয়েছে। আমার এই অকৃতজ্ঞ আচরণে নোরা হয়তো পুরা বাঙ্গালী জাতির প্রতি শ্রদ্ধাবোধ হারিয়ে ফেলেছে" এসব ভেবে সেদিন নিজেকে অনেক অপরাধী লাগছিল। বিমানে উঠে সারা বিমান হেঁটে বেড়ালাম আর মনে মনে নোরা কে খুজলাম কিন্তু পেলাম না।
এখনো আকাশে বিমান উড়ে যেতে দেখলে নোরাকে আমার মনে পড়ে। তখন চিৎকার করে তার কাছে ক্ষমা চাইতে ইচ্ছে করে। আর বলতে ইচ্ছে করে " নোরা ! বন্ধু আমার। তুমিতো আকাশ কন্যা। আকাশেই তোমার সাথে আমার পরিচয়। আবার আকাশে তুমি হারিয়ে গেলে। তোমার বন্ধু তোমাকে ভূলেনি। কিন্তু সে কথা তোমার কাছে পৌঁছে দিতে পারেনা সে। কারণ তোমার বন্ধু যে তোমার আকাশের ঠিকানা জানেনা"