সাংস্কৃতিক সংগঠন করার সুবাদে ক্যাম্পাসে যতজনের সাথে এ পর্যন্ত পরিচয় হয়েছে তার সবটা এতদিন সুখস্মৃতি ছিল। রাস্তায় দেখা হইলে কুশল বিনিময়, রেস্তোরাঁয় চা পানের জন্য বসা অথবা হাসিমুখে যে যার পথে চলে যাওয়া ইত্যাদি স্মৃতির বাইরে প্রথম বারের মতন বেদনা যোগ হইল।
যে ছেলেটিকে গতকাল বাস থেকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়ে খুন করা হইল তারে কৃষ্ণচূড়ার কোন এক কালচারাল প্রোগ্রামে কমেডি নাটকের ছোট একটি চরিত্রের জন্য অভিনয় দেখিয়ে দিয়েছিলাম। বিতর্ক, ক্রিকেট খেলা ইত্যাদির সাথে জড়িত থাকার জন্যে হয়তো অভিনয়েও সে দারুণ সাবলীল ছিল। সেই সাবলীল ছেলেটি কত সব জ্বলজ্বলে স্মৃতি রেখে হঠাৎ আড়াল হয়ে গেল।
তার বন্ধুবান্ধব আর সহপাঠী সহ ক্যাম্পাসের বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী আজকে চৌহাট্টাতে গিয়েছিল আন্দোলন করতে। তাদের সহপাঠী হত্যার বিচার চাইতে৷ এমনকি তার অনেক শিক্ষকও প্রিয় শিক্ষার্থী হত্যার প্রতিবাদে আন্দোলন করতে এসেছিল। আমি দেখেছি, প্রচন্ড হতাশা আর ক্ষোভে তাদের সবার চোখমুখ জ্বলজ্বল করছিল। এই হতাশা আর ক্ষোভের সাথে আরেকটি জিনিস লুকায়িত ছিল৷ তা হইল নিজের মৃত্যু ভয়। যেহেতু প্রতিদিন কাউকে না কাউকে বাসের চাকা পিষে মারছে তাই নিজেও হঠাৎ এইভাবে খুন হইবার ভয়ে সবাই ভীত ছিল।
এই ভয় আমাকেও পেয়ে বসেছে। যখন বাসে করে দূরে কোথাও যেতে চাই তখন ভয় হয় আর বুঝি প্রিয় পরিবারকে দেখতে পারবো না। অনিয়মের এই সড়ক পথে হঠাৎ এক্সিডেন্টে করে বুঝি মারা যাবো। এইসব ভেবে সারাক্ষণ ভীত থাকি। আর ভীত থাকি নিজের পরিবারকে নিয়ে। পরিবারের কেউ বাসে করে কোথাও গেলে এক চির পরিচিত অস্থিরতা এসে চেপে ধরে আমাকে। এক মুহুর্তের জন্য শান্ত থাকতে পারিনা। এমনি এক অশান্ত সময়ে ওয়াসিম মরে গেল। সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসটি গতকাল থেকে তার মৃত্যুশোকে ভারী হয়ে আছে। সবাই যে যার মত করে স্মৃতিচারণ করছে। শোক প্রকাশ করছে। দুঃখ প্রকাশ করছে। এই শোকের শেষ কোথায় তা কেউ জানে না। ওয়াসিমের মা বাবা তো তাদের একমাত্র সন্তানটিকে হারিয়ে ফেলেছে। এবার কোন মা বাবা শোকাহত হবে তার জন্য আমরা ভয়ে ভয়ে অপেক্ষা করি।
(কবিতা)
সড়ক নিরাপদ হবে কিনা
এই নিশ্চয়তাটি কেউ দিলো না এখনো
তবুও আমাদের বাইরে যেতেই হয়।
পড়ালেখা শিখতে যেতে হয়,
বন্ধুর বাড়িতে বেড়াতে যেতে হয়,
প্রিয়তমার সাথে দেখা করতে যেতে হয়,
আত্মীয়ের বিয়েতে যেতে হয়,
সাগর আর পাহাড় দেখতে যেতে হয়,
পরিবারের কাছে ফিরে যেতে হয়।
এই নিশ্চয়তাটি কেউ কখনো দিলো না
যে বাইরে গেলে আবার ফিরে আসা যাবে,
তিলতিল করে বোনা স্বপ্নটি ফিরে এসে পূরণ করা যাবে,
রোজগারের টাকা পেয়ে মা'কে একটা চশমা আর বাবা'কে একটা ঘড়ি কিনে দেওয়া যাবে,
প্রিয়তমার জন্মদিনের জন্য কেনা নাকফুলটি নিজের হাতে পরিয়ে দেওয়া যাবে,
ছোট ভাইয়ের জন্য সাইকেল আর বোনের জন্য গল্পের বই কিনে দেওয়া যাবে।
নিশ্চয়তা আমরা পাইনা তাই সড়কে নামলে সারাক্ষণ ভয় পাই।
ভয় পাই ফিটনেসবিহীন গাড়িকে,
ভয় পাই লাইসেন্সবিহীন ড্রাইভারকে,
ভয় পাই ধাক্কা মেরে ফেলা দেওয়াকে,
ভয় পাই জ্যামকে,
ভয় পাই দ্রুত চালনাকে,
ভয় পাই আগে যাবার প্রতিযোগিতাকে,
ভয় পাই ওভারটেককে,
ভয় পাই ড্রাইভারকে,
ভয় পাই হেল্পারকে,
ভয় পাই যাত্রিকে,
ভয় পাই নিজেকে।
কিন্তু আমরা তো সড়কে নিশ্চয়তা চাই,
নশ্বর দেহ নিয়ে আরেকটুখানি বেশি বেঁচে থাকার নিশ্চয়তা চাই।
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে মার্চ, ২০১৯ রাত ৯:২৭