আমি তখন টেনেটুনে ক্লাস টেনে পড়ি। রোজই আমাকে শহরের সবচেয়ে লোকস্য-লোকাল বাসটাতে ঝুলে ঝুলে আসা যাওয়া করতে হতো। বলাবাহুল্য, দেশে তখন যৌন রোগের মহামারি দশা চলছিলো।
পথে, অলিতে-গলিতে,খবরের কাগজের ভাজে, বাজারের ব্যাগে, বাসের জানালার ফাঁক গলে, মুড়ির ঠোংগায়, ৫০ পেরুনো বৃদ্ধের অফিস ফাইলে কিংবা রিক্স্বায় হুডের ছায়াতলে বিশেষ মুহূর্তে থাকা কপোত-কপোতীর কোল জমে যেত যৌন রোগের মহৌষধের বিজ্ঞাপনী লিফলেটে। এদের সবাই ই আবার ভীষণ প্রকৃতি প্রেমিক, উল্লেখ্য হারবাল ছাড়া তারা আর কোন চিকিৎসা পদ্ধতি অবলম্বন করতেন না (ex: ক*কাতা হারবাল)।
সে সময়টায় লোকাল বাসের মাঝবয়সীদের আড্ডার একটা বড় অংশ জুড়ে থাকতো সেই সব রঙচটা বিজ্ঞাপনের ভুলভ্রান্তি শোধরানো, সেসব ঔষধের পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া, এদের বিরুদ্ধে কি ব্যাবস্থা নেয়া উচিত পুলিসের ইত্যাদি ইত্যাদি...।
স্কুলগামী উঠতি বয়সী ছেলেটাও চাইতো পাশে থাকা মুরুব্বির চোখ এড়িয়ে একটা লিফলেট ব্যাগের ভেতর পগার-পাঁড় করে দেয়া, অতঃপর টিফিনের ফাকে সেই লাল-নীল লিফলেটের ব্যবচ্ছেদ বিন্যাস এবং হাসির স্রোতে গড়াগড়ি খাওয়া বিজ্ঞাপনে থাকা নানান 'non-sensored' শব্দ গুলো নিয়ে।
অফিস পাড়ায় বন্ধুসুলভ সহকর্মীর সাথে কানাকানিতে উঠে আসত ফিসফিসিয়ে, “অমুক সাহেব, ওরা যে লিফলেটে লেখে যেগুলা,আসলেই কি কাজ করে ওইরকম,আপনার কি মনে হয়??!!” (ল্যাও ঠ্যালা!)
এমনকি চারপাশ দেখে পা সরিয়ে জুতার সোলের নিচে চাপা পড়া লিফলেটটা একটু-আক্তু দেখে হয়তো সোনালি অতীতে ফিরে যেতেন কিছু দিবাস্বাপ্নিক দাদুরা।
সব কিছু ছাপিয়ে ধিক্কারের পাত্র/পাত্রী হয়েছিলেন কারা সবচেয়ে বেশি জানেন? সেই মানুষ গুলো যারা সমস্ত দিন কাঠ ফাটা রোঁদে পুড়ে এই বিব্রত কর লিফলেটের স্রোত বয়ে বেড়াতেন আমাদের মাঝে শহরের নানা প্রান্তে আর রাতে ঘরে ফিরতেন মাত্র ১০০ টাকার সম্বল হাতে। ভদ্রতার খাতিরে অনেকেই হয়তো থুতুটুকু ছুড়তে বাকি রেখেচিলেন তাদের প্রতি, প্রচণ্ড আক্রোশে অনেকেই “চটির” ভাষা ছাড়িয়ে করেছেন গালিগালাজ। আমি বলছি , খুব ভালো করেছেন, সুশীল সমাজের শার্ট-প্যান্ট পড়ুয়া সুসভ্য সদস্য হিসেবে আপনারা যথার্থই করেছেন। কিন্তু কই, এরা এই কাজ ছেড়ে দিলে পরে রোজ রাতের ১০০ টাকার চাল খড়ির হিসেবটা আপনাদের তো কোনদিন করতে দেখি নাই। ‘বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা’ নামক একটা বস্তুর দোহাই দিয়ে কয়েকজন ভদ্দর লোককে গলার রগ ছিড়তে দেখেছি, কিন্তু আদৌতেও তারা একটা শূন্য কোঠার খোজ দিতে শুনি নাই কোনদিন।
জানি না, কথার শুরু কিংবা শেষ প্রাসঙ্গিক হচ্ছে কিনা, তবুও একটা ছোট্ট ঘটনা মনে দিয়ে শেষ করছি,
-মতিঝিলের চত্বরে বাস থেমেছে মাত্র, জানালা গলে এক মহিলা যেই একটা লিফলেট দিতে গেল, এক ভদ্দর লোক মহিলার হাতটা ধরে চেঁচিয়ে উঠলেন, “লজ্জা করে না এই কাম করতে? এর চেয়ে ভিক্ষা কইরা খাইতে পারস নাহ??” ৫ মিনিট পরেই ইত্তেফাক মোড় থেকে একজন ভিক্ষারী উঠলেন বাসে, ঠিক সেই ভদ্দর লোক বরাবর আসার পর এবারও তিনি চেঁচিয়ে উঠলেন, “ভিক্ষা করস কেন? কিছু একটা কইরা খাইতে পারস নাহ???”
সুখবর!! সেই দিন আর নাই, ডিজিটালাইজেশনের সাথে সাথে হারিয়ে গেছে লিফলেটের যুগ, ফিরে এসেছে সুশীল সমাজে শান্তি, আর সেই সমস্ত যৌন রোগের মহান সব মহৌষধের ঠাই জুটেছে মঠেল কন্যাদের হৃদ কাপান বিলবোর্ডের পাশে, ডিভিডি বক্সের ব্যাক কাভারে, ডিস চ্যানেলের ট্যাগ লাইনে, আরও কত কই...
এখন তো সব ঠিকঠাক সুশীল সমাজ? তবে ওই ১০০ টাকার দিনমজুররা কোথায় কি করছে জানেন? খোজ রাখেন? আমি জানি আপনারা আংরেজি কপচে আমায় উত্তর দিয়ে বসবেন, “thats not a part of our business”
Isn't it?