সম্পাদকের ডায়েরি: একচক্ষু স্মৃতির কোলাজ
১.
অস্থিরতার কোন কারণ নেই মূলত। খাচ্ছি দাচ্ছি, ঘুরছি-ফিরছি, এক মোটামুটি দুশ্চিন্তাহীন শান্ত জীবন যাপন করছি। বাজার করছি, সন্তানবাৎসল্যে মেয়ের দুধ কিনছি, ডাইপার কিনছি, বাসা ভাড়া দিচ্ছি, ডিস-গ্যাস-পানি-বিদ্যুতের বিল দিচ্ছি, সবাই খুশি, আমিও খুশি। তবু মাঝে মাঝে কি কারণে যেন অস্থিরতায় ভুগছি। ছবি আঁকতে ইচ্ছে হলেই আঁকতে পারছি না, ইচ্ছেমত বাইরের রোদে বেরিয়ে পড়তে পারছি না। এমনি এমনি বসে থাকতে পারছি না। স্বাধীনতা নেই, এমন এক অনুভূতি কেবল একটু...একটু...ই কষ্ট দিচ্ছে মাঝে মাঝে।
কেন? এমন তো হবার কথা নয়!
সবাই তো এমন নিশ্চিন্ত জীবন চায়, অর্থনৈতিক নিশ্চয়তা, মাস শেষে এক ভাবনাহীন অর্থপ্রাপ্তির সম্ভ¢বনা। তাহলে এমন বিরক্ত লাগছে কেন মাঝে মাঝে?
অনিশ্চয়তার মাঝে সম্ভ¢বত শিল্পের বীজ লুকানো থাকে। এক মাস, দুই মাস, হয়ত কিছুই হল না, আবার ধুম করে পাঁচটা গল্প লেখা হয়ে গেল সাত দিনে, তিনটা ছবি আঁকা হয়ে গেল কিংবা কবিতা বেরিয়ে এল অল্প সময়ের ব্যবধানে। এগুলোর জন্য নিজেকে বেকার থাকতে হয়, তথাকথিত নয়টা-পাঁচটা ব্যস্ততা থাকতে নেই অন্য সব প্রয়োজনীয় পেশাজীবিদের মত। শিল্পী, লেখকদের জীবন হয় এমনই অনিশ্চিত, বেপরোয়া ও ঝুঁকিপূর্ণ।
আমি এখন কাজ করি একটি বেসরকারি ব্যাংকে। ব্যাংকের ভিতরটা খুব শীতল, পরিপাটি পরিবেশ। রঙ, রেখা আর কবিতা নিয়ে কথা বলার কেউ নেই এখানে, আমি দ্বিধাভক্ত হয়ে এপাশে একখন্ড আর ওপাশে আরেক খন্ড হয়ে কাতরাই। এ কাতরানো যদিও দেখা যায় না বাইরে থেকে! সৃজনশীলতা নষ্ট হচ্ছে চর্চার অভাবে।
আমাদের এখানে গল্পও তৈরী হয়না তেমন, কারণ ঘুরে ফিরে প্রতিদিনই একঘেয়ে একই বিষয়ের পুনরাবৃত্তি, বৃত্তবন্দী ঘটনাপ্রবাহ। কোন উত্থান, পতনের গল্প নেই এখানে। কোন চমকও নেই, নেই কোন সৃষ্টির আনন্দ, নেই কোন আবিষ্কারের উৎসব, কোন অহংকারেরও জায়গা নেই। আছে স্যুট, টাই পরে মেকি পোষাকের বাহাদুরি আর বিশেষ কিছু করছি এরকমের এক মিথ্যে প্রবোধ!
নিজের উপর এক রকম জোর করছি একটা নতুন কোন সৃষ্টির জন্য, একটা গল্প বা একটা কবিতা বা একটা সুন্দর কিছু। এভাবে জোর করে কি হয় কিছু? আমার এক রকমের অলস সময় কেটে যায় এখানে। ব্যাংকে আমি কাজ করি ‘কর্পোরেট ব্র্যান্ড ও মার্কেটিং কমিউনিকেশনস’ ডিভিশন-এ, এখানে তেমন ব্যস্ততা এখনও তৈরী হয়নি। এখানে কিছু বিল আর কয়েকটা নোট তৈরী করা, অল্প কিছু কাগজ পত্র ফাইলবন্দী করা, ব্যস এর মাঝেই সীমাবদ্ধ সব। কাজ বলতে আমি যা বুঝি তেমন কিছু নেই, অথচ এর জন্য প্রতিদিন আমাকে পাঁচটা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয় ঘড়ি ধরে, কি অদ্ভ¢ুত ব্যবস্থা! আর এর জন্যই আমি মাস শেষে একটা মোটামুটি অংকের টাকা পাই।
অথচ আমি যখন একটা তেলরঙের বা জলরঙের কাজ করি, বা কোন সৃষ্টিশীল লেখায় ব্যস্ত থাকি সেখানে পাই সৃষ্টির আনন্দ, মনে হয় কাজ করছি, কিছু একটা তৈরী করছি! এখানে মনে হয় সবই বড় অর্থহীন, কিছু অকারণ কাগজ-পত্রের স্তুপ তৈরী করছি যা বছর শেষে বেশীর ভাগই ময়লা আবর্জনায় পর্যবেসিত হবে, বড়জোর সের দরে বিক্রি করে দেয়া যাবে! সবাই এখানে কেবল অর্থ তৈরীতে ব্যস্ত। শেয়ার বাজার, রিটেইল ব্যাংকিং, অডিট এসমস্ত-ই এখানে বহুল উচ্চারিত শব্দ।
আর সবচাইতে কষ্টকর বিষয় হল, এ জাতীয় চাকরিতে মানুষের নিজস্বতা এবং ক্ষেত্রবিশেষে সম্মান বলে কিছু থাকে না, একটু আত্মসচেতন মানুষের জন্য এধরণের কাজ খুবই কষ্টকর, তা সে যত টাকাই দেয়া হোক না কেন। যখন ছোট ছিলাম আমার বাবাকে সবসময় এই কথাগুলো বলতে শুনতাম, তিনিও কখনও চাকরি করে খুব ভাল কিছু করতে পারেননি, যদিও ভদ্রলোকের অনেক গুণ ছিল । কারণও ঐ একটাই, বড্ড স্বাধীনচেতা ছিলেন।
এর আগে আমি যে সমস্ত কাজ করেছি তাতে অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা কম ছিল, তবে সম্মান ছিল অন্যরকম। করেছি শিক্ষকতা এবং সাংবাদিকতা। ঐ দুটি পেশাতেই খবরদারিত্ব বা বসিং বলে কিছু নেই, কাজের ধরণেই এক অফুরন্ত স্বাধীনতা, নিজের কাছেই নিজের জবাবদিহিতা। যদিও এখানে কাজের পরিবেশ এবং কাজটা আমার খারাপ লাগছে না, আমি একরকম উপভোগই করছি। আর আমার ঠিক উপরের বস বেশ হাসিখুশি মজার মানুষ, তাই কাজ করে আরাম পাই।
আমার এই লেখাটা অফিসে বসে প্রতিদিন একটু একটু করে লিখছি, যখনই সময় পাই অথবা ভাল লাগে না অন্য কিছু তখনই ফিরে আসি লেখাটির কাছে। এটি এক অদ্ভ¢ুত নেশা, যার ভিতর এই বিষয়টি নেই তাকে বোঝানো অসম্ভব¢। লিখতে বসলেই এক আবেশ আর মাদকতাময় ঘোরের মধ্যে ঢুকে পড়া যায়। নিজের সাথে নিজের কথোপকথন চলে, চিন্তা হয়ে উঠে স্পষ্ট এবং তীক্ষ্ম।
কদিন থেকে বড্ড গরম পড়েছে, দেশের রাজনৈতিক পরি¯ি'তিও ক্রমাগত জটিল আকার ধারণ করছে এই হিসেবে যে, প্রধান দুটি দলসহ অন্যান্য ছোট, মাঝারি দলের নেতা নেত্রী সব জেল থেকে বেরিয়ে এসে আবার রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে উঠছে, দেশে প্রায় দুবছর তত্ত্বাবধায়ক সরকার পরিবর্তনের যে সমস্ত অঙ্গীকার করেছিল এবং সেইমত কিছুটা চেষ্টা করেছিল সেগুলোর কোন ইতিবাচক ফলাফল কি পাওয়া হবে জনগণের? এই প্রশ্ন বিশেষজ্ঞ, রাজনৈতিক বিশ্লেষকসহ সাধারণ মানুষের মনে এক আশংকা হয়ে গুঞ্জন তুলে চলেছে অবিরত। আবারও কি আমরা সেই পূর্বাবস্থায় ফিরে যাব যেখানে হরতাল, ধর্মঘট এসমস্ত হিংসাত্মক ও জিঘাংসামূলক তথাকথিত রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিত্যনৈমত্তিক এবং সাধারণ বলে বিবেচিত হত? দেশের মানুষ ভবিষ্যতে যে পরিবর্তনের আর নতুন ভাবনার দিকে যেতে যাচ্ছিল তা কি রুদ্ধ হয়ে গেল? ব্যবসা, শিক্ষা, শিল্প, বাণিজ্য এগুলো কি আবারও সেই একই চক্রে আবর্তিত হবে?
এই সমস্ত নিয়েও এক চঞ্চল ও অস্থির সময় কাটাচ্ছে আমাদের ‘সামষ্টিক সচেতনতা’ (Collective Consciousness) । তবু আমি হতাশ হতে ঠিক রাজি নই। এই যে একটা নতুন রকমের চেষ্টা হল এর সবকিছুই পুরোপুরি হারিয়ে যাবে আমি এও ঠিক মনে করি না। পরিবর্তনটা অনেক সময়ই ধীর গতির হতে পারে, রাতারাতি পরিবর্তনের কোন যাদু আসলে কারও হাতেই নেই।মন ভাল নেই আমার, এধরনের বাক্য আসলে কি অর্থ প্রকাশ করে? এ বাক্য দিয়ে কি বোঝা যায়, যে আমার মনের জ্বর হয়েছে বা ঠান্ডা বা ব্যথা লাগছে? তাহলে এই মন খারাপ অর্থ সেরকম নয়। তবু আমার মন ভাল নেই। নানা রকম অসম্পূর্ণতা আর সম্ভবনার মৃত্যুতে ব্যথিত আমার হৃদয়, এ দুঃখবোধ একই সাথে সামগ্রিক এবং ব্যক্তিগত।
এখন বসে আছি অফিসে, চারদিন বন্ধের পর দুদিন হল অফিস করছি। সেই পরিচিত কাজ, কোন কিছুই নতুন নয়। কর্পোরেট কালচারে অভ্যস্থ হয়ে উঠছি ধীরে ধীরে। সেই সাথে আমার রূপাš-র ঘটে চলেছে। খারাপ লাগছে না, ভালও লাগছে না, ভাল লাগছে, খারাপ লাগছে! অদ্ভুত।
কদিন ঢাকায় খুব আরামে চলাফেরা করা যাচ্ছে, ঈদের প্রলম্বিত ছুটি শেষে মানুষজন বাড়ি থেকে এখনও ফিরে আসেনি, ফলে অনেক ফাঁকা এখন নগর। এরকম পরিবেশে নগরের সৌন্দর্য্য উপভোগ করা যায়, মনে হয় আমার শহরটা খুব সুন্দর। এত সাজানো ছিমছাম! ভাবতে ভাল লাগছে, এমন দিনে সব বড্ড নির্মল আর নিজেকে সুখী মনে হয়, যেন কোথাও কোন ক্লেদ নেই, মলিনতা নেই, নেই বিষন্নতা আর গ্লানি! বেঁচে থাকা বড্ড সুন্দর আর আনন্দময়।
আজ ২০শে অক্টোবর। ঈদের সময়ে যে ঢিলেঢালা ভাব ছিল তা পেরিয়ে ঢাকা আবারও জ্যাম আর কোলাহলের ব্যস্ত নগরী হয়ে উঠেছে। সকালে ভিড় ঠেলে অফিসে আসতে ব্যাপক জ্যামে পড়তে হয়, কোন কোন দিন সেটা প্রায় দু ঘন্টায় গিয়ে ঠেকে, অথচ বিশ মিনিটের পথ। অসহনীয় মনে হয় তখন এই জ্যামকে, সবার মেজাজ খিটখিটে হয়ে থাকে বলে সামান্যতেই লেগে যায় এর সাথে ওর। এক ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় সকালে, যদিও এই যানজট নিরসনের লক্ষ্যে সরকার স্কুলগুলোকে সাড়ে সাতটায় শুরু করেছে এই সপ্তাহ থেকেই। তবু পরিস্থিতির খুব একটা উন্নতি হয়নি। এই জ্যাম ঢাকাবাসীর নিত্যদিনের সাথী।
এই সমস্ত নিয়েই আছি। বেশ ভাল আছি, বেশ খারাপ আছি। কখনও কখনও সকাল হলে বা রাতের নিস্তব্ধতায় সব কিছু ভীষণ ভাল লাগে। কখনও কখনও সবকিছুই বড্ড নিরর্থক মনে হয়। এই বেঁচে থাকা কোন অর্থ বহন করে না। এরকম এক দ্বন্দ্ব সংঘাতের ভিতর দিয়েই অতিক্রান্ত হয়ে যাচ্ছে দিন।
দুই দিন অনবরত বৃষ্টি হচ্ছে সারাদেশে। অফিস বন্ধ ছিল, বাসায় শুয়ে বসেই দু’দিন কাটিয়েছি। আমার জীবনটা এপর্যন্ত যেখানে এসে দাঁড়িয়েছে, তাতে আমি মোটেই সন্তুষ্ট নই। আমার কি এখানেই এসে পৌঁছানোর কথা ছিল? জীবনের থেকে তেমন বড় কোন প্রাপ্তি হল না কেন? নিজের অবস্থান নিয়ে ভাবি, না শিল্পচর্চায়, না কবিতায়, না সৃষ্টিশীলতায়, না কর্মক্ষেত্রে পেশাগত জায়গায়, কোথাও যেন গিয়ে পৌঁছুতে পারিনি আজও। এক মধ্যবর্তী ঝুলন্ত অবস্থায় এই মধ্য ৩৬ এর জীবন! কোন অর্জন নেই, কোন অত্যুচ্চ জায়গা নেই! নিজের কাছেই এসমস্ত এক ধরণের অভিমান আর হতাশাব্যঞ্জক উচ্চারণ বলে প্রতীয়মান হয়। তবু এই সত্য, নিজের ভিতরে এক অতৃপ্তি আর ক্ষয়ের ক্রমাগত ক্রন্দন শুনতে পাই। হল না, তোমার কিছু হল না, শান্ত।
ধীরে ধীরে সময় বয়ে যায়, আয়ুর ক্ষয়ে অনেকখানি পথ জীবনে অতিক্রম করা হয়ে গেল, অথচ হল না কিছুই। এই চলমান জীবন এক অপার বিস্ময় আর না বোঝাই রয়ে গেল এখনও। কোন উদ্দেশ্য বোঝা গেল না।
২.
কোন নতুন সুসংবাদ নেই জীবনে বরং আছে দুর্ঘটনা, আমাদের বন্ধু ও ছোট ভাই সাইফুজ্জামান সোহাগ একদম অসময়ে হঠাৎ করেই মরে গেল। কতই না অল্প বয়সে ওর এই প্রস্থান! বড় জোর ২৪-২৫, কবিতা, গল্প লেখার সূত্র ধরেই পরিচয়, পরবর্তীতে তা আরও গভীর হয়। ওর অকাল মৃত্যু খুব মন খারাপ করে দিল, সেই বিষন্নতা ঘিরে থাকল বেশ কিছু দিন।
এর মাঝে দেশে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়ে গেল, আওয়ামি লীগ সরকার গঠন করল অভাবনীয় সংখ্যক আসনে বিজয়ী হয়ে, একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে গেল দলটি। মানুষ তাদের রায় জানিয়ে দিল গত সরকারের দুর্নীতি, সন্ত্রাস, জঙ্গীবাদের উত্থান আর সরকার পরিচালনায় ব্যর্থতার বিরুদ্ধে। জনগণ যত না আওয়ামি লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোটকে ভোট দিল তারও অধিক স্বাগত জানাল মূলত বিএনপি-জামায়েতের বিপক্ষেই । অনেক প্রতিশ্র“তি নিয়ে শেখ হাসিনার দল সরকার গঠন করল, এখন কেবল দেখার বিষয় কতদূর তা বাস্তবায়িত হয়, এদেশের মানুষ এসব দেখে অভ্যস্ত। সুতরাং কাজ ও কথার কতখানি মেল-বন্ধন রচিত হয় তাই দেখার বিষয়।
এসমস্তই চিন্তা জগতে খানিকটা জায়গা জুড়ে নেয়, না চাইতেও কখনও কখনও। সোনালী রোদে দুপুর এলিয়ে পড়ে থাকে, আর আমিও অফিসে বসে বসে কখনও পড়ি ‘দাদা’ ও ‘র্স্যুরিয়্যালিজম’, কখনও বা নিজেদের মাঝে আড্ডায় থাকি ব্যস্ত! আমার কাছে সব কিছু বড় অলস মনে হয়, স্লথ মনে হয় চলাচল, গতিহীন এবং স্থবির এক ঘুম পায়। এসমস্ত কী! কখন যেন বড় কিছু একটা করব তার জন্য প্রতীক্ষা করি, প্রতীক্ষাটা ইদানিং মনে হচ্ছে বড় দীর্ঘ। নিজে থেকে কিছু একটা ঘটাতে হবে, এমন অর্থহীন সময় বয়ে চলে যায় অথচ আমি বসে থাকি।
আবার ভাবি, সময় তো এমনই, তার বয়ে চলা মোটেই অর্থহীন নয়। আমার নির্জীবতায় কি এসে যায় তার! এও মনে হয় অনেক কিছু করেও কিছু হয়না, না করেও আসলে কিছু হয় না। সবই কেবল নিজের স্বস্তির জন্য। তখন আবার আগ্রহ থাকে না জীবনে বড় কিছু করার, জীবনকে এক অযতœ নেতিতে আক্রান্ত হতে দেখি! সময় তাই বসে বসেই চলে যায় এক মন্থর ছায়াছবির মত, কি করব! বসে বসে ভাবি, আবার ভাবিও না। এক অস্থিরতা টের পাই ভিতরে ভিতরে, কি যেন করার ছিল, কি যেন করার আছে! অস্থিরতা, অস্থিরতা।
এসমস্ত ছোট ছোট ঘটনা নিয়েই জীবন এগিয়ে যাচ্ছে। আমার মেয়েটি ধীরে ধীরে একটু একটু করে বড় হচ্ছে। ওর ছোট ছোট প্রত্যাশাগুলো আর চাহিদাগুলো দেখতে খুব ভাল লাগে। ছোট ছোট হাতগুলো দিয়ে যখন আমাকে জড়িয়ে ধরে, ওর পৃথিবী জুড়ে কেবল বাবা-মা, দাদু-নানু, মামা-খালা, ফুফু-চাচা আর ভাই-বোন। মিষ্টি সুরে কথামালা আর প্রশ্নবাণে ব্যস্ত রাখে সারাক্ষণ। ওর সবচাইতে প্রিয় প্রশ্ন ‘কিভাবে’, দ্বিতীয়ত ‘কেন’? ওর মতই জীবন সরল আর ভাবনাহীন ছিল আমাদের সবার। ওমন উৎসুক জানার আগ্রহটাই জরুরী।
৩রা ফেব্র“য়ারী ২০০৯
ইদানিং অফিসে কাজের চাপ একটু বেড়েছে, কাজের চাপ থাকলেই বরং ভাল লাগে, সময়টা সুন্দর কেটে যায়। কিন্তু কাজ না থাকলেই মুশকিল, নানা অকারণ ভাবনা আর ঘুম ঘুম আলস্যে সময় কাটতেই চায় না। অনেক দিন হল কোন বই করা হল না নিজের, বই মেলা আরম্ভ হওয়াতে এই সমস্ত ভাবি নিজের মনে।
১৬ ই ফেব্র“য়ারী ২০০৯
মনটা ভাল নেই, অফিসে বসে আছি, কাজ করছি সকাল থেকেই কিন্তু মনটা অস্থির লাগছে। অনুভূতিকে এক অন্যরকম আকাংখা, আক্রান্ত করছে হৃদয়। হৃদয়ে আজ ঘুণপোকা, এক ভাঙ্গনের শব্দ। মন চায় একরকম অথচ সমাজ-বাস্তবতা তার বিপরীতে। কি হবে এই অবরুদ্ধ হয়ে থাকায়? কি হবে এত নিয়মবদ্ধ শৃংখলায়?
তুমি আমাকে ভাবিয়ে তুলেছ ভাবনা। তুমি তো আসলে আমার ভাবনাতেই ধীরে ধীরে অবয়ব পাচ্ছে। তোমাকে নিয়ে ভাবতে চাচ্ছি না আমি, অথচ ভাবনায় তুমি বসে আছ। তোমাকে আমি গল্প আর কবিতায়, প্রেম আর অপ্রেমের এক জীবনে রূপায়ন করব। তোমাকে নিয়ে হব সঙ্গীত আর ছায়াচিত্র, আমার করে নিব সেই সমস্ত মুহূর্ত। সেই সমস্ত অলস দুপুর আর মাতাল হাওয়া, সেই সমস্ত দুরন্ত ছুটে চলা, সেই সমস্ত সঙ্গীত আর ভান আর ছলাকলা!!
শুধু তুমি আর আমি, আপাতত আর কিছু নেই। নই আমি কারও দায়িত্বশীল পিতা বা কারও স্বামী, নই আমি কারও পুত্র বা ভাই। এখন শুধু তুমি আর আমি!! এখন কেবল তুমিই, কল্পনায় আর ভাবনায়। একজন সৃষ্টিশীল মানুষের ভাবনার স্বাধীনতা থাকা খুবই জরুরী। দরকার সকল বন্ধন থেকে মুক্ত থাকা।
সেল ফোনটা এক কোনে পড়ে থাকে, কখন বেজে উঠবে তার ঠিক নেই। বেজে উঠবে কিনা তারও কোন ঠিক নেই। কেবলই অসহ্য এক প্রত্যাশা, তুমি ডাকবে।
২৩ শে ফেব্র“য়ারী
অথচ এগুলো এক হিসেবে অন্যায়, এই ভাব উদয় হওয়া! অথচ বাইরে দামাল রোদ্দুর আর ফাগুনের উতল হাওয়া বইছে সারা শহরব্যাপী, উদাস করা এক বাইরের ডাক আছড়ে পড়ছে হৃদয়ে। উপায়হীন এক দমবন্ধ করা পরিবেশে আটকে আছি অফিস নামক লৌহগরাদে, স্ব-আবি®কৃৃত বন্দিত্বে!!
অসহ্য এই দহন আর কান্তিকর এই একঘেয়ে আকাশহীন চারদেয়াল! ভীষণ এই রূদ্ধশ্বাস শুকনো পৃথিবীতে ভাবনাই বাঁচিয়ে রাখে, ভাবি কখন ফোনটা বেজে উঠবে। বেজে উঠবে তো! সংকেত পাঠাবে তো!
কিসের সংকেত? এ যদি অশনি সংকেতও হয়, সেও যেন এই স্থবির জীবনে খানিক উত্তেজনা তৈরী করে, এই বন্দিত্ব থেকে মুক্তি আসে। যদিও এটিকে ডায়েরি বলা যাবে না, তবু চরিত্রটি খানিকটা সেরকমই হয়ে উঠছে কখনও কখনও। তারিখ দিয়ে দিয়ে হঠাৎ করেই কেন লিখতে শুরু করলাম নিজেই জানি না। তারিখ দেখে দেখে পরিবর্তনের ধারাটি হয়ত বুঝতে চাইছিলাম। আর কি হতে পারে?
২রা মার্চ
কি লিখব? সারা দেশ শোকে মূহ্যমান, ২৫ শে ফেব্র“য়ারী বিডিআর পিলখানায় ভয়াবহ বিদ্রোহে (বিদ্রোহ না অন্যকিছু?) এ পর্যন্ত ৭০-এরও বেশী সামরিক ও বেসামরিক (যার অধিকাংশই সেনাকর্মকর্তা) লোকের মৃত্যুর খবর এবং আরও ৭২ জন সেনাকর্মকর্তার এখনও নিখোঁজ হওয়ার সংবাদে গোটা জাতি স্তম্ভি¢ত।
অথচ গোড়ায় যখন বিদ্রোহের খবর ছড়িয়ে পড়ল চারদিকে, তখন সাধারণ মানুষের মাঝে যেন একধরনের মৌন সম্মতি ছিল। তখন পর্যন্ত কেউ জানেই না যে ভিতরে কি ভয়াবহ নৃশংসতার সাথে হত্যাযজ্ঞ চালান হয়েছে। বিডিআর এর ভিতর তখন প্রকম্পিত হয়ে উঠছে আকাশ বাতাস প্রচন্ড গোলাগুলির শব্দে। সেদিন সকাল সাড়ে আটটার দিকেই আমি পিলখানার সামনে দিয়ে এসেছি, তার আধ ঘন্টা বা এক ঘন্টা পরই শুরু হয়ে যায় অবিশ্বাস্য সেই নারকীয় হত্যাযজ্ঞ।
চার পাঁচটা দিন সেই ভয়াল সাংঘাতিক অবস্থার মধ্যেই কেটে যায় আমাদের। আমার বাসাও সেখান থেকে খুব বেশী দূরে নয়, আমরা আওয়াজ পাই, বিকেল নাগাদ ড্রেনে ফেলে দেয়া লাশ ভেসে উঠতে থাকে এক কিলোমিটার দূরে । মানুষ আতংক আর বিহবলতায় অবাক ও বিস্মিত হয়ে উঠে। এ কেমনতর বিদ্রোহ? আমার জ্ঞান হওয়া অবদি এমন নৃশংসতার কোন স্মৃতি আমার মনে পড়ে না। আর্মি তলব করা হলেও তারা কেবল বাইরে অবস্থান নিয়েই থাকে। ৩০টি ট্যাংক মোতায়ন হয়, চারদিক ঘিরে ফেলে সোনবাহিনী। তবু অস্ত্র সমর্পন হতে হতে দ্বিতীয় দিনে গিয়ে গড়ায়। যখন অবশেষে বিডিআর অস্ত্র সমর্পন করে তখন দেখা যায় ১০ হাজারেরও বেশী জওয়ানের মাঝে এক হাজারও ভিতরে নেই, বাকিরা পালিয়ে গেছে। কিভাবে পালাল এরা? নানা রকম ষড়যন্ত্রের কাহিনী মুখে মুখে রটতে থাকে।
নতুন সরকারের চূড়ান্ত পরীক্ষা হয়ে যায় এই সময়ে। মাত্র ৫০ দিনের পুরনো সরকার অবশ্য ভালভাবেই সেই পরীায় উতরে যায়। সেনাবাহিনী ধৈর্য্য ও সংযম না দেখালে ক্ষতি এবং রক্তপাত আরও অনেক বেশী হতে পারত। তাছাড়া ঘণবসতিপূর্ণ এলাকা এই ধানমন্ডি, আজিমপুরসহ বিডিআর এর আশপাশ, সুতরাং অনেক বেসামরিক মানুষের জীবনও বিপন্ন হবার সম্ভবনা ছিল।
কার লাভ হল মূলত? সেসমস্ত উত্তরের জন্য অপো করতে হবে আমাদের আরও অনেক সময়। এমনকি উত্তর নাও জানা যেতে পারে। এ বিষয়টা নিয়ে আর মাথা ঘামাতে ইচ্ছা করে না। পুরো দেশ এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াতেই এক ভয়াবহ অস্থিরতা বিরাজ করছে, সেই সাথে যুক্ত হয়েছে পৃথিবীব্যাপী মন্দা, সব মিলে ২০০৯ টা যেন এক অশুভ বছরের ইঙ্গিতই দিচ্ছে!
৮ই মার্চ ২০০৯
অফিসে এসেছি যথারীতি জ্যাম ডিঙ্গিয়ে। বিডিআর এর ঘটনাটা এখন একটু পুরনো হয়ে গিয়েছে, তদন্ত চালাচ্ছে পুলিশ, র্যাব ও সেনাবাহিনী। জীবনের প্রয়োজনেই মানুষ অন্যান্য চলমান ঘটনায় মনোযোগী হয়ে উঠে, একই সাথে মিডিয়াও। এরই মাঝে পাকিস্তানে শ্রীলঙ্কার ক্রিকেটারদের উপর সন্ত্রাসী হামলা চালানো হয়। এতে পুলিশসহ ৮ জন মৃত্যুবরণ করে, দেশের ভিতরেও চলছে নানামুখী অন্তর্ঘাত, গুপ্ত খুন ও রহস্যময় সব হত্যাকান্ড। এই সামগ্রিক পরিস্থিতিতে মাঝে মাঝে ভাবি পৃথিবী তথাকথিত সভ্যতার এক মুখোশ ছাড়া আসলে আর কিছু নয়। মানুষ সভ্য হয়নি একফোঁটাও, মানুষের ভিতরে যে পশু প্রবৃত্তি তাকে আয়ত্তে আনতে পারেনি এত লাখ লাখ বছরেও। মানুষ মূলত যুদ্ধবাজ ও হিংসা পরায়ন এবং ক্ষেত্রবিশেষে পশুরও অধম। পশু হত্যা করে কেবল জৈবিক তাড়নায় কিন্তু মানুষ হত্যা করে লোভ, হিংসা, বিদ্বেষ, ক্ষোভ, ব্যর্থতা, সফলতা, ক্ষমতা, মতবাদ, ঈর্ষাসহ সকল প্রকার তথাকথিত বড় ও তুচ্ছ কারণে। এতদিনে তাহলে এই আমাদের অর্জন?
আমি ভয়ে ভয়ে থাকি, কে কখন বলে বসবে, এই যে আপনি টাই পড়ে, স্যুট করে অফিস করেন কেন? আপনাকে মরতে হবে! কিংবা এই যে আপনি দাড়ি টুপি রাখেন না কেন, আপনি ব্যাংককে চাকরি করেন কেন? আপনাকে মরতে হবে! কিংবা আপনি ক্রিকেট খেলা উপভোগ করেন কেন? আপনাকে মরতে হবে! আপনি এরকম কেন? আপনাকে মরতে হবে! আপনি কবিতা লেখেন কেন? আপনাকে মরতে হবে! আপনি গান শুনেন কেন? আপনাকে মরতে হবে! আপনি আমাদের দলে না কেন? আপনাকে মরতে হবে! আপনি ওদের দলে? আপনাকে মরতে হবে! আপনি কোন দল করেন না? আপনাকে মরতে হবে!
আপনাকে মরতে হবে!
আপনাকে মরতে হবে!
আপনাকে মরতে হবে!
আপনাকে মরতে হবে!
চারিদিকে এত মৃতে্যুাৎসব, আমি চরম এক আতংক আর অনিশ্চয়তায় বসবাস করি, আমরা চরম এক আতংক আর অনিশ্চয়তায় বসবাস করি। এ যেন এক মৃত্যু উপত্যকা! স্বাভাবিক মৃত্যুর কোন গ্যারান্টি নেই এই জনপদে!
১১ই মার্চ
এসমস্ত কিছুর মাঝেই প্রেম হয়, ভালবাসা হয়। ১২ই মার্চ
সারাদিন আজ তেমন কোন কাজ নেই। বসে বসে তাই বিরক্ত হওয়া ছাড়া আর কিছুই করার ছিল না, পত্রিকা পড়ে আর ইন্টারনেট ঘেটে ঘেটে কেটে গেল সময়। এর মাঝে ইলেকট্রিসিটি থাকে না নিয়ম করে প্রতিদিন।
এই জীবনটা আমি চাই নি, মানে এরকম অর্থহীন ও সৃষ্টিহীন দিন কাটানো! কি করব যদিও বুঝতে পারি না। একটা চলচ্চিত্র বানালে হয়ত অন্যরকম কিছু একটা হতে পারত, সেটি এই মুহূর্তে হয়ে উঠছে না। তাহলে এভাবেই সময়গুলো পার করে দিব? অসহ্য মনে হচ্ছে সব কিছু।
১৭ই মার্চ
একই রকম একঘেয়ে কাটছে দিনগুলো, সময়টা যেন মুখ ভার করে আছে! ভাবনা এখন অনেক দূরবর্তী, আবার সবকিছু আগের মতই ছন্দহীন। এর মাঝে অবশ্য একটি দুই-দিনের যৌথ প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ করলাম, কিন্তু আগের মত তেমন একটা মজা লাগল না, কেমন যেন প্রাণহীন মনে হল। আমি পাঁচ মিনিটের জন্য একবার গিয়েছি সেখানে।
কি হল ভাবনার? এখন বড্ড বিমূর্ত, আকারহীন সেই এক রকমের আকাঙ্খার জন্য মনও আর তেমন ব্যাকুল হয় না আগের মত। সব চলছে ঠিকঠাক, যদিও সব ঠিকঠাক চলাটা কখনও কখনও খুবই একঘেয়ে।
১৮ই মার্চ
আজ আবার ভাবনা ছুয়ে দিল মনকে। মানুষের মন এক জটিল সমীকরণ, একে বুঝিয়ে নিজের মত চালানো ভীষণ দুরূহ একটা ব্যাপার। যতই আমি বলছি ওদিকে যেও না ততই সে বারবার সেদিকেই ধাবিত হয়। ভাবনা আমার অন্তর্জগতে তার রং ছড়িয়ে দিচ্ছে আবারও। আমি খুব সাবধানে দূরত্ব রচনা করি ভাবনার সাথে, কারণ তার দিকেই ধাবিত হতে চায় চিন্তা ও চেতনা। আমি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করি!
আবার মন বড্ড অভিমান করে, কেন এরকম অদ্ভুত আচরণ করে নিজেই বুঝি না। ভাবনাতো আমার নয়, গর্দভের মত তাকে প্রত্যাশা করতে চায় বলে হাসি পায় এবং একই সাথে ভাবনাকে কবিতা, গল্প কিংবা শিল্পে রূপান্তরিত করার কথা তখন মনে হয়। ভাবনাকে পাওয়া যাবে কেবল ভাবনাতেই।
সুতরাং আমি খুব মর্মাহত হই। আমি নিজের কাছ থেকেই লুকাতে চাইছি যে আমি তাকে প্রত্যাশা করি, অন্যের কাছে তো বটেই। দারুন মাতাল হাওয়ায় চারদিকে যে জীবনের উদ্ভ¢াস তাতে ভাবনাকে নিয়ে ছুটে চলাতে কি খুব আনন্দ হবে? এ এক জটিল রহস্য, ভেবে ভেবে আকুল হই।
৩০শে মার্চ
ভাবনার জগতে কিছুদিন বিরাজ করা গেল, তারপর...
২৭ এপ্রিল
ইদানিং ভীষণ ব্যস্ততা, তাই লেখার সময় পাওয়া যাচ্ছে না। কর্পোরেট সংস্কৃতি অন্যান্য অফিস থেকে একটু ভিন্ন। এখানে কাজের প্রচুর চাপ, এবং সবই খুব দ্রুত করতে হয়। অর্থহীন অর্থ উৎপাদনে ব্যস্ত, কর্পোরেট কালচার!!
৩রা মে
কয়েকদিন নাভিশ্বাস ওঠা তীব্র গরমের পর দু-তিন দিন হালকা বৃষ্টি হল, ফলে আবহাওয়া কিছুটা ঠান্ডা। গরমের তীব্রতা নেই ফলে রাতে ঘুমান যাচ্ছে একটু আরামে। কিন্তু মনটা বিপ্তি থাকে, সারাণ জীবিকার প্রয়োজনে এই কাজ করে যেতে হয় আমাকে। আমিও এখন চূড়ান্ত সাধারণ, মাঝে মাঝে বড্ড ভয় পেয়ে যাই আমি কি আপাদমস্তক পরিবর্তিত হয়ে যাব?
১৪ই মে
অফিসের কাজে চট্টগ্রাম গিয়েছিলাম, কিন্তু ঘুরে ফিরে দেখতে পেলাম না কিছুই এতটাই ব্যস্ত ছিলাম শাখা উদ্বোধন নিয়ে। জীবনটা জড়িয়ে যাচ্ছে ব্যাংকের সাথে। ফিরেছি পরশু রাতে, গতকালই আবার অফিস করেছি। বয়ে যাচ্ছে সময়, কল্পনার অদ্ভুত মায়াবী জায়গাগুলো ক্রমাগত সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে, সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে বিস্মিত হবার ক্ষমতা।
আমার মেয়ে আমাকে শাসন করে এখন, বলে এটা করবে না, সিগারেট খাবে না, এখানে এসে বসে থাক ইত্যাদি। ওকে যত দেখি ততই মুগ্ধ হই! ওই এখন আমার জীবনের উদ্দেশ্য এবং কষ্ট করার একমাত্র কারণ।
৭ জুন
ব্যস্ততার কারণে লেখা হয়ে উঠেনি বহুদিন, নানাবিধ ব্যাংকের কাজকর্মে ব্যস্ত থেকেছি। মনে হয়েছে অনেক কিছুই কিন্তু লিখে উঠতে পারিনি। প্রায় এক মাস পর লিখছি। বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছি ক্রমশ সৃষ্টিশীলতার জগৎ থেকে। এই কি আমার পরিণতি হবে শেষ পর্যন্ত!
ভাল লাগে না কিছুই, অস্থিরতা ক্রমশ বেড়েই চলেছে, এখানে যারা কাজ করে তাদের অনেকেই বেশ ভাল মানুষ তবে সেই তাগিদ নেই। এদের বেশীরভাগের কাছে চাকরিটাই মনে হয় জীবন। আর কিছু নয়, কোন রকম অস্থির হতে দেখি না, জীবন এমনই বয়ে যায়, দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর এভাবেই। বাইরের অসম্ভব সুন্দর যে মহা-জীবন তা কি ওদের কানে পৌঁছে না?
আমার আত্মা আমি কি বিক্রি করে দিয়েছি এই অদ্ভুত সাজান চার দেয়ালের ভিতরে? আমার ইচ্ছা করে যে সমস্ত কথা বলতে, নিজের মাঝে যে সমস্ত বিষয়গুলো ক্রমাগত ঘুরপাক খায় ফিসফিস করে কিছু একটা বলতে চায় তার মুখ আমি বন্ধ করে রেখেছি কি সযতেœ।
কার জন্য লিখব, কে পড়বে এসমস্ত। পড়লেই বা আমি কি পাব? তবু বসে থাকি সেই একজন নিবিষ্ট পাঠকের আশায় যে আমার সাথে যোগাযোগ করতে পারবে। আমার ভাবনার সাথে তাকে এক করে দেখি।
বাইরে দমকা বাতাস দিচ্ছে, বৃষ্টি নেমে আসতে পারে যে কোন সময়। অফিসের বাঁধা-ধরা সময়টা দ্রুত শেষ হয়ে আসছে। আমি অপেক্ষা করছি কখন এই বন্দিত্ব থেকে মুক্তি পাব।
১৬ জুন
অদ্ভুত এই জীবন, ঘুরে ফিরে অনেক সময়ই দেখা হয়ে যায় নিজের অতীতের সাথে, তখন সেই অতীত চমকে দেয়। ভাবনার জগতে সবকিছুই ওলট-পালট হয়ে যায়। নিজের ইচ্ছার সাথে নিজেরই বিরোধ তৈরী হয়, ধীরে ধীরে ভাবনার জগত থেকে যেন আকার পেতে শুরু করে বাস্তবতা। বিমূর্ত থেকে অবয়বের পৃথিবীতে রূপান্তরিত হয় বাস্তবতা, আবার সে এমনই এক দেয়াল তৈরী করে যা ডিঙ্গিয়ে যাওয়া যেন এক পাহাড়সম বাধা, যা এক সময় ছিল সহজ পাওয়া, মনে হত একান্ত নিজের তাই যেন এখন এক সুদূর ভাল লাগা কেবল।
জট পাকিয়ে যাচ্ছে, এবং লেখাটি ধীরে ধীরে হয়ে উঠছে বিমূর্ত। যেন নিজের থেকে এবং অন্য অনেকের থেকেই কিছু বিষয় লুকিয়ে বলতে চাইছি অনেক কিছু। ইশারা আর ইঙ্গিতের জগতে সবকিছু হয়ে উঠছে আপাত অবস্থার মতই রহস্যময়।
বিমূর্ততার দিকে আমার বরাবরই ঝোঁক, কবিতায়, ছবিতে, শব্দে, রঙে, রেখায় আমি বলতে চেয়েছি এক জীবনের মত গল্প। নেহায়েত নিজেরই অভিজ্ঞান, নিজের আত্মায় অনুভূত বিচিত্র আবেগ, অনুভব!
জগৎ-টাকে যেভাবে দেখেছি সেভাবেই উপস্থাপন করতে চেয়েছি, ভাবনা ভাগ করে নিতে চেয়েছি অপরের সাথে।
১৮ জুন
আকাশটা ইদানিং যেন আগুন ঝরায়, দুপুরের দিকে অফিস থেকে বের হলে চামড়ায় চড় খাবার মত অনুভূতি হয় এমন অসম্ভব তীব্র উত্তাপ থাকে রোদে। লোড শেডিং চলছে সমানে, এখন এক রাজনৈতিক সরকার ক্ষমতায়, অথচ সাধারণ মানুষের জীবন যেন আরও অবরূদ্ধ এই জনপদে। র্যাবের হাতে পলিটেকনিক ইন্সটিটিউটের দুই ছাত্র প্রাণ হারাল সেদিন, আইন শৃংখলা বাহিনীর এই বিনা বিচারে মানুষ হত্যার বিরূদ্ধে তথাকথিত অনেক বুদ্ধিজীবিই মুখ খুলছেন না। এক হিসেবে জানা যায়, জুন ২৫, ২০০৪ এ র্যাব (র্যাপিড এ্যাকশন বেটেলিয়ান) গঠনের পর থেকে এ পর্যন্ত র্যাবের হাতে পাঁচ বছরে এক হাজারেরও বেশী মানুষ প্রাণ হারিয়েছে (সূত্র: দৈনিক নিউ এ্যাজ পত্রিকার ১৭ জুন, ২০০৯ সংখ্যা, পৃষ্ঠা-৪, কলাম-৮ এর শেষ প্যারায় উল্লেখিত তথ্যসূত্র-মানব অধিকার সংস্থা অধিকার এর বরাত দিয়ে প্রকাশিত সংবাদ)। মৃত সেই দুই ছাত্রের একজন মোঃ আলী জিন্নাহ-র পরিবার এর পক্ষে তার ভগ্নীপতি জসিম উদ্দিন বাদি হয়ে ঢাকা চিফ ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে ১১জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছে।
এটি একটি উদাহরণ মাত্র, এরকম আরও কত ঘটনা ঘটছে প্রতিনিয়ত, অথচ এই সরকারের প্রতিশ্র“তি মতে কোন বিচার বহির্ভূত হত্যাকান্ড এই সরকারের সহ্য করার কথা না, এ সমস্ত তবুও চলছে। বাজারে জিনিষপত্রেও আগুন লেগেছে, মানুষের ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। এ দেশের মানুষও চরমভাবে (আমি, আমরাও বাদ যাই না!) নিয়ম শৃংখলার প্রতি উদাসিন, গতকালই এক ভয়াবহ ট্রেন-বাস সংঘর্ষ হয়ে গেল দিনে দুপুরে মগবাজার রেল ক্রসিং-এ।
এই সমস্ত কিছুর মাঝেই আছি। নিজেকে প্রবোধ দেই, এই তো বেশ আছি!!! এরই মাঝে প্রেম হয়, মানুষ সন্তান নিয়ে, অফিস আদালত নিয়ে বেশ আছে, আমাদের টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে অধিকাংশ তথাকথিত নাট্য নির্মাতারা এই সমাজের পচনের মতই সব ফালতু ফালতু নাটক বানিয়ে যাচ্ছে, যেন সব গর্দভ কেউ কিছু বোঝে না। ফালতু প্রেম, ভন্ডামি, ভণিতা এই সমস্ত হচ্ছে নাটকের মাল মশলা। তাও সকলে যে হারে স্টার বনে যাচ্ছে (একটা, দুটা রদ্দি নাটকে একটু চেহারা দেখিয়েই) তাদের না দেখলে বিশ্বাসই হবে না, কাউকে আর মানুষই জ্ঞান করছে না এই সমস্ত উদ্ধত উ™£ান্ত তথাকথিত নট ও নটীগণ! বাণিজ্যিক মিডিয়াও এসমস্তই উৎসাহিত করছে, মানুষের কথা এগুলোতে অনুপস্থিত। আছি, বেশ ভালই আছি এই জনপদে।
আমার অতীত কেবল ফিসফিসিয়ে কথা কয়ে যায়, ভাবনার জগতও আছে সেই সমস্ত অলীক ও ক্ষণিক ভাল লাগার সময়গুলোতে। বাড়িতে আমার কন্যা, স্ত্রী এবং জননী আমার অপেক্ষায় থাকে, আমাকে নিয়ে আমার কন্যার যত খেলা। ওর মত ভাবনাহীন এবং নিষ্পাপ পৃথিবী আমার নয়। এখানেই বেড়ে উঠবে আমার সন্তান এবং আমাদের সন্তান? এই পৃথিবী আমরা রেখে যাব তাদের জন্য? যেখানে বিনা বিচারে মানুষ মেরে ফেলা হয়?
বলা হয়ে থাকে দশজন অপরাধীও আইনের ফাঁক গলে বেরিয়ে যাক তবু যেন একজন নিরপরাধ ব্যক্তিও ভুল করে সাজা না পায়। অথচ আমাদের এখানে এসমস্ত হচ্ছে কি? ২৪ জুন
আমাকে ডেকে ফিরে আনন্দ এবং দুঃখ একসাথে। আনন্দের আরেক নাম তুমি, কখনও কখনও প্রবল আকাংখা জমে, সে সমস্ত ভুলে গিয়ে আবার পুনরায় তোমাকে গড়ি। ভাবনা তবুও যে কোন অজুহাতে তোমাকে হাজির করে যখন তখন।
মাত্রাতিরিক্ত গরমে মানুষের ত্রাহী ত্রাহী অবস্থা, প্রাণবায়ু বেরিয়ে যায় যায়। বাংলাদেশে এই প্রথম দিনের আলো সংরক্ষণের জন্য ঘড়ি একঘন্টা এগিয়ে আনা হয়েছে, দিনের আলো এখন প্রায় আটটা পর্যন্ত পাওয়া যায়, তবুও লোড শেডিং-এর কোন সুরাহা হচ্ছে না। আগের মতই চলছে তীব্র লোড শেডিং। সারাদিনে আট দশবার ইলেকট্রিসিটি চলে যাচ্ছে, ফলে এই গরমে মানুষের অবস্থা যাচ্ছেতাই। সারাক্ষণ এক হাসফাস পরিস্থিতি!
কোন বৈচিত্র নেই।
৮ জুলাই
আজকে আকাশ মেঘলা, মেয়েটার জ্বর দেখেও অফিসে আসতে হয়েছে। ওর ছোট ছোট হাত দিয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরে রেখেছিল সকালবেলা, আসতে দিতে চায়নি। সব কিছু মিলে মনটা ভাল নেই। আমার মন ভাল না থাকার আরও নানা রকম কারণ আছে, তার মাঝে একটি হচ্ছে আমার অস্থির স্বভাবের কারণে কোন নির্দিষ্ট জায়াগায় আমার টিকে না থাকা। আমি এতই বেশী পরিবর্তনের ভিতর দিয়ে গিয়েছি যে আমার থেকে সকলেই তথাকথিত ক্যারিয়ার...
১৪ অক্টোবর
মাঝখানে বেশ কিছুটা সময় এই লেখাটা থেকে দূরে ছিলাম। এর মাঝে ঈদের সময় ঢাকার বাইরে থেকে ঘুরে এসেছি। বেশ ভাল লেগেছে এই কোলাহল থেকে ক্ষণিক দূরত্বে প্রকৃতির কাছে কিছুটা সময় থাকা। আমরা চা বাগানের একটা বাংলোতে ছিলাম, চারদিকে কি চকচকে সবুজ! রাতে কি অজস্র তারা দেখা যায় আকাশে আর নিচে জোনাকী! আমার মেয়ের গরু দেখে, প্রজাপতি দেখে অনেক আনন্দ, ঘুরে ঘুরে দৌড়ে বেড়িয়েছে কয়েকটা দিন।
ঢাকায় ফিরে এসেও কিছুদিন বেশ আরামে চলাফেরা করা গেল। যানজটহীন নিরূপদ্রব রাস্তাঘাট।
সেই আরামে ভয়ানক এক ঝাঁকুনি দিয়ে আবারও ব্যস্ত ভীড় আর জটলা আমাদের রন্ধ্রে রন্ধ্রে বিরক্তির এক ঢেউ তুলে দিল। দেশে সব ভয়াবহ ঘটনা ঘটছে, সমাজ অস্থির এবং নিষ্ঠুর হয়ে উঠছে, তার মাঝে সর্বশেষ সংযোজন হল রাসু খাঁ নামের ভয়ানক অসুস্থ এক সিরিয়াল কিলারের, জ্যাক দ্যা রিপারের বাংলাদেশী সংস্করণ। ১১ জন মহিলাকে ধর্ষণের পর খুন করে এই ভয়ংকর দানব দিব্যি ঘুরে ফিরে বেড়াচ্ছিল। মানুষ এখানে এমন অসুস্থ হয়ে পড়ছে যে খুন করে সেই মাথা নিয়ে দৌড়ে বেড়াচ্ছে রাস্তায়। এই অসুস্থতার উৎস কি?
১৯ অক্টোবর
আমার ভাগ্যটা অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সর্বদাই মন্দ। আগে যে পত্রিকায় কাজ করতাম সেখানে চার বছর প্রায় একই বেতনে কাজ করতে হয়েছে, বারবার বাড়াবার কথা বলেও সর্বোচ্চ দুই হাজার বাড়ানো হয়েছিল। রাগে ক্ষোভে সেই চাকরি ছেড়ে দিয়েছিলাম। ব্যাংকে এসেও আমি এক বিদঘুটে পরিস্থিতির মুখোমুখি। যেখানে দুই বছরে পদন্নোতি হয় সেখানে আমার লাগছে প্রায় চার বছর, পুরো একটা বছর আমার নাই করে দিল, ইনক্রিমেন্টটাও লাগল না এক বছরে। একে দুর্ভাগ্য ছাড়া আর কি বলব?
১৫ নভেম্বর
লিখছি না প্রতিনিয়ত, ব্যাংকের একঘেয়ে এই কাজে হাপিয়ে উঠেছি, তারই ফলশ্র“তিতে হচ্ছে না কোন ধরনের সৃষ্টিশীল কাজ। ভীষণ বিরক্ত আমি, ভীষণ রকমের ক্ষুব্ধ নিজের উপর!!
এই কাজে কোন রকমের বৈচিত্র নেই, বৈচিত্রহীন বলেই আমি সৃষ্টিহীন। পত্রিকায় যখন ছিলাম তখন কাজের একটি আনন্দ ছিল, নানান বিচিত্র ধরনের মানুষ ও পরিবেশ, নানান ধরনের গল্প ও জীবনের কাছাকাছি হতাম। সমাজের সকল শ্রেনীর মানুষ ও পেশাজীবির মুখোমুখি হবার সুযোগ ছিল।
কত না মজাদার ছিল সে সমস্ত অভিজ্ঞতা! সারা দেশটা চষে বেড়াতাম। আজকে খুলনা তো কাল চাঁদপুর। কখনও সেরাকন্ঠের খোঁজে তো কখনও জাটকা অভিযানে চলে গিয়েছি স্পিড বোটে করে পদ্মার মোহনায়। ফটোগ্রাফিতে দেশকে তুলে এনেছি অবলীলায়, কোন বাঁধা ধরা সময় ছিল না, ছিল না প্রতিদিন সকাল হতে সন্ধ্যা পযন্ত অফিসের চৌহদ্দিতে বন্দী হয়ে থাকার বাধ্যবা