১৯৭৮ এ এসএসসি পাশের পর পরই আমি টিউশনি করতে শুরু করি। বাবা ৬৯ এ ইপিআইডিসি’র চাকরী থেকে অবসরে যাবার পর সংসারের আয় ছিল একমাত্র বাড়ী ভাড়া বাবদ ২৭৫ টাকা। ছোট দু’বোন স্কুল পড়ুয়া। সংসারে ভীষন অভাব-অনটন। ৭ সদস্যের পরিবারে জনপ্রতি সকালে-রাতে ০৩ টি করে রুটি, দুপুরে মাপা ১ প্লেট ভাত। টানা পাঁচ বছর এ খাদ্য তালিকার হেরফের হয়নি। যুবক বয়সের সে সময়ে সারাক্ষনই প্রায় ক্ষুধার্থ থাকতাম। অতএব টিউশনী ব্যতিত টাকা উপার্জনের অন্য পথ ছিলনা।
খিলগাঁও তালতলার একটি বাসায় ক্লাস টু’র একটি ছেলেকে দিয়ে টিউশনি শুরু। টিউশন ফি মাসে ৩০ টাকা। জীবনের প্রথম টিউশনীতে আমি কিছুতেই মন বসাতে পারছিলাম না। কারন প্রথমতঃ ছেলেটি ছিল ভীষন আদুরে দ্বিতীয়তঃ পড়ালেখা বিমুখতা। এত ছোট ছেলেকে শাষন করতেও ইতস্ততঃ বোধ করতাম। মেজাজ থাকতো সপ্তমে। ফলে একমাস পড়িয়েই এ টিউশনীতে ক্ষান্ত দিলাম। অবশ্য এ মাসেই খিলগাঁও এ ১০০ টাকার একটি সকালে আর ১৫০ টাকার একটি টিউশনী নয়াটোলা চেয়ারম্যান গলিতে বিকাল থেকে পড়ানোর জন্য পেয়ে গেলাম।
তখন খিলগাঁও এ নিজ বাড়ীতে থাকি। আমি সন্ধের পর মগবাজার আম বাগানে ১৫০ টাকায় আরও একটি টিউশনী নিলাম। প্রতি টিউশনিতে সপ্তাহে ০৬ দিন পড়াতে হত। অংকে বিশেষ দুর্বলতার কারনে আমার সবগুলো টিউশনিই ৫ম শ্রেনি পর্যন্ত সীমাবদ্ধ ছিল। তবে সবগুলোই ছিল ইংলিশ মিডিয়ামের। বিকেল ৩ টায় ঘর থেকে হয়ে কখনও রেল লাইন ধরে, কখনও মালিবাগ বাজার পার হয়ে টিএন্ডটি কলোনীর মধ্য দিয়ে হেটে হেটে নয়াটোলা চেয়ারম্যান গলিতে যেতাম, আসতাম। কমদামী চামড়ার সেন্ডেল, কখনওবা স্পন্জ এত হাটাহাটিতে বেশিদিন টিকতো না। আর শীত সহ্য করা গেলেও রোদ-বৃষ্টির দিনের কষ্টটা এখনও যেন ষ্পষ্ট অনুভব করি। কাঠের ডাটওয়ালা কাপড় ছেড়া বাসার একমাত্র ছাতাটি নিয়ে বৃষ্টিতে চলতে লজ্জাই লাগতো।
বিকেল সাড়ে তিনটা থেকে পাঁচটা পর্যন্ত রুশো - রুমন নামের খুব মিষ্টি চেহারার দু’টি ছেলেকে পড়াতাম। বিকেল পাঁচটার পর ০৬ টা পর্যন্ত কোন কাজ থাকতোনা। সন্ধার পরই যেহেতু কাছাকাছি টিউশনি আর মগবাজার চেয়ারম্যান গলিতেই বড় বোনের বাসা। আমি বড় বোনের বাসায় একবার ঢু মেরে কখনও হোটেলে বসে (পকেটে পয়সা থাকলে) পুরি-চা খেতাম, নয়তো ঘোরাঘুরি করতাম। পরে অবশ্য আমবাগানের ‘আজাদ ক্লাব’ ব্যায়ামাগারে ৫ টা থেকে ৬ টা পর্যন্ত ব্যায়াম করে সময়টুকু কাটাতাম। টিএন্ডটি কলোনীর এবং আশপাশের অনেক ছেলেরা ক্লাবটিতে ব্যায়াম করতো। সন্ধার পরপরই আম বাগানে সোহেল নামের মিষ্টি দুষ্টু ছেলেটিকে পড়াতাম। ওদের দোতলা বাড়ীর জানালার পাশে বসে বহু বহু দিন বিষন্ন মনে সূর্যাস্তের লালিমা, সূর্যের ডুবে যাওয়া দেখতাম।
বিকেলে রুশো রুমনদের বাসার প্রথম টিউশণীতে প্রতিদিনই নাস্তা হতনা। কোন সময় নাস্তা এলে প্রথমেই বাবা আর ছোট বোনদের কথা মনে পড়তো। খেতে ভীষন সংকোচ হতো। আর ব্যায়াম করে সন্ধের পর সোহেলদের বাসায় ঢুকেই ওকে ইশারায় পানি আনতে বলতাম। হালকা ঠান্ডাপানির বোতল এলে প্রায়ই বলতাম, ওয়াসা ফ্রী, তাইনা সোহেল ? ও হেসে বলতো ‘একটু পরে নাস্তাও ফ্রী হবে স্যার’। আমি একটু উচ্চস্বরে হেসে উঠতাম। হ্যা, এটা সত্য’ আমি আমার সমস্ত অস্তিত্ব দিয়ে আমার ছাত্রদের পড়াতাম। আর ওদের রেজাল্টও হতো ১ থেকে ৩ এর মধ্যে। ৩ টি টিউশনিতে মোট ৪৫০ টাকা পেতাম। সে সময় ঐ পরিমান টাকায় ছোট দুটি বোনের লেখাপড়া এবং সংসারের টুকটাক খরচের জন্য খুবই খুবই প্রয়োজন ছিল। তবে অনেক সময় কষ্ট পেতাম টিউশনীর টাকাটা পেতে দেরী হলে। টিউশনি আর মেজো বোনের দেয়া টাকায় ১৯৮০ এ এইচএসসি পরীক্ষা দিলাম, পাশও পেলাম।
টিউশনী থেকে ফিরতে রাত ৮ টা বেজে যেত। বাবাকে খাটে বসা দেখতাম। বাসায় টিভি, রেডিও কিছুই ছিলনা। বাবা অবশ্য বই কিংবা পেপার পড়তেন, কিন্তু তাই বা কতক্ষন। দু’বার হার্ট এটাক হওয়ার পর তাঁর শারীরিক শক্তিও তেমনটা ছিলনা। কোনদিন ফিরতে রাত ০৯ টা বা তার বেশী হলে বাবা বলতেন, এত দেরি করলি ! বাবার এমন আকুতি ভরা প্রশ্ন শুনে বুকের ভীতরটা হু-হু করে উঠতো। বুঝতাম বাবা কত একাকী জীবনের শেষ সময়টুকু কাটাচ্ছেন।
টিউশনির টাকা পেয়ে ছোট বোনদের স্কুলের বেতন, টুক-টাক কেনাকাটা করতাম। তবে রফিকের দোকানের বাকী দিতাম সবার আগে।
এর কিছু দিন পরই ১৯৮৬ এ ছোট ভাই জার্মানী চলে গেল। আমাকে দেয়া বাবার ‘পাওয়ার অব এটর্নির’ বলে টঙ্গির জমি বিক্রি করে ওকে টাকা দিলাম। তবে মনে মনে খুশীও হলাম এই ভেবে, জার্মানী থেকে মার্ক আসবে। জীনস-কেডস পড়বো। টিউশনী আর করবোনা। নাটক করবো। আমার লেখাপড়া আবার শুরু হবে। ছোট বোন গুলো স্বচ্ছন্দে লেখাপড়া করবে। খাবারের কষ্ট আর হবেনা ইত্যাদি অনেক রঙিন কল্পনার ছবি আকা চললো।
সিলেট থেকে ডিপ্লোমা শেষে বড় ভাইও ৮৬/৮৭ এ কেয়ার এর চাকরীতে টাঙ্গাইল এ পোস্টিং পেল। আমি আরো উত্ফুল্ল। সত্যি সত্যিই ৭৮ থেকে ৮৬ এ দীর্ঘ সময়ে দিনে ৪/৫ টা টিউশনী করে করে ছোট দু’টি বোনের লেখাপড়া করানো, সীমিত টাকায় চাহিদা মেটানো এবং বিভিন্ন টানা পোড়নে আমি চরমভাবে হাপিয়ে উঠেছিলাম। তবে ভাইদের উন্নতি-উত্কর্ষতা ও আশ্বাস সত্ত্বেও আমি ২টি টিউশনী চালিয়ে গেলাম। এরই মাঝে এইচএসসি’র ছয় বছর পর ১৯৮৬ এ পরীক্ষা দিয়ে বিএ পাশও করলাম।
তার পর দিন কেটে গেল কতইনা দ্রুত গতিতে। জীবনের দৃশ্যপটও পাল্টে যেতে থাকলো যেন তারও চেয়ে দ্রুত। অনেক স্বপ্ন-আশা আলোর গতিতে উর্দ্ধাকাশে মিলিয়ে গেল।
টিউশনীর সে সময় আর জীবনের সে বিশেষ দিনগুলোর কথা এখনও ভীষন মনে পড়ে। তা নিয়ে ভাবি। ‘টিউশণী’ করা থেকে পাওয়া ‘শিক্ষা’ ( ‘টাকা’ নয় ) আমাকে অনেক শিক্ষার চেয়েও যেন অনেক বড় কিছু শিখিয়েছে। আবার শিক্ষকতার এ মহান পেশা (আমি বলি ‘নেশা’ ) ‘র বর্তমান নিম্নগতি হাল-চালও দেখি। বাসায় এসে যেসব ছেলে-মেয়েরা পড়ায়, তাদের দিকে গভীর মমতায় চেয়ে থাকি। কত সৎ আর সুন্দর মনের মানুষ হলে ‘বাসায় এসে’ বাচ্চাদের ‘পড়ানো’ !! আহা, এরা কি বাড়ী থেকে খেয়ে বের হয়েছে ? কতদূর পথ হেঁটে, বাসে গাড়ীতে জ্যামে কষ্ট পোহায়ে পড়াতে এসেছে ?! কখন কিভাবে বাড়ী ফিরবে ?! এত প্রতিযোগিতার যুগে, যেখানে ‘স্কুলের শিক্ষক’রাই ক্লাস ফাঁকি দিয়ে, ন্যায়-নীতি-বিবেক বিসর্জন দিয়ে বাসায় ব্যাচের পর ব্যাচ পড়াচ্ছে, সেখানে এসব ‘ক্ষুদে এবং সত্যিকারের শিক্ষক’রাই যেন আমার দৃষ্টিতে বিশাল কিছু হয়ে ধরা পড়ে !! অনেক অনেক ইচ্ছে হয়, বিশাল কিছু করে, এদের কষ্ট যদি মুছে দিতে পারতাম !!
ইচ্ছে হয়, আবার টিউশনির দিনগুলোয় ফিরে যাই ! যদি যেতে পারতাম !!
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ সকাল ১১:৩৯