রাশেদা। এলাকার মেধাবী এবং পরিচিত সুন্দরী মেয়ে। শরীলের সাথে মানান সই নিত্য নতুন ড্রেসআপ, মেকাপ, কথা বার্তায় স্মার্ট এবং চাল চলনে স্টাইলিশ ভাব থাকার কারণে তাকে এ পরিচিতি দিয়েছে। আমি ছোট বেলায় তাকে খুব পছন্দ করতাম। এলাকার ছোট বড় সবাই তাকে পছন্দ করত। এলাকায় রাশেদার পরিবারের নাম ডাক ছিল। এর অবশ্যি কারণ আছে; রাশেদার বাবা একজন ধনাট্য কাপড় ব্যবসায়ী ছিলেন। স্থানীয় পর্যায়ে তাদের দোকান ছিল সবার চেয়ে বড় এবং তিনি সব সময় বাজার পরিচালনা কমিটির সভাপতি ছিলেন। এ নিয়ে তার বাবার সাথে কিছু মানুষের দ্বন্দ ছিল।
রাশিদার সাথে মহব্বত করার জন্য এলাকার উঠতি বয়সে পোলাইনের লাইন লেগে থাকত। সর্বশেষ সফিক ভাই এ খাতায় নাম লিখালেন। তার সিরিয়াল-১৩২। তাদের বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব আসে ভুরি ভুরি। রাশেদা বাবার এক মাত্র আদরের মেয়ে, লেখা পড়ায় ভালো হওয়ার কারণে এ বয়সে তার পরিবার তাকে বিয়ে দিতে রাজি ছিলনা। কিন্তু প্রবাসী এবং নব্য চাকুরিজীবী গোছের পাত্ররা হাল ছাড়তে নারাজ। বর্তমানে বিয়ের বাজারে রাশেদার দাম অনেক উঁচুতে অবস্থান করছে।
রাশেদার সাথে আমার খুব খাতির জমে ছিল। রাশেদা যখন দশম শ্রেণিতে পড়ে আমি তখন ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ি। তাদের বাড়ি আমাদের বাড়ির নিকটে হওয়ার কারণে খাতির জমাতে অতিরিক্ত সাহায্য করেছে। রাশেদার সাথে আমার এ খাতির অনেকের চোখে ঈর্ষা লাগত। কিন্তু রাশেদার পরিবারের কাছে এটা স্বাভাবিক ছিল। আমরা এক সাথে স্কুলে আসা যাওয়া করতাম। মাঝে মাঝে অংক না বুঝলে তার কাছে অংকের সমাধান নিয়ে আসতাম। বিকাল বেলা পুকুর পাড়ে এদিক সেদিক ঘুরে বেড়াতাম। রাশেদা মাঝে মাঝে দুষ্টুমি করে আমাকে বলত; তুই আমার নায়ক, আমি তোর নায়িকা… বলে হেসে উঠত। আমি লজ্জায় মুখ লুকাইতাম।
রাশেদার প্রেমিক পুরুষদের সাথে ইদানিং আরেকটি অতিরিক্ত জ্বালা যন্ত্রণা যোগ হইছে। এলাকার বখাটেরা রাস্তাঘাটে তাকে সময়ে অসময়ে বিরুক্ত করে। চিকন সূরে শিস বাজায়, চিঠি, নানা প্রকার উপহার সামগ্রী সাধেন। প্রথম অবস্থায় আমরা খুব ভড়কে গিয়েছিলাম। বখাটেদের ভয়ে পরিবার কে কোন কিছু বলতে পারিনি । তারা আমাকে দেখলে মজা নিয়ে বলত, দেখ দেখ নাযক যায়; ল. সাইজ করি, শালার মাইয়্যা, দেশে এত পোলা থাকতে এই পিচ্চি কে নায়ক বানাইছে…। আমি তাদের কথাবার্তা শুনে ভয় পেতাম, অবাক হতাম কিঞ্চিত, রাশেদার আমার নায়ক হয় কিভাবে! তবে, সেই সময় আমার নায়ক হতে খুব ইচ্ছা করত। কল্পনায় রাশেদা আপুর ভিলেনদের মেরে ফাঁটিয়ে দিতাম। কিন্ত কিছুক্ষণ পর নিজেকে পিচ্চি হিসেবে আবিস্কার করেছি। একদিন পাড়ার বখাটে রিপন রাশেদা খুবই অশালীন অঙ্গ ভঙ্গি করে, তার সাথে খুবই বাজে কথা বলেছে। এ আচরণে রাশেদা আপুকে বিচলিত হতে দেখেছি। শেষ পর্যন্ত তার বাবার নিকট সব কিছু খুলে বলেছেন। তার বাবা ক্ষিপ্ত হয়ে রিপন কে ধরে এনে গাছে বেঁধে পিটিয়েছে। রিপন তেইশ তিন হাসপাতালে ছিল।
এ ঘটনার পর রাশেদার বাবা জহির সাহেব মেয়ে কে নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েন। শেষ পর্যন্ত ঢাকায় এনে মেয়েকে স্কুলে ভর্তি করে দেন। রাশেদা মামার বাসায় থেকে লেখাপড়া করবে। রাশেদা চলে যাওয়াতে আমি খুব নি:সঙ্গতা অনুভব করি। রাশেদা মনে অনেক কষ্ট পেয়েছে। হঠাৎ পরিবার, স্কুল, বন্ধু-বান্ধব ছাড়ার যে বিরহ বিচ্ছেদ ঘটে তা সেদিন তার চোখে মুখে ফুটে উঠেছিল।
রাশেদার সাথে প্রায় ছয় মাস হয়েছে দেখা সাক্ষাত, কথা বার্তা নাই। তার সাথে কল্পনায় কথা বলতাম। সেদিন শুনতে পেলাম রাশেদা গ্রীষ্মের ছুটতে বাড়িতে আসছে। খবর শুনে খুবই উৎফুল্লা হয়েছি, পুকুর পাড়ে আবার ঘুরাঘুরি হবে, সাপ-লুডু খেলা জমবে; খরখোসের বাচ্ছা নিয়ে দৌড়ঝাপ করব।
রাশেদা বাড়ি এসেছে। তার ঘনিষ্ঠ জনেরা সবাই তার সাথে দেখা করতে এসেছে; এ তালিকায় আমি বাদ যাব কেন? শহরে যাওয়ার ফলে তার চেহারায় মেম লুক এসেছে। কথা বার্তায় পরিবর্তন এসেছে অল্প স্বল্প। আমার দর্শণে সে খুবই উৎফুল্ল। তার সাথে দীর্ঘক্ষণ এটা সেটা নিয়ে কথা বার্তা হলো। শহরে স্কুলের স্যারদের রাগ কেমন? দেরি করলে কেমন পিটুনি দেয়, স্কুলের মাঠে সাইকেল চালানো যায় কিনা ইত্যাদি ইত্যাদি।
রাশেদা আপু এসেছে; স্কুল ছুটি দিয়েছে কয়েক দিন। আপু বলেছে, এবার তার মামার বাড়িতে আমাকে বেড়াতে নিয়ে যাবে। তার মামার বাড়ি মেঘনার উপারে। মামা বাড়িতে আমার বয়সি অনেক পোলাপাইন আছে। তারা নাকি অনেক দুষ্টুমি করে। সেখানে গিয়ে ইচ্ছামত দুষ্টুমি করব; ভাবতে ভাবতে রাতে ঘুমিয়ে গেলাম।
রাত তিনটা বেঁজেছে। চিৎকার শোরগোলে ঘুম ভেঙ্গে গেল। এলাকায় ডাকাত পড়েছে। আওয়াজ রাশেদা আপুদের বাড়ি থেকে আসছে। সবাই দৌড়িয়ে সেদিকে যাচ্ছে। আমিও গেলাম। সেখানে গিয়ে যা দেখলাম চোখে বিশ্বাস করার মত নয়। রাশেদার বাবার রক্তাক্ত দেহ পড়ে আছে। রাশেদা এবং তার মা হাত পা বাধা অবস্থায় মেঝেতে শুয়ে কাতরাচ্ছে। তাদের শরীর এবং পোশাকের মধ্যে অসামঞ্জস্যতা বিরাজ করছে। গ্রামের লোকজন গাড়িতে করে থানায় নিয়ে যাচ্ছে মামলা এবং চিকিৎসা করার জন্য।
পর দিন স্থানীয় পত্রিকায় তাদের নিয়ে ভয়ংকর এবং লোহমর্ষক কাহিনী ছাপায়। লোক মুখে এবং খবরে জানা যায়, একদল ডাকাত এসে রাশেদাদের বাড়িতে প্রবেশ করে অস্ত্রের মুখে সবাই কে জিম্মি করে। রাশেদার বাবা প্রতিবাদ করতে গেলে হাত এবং মুখ বেঁধে কুপিয়ে রক্তাক্ত করে। তারপর রাশেদা এবং তার মায়ের উপর পাশবিক নির্যাতন চালায়।
রাশেদার বাবা জহির সাহেব জমের সাথে তিনদিন পর্যন্ত লড়ে অসহায়ভাবে আত্মসর্ম্পণ করে পরপারে চলে গেছেন। রাশেদা এবং তার মা হাসপাতালে ভর্তি। এ ঘটনায় এলাকায় শোকের ছায়া এবং আতঙ্ক বিরাজ করেছে। বখাটে রিপন, তাদের দীর্ঘ দিনের রাজনৈতিক- ব্যবসায়ী প্রতিদ্বন্দী এবং দশ থেকে বারোজন অজ্ঞাতনামা দেখিয়ে থানায় মামলা দায়ের করা হয়।
ঘটনার তিন মাস অতিক্রান্ত হলেও মামলার প্রধান আসামী রিপন এখনো ধরে পড়েনি। অন্যান্য আসামীদের থেকে অব্যাহত হুমকি ধুমকি আসছে নিয়মিত। ফলে রাশেদাদের পরিবার চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। তাদের ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান অনেক দিন ধরে বন্ধ রয়েছে। ব্যাংকের পাওনাদার এবং অন্যান্যা ব্যবসা সংক্রান্ত লোকজন বাড়িতে নিয়মিত হাজির হচ্ছেন। উপায় না দেখে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বিক্রি করে সকলের সাথে ঝামেলা মিটানো হয়েছে। নিরাপত্তাহীনতার কারণে রাশেদার মামা এসে তাদের কে এখান থেকে নিয়ে গেছেন।
এর পর রাশেদা এবং তার পরিবারের সাথে আর কোন দিন দেখা সাক্ষাত হয়নি। তাদের বাড়ি ঘরে ভূতুরে পরিবেশ বিরাজ করছে। রাত্রের বেলা অনেকে রাশেদার বাবাকে চলাফেরা করতে দেখতেন, তিনি নাকি বোবা কান্না করে রাশেদা এবং রাশেদার মায়েকে বাঁচানোর আকুতি জানিয়ে থাকেন। ফলে অনেকে সেদিকে পা মাড়ান না। এখন তাদের বাড়ি ঘর ভগ্নাংশে পরিণত হয়েছে। সেখানে শিয়াল বেঁজির বসবাস করে বংশ বিস্তার করেছে।
এখন শুধু জানতে ইচ্ছে করছে রাশেদার পরিবার কেমন আছে।
-----_---------
স্কেচ: মুই
মাধ্যম: কলম
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে আগস্ট, ২০১৭ বিকাল ৪:৩৭