মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী কর্ম-জীবনের শুরু থেকে সামাজিক জুলুম, অর্থনৈতিক শোষণ এবং রাজনৈতিক দমননীতির বিরুদ্ধে লড়ে গেছেন। বাংলা-আসামের বিভিন্ন স্থানে জমিদার, সুদখোর শোষক মহাজনদের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ সংগ্রামে, কখনো বা উপনিবেশবাদী বৃটিশের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবাদী তৎপরতায়, খিলাফত আন্দোলনে, কংগ্রেস ও মুসলিম লীদের স্বাধীনতা সংগ্রামে। ততকালীন পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে তিনি অর্থনৈতিক ও গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ের সংগ্রামে, মাতৃভাষার দাবী প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে, প্রাদেশিক স্বায়ত্বশাসন আদায় এবং আঞ্চলিক বৈষম্য দূরীকরণের আপোষহীন সংগ্রাম করে গিয়েছেন।
প্রতিবেশী বৃহৎ রাষ্ট্র ভারত গঙ্গায় বাধ দিয়ে পানিপ্রবাহ ভাগীরতি নদীতে নিয়ে যায়া বন্ধ করার জন্য এবং বাংলাদেশর পানির অংশদারিত্ব আদায় করার জন্য বিশ্ববাসীকে এ বিষয়ে সচেতন করে বাংলাদেশের দাবীর প্রতি সমর্থন আদায়ের লক্ষ্যে মজলুম জননেতা মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী ১৯৭৬ খিঃ ১৬ মে ফারাক্কা অভিমুখে লংমার্চ করেছিলেন। সারাদেশ থেকে অগণিত মানুষ রাজশাহী মাদ্রাসা মাঠে এসে জমায়েত হয়। সেখান থেকে লংমার্চ শুরু হয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জের কানসাটে গিয়ে শেষ হয়।
দিনটি ছিল রোববার। সকাল ১০টায় রাজশাহী থেকে শুরু হয় জনতার পদযাত্রা। হাতে ব্যানার আর ফেস্টুন নিয়ে অসংখ্য প্রতিবাদী মানুষের ঢল নামে রাজশাহীর রাজপথে। ভারতবিরোধী নানা শ্লোগানে শ্লোগানে মুখরিত হয়ে উঠে পুরো জনপদ। বেলা ২টায় লাখো মানুষের গোদাগাড়ীর প্রেমতলী গ্রামে গিয়ে পৌঁছায়। সেখানে মধ্যাহ্ন বিরতির পর আবার যাত্রা শুরু হয়। সন্ধ্যা ৬টায় লং মার্চ চাঁপাইনবাবগঞ্জ কলেজ মাঠে পৌঁছায়। কলেজ মাঠেই রাত যাপনের পর সোমবার সকাল ৮টায় আবার যাত্রা শুরু হয় শিবগঞ্জের কানসাট অভিমুখে। ভারতীয় সীমান্তের অদূরে কানসাটে পৌঁছানোর আগে মহানন্দা নদী পার হতে হয়। লাখ লাখ মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে যোগ দেন এই লং মার্চে। তারা নিজেরাই নৌকা দিয়ে কৃত্রিম সেতু তৈরি করে মহানন্দা নদী পার হন। কানসাট হাইস্কুল মাঠে পৌঁছানোর পর সমবেত জনতার উদ্দেশে মজলুম জননেতা মাওলানা ভাসানী তার জ্বালাময়ী ভাষণ দেন।
মাওলানা ভাসানী ভারতের উদ্দেশে বলেন, ‘তাদের জানা উচিত বাংলার মানুষ এক আল্লাহকে ছাড়া আর কাউকে ভয় পায় না। কারো হুমকিকে পরোয়া করে না।’ তিনি বলেন, ‘আজ রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও কানসাটে যে ইতিহাস শুরু হয়েছে তা অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর নতুন অধ্যায়ের সৃষ্টি করবে।’ মাওলানা ভাসানী এখানেই লংমার্চের সমাপ্তি ঘোষণা করেন। বাংলাদেশ সীমানার মধ্যে লং মার্চ সমাপ্ত হলেও সে দিন জনতার ভয়ে ভীত ভারতীয়রা সীমান্তে প্রচুর সৈন্য মোতায়েন ও নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করে।
ভাসানীর নেতৃত্বে ফারাক্কার বিরুদ্ধে তীব্র জনমত গড়ে ওঠে। দেশবাসী দাবি তোলে বাংলাদেশের প্রতি ভারতের অন্যায় আচরণের বিষয়টি আন্তর্জাতিক আদালতে উত্থাপনের। ভাসানীর প্রতি শ্রদ্ধা এবং দেশবাসীর দাবির প্রেক্ষিতে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ফারাক্কার বিষয়টি জাতিসংঘে উত্থাপন করেন।
এই ফারাক্কা লংমার্চ হওয়ার কারনেই ফারাক্কা বাধ এবং গঙ্গার পানি প্রবাহ আন্তর্জাতিক মর্যাদা পায় এবং ভারত গঙ্গার পানিতে বাংলাদেশের হিস্বা দিতে চুক্তি করে যে বিষয়টি জাতিসঙ্গেও উত্তাপিত হয়। এই ১৬ই মে ফারাক্কা লংমার্চ আমাদের জাতীয় ইস্যু। অন্যান্য আন্তর্জাতিক ৫৪ টি নদী গুলোরও প্রকৃত এবং সমানভাবে বিতরনে ব্যবস্থা হওয়া আবশ্যক।
এদিকে চলতি বছরের শুকনো মওসুমের শুরুতেই বাংলাদেশে পদ্মা নদীতে চরের বিস্তার ঘটে চলেছে। সেই সঙ্গে পদ্মার শাখা-প্রশাখাসহ অন্তত ৩৬টি নদী কার্যত মৃত খালের রূপ নিয়েছে। এবার শুকনো মওসুম শুরুর আগেই গঙ্গায় পানির সংকটের প্রভাবে বাংলাদেশের পদ্মা শুকিয়ে মরা গাঙ্গে পরিণত হতে শুরু করেছে। এখনই পদ্মার বুক চিরে চলাচল করতে শুরু করেছে বালুবাহি ট্রাক, চাষাবাদও শুরু হয়েছে অনেক স্থানে।
এদিকে, ফারাক্কা চুক্তি অনুযায়ী প্রতিবছরের মতো এবারেও ১ জানুয়ারি থেকে শুরু হয়েছে শুকনো মওসুম। ভারতের সাথে চুক্তি মোতাবেক এই শুষ্ক মওসুমের ৩১ মে পর্যন্ত উভয় দেশ দশদিনওয়ারি ভিত্তিতে গঙ্গার পানি ভাগাভাগি করে নেবার কথা। কিন্তু ভারতের পক্ষ থেকে কখনই এই সিডিউল মানা হয় না। সরকারের একজন কর্তাব্যক্তি স্বীকার করেন, চুক্তির ইন্ডিকেটিভ সিডিউল অনুযায়ী অনেক সময় পানি পাওয়া যায় না- এটা ঠিক। এ বিষয়টি ভারতকে জানানো হয়েছে এবং চুক্তি যথাযথভাবে মেনে চলার তাগিদ দেয়া হয়েছে। কিন্তু গঙ্গার ফারাক্কা পয়েন্টে পানি প্রবাহ আদৌ না থাকলে কীভাবে সিডিউল ঠিক থাকবে- তা জানা যায়নি।
বিশেষজ্ঞদের হিসাবমতে ফারাক্কা চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশ গত পাঁচ বছরে ২০ ভাগ-এর কম পানি পেয়েছে। দেশের পানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গত ২১ থেকে ৩১ মার্চ ওই ১০ দিনে ভারত বাংলাদেশকে ১৫ হাজার ৬০৬ কিউসেক পানি দিয়েছে। যা ছিল স্মরণকালের সর্বনিম্ন পানির রেকর্ড। ১৯৯৬ সালে স্বাক্ষরিত ৩০ বছর মেয়াদি গঙ্গার পানি চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশ কেন এতো কম পানি পেল, এ নিয়ে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয় কিম্বা যৌথ নদী কমিশনের পক্ষ থেকে কোনো প্রতিবাদ জানানো হয়নি। ভারতের কাছে আপত্তি তোলা হয়নি- কেন বাংলাদেশকে এই শুষ্ক মওসুমে ধারাবাহিকভাবে কম পানি দেয়া হলো। যৌথ নদী কমিশনের (জেআরসি) তথ্যানুযায়ী, ইতোপূর্বে ২০০৮ সালে ১১ থেকে ২০ এপ্রিল পর্যন্ত ওই ১০ দিনে ফারাক্কা পয়েন্ট দিয়ে বাংলাদেশের সর্বনিম্ন পানি পাওয়ার রেকর্ড ছিল ১৭ হাজার ৫১৯ কিউসেক। চলতি শুষ্ক মওসুমে চুক্তি মোতাবেক বাংলাদেশ মাত্র ৪ বার ৩৫ হাজার কিউসেক করে গঙ্গার পানি পেয়েছে। এছাড়া ১ জানুয়ারি থেকে ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত ১০ দিনওয়ারি হিসাবে প্রতিটিতে বাংলাদেশ পানির ন্যায্য হিস্যা থেকে বঞ্চিত হয়েছে।
প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, গঙ্গার উৎস থেকে ফারাক্কা পর্যন্ত বহু বাঁধ আর খালের মাধ্যমে গঙ্গার পানি প্রত্যাহার করে চলেছে ভারত। শুধু ফারাক্কা বাঁধ নয়, কানপুরের গঙ্গা ব্যারাজ ও হরিদুয়ারে গঙ্গার পানি প্রত্যাহারে নির্মিত কৃত্রিম খালসহ অসংখ্য স্থাপনা নির্মাণ করেছে তারা। এখানেই শেষ নয়, ভারত ফারাক্কার উজানে উত্তর প্রদেশ রাজ্যের কানপুরে গঙ্গার ওপর আর একটি বাঁধ নির্মাণ করছে। এতে ব্যয় হচ্ছে প্রায় সাড়ে ৯শ’ কোটি রূপী। এছাড়া উত্তর প্রদেশ ও বিহারে সেচের জন্য প্রায় চারশত পয়েন্ট থেকে পানি সরিয়ে নেয়া হচ্ছে। এসব পয়েন্ট থেকে হাজার হাজার কিউসেক পানি প্রত্যাহার করা হচ্ছে। পরিণতিতে ফারাক্কা পয়েন্টে পানির প্রবাহ যে কমে যাবে তা পানির মতোই পরিষ্কার। ফলে বাংলাদেশের হাজারো চিৎকার আর আহাজারি সত্ত্বেও ফারাক্কা পয়েন্টে পানি না থাকার ফলে বাংলাদেশ তার ‘নায্য হিস্যা’ দূরে থাক সাধারণ চাহিদাটুকুও পূরণ করতে পারবে না।
বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশের পদ্মার যে বিপুল আয়তন তাতে স্বাভাবিক প্রবাহ থাকলে প্রাকৃতিক ও পরিবেশগত বিপর্যয় সৃষ্টির কথা উঠতো না। কিন্তু ভারত নেপালের কোশি থেকে শুরু করে ফারাক্কা পর্যন্ত সুদীর্ঘ পথে পানি প্রত্যাহারের যে একতরফা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে- তাতে বাংলাদেশের বিপর্যয় অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠেছে। শুধু বাঁধ-ব্যারাজই নয়, গঙ্গার পানি সরিয়ে নিতে ভারত অনেক আগে থেকেই গঙ্গায় বৃহদাকার তিনটি খাল প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে। এসব খালের মোট দৈর্ঘ ১৩ হাজার ৬শ’ কিলোমিটার। এগুলো হচ্ছে, ‘আপারগঙ্গা ক্যানাল প্রজেক্ট’, ‘মধ্যগঙ্গা ক্যানাল প্রজেক্ট’ এবং ‘নিম্নগঙ্গা ক্যানাল প্রজেক্ট।’ এ ধরনের প্রকল্পের খালের মাধ্যমে গঙ্গার পানি সরিয়ে নিয়ে সেচ দেবার ব্যাপক কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে তারা।
‘আপারগঙ্গা খাল প্রকল্পের’ মাধ্যমে উত্তর প্রদেশের ২৫ লাখ একর জমিতে সেচ দেয়ার লক্ষ্যে ৬ হাজার কিলোমিটারের বেশী খাল কেটে পদ্মার পানি সরিয়ে নেয়া হচ্ছে। ‘মধ্যগঙ্গা ক্যানাল প্রজেক্ট’ নামের প্রকল্পে মূল ও শাখাসহ খননকৃত খালের মোট দৈর্ঘ প্রায় ১৬শ’ কিলোমিটার। ‘নিম্নগঙ্গা সেচ প্রকল্পের’ জন্য ৬ হাজার কিলোমিটার খালের মাধ্যমে গঙ্গার পানি সরিয়ে নেয়া হচ্ছে। উল্লেখ্য, গঙ্গা প্রধানত তিনটি উৎস থেকে পানিপ্রবাহ পেয়ে থাকে। এগুলো হলো, মূল উৎসের হিমবাহ থেকে উৎসারিত পানি, উপনদীগুলোর প্রবাহ এবং বৃষ্টির পানি। এছাড়াও ঝর্ণা এবং নালা-নর্দমা থেকে কিছু পানি জমা হয়। ভারত এর প্রায় সবক’টি উৎসকেই বিভিন্নভাবে বাধাগ্রস্ত করছে বলে প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়। এভাবে এসব উৎসের শতকরা ৯০ ভাগ পানি সরিয়ে নেয়া হচ্ছে। ফলে নদীতে মাত্র ১০ ভাগ পানি স্বাভাবিকভাবে প্রবাহিত হতে পারছে বলে সূত্রে প্রকাশ।
ফারাক্কা বাঁধের ফলে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল মরুভূমিতে পরিণত হয়েছে। এবার টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণের মাধ্যমে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলকে মরুভূমিতে পরিণত করার ষড়যন্ত্র হচ্ছে। এর বিরুদ্ধে সকল দেশপ্রেমিক শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। ফারাক্কা, ও টিপাইমুখসহ ভারতের অব্যাহত পানি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে দেশপ্রেমিক, জাতীয়তাবাদী ও গণতান্ত্রিক শক্তির জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলতে হবে। মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানীর প্রদর্শিত পথই হচ্ছে ভারতের অব্যাহত আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের পথ।
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই মে, ২০১৬ সকাল ১০:১৭