এক ব্যক্তি তাল চিনে কিন্তু আপেল চিনে না। তাই তালের সাথে তাল মিলিয়ে একদিন আপেলকেও তাল বলে ফেলল। ধীরে ধীরে আরও অনেক আপেল অচেনা লোক আপেলকে তাল বানিয়ে দিল। এদিকে কিছু আপেল চেনা লোকও তালে তাল মিলিয়ে তাল দিয়ে আপেলকে ঢেকে দিল। আপেল আর তাল ওই এলাকায় হয়ে গেল একাকার। ঠিক জঙ্গি শব্দের কপালেও এমনি কিছু জুটেছে। বর্তমানে জঙ্গি নিয়ে যে ধুম্রজাল তৈরি হয়েছে তাও এক তালব্য তাল। বিষয়টি বিস্তারিত পড়লেই তা পরিষ্কার হবে। যখন কোথাও জঙ্গি শব্দের পক্ষে কথা বলতে শুরু করি তখন লোকেরা না শুনেই বলা শুরু করে আরে! আরে ! কি বলছেন। আপনি তো সমস্যায় পড়ে যাবেন। যখন আমার বলা শেষ হয় তখন তারা নিজের কথা প্রত্যাহার করে নেয়।
ফার্সি “জঙ্গ” শব্দের অর্থ যুদ্ধ, লড়াই। আর যারা যুদ্ধ করে তাঁদেরকে বলা হয় জঙ্গি বা যোদ্ধা। বাংলা একাডেমীর সংক্ষিপ্ত বাংলা অভিধানে “জঙ্গ” শব্দের অর্থ যুদ্ধ, লড়াই বলা আছে। (২য় সংস্করণ, পৃষ্ঠা নং- ২১৬)। বিভিন্ন সময় ইসলামের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য যে যুদ্ধগুলো সংঘটিত হয়েছিলো সেগুলোকে ফার্সি ভাষায় জঙ্গ বলে অভিহিত করা হয়। যেমনঃ জঙ্গে বদর, জঙ্গে অহুদ, জঙ্গে কারবালা ইত্যাদি। আর যারা ওই যুদ্ধে অংশ গ্রহন করেছিলেন তাঁরা হলেন জঙ্গি। অর্থাৎ সাহাবায়ে কেরামরাও (রাঃ) ছিলেন জঙ্গি। তেমনিভাবে যারা দেশের জন্য ন্যায়ের পক্ষে যুদ্ধ করে তাঁরাও জঙ্গি বা যোদ্ধা।
অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় যে বর্তমানে এমন এক শ্রেণীর লোককে জঙ্গি উপাধি দেয়া হচ্ছে যারা আদৌ জঙ্গি নয়, বরং এদের উপাধি হতে পারে সন্ত্রাসী কিংবা উগ্রবাদী কিংবা অতর্কিত ঘাতক। যারা বোমা মেরে মানুষ মারে, আত্মঘতি হামলা করে তাদেরকে জঙ্গি উপাধি দিয়ে একদিকে যেমন কূজনকে পুরস্কৃত করা হচ্ছে অন্যদিকে জঙ্গি শব্দটাকে কলঙ্কিত করা হচ্ছে। যারা ইসলামের নাম দিয়ে নাশকতা করে তারা কখনো জঙ্গি হতে পারে না। আবার যারা শাসনের নাম দিয়ে জুলুম অত্যাচার করে তারাও কখনো শাসক হতে পারে না। এরা উভয়েই সন্ত্রাসী। প্রতিটা সন্ত্রাসের আলাদা নামকরণ হলেও হতে পারে তবে সেটা কেন জঙ্গ শব্দকে প্রভাবিত করবে। আমি চাই জঙ্গি শব্দের অঙ্গ থেকে কলঙ্কের চাঁদর সরিয়ে ফেলা হোক। যেমনঃ আমরা জঙ্গি দমনের পক্ষে, জঙ্গিবাদীর প্রতিবাদে মানব বন্ধন, জঙ্গি নির্মূল অভিযান ইত্যাদি পরিবর্তন করুন। দেখুন, জঙ্গি( যোদ্ধা ) যদি নির্মূল হয় তবে দেশকে বহিঃ শত্রুর আক্রমন থেকে রক্ষা করবে কে? সুতরাং আমরা জঙ্গি দমনের পক্ষে নয় আমরা জঙ্গি লালনের পক্ষে। আমরা সন্ত্রাস দমনের পক্ষে, আমরা উগ্রবাদী দমনের পক্ষে। ইসলামের নাম দিয়ে নাশকতাকারী কখনো জঙ্গি ( যোদ্ধা ) হতে পারেনা।
বিগত দিনে আমরা আরও লক্ষ্য করেছি একটা সম্মানজনক শব্দের সাথে ধিকৃত শব্দ যোগ করে ওই শব্দটাকে গালি হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছিল। যেমনঃ মতলববাজ, ধান্দাবাজ, পল্টিবাজ, গিরিঙ্গিবাজ, ফটকাবাজ, ধোঁকাবাজ ইত্যাদি শব্দের বাজ নামক বাজে শব্দটি ফতোয়ার সাথে লাগিয়ে ওলামায়ে কেরামকে ফতোয়াবাজ বলে সম্বোধন করা হতো। কোরআন হাদিস ও ফিকাহ’র সমন্বয়ে যারা ইসলামী আইন শাস্ত্রে ডিগ্রি অর্জন করে তাঁদেরকে বলা হয় মুফতি। আর এই মুফতিদের দ্বারাই শরীয়তের ব্যাপারে সৃষ্ট কোন সমস্যার সমাধান দেওয়ার নামই ফতোয়া।
এর আর একটু পিছনে তাকালে দেখা যায় সুন্নত পালনকারী মুসলমানদের বলা হতো মৌলবাদী। পর্বে পর্বে এসব মহৎ শব্দগুলো যে আঘাত প্রাপ্ত হচ্ছে এর পিছনে খেতাব প্রদানকারীদের কু মতলব লুকিয়ে রয়েছে। মৌলবাদী নিয়ে যখন পাগলের প্রলাপ ছড়াচ্ছিল তখন মৌলবাদীর স্বপক্ষে আমি একটা ইসলামী সঙ্গীত লিখেছিলাম, যেখানে ফুটে উঠেছে মৌলবাদের পরিচয়। যেটা নিম্নরুপঃ
মৌলবাদী ডাক শুনে তুই হারাইলি কেন মনোবল,
আমি এক মৌলবাদী জোড়ে জোড়ে বল।
মূল ছাড়া কি দাঁড়ায় তরু পায়কি তাকত বল
মূল বিহনে সবই যে ভুল সবই যে অচল
মূলের তরেই ফুলের ফোটা জন্মে গাছে মজার ফল।
আমি এক মৌলবাদী জোড়ে জোড়ে বল।
মৌলবাদী সবার আদি আল্লাহ তায়ালার পরে
মুহাম্মাদ(সঃ) তো সবার নেতা মৌলবাদের ঘরে
মৌলবাদের বিধান মত চলবে গোটা ধরাতল।
আমি এক মৌলবাদী জোড়ে জোড়ে বল।
আল্লাহ তায়ালা অনাদি মূল বিধান মৌলবাদ
সেই বিধানকে মানে যদি তারে বলে মৌলবাদী
মৌলবাদ জিন্দাবাদ সবার আগে চল।
আমি এক মৌলবাদী জোড়ে জোড়ে বল।
বহুল আলোচিত আল-কায়েদা প্রধান নেতা ওসামা বিন লাদেন। অর্থাৎ লাদেনের পুত্র ওসামা। তাহলে আল- কায়েদা প্রধান তথা বহুল আলোচিত ব্যক্তিটি হলেন ওসামা। কিন্তু বিভিন্ন সময় বিভিন্ন সংবাদ পত্রে ওসামাকে লাদেন বলে সম্বোধন করতে দেখা গেছে। ১) বেঁচে আছেন লাদেন, থাকছেন বাহামা দ্বীপে! ২) চমক দিতে ভালবাসেন লাদেন ইত্যাদি। শিক্ষিত অশিক্ষিত অধিকাংশ লোকেরাই ওই ব্যক্তিকে লাদেন বলেই জানে। চুরান্ত কথা হল ওই ব্যক্তিরা ওসামা বিন লাদেন এই বাক্যের অর্থ না জেনেই মনগড়া ওসামাকে লাদেন বলে থাকে, জঙ্গি শব্দটাও অনেকটা এরকম।
আব্দুল কাদের জিলানী রহঃ এর পিতার নাম ছিল আবু ছালেহ জঙ্গি মুছা। ইতিহাস বলে তিনি উচ্চ স্তরের আল্লাহর অলি ছিলেন। এমন ব্যক্তিকে সন্ত্রাসী বলা যায় কি? নুরুদ্দিন জঙ্গি রহঃ আরবের একজন ধার্মিক বাদশাহ ছিলেন। ৫৫৫ হিজরিতে আল্লাহ তায়ালা স্বপ্নযোগে তাঁকে নবীজির লাশ চুরির চক্রান্তকারীদের চেহারা হুবহু চিনহিত করে দিলেন অতঃপর তিনি আল্লাহর রহমতে সকল চক্রান্ত নস্যাৎ করে দিলেন। এ হেন ব্যক্তি সন্ত্রাসী হতে পারে কি?
যুদ্ধের নিমিত্তে যে বিমানগুলো ব্যবহার করা হয় সেগুলোকে বলা হয় জঙ্গি বিমান। জঙ্গি শব্দ যদি সন্ত্রাসী অর্থে ব্যবহৃত হয় তবে বিমান গুলো হয়ে যায় সন্ত্রাসী বিমান অথবা জঙ্গি বাদ দিয়ে বিমানগুলোর অন্য নামকরণ করতে হয়।
অজ্ঞজন কিংবা মতলবাজ দ্বারা যখন কোন শব্দ আঘাত প্রাপ্ত হয় তখন বিজ্ঞজনের উচিত তালে তাল না মিলিয়ে সঠিক ব্যাপারটা তুলে ধরা অন্যথায় একটা ভুল মজবুত আকারে প্রতিষ্ঠা পায়। যেটাকে পরবর্তীতে সংশোধন করা অনেক কষ্টকর। যেমন বটের চারা, যেটা একজনের দ্বারাই সহজে টেনে তোলা সম্ভব কিন্তু শিকড় গেঁড়ে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেলে কুঠার দিয়ে তোলাও অসম্ভব।
দাড়ি টুপি পরিহিত লোক দেখলেই অনেকে উপহাস বশত মোল্লা ডাকে অথচ মোল্লা একটা সম্মানিত শব্দ। মোল্লা বা মুল্লাহ শব্দটি এসেছে তুর্কি ভাষা থেকে যার অর্থ জ্ঞানী। এখানে ইসলামী জ্ঞানে জ্ঞানী ব্যক্তিকেই বুঝানো হয়েছ। সুতারং যাকে তাকে যেমন মোল্লা উপাধি দেয়া যায়না তেমনি মোল্লা নামক সম্মানিত শব্দকে উপহাস করাও ঠিক নয়।
সন্ত্রাসী অর্থে যারা কওমি মাদ্রাসাকে জঙ্গি আস্তানা বলতে চায় তারা নবী মুহাম্মাদুর রসুলুল্লাহ (সঃ) এর সুন্নাত অনুযায়ী জীবন যাপনের পরিপন্থী মনোভাবের অধিকারী। গুলশান হামলার ঘটনা দিয়েও কি প্রমান পাননি আসলে কারা সন্ত্রাসী/উগ্রবাদি? ছদ্মবেশীর কু কর্মের দায় ভাল মানুষের উপর চাপানো কেবল ভণ্ডের দ্বারাই শোভা পায়। আর এ স্বভাবের জন্য অপেক্ষা করছে আল্লাহর গজব। ( স্মরণ করুন মুছা আঃ এর উপর কারুন ও তার দলবল কর্তৃক নারী বিষয়ক নিকৃষ্ট মিথ্যা অপবাদ প্রদানের ভয়াবহতা, তাদের এ মিথ্যা অপবাদ দেয়ার অপরাধে আল্লাহ তায়ালার আদেশে মাটি তাদেরকে জ্যান্ত অবস্থায় গ্রাস করে নিয়েছিলো।) জঙ্গির ব্যপারে ধুম্রজাল সৃষ্টিকারী মতলববাজ এবং জানা, না জানা নাচের বুড়ি উভয়কেই বলছি জঙ্গি শব্দের উপর থেকে কলঙ্কের চাঁদর সরিয়ে ফেলুন। ঢালাও ভাবে ক্ষেত্রহীন জঙ্গি শব্দের প্রয়োগ বন্ধ করুন।
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে মার্চ, ২০১৭ সকাল ১১:২৭