সেইদিন টিভিতে চাকা সাবানের একটা এ্যাড দেখলাম। মা’রে সবাই মিলা ধন্যবাদ দিতেছেন উনাদের কাপড় ধুইয়া দেওয়ার জন্য। আমার খুব খারাপ লাগলো এ্যাডটা দেইখা। মেজাজও খারাপ হইলো। বাংলাদেশে মানুষ কোন্ দেশি ঘাস খাইয়া এইসব এ্যাড বানান্ আমি জানি না।
মা’রে কাপড় কাঁচার জন্য ধন্যবাদ দিবেন, এই কথার মানে কী? আপনি একজন পূর্ণবয়ষ্ক সুস্থ স্বাভাবিক মানুষ। আপনার নিজের কাপড় আপনার নিজের ধোয়া উচিৎ। লন্ড্রিতে দেন বা ওয়াসিং মেশিন ঘুরান বা নিজের হাতে ধোন, নিজের নোংরা কাপড় আরেকজনরে দিয়া ধোয়ানো যে অসভ্যতা এবং নিচু মানসিকতার লক্ষণ তা আমাদের এই যুগে জানা থাকা উচিৎ! আমাদের দেশে বাসায় অত্যন্ত সস্তায় কাজের মানুষ আছেন। মানুষ তাদের দিয়াও এইসব করেন। টাকার বিনিময়ে সেবা যেহেতু কেনা যায়, তাই উনাদের দিয়াও আপনি নিজের ময়লা পরিষ্কার করাইতে পারেন। কিন্তু মা ক্যানো?
মা’র দায়িত্ব আপনার কাপড় কাঁচা? আপনারে সকাল বিকাল মুরগ মুসল্লম আর ইলিশ পোলাও আর কাউনের চাইলের পায়েশ রাইন্ধা খাওয়ানোর? জন্ম দিছেন বইলা আপনারে ২৪ ঘন্টা গ্রাহক সেবা দেওয়া উনার নৈতিক ও সামাজিক ও রাজনৈতিক ও আধ্যাত্মিক দায়িত্ব?
আমাদের দেশের সব মা’রা- সব অর্থনৈতিক অবস্থার, সব সামাজিক অবস্থানের, সব পেশার, সব শ্রেণির ও সব ধর্মের মা’রাই আমাদের বিনামূল্যে বিনা বাক্যব্যয়ে শারীরিক ও মানসিক শ্রম দিয়া আসতেছেন। ক্যানো? শুধুমাত্র মাতৃত্ব জাতীয় অপত্য স্নেহ থিকা? শুধুমাত্র আপনারে উনার শরীরের অংশ, নিজের অংশ বইলা মনে করেন, তাই? শুধুমাত্র ভালোবাসা থিকা?
না!
উনারা করেন, কারণ করার আর কেউ নাই। উনারা করেন, কারণ, উনারা যুগে যুগে ঘরে ঘরে আপনার মত অকর্মণ্য অথর্ব শিশুদের জন্ম দিছেন। আপনার মা একদিন রান্না ফালায়ে রাখলে আপনি বা আপনার মহান বাপে গিয়া একদিনের জন্য আধাদিনের জন্য হইলেও রান্নাঘরের হাল ধরবেন না। কারণ আপনি খুব উচ্চপদস্থ একজন ব্যক্তি। কারণ, আপনি খুব রিক্সাওয়ালা, খুব শারীরিক পরিশ্রম গেছে আপনার। কারণ, আপনি রান্না জানেন না। কারণ, আপনি সমাজের গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়া মাথা ঘামান। কারণ, রান্না ‘মেয়ে’দের বিষয়! কারণ, রান্না জানা ছেলেরা ‘হাফ-লেডিস’, ‘হিজরা’ এবং ‘স্ত্রৈণ’! কারণ, মা না থাকলে কাজের লোক আছে, রেস্টোরেন্ট আছে, টেইকওয়ে আছে, কিন্তু আমি নাই, কারণ, আমি পুরুষ! আমি সিংহ! কারণ, রান্নার মত ছোট জিনিস আমারে মানায় না!
আমার বাবার সাথে আমার মতের পার্থক্য আছে। আমার একমাত্র ভাইয়ের সাথে আমার দিনে পঞ্চাশ হাজারবার ঝগড়া হয়। কিন্তু আমি ‘গোপনে’ তাদের অসম্ভব ভালোবাসি, কারণ তারা আমার মা’রে কাপড় কাঁচা, রান্না জাতীয় জায়গায় অত্যাচার করেন না। আমার বাপ, মা, ভাইয়া এবং বৌদি সবাই নিয়মিত অফিসে যান এবং সবাই নিয়মিত বাসায় কাজ করেন। বাসায় দুপুর বা রাত্রের খাবার পরে বাসায় কাজের মানুষ বা ডিসওয়াশার থাকার পরেও আমার বাপ সমস্ত খাবারের প্লেট রান্নাঘরে নিয়া নিজ হাতে ধুইয়া দেন। আমার ভাই একদিন অন্তর অন্তর রান্না করেন। সেই ডালের ভিতর পাকা আপেল দেওয়া বা চেরিফল দিয়া রান্ধা মুরগী কোনো মানুষ বা অন্য সুস্থ কোনো প্রাণীর পক্ষে খাওয়া সম্ভব না, সন্দেহ নাই, কিন্তু উনার উৎসাহে কোনো কমতি নাই তাতে!
মেয়েরাও যে কোনো অংশে ভালো, তা বলতেছি না। আমার নিজের পরিচিত এমন অনেক মেয়ে আছেন, যারা ঘরের কাজ করারে অসম্মান ভাবেন। সেই অসম্মান ‘মা’ করুক, সমস্যা নাই, কিন্তু আমি করতে পারবো না! যেন কাজের বেলায় মা এবং কাজের মানুষের শ্রেণি একই! কাজ শেষ হইলে মা'রে জড়ায়ে ধইরা চুমা দিয়া ‘মাদার্স ডে’র কেক নিয়া স্ন্যাপচ্যাট আর ফেইসবুক আর ইন্সটাগ্রামে ছবি দেওনের সময় মা’র আবার শ্রেণিউত্তরণ ঘটে। সেই সময় ‘আমার মা দুনিয়ার বেস্ট মা’, ‘আমার মা দুনিয়ার সবচেয়ে সুন্দরী মা’, ‘আমার মা’র মত ভালো মানুষ দুনিয়াতে একটাও নাই’, ‘আমার মা না থাকলে আমি বাঁচবো না’ টাইপ ডায়লগ টপাটপ বাইর হইতে থাকে।
মা’রা আজব প্রাণী। তাদের যে এই যে একবার উঁচু শ্রেণিতে উঠানো হইলো, একবার বান্দি শ্রেণিতে নামানো হইলো, এইটা উনারা টের পান। উনারা তো নির্বুদ্ধি প্রাণী না, নাকি? টের পাইয়াও উনারা আপনার নোংরা আন্ডারওয়্যার কাঁইচা আপনার ও আপনার বন্ধুদের ‘মা দিবস’ সেলিব্রেট করার জন্য চায়নিজ ফ্রায়েড রাইস আর চিকেন উইংস রাইন্ধা আপনার সাথে সেলফি তুলতে আসেন। আপনে কন, ‘মা উফফফ, এইসব কী কাপড় পরে আছো? এই ছবি তো ফেইসবুকে দেব!’
আপনার মা নিরবে শ্বাস ফেইলা কাপড় পাল্টাইতে পাল্টাইতে বান্দি শ্রেণি থিকা ‘আপনার’ শ্রেণিতে ওঠেন। মানে ভান করেন ওঠার। তারপর আপনারা একসাথে ‘মা দিবস’ পালন করেন। এবং ফ্রায়েড রাইস খান।
আপনাদের সবাইরে মা দিবসের শুভেচ্ছা
সংগৃহীত
লেখিকাঃ নাদিয়া ইসলাম
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই মে, ২০১৬ দুপুর ২:২১