“ক্রুসেড বীর”
লেখাঃ শাকিল মাহমুদ সুমন
ক্রুসেড শব্দের আভিধানিক অর্থ হলো জিহাদ বা ধর্মযুদ্ধ। ধারণা করা হয় ক্রুসেড শুরু হয়েছিলো ১০৯৬ খ্রিস্টাব্দে এবং এর সমাপ্তি ঘটে ১২৯২ খ্রিস্টাব্দের দিকে। সুদীর্ঘ ২'শ বছর ব্যাপি এ যুদ্ধ চলেছিলো যা ক্রুসেড নামে পরিচিত।
ক্রুসেড মধ্যযুগীয় ইউরোপ ও এশিয়ার ইতিহাসে একটি আলোড়ন সৃষ্টিকারী ঘটনা। ইউরোপীয় খ্রিস্টানদের মতে তাঁদের ধর্মীয় নেতা পোপের নির্দেশে বুকে ক্রুশ(✝) চিহ্ন নিয়ে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলো এবং ক্রুশকে যুদ্ধের পতাকা হিসেবে ব্যবহার করেছিলো বলেও এ যুদ্ধ ইতিহাসে ক্রুসেড নামে পরিচিত।
তবে মুসলমান গবেষকগন এবং অধিকাংশ ইউরোপীয় ঐতিহাসিক লেকখগনের মতে মুসলিম জাতির সঙ্গে খ্রিস্টানদের প্রতিটি সংঘর্ষ ক্রুসেড নামে পরিচিত।
পূর্বে ধারণা করা হতো ক্রুসেডাররা যে যুদ্ধে যেত তা ছিলো পবিত্র যুদ্ধ, কিন্তু সে ধারণা সঠিক নয়। হাজার হাজার বছর ধরে ক্রুসেডাররা ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের উপর নির্মম নির্যাতন চালিয়েছিলো, সন্ত্রাস চালিয়েছিলো। অথচ তারপরেও ক্রুসেডরা মুসলিম জাতিকে সন্ত্রাস বলছে। ইউরোপীয়ান এবং আমেরিকানরা এখনো ক্রুসেডকে পবিত্র যুদ্ধ বলে অভিহিত করে এবং মুসলমানদের সন্ত্রাসী বলে।
এভাবে হাজার হাজার বছর ধরে ক্রুসেড অর্থাৎ খ্রিস্টান জাতি মুসলমানদের উপর নিষ্টুর নির্যাতন চালিয়েছিলো। তারপর পৃথিবীর বুকে ইরাক প্রদেশের তাকরিৎ নামক স্থানে ১০৩৭ খ্রিস্টাব্দে জন্মলাভ করেন ইতিহাসের ক্রুসেড বিজয়ী মহাবীর সুলতান সালাহ্উদ্দিন ইবনে আইয়ূব।
প্রিয় পাঠকগন এখন আমরা দেখবো কিভাবে এই ক্রুসেড বিজয়ী মহাবীর ক্রুসেডকে পরাজিত করে ধর্মপ্রান মুসলমানদেরকে রক্ষা করেছেন নানা নির্যাতন নিপীড়নের হাত থেকে।
ক্রুসেড থেমে নেই। ১১৬৯ সালে মিশরের ফাতেমিয়া বংশীয় শেষ খলিফা আল আজিজের বিদ্রোহী সেনাপতি দিরগামকে দমন করতে অসমর্থন হলে প্রধানমন্ত্রী সাবের আল সা'দী আলেপ্পার রাজ নুরুদ্দিনের সেনাপতি 'শেকরুহ' মিশরে উপস্থিত হন এবং বিলবেজ নামক স্থানে বিদ্রোহী সেনাপতি দিরগামকে নিহত করেন। এর অল্প কিছুদিনের মধ্যে 'শেকরুহর' মৃত্যু হয় এবং সালাহ্উদ্দিন আইয়ূব মিশরের মন্ত্রিত্ব লাভ করেন। এরই মধ্যে আল আজিদ দিনিল্লা নামক একজনের মৃত্যু হয় ১১৭১ সালে। প্রধানমন্ত্রী মৃত খলিফার পরিবারবর্গকে প্রচুর বৃত্তি প্রদান করে স্বয়ং সিংহাসনে আরোহন করেন, ইনিই সুলতান সালাহ্উদ্দিন। এরপর থেকে যা যা ঘটতে থাকে তাকে ক্রুসেড ড্রামার ইন্টারভাল বলা চলে।
১১৭১ সালে সালাহ্উদ্দিন সুলতান হবার পর কতিপয় মিশরীয় নেতার আহ্বানে সিসিলির নর্মান রাজ দ্বিতীয় উইলিয়াম ছয়'শ যুদ্ধ জাহাজ ও ত্রিশ হাজার সৈন্যসহ মিশরের আলেক্সান্ড্রিয়া বন্দর আক্রমণ করে। সালাহ্উদ্দিন অবিলম্বে বিদ্রোহী নায়কগনকে ধৃত ও হত্যা করেন এবং সিসিলি রাজ্যের সম্মুখীন হন। যুদ্ধে পরাজিত হয়ে উইলিয়াম স্বরাজ্যে প্রত্যাবর্তন করে। এর কয়েক বছর পর প্রায় ১১৭৬ সালে সিরিয়ার বালক সুলতান মালেকু শাহ্ ইসমাইল মন্ত্রী গুমস্তাপীবের পরামর্শে দামেশক থেকে আলেপ্পায় রাজধানীতে গমন করেন। ক্রুসেডীয় খ্রিস্টানরা এই সুযোগ হাতছাড়া না করে দামেশক নগর অবরোধ করে। এ খবর সুলতান সালাহ্উদ্দিন জানতে পারেন এবং সাথে সাথে সাত'শ সৈন্য নিয়ে দামেশক পৌঁছান। তখন খ্রিস্টীয় ক্রুসেডাররা সুলতানের সাথে মুখোমুখি না হয়ে অবরোধ প্রত্যাহার করে।
একটি কথা, সকল ধর্মেই এমন কিছু কুলাঙ্গার থাকে যারা নিজের ধর্মে বিশ্বাসী না এমনকি অন্য ধর্মেরও অনুসারী না কিন্তু এরা সকল ধর্মে বিবাদ সৃষ্টি করে। তেমনই একজন হলো সিরিয়ার মন্ত্রী, তিনি যখন দেখলেন তার উদ্দ্যেশ্য চিরতার্থ হচ্ছে না তখন তিনি মৌসল অধিপতি সায়েফউদ্দিন জঙ্গীর ভাতিজা মালেকু সালেহের পরামর্শে দামেশক আক্রমণ চালায় এবং সুলতান সালাহ্উদ্দিনের সাথে যুদ্ধ শুরু হয়। যুদ্ধে আল্লাহ্র অশেষ মেহেরবানীতে সুলতান সালাহ্উদ্দিন জয়লাভ করেন। তারপর তিনি সিরিয়ার তখতে ভাই তুরান শাহকে ক্ষমতা প্রদান করে মিশরে ফিরে যান। এভাবে সুলতান সালাহ্উদ্দিন পৃথিবীর বহু দেশ ভ্রমণ করতেন এবং ক্রুসেড হতে মুসলমানদের রক্ষার্থে ঝাপিয়ে পড়তেন।
প্রতি শতাব্দীতে অন্তত একজন করে বীর দেখার সৌভাগ্য হয় পৃথিবীর মানুষদের। তার মধ্যে একজন হলো সুলতান সালাহ্উদ্দিন। এরপরে ১১৭৭ সালে সুলতান সালাহ্উদ্দিন প্যালেস্টাইন অর্থ্যাৎ ফিলিস্তিনের মার্জিয়ান নামক এর সাথে ক্রুসেডার খ্রিস্টীয়গনদের যুদ্ধে পরাজিত করে জয়লাভ করেন। ২রা অক্টোবর ১১৮০ সালে সুলতান সালাহ্উদ্দিনের আহ্বানে সানজা নদীর তীরে পশ্চিম এশিয়ার মুসলিম রাজন্যবর্গের এক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। বিভিন্ন স্থানের ইকনিয়াম, মৌসল, জার্জিয়া,আর্শেনি,আরবাল, কায়দা মার্দিন প্রভৃতি সকলের সাথে প্রতিশ্রুতি হয় যে দুই বছর পর্যন্ত পরষ্পর বিবাদ হতে নিবৃত্ত থাকার।
১১৮১ সালে আলেপ্পো রাজ মালেক সালেহ ইসমাঈলের মৃত্যু হলে তার পিতৃব্য পুত্র মৌসলপতি আয়েজউদ্দিন মসউদ আলেপ্পো রাজ্যলাভ করে এবং সে সুলতান সালাহ্উদ্দিনের বিরুদ্ববাদী হয়। ১১৮২ সালে সুলতান সালাহ্উদ্দিন মিশর, সিরিয়া,আরব, ও নিউবিয়ার স্বাধীন সুলতান বলে ঘোষিত হন। তারপর ফিলিস্তিনের ক্রুসেডারগন পূর্ব সন্ধি লঙ্ঘন করায় সালাহ্উদ্দিন মিশরে উপস্থিত হন এবং যুদ্ধ শুরু করেন। যুদ্ধে তার ভাইয়ের ছেলে ফররুখ শাহ্ সাহায্যে এগিয়ে আসেন, দুজনের সম্মিলিত যুদ্ধে জয় আসে মুসলমানদের অনুকূলে।
ক্রুসেডার খ্রিষ্টীয় সেনাপতি রেজিনাল্ড আইলা বন্দর অবরোধ করে এবং আরব বনিকদের বারোটি জাহাজ লুটপাট করে আগুন জ্বালিয়ে দেয় ও বনিকদের সেখানে হত্যা করে। অতঃপর রেজিনাল্ড মদিনার দিকে ছূটে বিশ্বনবী হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) এর সমাধি উৎখাত করার জন্য। এ খবর সুলতান সালাহ্উদ্দিনের নৌ সেনাপতি শুনতে পান এবং লোহিত সাগরের তীরবর্তী স্থানে ক্রুসেডারদের গতিরোধ করেন। সেখানে যুদ্ধ সংগঠিত হলে রেজিনাল্ড পরাজিত হয়ে ফিলিস্তিনে পালিয়ে যায়। সুলতান সালাহ্উদ্দিন প্রতিজ্ঞা করেন নিজ হাতে রেজিনাল্ডকে হত্যা করার।
তারপর ইতিহাসে আরেকটি যুদ্ধ সংগঠিত হয় যা ‘হিত্তিন যুদ্ধ’ নামে পরিচিত। সেখানে ত্রিশ হাজার ক্রুসেডীয় নিহত হয় মুসলমানদের শক্তিতে এবং জয় আবারও চলে আসে মুসলমানদের পক্ষে। সুলতান সালাহ্উদ্দিনের প্রতিজ্ঞা অনুসারে তিনি রেজিনাল্ডকে বন্দি করেন এবং নিজ হাতে তাকে হত্যা করেন। এভাবে ক্রুসেডারদের পরাজয় দেখে জেরুজালেমের নগরবাসী সুলতান সালাহ্উদ্দিন এর নিকট আত্মসমর্পণ করে ২রা অক্টোবর ১১৮৭ সালে।
ক্রুসেডারদের শোচনীয় অবস্থা এবং পবিত্র ভূমি জেরুজালেমের পতন ইংল্যান্ডের রাজা এবং ফ্রান্সের রাজা মেনে নিতে পারেনি। দুই দেশের রাজার মধ্যে পূর্বেই শত্রুতা ছিলো, তাদের মধ্যকার সেই শত্রুতা সমাপ্ত করে দুজন যোগ দেয় ক্রুসেডে। তারপর শুরু হয় ভয়াবহ ৩য় ক্রুসেড। ক্রুসেডাররা পবিত্র ভূমি জেরুজালেম আক্রমণ করার জন্য বিশাল সৈন্য নিয়ে আনাতোলিয়া হয়ে যাত্রা শুরু করে। কিন্তু ক্রুসেডাররা পবিত্র ভূমি জেরুজালেমে পৌছানোর পূর্বেই ১১৯০ সালের ১০ জুন এশিয়া মাইনরের কাছে একটি সাগরে বর্ষীয়ান জার্মান সম্রাট ফ্রেডেরিক বারবারোসা সলিল সমাধি হয়। তার মৃত্যুতে জার্মান ক্রুসেডাররা কষ্ট পেয়ে ভয়ে অধিকাংশ সৈন্যদল দেশে ফিরে যায়।
১১৯১ সালে আক্কা নগরবাসী নিরুপায় হয়ে আত্মসমর্পণ করে সুলতান সালাহ্উদ্দিনের কাছে। সিংহ হৃদয় রিচার্ড নিজ প্রতিজ্ঞা রক্ষা না করে নগরের সাতাশ হাজার ইহুদি ও মুসলমান নাগরিকদের হত্যা করে খ্রিষ্টীয় ধর্ম প্রদর্শন করে। আক্কা অবরোধের সময় দুবছরে খন্ডখন্ড যুদ্ধে প্রায় এক লক্ষাধিক খ্রিস্টান সৈন্য নিহত হয়। ধর্মের জন্য এমন আগুন আর কোথাও জ্বলে উঠে নি। ১১৯২ সালের জুন মাসে সুলতান সালাহ্উদ্দিন এবং ইংল্যান্ডের প্রথম রাজা রিচার্ড রামলা নামক চুক্তি সাক্ষর করেন। চুক্তির শর্ত মোতাবেক জেরুজালেম মুসলমানদের নিয়ন্ত্রণে ছেড়ে দেওয়া হবে এবং খ্রিষ্টীয় তীর্থযাত্রীদের জন্য উন্মুক্ত করা হবে। এই চুক্তি ল্যাটিন রাজ্যকে টায়ার থেকে জাফা পর্যন্ত সীমাবদ্ধ করে দেয়।
১১৯৩ সালের ৪ঠা মার্চ সালাহ্উদ্দিন দামেস্কে অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং সেদিনই এই পৃথিবী ত্যাগ করেন ইতিহাসের এই মহাবীর। মৃত্যুর সময় তার ব্যক্তিগত সম্পদের এক টুকরা স্বর্ণ ও চল্লিশ টুকরা রূপা ছিলো যা তিনি অধিকাংশই গরীব প্রজাদের দান করেন। দামেস্কের উমাইয়া মসজিদের বাহিরে তাকে দাফন করা হয়।
সালাহ্উদ্দিন ছিলেন এমনই একজন বীর যাকে এখনো পৃথিবীর মানুষ স্মরণ করেন। তার নামে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে তৈরি হয়েছে নানা সংস্থা, বিশ্ববিদ্যালয়। ইতিহাসের কালো অক্ষরে লিখা আছে সুলতান সালাহ্উদ্দিন ইবনে আইয়ূবের জীবনী।
ইসলাম রক্ষার্থে এই মানুষটির ভূমিকা ছিলো অটুট। যিনি জীবনে কখনো পরাজয়কে মেনে নেন নি, মুসলমানদের বিপদে যিনি কখনো পিছপা হন নি, যিনি মুখোমুখি লড়াই করেছেন নাস্তিক, ক্রুসেডারদের বিরুদ্ধে তিনিই হলেই সুলতান সালাহ্উদ্দিন ইবনে আইয়ূব। মূলত ক্রুসেড যারা গঠন করেছিলো তারা খ্রিস্টান ধর্মের অনুসারী কিন্তু তাদের ছিলো এই ব্যপারে সম্পূর্ণ ভুল ধারনা এবং এখনো আছে।
খ্রিষ্টানদের ধর্মগ্রন্থের নাম বাইবেল যা নাজিল হয়েছিলো যিশুর উপর আর এর যিশুই মুসলমানদের নবী হযরত ঈসা (আঃ)। ইসলাম ধর্মের কার্যপ্রণালী এবং খ্রিস্টান ধর্মের কার্যপ্রণালীর মধ্যে খুব বেশি পার্থক্য নেই। যিশু তাদের সেই শিক্ষা কখনো দেন নি যে শিক্ষায় খ্রিষ্টানরা মুসলমানদের উপর হামলা চালাবে। কিন্তু তৎকালীন খ্রিস্টানরা নিজেদের আধিপত্য বিস্তার শুরু করতে থাকে ফলে তাদের ভিতর চলে আসে অংকারবোধ ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের উপর এবং তারা নানাভাবে প্রতিনিয়ত নির্যাতন চালাতে থাকে মুসলমানদের উপর।
ধীরে ধীরে নির্যাতনের মাত্রা বাড়তে থাকলো এবং খ্রিষ্টানদের মধ্যে ক্রুসেড নামক সংগঠন তৈরি হতে থাকলো, সেখান থেকেই আসে ক্রুসেড। সেই মূহুর্তে ক্রুসেডের দানব হিসেবে পৃথিবীতে আবির্ভাব হয় সুলতান সালাহ্উদ্দিন ইবনে আইয়ূবীর এবং শেষ পর্যন্ত ক্রুসেডের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন নির্ভয়ে।
তথ্যসূত্রঃ ইন্টারনেট, ইউটিউব, ক্রুসেড সিরিজের বইসমূহ।
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০১৮ রাত ৯:৩১