১.
এক সময় অন্য ধর্মের লোক হিন্দুদের ঘরে ঢোকা নিষেধ ছিল। অন্য ধর্মের লোক ঘরে প্রবেশ করলে নাকি নাপাক হয়ে যায় বা লক্ষ্মী দেবী পালায়!
আমাদের টিউবওয়েল থেকে পানি নিতে আসা গীতা মাসির কলস ছুঁয়ে ছিলাম (ছোট বেলায়) মিজান মামার কথায়। মামা আমাকে দিয়ে দুষ্টামি ছলে কলস ছোঁয়ানোর কারণ- মজা দেখবে বলে। যেইনা কলস ছুঁয়েছি, গীতা মাসি তেড়ে আসলো আমায় মারতে। দৌড়ে দূরে সরে আসলাম। "শেখের ঘরের শেখ, জাউরার ঘরের জাউরা" ইত্যাদি অশ্রাব্য বলে- কলসের পানি ফেলে, বেশ কয়েকবার পানি দিয়ে কলসটিকে ধুয়ে পাক্-সাফ্ করে পূনরায় পানি ভরে কাঁখে তুলে চলে গেল।
মামাকে জিজ্ঞেস করলাম- মামা কলস ছুঁলাম বলে এমন করল কেন(?) এবং বকল কেন?!
মামা বলল- ওরা মনে করে মুসলমানরা হিন্দুদের কলস ছুঁলে তা অপবিত্র হয়ে যায়। মাটির কলস হলে তা এখনই ভেঙ্গে ফেলত। কাসার কলস বলে ভাংতে পারেনি!
মামার কথাটা আমার মাথায় ধরল না। ছুঁলে অপবিত্র হবে কেন?! গীতা মাসিরা মানুষ; আমরা মানুষ না?!
মামা বলল- ওদের আর আমাদের মাঝে ধর্মে অনেক ব্যাবধান। ওরা মূর্তি পূজা করে; কচ্ছপ খায়। আর আমরা নামাজ-রোজা করি এবং গরু খাই।
মনে মনে ভাবলাম- ওরা গরুর দুধ পান করে এবং গোবর দিয়ে ঘুঁটে তৈরী করে রান্নার কাজে জ্বালানিরূপে ব্যাবহার করে, মেজ-বেড়ায় প্রলেপ দেয়- অথচ; শুধু কচ্ছপ খায়, গরু খায়না! বিষয়টা আমার কাছে বিস্ময়কর মনে হল। তাও প্রশ্ন জাগল- আমরাইবা কচ্ছপ খাই না কেন?
ধর্ম স্যারকে বলতে শুনেছি- যার ধর্ম তার কাছে বড় এবং ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করা ঠিক না। স্যারের কথা গুলো স্মরণ করে, এসকল ভাবনা দিয়ে মনকে আর ঘাটাঘাটির সুযোগ দিলাম না। তাছাড়া ধর্মজ্ঞানে এতটা পরিপক্কও নই।
গীতা মাসির অশ্রাব্য বুলি জাউরা অর্থ বুঝতাম দুষ্টু। আর অনেক পরে জানলাম, জাউরা মানে- জারজ। শেখ বলতে বুঝতাম মুসলমান। পরে জানলাম শেখ হচ্ছে মুসলমান বংশের উপাধি।
আমি শেখ বংশের ছেলে নই। আমার আত্মীয়; দুরাত্মীয়; বন্ধু-বান্ধব; পরিচিত কাররই শেখ বংশ ছিলনা। একমাত্র আমার বাবার নেতার বংশ ছিল শেখ। মাওলানা ভাসানি; কবি নজরুল; কবি রবিন্দ্র নাথের মত তিনিও ছিলেন আমার প্রিয় মানুষ। তবে, গীতা মাসি কোন সূত্র ধরে আমাকে কলস ছোঁয়াতে (কুসংস্কারের দরুন) শেখের ঘরের শেখ বলে গালি দিলেন?! তাহলে, গীতা মাসিরা মুসলমান মানেই- শেখ বুঝেন? অথবা কোন কারণে কি শেখ শব্দের প্রতি বিরক্ত ছিলেন? গীতা মাসিরা কোন সাহেবের পক্ষে ছিলেন? মাসি কি জানেন না- ভাষার জন্যে, দেশের জন্যে হিন্দুদের ভূমিকা এবং রক্ত আছে বাংলার মান চিত্রে?!
২.
কলস ছুঁয়ে ছিলাম সকাল ১০টায়। বিকালে এসে গীতা মাসি নালিশ করে গেলেন। রাতে খাবারের পাটিতে বসে আব্বা আমাকে শাসালেন।
আব্বাকে অনেক ভয় পাই, তবুও সাহস করে বললাম- দুষ্টামি মন্দ কাজ এটা আমি মানি। কিন্তু কলস ছুঁলে অপবিত্র হবে কেন? আর আমাদের জন্য ওদের ঘরে ঢোকা নিষেধ কেন?
আব্বা বললেন এটা তাদের ধর্ম রীতি।
"আমি মানি না" আব্বার সামনে সাহস পাইনি বলতে। যদি বলতে পারতাম, উপঢৌকন হিসেবে একটা থাপ্পর পেতেও পারতাম অবশ্য। খাওয়া শেষ করে যখন আব্বা উঠে চলে গেলেন, মা'কে বললাম- ওরা যে আমাদের টিউবওয়েল থেকে পানি নেয়! আমাদের ঘরে আসে! যদি কাল থেকে টিউবওয়েলের পানি নিতে না দেই! আমাদের ঘরে প্রবেশ করতে না দেই!
মা বললেন- কৃষ্ণপুর এবং হরিনপুর দুই গ্রাম মিলে ১টিই আর্সেনিক মুক্ত টিউবওয়েল মাত্র। পানি সবাই নিবে, বাঁধা দিবি কেন? তোর বাবা একজন ডাক্তার এবং জনগনের প্রতিনিধি, তার কাছে সর্ব ধর্মের লোক আসবে এটাই স্বাভাবিক। এত কথার দরকার নাই, খাওয়া শেষ করে পড়তে যা!
খাওয়া শেষ করে, পড়তে না গিয়ে সোজা বিছানায় চলে আসলাম। সম্মান করার কারণে বড়দের অযৌক্তিক কথাকে ছাড় দেওয়ার অর্থ এই নয় যে; তাদের কথাকে মেনে নিয়েছি! বরং- ক্ষোভ নিয়ে অপেক্ষায় রইলাম পরিবর্তনের।
৩.
কয়েক বছর পর...
ক্ষেত্র কাকার বড় ভাই বিনয় কাকা পরিবার নিয়ে শহরে থাকতেন। ভাল বেহালা বাদক ছিলেন তিনি। তার কাজ ছিল বেহালা তৈরি করা। বৃদ্ধ হয়ে গেছেন। শেষ ইচ্ছে, জন্ম ভুমিতেই কায়া পালটাবেন। তাই স্বপরিবারে গ্রামে চলে আসলেন।
এই পরিবারের মেঝ ছেলে শংকর দা, অতি মিশুক; ভদ্র এবং সাহসী। এসেই হিন্দু-মুসলিম সবার সঙ্গে অনায়াসে মিশে গেলেন। শংকরদা- ফুটবল; ভলিবল খুব ভাল খেলতে পারতেন। জুডু-কারাতেও ভাল জানতেন। যার কারণে সর্ব ধর্মের যুবকদের দৃষ্টি কাড়তে সক্ষম হলেন দ্রুত। শংকরদা'র জন্য হিন্দু যুবকরাও মিশতে শুরু করল মুসলমানদের সঙ্গে। খেলা; সকল সামাজিক ভাল কর্ম কাণ্ডে মুসলমানদের সঙ্গে একতায় সুন্দর একটা পরিবেশ সৃষ্টিতে প্রশংসনীয় ভূমিকা রাখলেন।
শংকরদা কারাতে শিখাতেন যুবকদের। হিন্দু-মুসলিম যুবকরা মিলে একটা সংগঠনও করলেন। কলস ছোঁয়ার অপবিত্রতার কুসংস্কার আর অন্য ধর্মের লোকদের তাদের ঘরে প্রবেশ করার ফলে লক্ষ্মী দেবী পালানোর হাস্যকর বিষয়টা হিন্দু সমাজ থেকে মুছে যেতে থাকল। সংগঠনের যুবকদের মাধ্যমে, মুসলমান সমাজ এবং হিন্দু সমাজে যৌতুক দেয়া-নেয়ার বিরুদ্ধে পোস্টার ছাপিয়ে সবাইকে সচেতন করার চেষ্টা করলেন। শহর থেকে আসা শংকরদা'কে নিয়ে এলাকার চায়ের দোকানে বেশ আলোচনা।
কথায় বলে- ভাল কাজে বাঁধা বেশি। শংকরদা'র প্রতি বাঁধা হয়ে দাঁড়ালো হিন্দু সমাজ। বিশেষ করে প্রভাবশালী হিন্দুরা। মন্দ লোক গুলো ভাবছে, শহর থেকে এসেই নেতা হয়ে যাচ্ছে! কয়দিন পর সমাজ আমাদের গণ্য করবেনা। সুতরাং, যত দ্রুত সম্ভব গ্রাম ছাড়া করা দরকার। তলে তলে কিছু মুসলামানও আঁতাত করল শংকরদা'র বিরোধীদের(যারা শংকরদা'র জন্য শোষণ করতে পারতে ছিলনা হিন্দুদের) সঙ্গে। শংকরদা'কে সরাসরি কিছু বলতে না পারলেও তার বাবাকে ডেকে বলে দিলেন- তুমি পরিবার নিয়ে শহরে থেকেছ। এটা গ্রাম, শহর না। আমাদের হিন্দু সমাজে রীতি-নীতি আছে। তোমার ছেলে যেভাবে মুসলমানদের সঙ্গে মিশে ওদের বাড়ি ঘরে আনা শুরু করছে, কয়দিন পর হিন্দু পাড়া হয়ে যাবে- শেখ পাড়া! শংকর সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে, ওরে থামাও!
স্বয়ং বিনয় কাকার ভাই ক্ষেত্র কাকাই ব্যাঙ্গ করে বলল- কে জানে, শেখদের সাথে মিলে আপনার ছেলে গরু কোরবানি দেয়া শুরু করে নাকি আবার!
হাজার হোক মায়ের পেটের ভাই। 'জাত খায় জাতের মাংশ!' ভাই হয়ে ভাইকে সমাজের লোকদের কাছে এভাবে হেয় করার কষ্ট সহ্য করতে না পেরে, কেঁদে ফেললেন বিনয় কাকা! বিনয় কাকা পরিবার নিয়ে গ্রামে আসুক ক্ষেত্র কাকা চায়নি। না চাওয়ার কারণ হল- ক্ষেত্র কাকার দখলকৃত বড় ভাইয়ের জায়গাটি ছেড়ে দিতে হবে, সে ভোগ করতে পারবেনা। ক্ষেত্র কাকা আমার বাবার ভক্ত ছিল। সে আব্বার প্রভাব খাটিয়ে বিনয় কাকাকে দখলকৃত জায়গা ছাড়বেনা চেষ্টা করছিল। আব্বা সাফ জানিয়ে দিলেন- বিনয় তোমার মায়ের পেটের ভাই, সেও অর্ধেক অংশ পাবে। শেষ পর্যন্ত ভোগ দখলকৃত জায়গাটি তাকে ছাড়তেই হল। কিন্তু ভাইয়ের প্রতি ক্ষোভ রয়ে গেল। সে ঘায়েল করার সুযোগ ফন্দি আঁটতে লাগল!
বিনয় কাকা লেখা-পড়া করা মানুষ। সকল সন্তানকে আদর-শাসনে মানুষ করেছেন তিনি। কোন সন্তানের জন্যে, নালিশ শুনতে হয়নি তাকে। তিনি হিন্দু সমাজের লোকদের বলে দিলেন- আমরা যদি প্রয়োজনে মুসলমানদের সঙ্গে মিশতে পারি, মুসলমান আমাদের বাড়িতে বা ঘরে আসা কি অন্যায়? আমার ছেলে যদি অন্যায় করে, আমি অবশ্যই তার শাসন বিচার করব এবং সীমায় থাকতে বলব। তবে, আমার কাছ থেকে অন্যায় কিছুকে মেনে নেয়ার মত শিক্ষা পায়নি কোন সন্তান! আমিও হিন্দু। সুতরাং, ধর্ম রীতি-নীতি আমাকেও মানতে হবে।
শংকর'দা কুসংস্কারের বিষদাঁত ভাঙ্গার আপ্রান চেষ্টা করেছেন। কিন্তু সময় পাননি। বিনয় কাকা.. সমাজ এবং আপন ভাইয়ের শত্রুতার দরুন, মনে কষ্ট পেয়ে সন্তান নিয়ে পূনরায় শহরে চলে গেলেন। জন্মভূমিতে দেহ ত্যাগ করার চরম আকাঙ্ক্ষা ছিল তার। তা আর হল না। বুকে কষ্ট নিয়ে; অভিমানে জন্মভূমি ছেড়ে চলে গেলেন।
শুনেছি, বিনয় কাকা ভ্রহ্মে নেই।
সকল স্থানে; সমাজে; সর্ব ধর্মে- কুসংস্কারের পতন ঘটিয়ে, সবাই আজ এক থালায় ভাত খায়। অথচ; বিনয় কাকা আর শংকরদা'র আসল মূল্যায়ন হলনা এই ভঙ্গুর সমাজে!
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে অক্টোবর, ২০১৩ বিকাল ৫:২০