somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানীদের আত্মসমর্পণের ২৯ বছর পরেও যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া এক সৈন্যের গল্প

০৮ ই জুলাই, ২০২৪ দুপুর ১২:০৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


''এমনকি যদি শত্রুর হাতে ধরা পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে, তবুও আত্মহত্যা করতে পারবে না তুমি। সে তিন বছর লাগুক কি পাঁচ বছর, যা-ই ঘটুক না কেন, আমরা তোমার জন্যে ফিরে আসবোই। সেই পর্যন্ত, যতক্ষণ তোমার সাথে একজন হলেও সৈনিক আছে, তুমি তাকে নেতৃত্ব দিয়ে যাবে। তোমাকে হয়তো শুধু নারকেল খেয়ে বেঁচে থাকতে হতে পারে, যদি তা-ই, হয়, তোমাকে সেটা খেয়েই বেঁচে থাকতে হবে। কোন পরিস্থিতিতেই তুমি নিজের প্রাণ স্বেচ্ছায় বিসর্জন দিতে পারবে না।''

এটাই ছিলো হিরু ওনোদা'র কমান্ডিং অফিসারের নির্দেশ। আর এই নির্দেশ পালন করতে গিয়েই, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানী সৈন্যবাহিনীর আত্মসমর্পণের ২৯ বছর পরেও তিনি যুদ্ধ করে গিয়েছেন ফিলিপাইনের লুবাং দ্বীপের গভীর অরণ্যে।

যখন ওনোদার ২০ বছর বয়স, হঠাৎ একদিন সেনাবাহিনীতে যোগদানের নির্দেশ আসে তার উপর। সে সময় তিনি একটি জাপানী ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে চাকরী করছিলেন। নির্দেশ পেয়েই তিনি চাকরী ছেড়ে দিলেন, এরপর যোগ দিলেন সামরিক প্রশিক্ষণে। প্রশিক্ষণের সময় তার এক বিশেষ দক্ষতা চোখে পড়ে উপরমহলের, সেনাবাহিনী'র ইনফেন্ট্রি বিভাগ থেকে বদলি করে তাকে গোয়েন্দা বিভাগে পাঠানো হয়।

সেইখানেই তাকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় কিভাবে শত্রুর চোখকে ফাঁকি দিয়ে খবর সংগ্রহ করতে হয়। সেই সাথে প্রশিক্ষণ চলে গেরিলা যুদ্ধবিদ্যার। এর সাথে সাথে তিনি পারদর্শী হয়ে উঠেন কিভাবে শত্রুবাহিনী'র পিছনে গিয়ে ছোট্ট একদল সৈন্যেদলের সাহায্যে শত্রুসেনাদের বিপর্যস্ত করে দিতে হয়।

যথাযথ প্রশিক্ষণ শেষে জাপানী রাজকীয় সামরিক বাহিনীর গোয়েন্দা বিভাগের একজন কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ পান ওনোদা। ১৯৪৪ সালের ২৬ ডিসেম্বর, বিশেষ সেই দায়িত্ব দিয়ে তাকে পাঠানো হয় ফিলিপাইনের ঐ দ্বীপে।

ওনোদা দ্বীপে গিয়েই জাপানী সৈন্যদলের সাথে যোগাযোগ করে কাজ শুরু করে দেন। কিন্তু, বিধি বাম। তিনি দ্বীপে নামার কিছু দিন পরেই, মিত্রবাহিনী'র সৈন্যরা সেখানে আক্রমণ করে। পরাজয় মেনে নিয়ে বেশির ভাগ জাপানী সৈন্য আত্মসমর্পণ করে বসে। বাকিদের কিছু মারা পড়ে, আর কিছু ৩-৪ জনের ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে গভীর অরণ্যে লুকিয়ে পড়ে।

এমনই এক দলের নেতৃত্ব দিয়ে গেরিলা যুদ্ধ শুরু করেন ওনোদা। এই ছোট ছোট দলগুলো'র বেশির ভাগই শত্রুবাহিনীর হাতে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। কিন্তু, ওনোদা আর তাঁর দলের তিনজনকে ধরতে ব্যর্থ হয় মিত্রবাহিনী। এই চারজনের দলটি শত্রুর ঘুম হারাম করে দিয়ে গেরিলা যুদ্ধ চালিয়ে যেতে থাকেন।

১৯৪৫ সালের অক্টোবার মাস, ঐ দ্বীপের একটি ফার্মে খাদ্য সংগ্রহের জন্যে অভিযান চালাতে গিয়ে একটি লিফলেট হাতে পায়। তাতে লেখা- ''যুদ্ধ শেষ হয়ে গিয়েছে অগাস্টের ১৫ তারিখে। তোমরা পর্বত থেকে নেমে আসো।''

দলটি বনে ফিরে গিয়ে অন্যান্য দলের সাথে এ নিয়ে আলোচনা করে এই সিদ্ধান্তে পৌছালো যে, এটা নির্ঘাৎ শত্রুদের পাতা ফাঁদ। জাপান এতো তাড়াতাড়ি যুদ্ধে হেরে গিয়েছে বলে তাদের বিশ্বাস হলো না। আসলে তাঁদের জানার কথা নয় যে, হিরোশিমা আর নাগাসাকিতে আনবিক বোমা ফেলা হয়েছে। এছাড়াও, মাত্র কয়েক দিন আগেই তাদের একটি দলের উপর গুলিবর্ষণ করা হয়েছিলো।

সেই বছরের শেষের দিকে, গেরিলা বাহিনী'র অনবরত আক্রমনে অতিষ্ঠ হয়ে উঠায় স্থানীয় অধিবাসীদের অনুরোধে একটি বি-১৭ বিমানে করে পুরো জঙ্গলে আবারো আত্মসমর্পণের নির্দেশ দিয়ে লিফলেট ফেলা হয়। এবারে ঐ লিফলেটে স্বাক্ষর করেন জাপানী রাজকীয় সেনাবাহিনীর জেনারেল ইয়ামাশিটা। কিন্তু, এবারেও গেরিলা দলগুলো আত্মসমরপনে অস্বীকৃতি জানায়। কারণ, লিফলেটের ভাষানুযায়ী জাপানের পরাজয় সংবাদ তাদের কাছে গ্রহণযোগ্য ছিলো না। তাই তাদের মনে হলো, এটা শত্রুবাহিনী আরেকটি চাল।

তাদেরকে আত্মসমর্পণের চেষ্টা এবারেও ব্যর্থ হলে, জাপানের সংবাদপত্র, গেরিলা সৈন্যদলের পরিবারের ছবি ও চিঠি জঙ্গলে আবারো ফেলা হলো। উদ্দেশ্য তারা যেন জানতে পারে যে জাপান সত্যিই যুদ্ধে হেরে গিয়েছে। কিন্তু, প্রতিটি বারেই গেরিলা দল লিফলেটগুলোতে কিছু না কিছু খুঁত বের করে ধরে নিলো এগুলোও শত্রু বাহিনী তাদের ধরার জন্যে করেছে।

এমনকি যুদ্ধের অনেক বছর পরও যখন স্থানীয় কোন মানুষ জঙ্গলগুলোর কাছে আসতো, তখনো গেরিলা দল মনে করতো এটা সেই
দ্বীপের মানুষদের ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে তাদেরকে ধরতে আসার কোন চাল। তাই, তারা এই মানুষদের উপরও গুলি ছুড়তো।

এভাবেই একদিন, পাঁচ বছর পর, ওনোদার ছোট্ট গেরিলা দলের একজন আত্মসমর্পণ করলে ওনাদা আরো সাবধান হয়ে যান। তারা বনের আরো গহীনে নিজেদের লুকিয়ে ফেলেন।

তারও পাঁচ বছর পরে, ওনাদার আরেক সঙ্গী স্থানীয় লোকজনের হাতে ধরা পড়ে মারা যান। এবারে, বাকি থাকলো মাত্র দুইজন- ওনাদা নিজে এবং কজুকা।

এরপর, ১৭ বছর ধরে এই দু'জন জঙ্গলের থেকে 'শত্রুবাহিনী'-র যথাসম্ভব ক্ষতিসাধন করে যেতে লাগলেন। সেই সাথে চললো গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ। তাদের উদ্দেশ্য ছিলো যদিবা কখনো জাপানী সৈন্যদল ঐ দ্বীপে আসে, তাদেরকে গেরিলা যুদ্ধে দক্ষ করে তোলা। যেহেতু, ওনোদার কমান্ডিং অফিসার কথা দিয়েছিলেন, যে করেই হোক তারা ফিরে আসবেন তাদের জন্যে, গেরিলা দল তাই যুদ্ধ চালিয়ে যায় মাটি কামড়ে।

অক্টোবর, ১৯৭২ সাল। ২৭ বছর লুকিয়ে থাকার পর, কজুকা ফিলিপিনের এক পেট্রোল দলের সাথে লড়াই-এ নিহত হোন। কজুকার মৃতদেহ পেয়ে এবারে জাপান সরকারের টনক নড়ে। তাদের মনে পড়ে যায় ওনোদার কথা। হয়তো তিনি এখনো বেঁচে আছেন! যদিও, অনেক আগেই তাঁকে মৃত ঘোষনা করা হয়েছিলো। তাঁকে খোঁজার জন্যে একটি তল্লাসী দল পাঠানো হয় ঐ দ্বীপে। উদ্দেশ্য, যদিবা তাঁকে পাওয়া যায়। কিন্তু, ওনোদা ধরা দিলেন না। যুদ্ধ চালিয়ে গেলেন এরপরও।

শেষ পর্যন্ত, নারিও সুজুকি নামের এক কলেজ ছাত্র, সিদ্ধান্ত নিলো সে নিজে একবার চেষ্টা করে দেখবে। ওনোদা'র খোঁজে সে বনে একা ঘুরতে লাগলো। এক পর্যায়ে, সে ওনোদা যে জায়গায় ঘাঁটি গেড়েছিলেন, তা বের করে ফেললো। সেই সাথে দেখা পেলো ওনোদারও। সুজুকি তাঁকে বুঝানোর চেষ্টা করলো, অনুরোধ করলো আত্মসমর্পণের। কিন্তু, ওনোদা এবারেও অস্বীকৃতি জানালেন।

ব্যর্থ হয়ে সুজুকি ফিরে গেলো জাপানে। গিয়ে জানালো ওনাদার সাথে সাক্ষাতের কথা। মেজর তানিগুচি, ওনোদার কমান্ডিং অফিসার তখন চাকরী থেকে অবসর নিয়ে একটি বইয়ের দোকানে কাজ করছেন। সব শুনে তিনি নিজে গেলেন সেই দ্বীপে ওনোদার সাথে সাক্ষাৎ করতে। গিয়ে নির্দেশ দিলেন আত্মসমর্পণের।



১৯৭৫ সালের মার্চের ১০ তারিখ। ওনোদার তখন ৫২ বছর বয়স। পুরো ইউনিফর্ম পড়া অবস্থায় জঙ্গল থেকে বেরিয়ে এলেন তিনি। ফিলিপাইনের প্রেসিডেন্ট ফারদিনান্ড মার্কোসের নিকট নিজের সামুরাই তলোয়ার জমা দিয়ে আত্মসমর্পণ করলেন। ফিলিপাইনের প্রেসিডেন্ট তাঁকে ক্ষমা করে দিয়ে জাপানে পাঠিয়ে দেন।



জাপান তাঁকে বীরের বেশে বরণ করে। কিন্তু, এ কোন জাপান! ওনোদা যে জাপানকে চিনতেন এতো সে জাপান নয়! সব কিছু বদলে গিয়েছে পশ্চিমা সংস্কৃতির প্রভাবে। বেশিদিন থাকতে পারলেন তাই। পাড়ি জমালেন ব্রাজিলে। সেখানেই, তিনি বিয়ে করলেন। ব্রাজিলে বসেই লেখে ফেলেন তাঁর আত্মজীবনী No Surrender, My Thirty-Year War



১৯৮০ সালের দিকে, যখন এক জাপানী তরুণের হাতে পিতা-মাতার মৃত্যু সংবাদ শুনলেন, ওনোদা বুঝলেন জাপানের অবস্থা ভালো নয়। তরুণ সমাজ বিপথে চলে যাচ্ছে। শেষ পর্যন্ত, ১৯৮৪ সালে তিনি দেশে ফিরে আসেন। শুরু করেন, কিভাবে কঠিন পরিস্থিতেও বেঁচে থাকতে হয়, তার উপর একটি প্রশিক্ষণ স্কুল। সেখানেই জাপানের তরুণ প্রজন্মকে শিক্ষা দিতে থাকেন তাঁর অভিজ্ঞতার ঝুলি খালি করে।



১৬ জানুয়ারী, ২০১৪ সালে ৯২ বছর বয়সে মারা যান এ মহান সৈনিক।



======
রিপোস্ট
======
১ম প্রকাশঃ ০২ রা জুন, ২০১৭ রাত ১:০৮
======================
কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ ওয়াশিংটন পোস্ট
======================
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই জুলাই, ২০২৪ দুপুর ১২:৫৩
১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

পাগলের প্রলাপ' যখন সত্যি হয়......

লিখেছেন জুল ভার্ন, ০৭ ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ সকাল ১০:১৯

'পাগলের প্রলাপ' যখন সত্যি হয়......
[/সব

আমার এক মামা ততকালীন পূর্ব পাকিস্তানে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে জব করতেন হোটেলের শুরু থেকেই। সেই মামা মাঝেমধ্যে আমাদের জন্য হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল থেকে মুখরোচক কেক, পেস্ট্রি ছাড়াও বিভিন্ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

তার চাওয়া পাওয়ার কিছু ছিল না, তবুও

লিখেছেন খাঁজা বাবা, ০৭ ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১:৩২



শেখ হাসিনার নাকি বায়ক্তিগত চাওয়া পাওয়ার কিছু ছিল না। শেখ মুজিবের বেয়ে নাকি দুর্নীতি করতে পারে না। সে এবং তার পরিবার যে হাজার হাজার কোটি টাকার দুর্নীতি করতে পারে... ...বাকিটুকু পড়ুন

দেশের বর্তমান পরিস্থিতি সংক্রান্ত বিষয়ে সামু কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি

লিখেছেন সাড়ে চুয়াত্তর, ০৭ ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৩:৪৬

ছাত্র-জনতার সম্মিলিত অভ্যুত্থানের মাধ্যমে গত ৫ আগস্ট, ২০২৪ তারিখে ফ্যাসিস্ট হাসিনা এবং তার দলের পতন ঘটানো হয়। এটা আমাদের একটা জাতীয় গৌরবের দিন। এটা নিয়ে কারও সন্দেও থাকলে মন্তব্যে লিখতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

জ্বীনভুতে বিশ্বাসী বাংগালী ও ঢাকায় ৫০ হাজার ভারতীয় একাউন্টটেন্ট

লিখেছেন সোনাগাজী, ০৭ ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৪:৩৩




ব্লগার সাড়ে চুয়াত্তর ব্লগে লিখেছিলেন যে, উনার ভগ্নিপতিকে জ্বীনেরা তুলে নিয়ে গিয়েছিলো; ২ সপ্তাহ পরে ভগ্নিপতিকে দিয়ে গিয়েছে; এই লোক, সামুর কাছে আমার বিরুদ্ধে ও অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

বেছুর নিজস্ব একটি জ্বীন ছিলো!

লিখেছেন সোনাগাজী, ০৭ ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ রাত ৮:২৪



আমাদের গ্রামের খুবই সুশ্রী ১টি কিশোরী মেয়েকে জংগলের মাঝে একা পেয়ে, প্রতিবেশী একটা ছেলে জড়ায়ে ধরেছিলো; মেয়েটি ঘটনাকে সঠিকভাবে সামলায়ে, নিজের মাঝে রেখে দিয়েছিলো, এটি সেই কাহিনী।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×