আমি একটি মেয়েকে ভালোবাসতাম। অনেক ভালোবাসতাম। আমার সাথে তার সম্পর্ক প্রায় চার বছর স্হায়ী হয়েছিল। শুরুটা হয়েছিল আচমকা কিন্তু শেষটা হয়েছিল ধপ করে প্রদীপ নিভে যাওয়ার মত। এই চার বছরে কত শত ঘটনা, কত শত রটনা ঘটেছিল তা বলে শেষ করা যাবেনা। হয়ত পর্ব আকারে লিখলে প্রতিদিন একটি করে পর্ব লিখে জীবন পার করে দিতে পারব। আমি যখন ইন্টারমিডিয়েট শেষ করে সদ্য ভার্সিটি ভর্তি হয়েছিলাম ঠিক তারপর থেকে তার সাথে সম্পর্কে জড়িয়েছি। তখন সে সপ্তম শ্রেণিতে পড়ে। এই বয়সে মেয়েদের মন জয় করা খুব কঠিন। কারণ তাদের মনে ভয়, চাঞ্চল্য, আগ্রহ, পরিবারের শাসন সব কিছু ভর করে, আর গ্রাম হলে তো কোন কথাই নেই। তার মন জয় করতে আমার অনেক পরীক্ষা, সাধনা, চেষ্টা করতে হয়েছে। তাকে নিয়ে আমার শত শত ঘটনা জমা আছে। সেখান থেকে আজকে একটি শেয়ার করছি।
২০১২ সাল। এলাকার রাজনৈতিক কোন্দলের কারণে কয়েকটি বিছিন্ন ঘটনায় আমাকে জড়িয়ে দেয়া হয়েছে। আমি ফেরারি আসামী হয়ে এক এলাকা থেকে আরেক এলাকায় যাযাবরের মত ঘুরে বেড়াচ্ছি। পুলিশ আমাকে হন্য হয়ে খুঁজছে। কিন্তু আমাকে ধরা এত সহজ ছিল না। বারবার মোবাইল আর সিম কার্ড পরিবর্তণ করে নীলার সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছি। নীলার সাথে কিভাবে আমার সম্পর্ক হয়েছিল সে ঘটনা আরেক দিন লিখব। আমার সাথে নীলার মোবাইল কানেকশন সহজ হয়েছিল তার মায়ের কারণে। মেয়ে সহ মাকে কিভাবে ম্যানেজ করেছি সে খবর না হয় আরেকদিন জানাব।
পুলিশ আমাকে গ্রেফতার করার জন্য হন্য হয়ে খুঁজছে। তাছাড়া এলাকায় নতুন আরেকটি মার্ডার হলে সেখানে আমাকে জড়িয়ে দেয়া হয়েছে। তাই অভিজ্ঞজন পরামর্শ দিলো একেবারে আত্মগোপন করে নিজ থেকে গুম হয়ে যেতে এবং তথ্য যোগাযোগ প্রযুক্তি একেবারে ব্যবহার না করতে। কিন্তু আমার পক্ষে তা ছিলো একেবারেই অসম্ভব। কিন্তু কি আর করা, জীবন বাঁচানো যেখানে ফরয হয়ে গেছে সেখানে অন্য কিছু ভাবা মানে খাল কেটে কুমিড় আনা। কিন্তু তার আগে নীলার সাথে দেখা করে বিষয়টি বোঝানো দরকার। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আত্মগোপনকৃত স্হান থেকে প্রায় বিশ মাইল পথ অতিক্রম করে নীলাদের বাড়ির কাছাকাছি যখন এসেছি তখন রাঁত প্রায় বারো'টা বেজেছে। তাদের বাড়িতে আসতে আমার বিকল্প পথ পাড়ি দিতে হয়েছে, এই জন্য আমাকে একটি নদী সাঁতরিয়ে একটি ধানের বিল মাড়াতে হয়েছিল। আমি নীলাদের বাড়ির কাছাকাছি এসে মোবাইল অন করে নীলাকে ফোন দিলাম, বললাম আমি তোমাদের পুকুর পাড়ে আছি। প্রথম অবস্হায় সে বিশ্বাস করতে চায়নি। কিন্তু আমি যখন জোড় দিয়ে বললাম তখন সে আমার কথা বিশ্বাস করেছিল এবং রাতের আধারে এসে চুপি চুপি আমার সাথে দেখা করেছে। তার সাথে দেখা করতে গিয়ে আমার সমস্ত ভয়, চিন্তা নিমিষেই দূর হয়ে গেল। আমি তার হাতটি ধরে শুধু বলিছি, কেমন আছো? একথা বলার পর সে আমার গলায় ধরে কিযে কান্না। প্রায় আধাঘণ্টা ধরে একটানা কেঁদে ছিলো, জীবনে কোন মেয়েকে এভাবে কান্না করতে দেখিনি। কান্নার গভীরতা এতোটা ছিলো যে, একই সাথে তার নাক, মুখ, চোখ দিয়ে পানি চলে এসছে। তার কান্নার তিনটি কারণ ছিল:
এক- আমি বিপদে আছি।
দুই-আমার সাথে সম্পর্ক থাকার কারণে তার বাবা তাকে বিভিন্ন রকম কথা বলত, সম্ভবত সে সেগুলো মানুষিক টর্চার হিসেবে নিয়েছিল।
তিন-নীলার বাবা হয়ত আমার বিরুদ্ধে আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো।
প্রায় আধা ঘন্টা হতে চলেছে নীলার কান্না চলছে। আমি তাকে বিভিন্নভাবে শান্তনা দিচ্ছি। কিন্তু এমন সময় ভয়ানক কান্ড ঘটে গেল। নীলার বাবা বিষয়টি টের পেয়ে আরো দু'চারজন মানুষ নিয়ে আমাকে ধরে ফেলতে সক্ষম হলো। আমার আর নীলার মোবাইল সেট দুটি নিয়ে চুলার আগুনে পুড়িয়ে ফেললো। আমাকে ঘরে বন্দি করে পুলিশ কে গোপনে খবর দেয়া দেন। নীলার মামা ছিলো পুলিশের উর্দ্ধতন কর্মকর্তাদের একজন। ফলে সারা বিষয়টা তারা খুব ভালোভাবে হ্যান্ডেল করেছে। আমার বন্ধি করার বিষয়টি প্রথম অবস্থায় অন্য মানুষদের কে জানতে দেননি। কিন্তু নীলার মা ঘটনার ভয়াবহতা বুঝতে পেরে সুযোগ বুঝে বদ্ধ ঘরের দরজা খুলে দেন যাতে করে আমি পালিয়ে যেতে পারি। আমি প্রেমিকার মায়ের এই উপকার সাদরে গ্রহণ করেছিলাম। বন্ধি শিবির থেকে বের হয়ে সাথে সাথে সামনের ধানি জমিতে নেমে গেলাম, উদ্দেশ্য দ্রুত লুকানো। ইতিমধ্যে পুলিশ এসে উপস্হিত হয়েছে। তারা এসে আমাকে না পেয়ে খুবই হতাশ হলো। এর আগে আমাকে ধরার জন্য তারা বিভিন্ন ফাঁদ পেতেছিলো। তবে সে সময় তারা বেশি সুবিধা করতে পারেনি। কিন্তু আজকে নাগালের মধ্যে পেয়ে ফসকে যাবে এমটা মেনে নিতে পারছেনা। অপরপক্ষে তারা বুঝেছিলেন আমি বেশিদূর যেতে পারেনি, তাই ক্রাকডাউন রচনা করলেন, এবং ধানক্ষেতে টর্চ লাইট দিয়ে সার্চ করা শুরু করলেন। আমি উপায় না দেখে পাশের এক ডোবার পানিতে নেমে কচুরি পানার মধ্যে লুকিয়ে থাকলাম। এর মধ্যে নীলার বাবা নতুন চাল চাললেন। তিনি সবার নিকট প্রচার করলেন, তাদের বাড়িতে ডাকাত পড়েছে, তাই পুলিশ কে খবর দেয়ার পর তারা ডাকাতদের খোঁজে তল্লাসি শুরু করেছে। এতে গ্রামবাসী দ্বিগুন উৎসাহ নিয়ে পুলিশদের সাথে বিলের সমস্ত ধানি জমিতে তন্ন তন্ন করে খুঁজতে লাগলেন। কিন্তু আমার হদিস তারা কিছুতেই পায়নি। রাত দু'টার দিকে গ্রামবাসী ডাকাত না পেয়ে যে যার ঘরে ফিরে গেছেন। কিন্তু পুলিশের কয়েকজন সদস্য তখনো ধান খেতে বসেছিল। তারা ভেবেছিল, মানুষ জন চলে গেলে আমি হয়ত স্হান ত্যাগ করার জন্য হাটা শুরু করব। কিন্তু আমি তাদের স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম। ফলে কোথাও মুভমেন্ট করিনি।
নীলাকে ঘরে মধ্যে আটকিয়ে রাখা হয়েছে যাতে কারো সাথে কোন কথা বলতে না পারে। আমি সারা রাত কচুরি পানার মধ্যে লুকিয়ে ছিলাম। ফজরের আযান হলে পুলিশ তাদের অবস্হান ছেড়ে চলে যায়। আমি কচুরি পানা থেকে উঠে এসে পুলিশের যায়গা এসে বসলাম। আমার সমস্ত শরীল পানিতে ভিজে সাদা ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। এবং সারা শরীল চুল্কানির গোটা উঠে লাল বর্ণ ধারণ করেছে। ডোবাতে থাকা কালীন অবস্থায় জোঁকগুলো আমার থেকে জোড় করে রক্ত টেনে খেয়েছে। তাছাড়া অনতি দূরে একটি দাড়াস সাপ মরে পেট ফুলে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছিল। গন্ধে ভিতর থেকে নাড়িভুড়ি উল্টিয়ে যাচ্ছে, বাধ্য হয়ে মুখ দিয়ে কয়েকবার বমি করিছি। সকালে সূর্য উঠার সাথে সাথে বিলের একেবারে মাঝেখানে চলে যাই। সেখানে সারা দিন বসে ছিলাম। সত্যি করে বলছি সেদিন পেটে কোন দানাপানি দিতে পারিনি। শুধু মাত্র জোহরের সময় রোদ তীব্র হলে কয়েক ঢোক বিলের পচা পানি খেয়েছি। রাত নেমে আসলে সেখান থেকে সরে গিয়ে এক আত্মীয়ের বাসায় তিন দিন শুয়ে ছিলাম। সাথে প্রচন্ড জ্বর ছিলো।
নীলাকে বন্ধি করে রাখা হয়েছে যাতে সে মানুষের সাথে মিশতে না পারে। আশংকা ছিলো যদি সে মানুষের কাছে সত্য ঘটনা বলে দেয় তাহলে কেলেঙ্কারী ছড়াবে! অপরদিকে আমার জ্বরের প্রকোপ প্রচণ্ড ভাবে বেড়ে গেছে। কয়েক দিন যাবৎ হুশ ছিলোনা। বাড়িতে কাগজের স্লিপ লিখে খবর পাঠানো হয়েছে। মা-বাবা আমায় দেখে কিযে কান্না। তারা সব ঘটনা শুনতে পেয়ে অবাক হয়েছেন। তারা ভাবতে পারেনি আমাকে ফাঁসানোর জন্য নীলার বাবা এমন চক্রান্ত করতে পারে! আমার শরীলের অবস্হার অবনতি হলে বাবা গোপনে আমাকে চাঁদপুরের একটি প্রাইভেট ক্লিনিকে ভর্তি করে দেন।
নীলাকে জানানো হয়েছে আমাকে পুলিশে ধরেছে। আমার আজীবন জেল অথবা ফাঁসি হতে পারে। তাকে বুঝানো হচ্ছে, সে যদি আমাকে ভুলে না যায় তাহলে তার মামা আমাকে বন্দুক যুদ্ধের নাটক করে ক্রস ফায়ার দিবেন। প্রথমে সে কিছুতেই বিশ্বাস করেনি; কিন্তু তার সামনে কিছু মানুষকে দিয়ে এমনভাবে ঘটনার বর্ণনা করা হতো যাতে সে বিশ্বাস করতে বাধ্য হয়েছে। ফলে আমাকে নিয়ে তার দুশ্চিন্তার অন্ত ছিল না। তার উপর আবার নতুন ঝামেলা যোগ হইছে, নীলার বাবা নীলার ফুফাতো ভাইয়ের সাথে বিয়ে ঠিক করে করেছেন। বার বার হুমকি দেয়া হচ্ছে ফুফাত ভাইকে যদি সে বিয়ে না করে তাহলে আমাকে নিশ্চিত ক্রস ফায়ার দিবে। প্রথম অবস্হায় নীলা কিছুতেই রাজি ছিলোনা কিন্তু তাকে যখন কিছু পেপার কাটিং দেখানো হয়, তখন সে বিশ্বাস করেছিল সত্যি সত্যি পুলিশ মানুষ কে ক্রস ফায়ার দেয়। আমার জীবন বাঁচানো তার জন্য জরুরি হয়ে পড়ে। তাই মন কে কুরবানি দিয়ে নিজের দেহকে ফুফাত ভাইয়ের কাছে উৎসর্গ করেছিল।
আমি যখন সম্পূর্ণ সুস্হ্য হই তখন সম্পূর্ণ ঘটনা জেনে পুনরায় মানুষিকভাবে ভেঙ্গে পড়ি। সে সময় আইনি বাধ্যবাধকতা, পুলিশি দাবড়ানি এবং ফেরারি জীবনের কারণে কিছুই করতে পারিনি। পরে মনকে শান্ত দেই এই বলে যে, নীলা আমাকে জীবিত ভালবেসে ছিল, তাই মৃত প্রেমিকের চেয়ে জীবিত প্রেমিক তার কাছে অধিক শক্তিশালী মনে হয়েছে । আমার বেঁচে থাকাটাই তার কাছে মুখ্য ছিল। তার একটি বেদনা দায়ক সিদ্ধান্তের কারণে একটি প্রাণ যদি বেঁচে যায় এটাই বা কম কিসের?
আমি এখন বেঁচে আছি। হয়ত বেঁচে থাকব। আইনি ঝামেলা থেকে মুক্ত হয়ে সমাজের মূল ধারায় ফেরত এসেছি। কিন্তু যারা নীলাকে মিথ্যা বলেছে, ব্লাক মেইল করেছে তারা এই সমাজের কীট। তাদের দেখলে আমরা প্রকাশ্যে স্যালুট করি কিন্তু পিছে জানোয়ার বলে গালি দেই।
পরিশেষে, নীলার সিদ্ধান্তে কোন প্রত্যারণা ছিলোনা। সত্যি সত্যি যদি আমি ধরা খেতাম? তবে আমি কখনো তার এই বিশ্বাস ভাঙ্গতে চাইনি। কারণ তার ভুল বিশ্বাসের মূল্য এতো বিশাল ছিলো যে সত্য ঘটনা জানা সেখানে মূল্যহীন। পরে হয়ত সত্য ঘটনা জেনেছে। কিন্তু ততদিনে স্বামী-সংসারে ডুবে গিয়ে আমাকে মন থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছে।
ভালো থেকে নীলা।
স্কেচ:শাহাদাৎ হোসাইন।
মাধ্যম: ইলাস্ট্রেটর
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে মার্চ, ২০১৮ বিকাল ৪:৩৯