রেনে দেকার্তের একটি থট এক্সপেরিমেন্ট যার ভিত্তিতে এই ছোট লিখাটি (ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শনের অধ্যাপক শেলী ক্যাগান এর বক্তৃতা অবলম্বনে)
দেকার্তের পরীক্ষা
এই পরীক্ষাটার শুরুই চিন্তা থেকে যেখানে আমি একটা সকালের কথা ভাবছি। ধরি, একদিন সকালে ঘুম ভেঙে আমি হেটে বাথরুমে যেয়ে আয়নায় তাকাতেই দেখলাম যে আমি আমাকে আয়নায় দেখতে পাচ্ছি না (মানে আমার শরীরকে দেখা যাচ্ছে না), আয়নায় কিছুই নেই। যেখানে আমার মাথা থাকার কথা (অন্তত যেখানে আমার মাথা থাকবে বলে আমি ভাবছি) সেখানে হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেয়ার চেষ্টা করলাম; আমার মাথা তো দূরে থাক, কোন কিছুই অনুভব করতে ব্যর্থ হলাম। হাতের দিকে তাকালাম, কিছু নেই, আংগুলের দিকে তাকানোর চেষ্টা করলাম, সেখানেও কিছু নেই। আমার গোটা শরীরটাই নেই, কিন্তু আমি আছি, কারণ আমি যেহেতু এরকম একটা চিন্তা করতে পারছি, যার অর্থ যেকোন উপায়েই হোক আমার অস্তিত্ব বর্তমান! এই ‘আমি’ টাই দেকার্তের ‘চিন্তা করতে পারা সেই অস্তিত্ব’—মন কিংবা আরও নির্দিষ্ট করে বললে ‘আত্মা।’
দেকার্তের সিদ্ধান্ত হচ্ছেঃ আমি যেহেতু আত্মাকে (আমাকে) দেহের অস্তিত্ব ছাড়া কল্পনা করতে পারছি সেহেতু আত্মা অবশ্যই শরীর থেকে আলাদা কিছু, যা শরীরের মত কোন বস্তু নয়, বরং অশরীরী (Immaterial)—মন ও আত্মার দ্বৈত (Dualist) তত্ত্বে বিশ্বাসী কার্টেসিয়ান বা দেকার্তের অনুসারিরা একে প্রমান হিসেবে উপস্থিত করে।
[দেকার্তে দর্শনে অস্তিত্বের জন্য অবশ্যম্ভাবী হচ্ছে চিন্তা করার ক্ষমতা কারণ দেকার্তে বলছে ‘আমি ভাবি, তাই আমি আছি’ (I think, therefore I am—Cogito, ergo sum)].
আত্মার অস্তিত্বের বিষয়ে সক্রেটিসরও এমনই ধারণা (প্লেটোয় বর্ণিত সক্রেটিস হেমলক পানে মৃত্যুর আগে তাঁর অনুসারিদের সাথে কথোপকথনের সময় এসব ব্যাখ্যা দিয়ে যায়। প্লেটো সক্রেটিসকে দ্বৈতবাদি হিসেবেই চিত্রিত করেছে, প্লেটো নিজেও তাই)। সক্রেটিসে আত্মা হচ্ছে সেই আলাদা অস্তিত্ব যেটা চিন্তার দিকটাই কেবল দেখে; ইচ্ছা, আকাঙ্খা, অনুভূতি ইত্যাদি শারীরিক বিষয়ের সাথে আত্মার কোন সম্পর্ক নাই, এসব কেবলই শরীরের বিষয়। সুতরাং আত্মা হচ্ছে যৌক্তিক/বুদ্ধিবৃত্তিক। তাছাড়া সক্রেটিসের কথোপকথনে আত্মার অস্তিত্ব আছে কি নেই সেই ব্যাপারে এমন কোন জোড়ালো যুক্তি-তর্ক উপস্থাপন করা নেই, কেননা আত্মার অস্তিত্বের বিষয়ে সক্রেটিসে এটিকে পূর্ব-ধারণা হিসেবে সুনিশ্চিত বলেই ধরে নেয়া হয়েছে। সক্রেটিসের প্রশ্ন তাই আত্মা আছে কি নেই তা নয় বরং আত্মা অবিনশ্বর কিনা সেই বিষয়কে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়েছে। তার মূল প্রশ্ন বরং আত্মা শরীরের মৃত্যুর পরও বেঁচে যাবে কিনা তাই নিয়ে, এবং সেই প্রশ্নেও সক্রেটিসের সিদ্ধান্ত যে আত্মা অবিনশ্বর। আরেকটা বিষয়, সক্রেটিসে আত্মা বরং সৌন্দর্য্য বা ন্যায্যতার মত এরকম আরও বিমূর্ত ধারণার বিষয়ে চিন্তা করে, প্লেটোর দর্শনেও তাই।
প্লেটোর দর্শনে যেহেতু বাস্তব পৃথিবীতে পরিপূর্ণ সৌন্দর্য্য বা সম্পূর্ণ ন্যায্যতার কোন বাস্তবিক উদাহরণ নেই, আছে কেবল প্রায়-সুন্দরের ধারণা বা প্রায়-ন্যায্য সমাজ, তাই এসব কেবল আত্মাই ভাবতে পারে। একারনেই সৌন্দর্য্য বা ন্যায্যতার মত বিমূর্ত ধারণাকে বলা হয় প্লেটোনিক; অন্যদিকে, শরীর কেবল এসব সৌন্দর্য্য বা ন্যায্যতার মত বিমূর্ততার সাথে এক ধরনের মিথস্ক্রিয়ায় অংশ নিতে পারে। একটা উদাহরণ দিলে বোঝা যাবে, ধরা যাক সংখ্যা, আমাদের মন সংখ্যা ভাবতে পারে—যেমন দুই (২) সংখ্যাটা। কিন্তু সংখ্যার ধারণা এমন একটা ধারণা যেটা প্রাকৃতিক জগতে অনস্তিত্বমান, এটিকে দেখা যায় না, ছোঁয়া যায় না, খাওয়া যায় না, কেবল চিন্তা দিয়ে একে ভাবতে পারা যায় বা কল্পনায় আনতে পারে—এসবই প্লেটোনিক বিমূর্ত ধারণা যা মনই কেবল ভাবতে পারে। দেহ এই বিমূর্ত ধারণার সাথে মিথস্ক্রিয়া করতে পারে কেবল, যেমন চোখ দুটি বস্তু দেখতে পায়, কিন্তু এমন নয় যে দুই সংখ্যাটার কোন বাস্তবিক অস্তিত্ব আছে, আদতে কোন সংখ্যারই কোন অস্তিত্ব নেই, কিন্তু আমরা চিন্তার মাধ্যমে অংক করতে পারি, এসব প্লেটোনিক আরও বিমূর্ততাকে চিন্তা করতে পারি।
প্রতি উত্তর
এর বিপরীতে যারা আত্মার অস্তিত্বে বিশ্বাস করে না (Physicalist) তারা আরেকটি উদাহরণ উপস্থাপন করে। দেকার্তের সেই থট এক্সপেরিমেন্টের আদলে কল্পনা করি এমন একটা পৃথিবী যেখানে শুকতারা নেই কিন্তু সন্ধ্যা তারা আছে, এরকম একটা কল্পনা করা সম্ভব নয়। আমি এটি সম্ভব বলে ভাবলেও আসলে এটি কল্পনা করা যাবে না, কারণ শুকতারা ও সন্ধ্যাতারা মূলত একই, যা আদতে কোন আলাদা তারাতো নয়ই বরং এটি শুক্র গ্রহ। সুতরাং, গ্রহটি সন্ধ্যায় থাকবে আর ভোরে থাকবে না এই কল্পনা অসম্ভব, যেহেতু এটি একই বস্তু। তাছাড়া, প্রথমাবস্থায় আমি এমনটা কল্পনা করতে পারছি মনে হলেও প্রকৃতপ্রস্তাবে আমি এটি কল্পনা করতে পারি না। একই ভাবে, আসলে দেহহীন আত্মার অস্তিত্বের বিষয়ে আমি কল্পনা করতে পারছি এটি ভাবলেও আদতে দেহ ছাড়া আত্মার অস্তিত্ব চিন্তা করা যায় না...।
সুতরাং দেহের মৃত্যুর পর আত্মার টিকে থাকার সম্ভবনাও এই দর্শনে খারিজ করে দেয়া হচ্ছে। দেহহীন আত্মার অস্তিত্ব বলে কিছু নেই, এই দর্শনে আত্মার অস্তিত্ব বা চিন্তা করাকে ক্ষমতাকে দেহের এক বিশেষ দক্ষতা হিসেবেই দেখা হয়।
কিন্তু মজার বিষয় হলঃ দেকার্তের চিন্তা পরীক্ষাটা শুকতারা ও সন্ধ্যাতারার (শুক্রগ্রহের) ক্ষেত্রে পরীক্ষা করতে গিয়ে ঠিক কোথায় যেয়ে যে গলদটা হয় সেটা চিহ্নিত করা খুবই কঠিন হয়ে পড়ে।
২১ আগষ্ট, ২০২০
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই ডিসেম্বর, ২০২০ সকাল ৮:২৪