বাংলাদেশের কোন কোন জেলায় ঈদুল ফিতর ও আযহা উদযাপন হয় এক দিন আগে ও পরে। বেশ কয়েক বছর ধরেই শুরু হওয়া বিষয়টি এখন মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়ছে প্রত্যন্ত গ্রামগুলোতে, এমন কি সম্ভবত ছোঁয়াচে ব্যাধির মত খোদ রাজধানী ঢাকা শহরের দু একটি এলাকায় শাওয়াল মাসের এক তারিখ ঈদ উদযাপন না করে রমজান মাসের ২৯ বা ত্রিশ তারিখেই ওরা সকাল বেলা ঈদের নামাজ পড়ে হাস্যকর ভাবে কোলাকুলি শুরু করে দেয় । ওরা ঈদের নামাজ পড়ে বাড়ীতে এস দেখে বাড়ীর অন্য কোন সদস্য হয়তো ত্রিশ তম রোজা পালন করছে । বিষয়টি হচ্ছে সৌদি আরবের সঙ্গে মিল রেখে রোজা শুরু করা এবং রোজা শেষে সৌদি আরবের সঙ্গে মিল রেখে ঈদ উদযাপন না করলে ওদের মতে কোন কিছুই শুদ্ধ হবেনা । বাংলাদেশের মানুষের ধর্মপ্রাণ হবার সুযোগটি কাজে লাগিয়ে এক শ্রেণীর পীর নামধারি ধর্ম ব্যবসায়ি গোষ্ঠী মুসলমানদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব ঈদুল ফিতর এবং ঈদুল আযহা পালন করাকে বিতর্কিত রুপ দিচ্ছে ।
সৌদি আরবে সাথে মিল রেখে এবারও ঈদ উদযাপিত হবে - দক্ষিন চট্টগ্রামের ৭টি উপজেলার ৩০ টি গ্রাম। পটুয়াখালির ২২টি গ্রামের ৫০০ এর অধিক পরিবার এবং শরিয়ত পুরের ডামুড্যা উপজেলার অধিকাংশ গ্রামে ঈদ উদযাপন করবে। । চাঁদপুর জেলার হাজিগঞ্জ সহ চারটি উপজেলার মট ৪০ টি গ্রামে র ঈদ উদযাপনের প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে । ফরিদপুর জেলার ভাংঙ্গা থানায়ও কয়েকটি গ্রামে ঈদ উদযাপন করা হয় সৌদি আরবের সাথে মিল রেখে। এর বাইরেও দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের পীর-আক্রান্ত অনেক এলাকার শত শত পরিবার সৌদি আরবের সঙ্গে মিল রেখে ঈদ উদযাপন করবে ।
বছরে দুই ঈদে ৪ দিন পালন নিয়ে সাধারণ মানুষের প্রশ্ন,
(১) সৌদি আরবে ইফতার হয় আমাদের দেশে যখন রাত ১০টা । সৌদি আরবের সঙ্গে মিল রেখে ঈদ উদযাপনকারীরা রাত ১০টায় ইফতার করেন না কেন? মাগরিব নামাজ কেন রাত ১০টায় পড়েন না ?
(২) সৌদি আরবে ফজরের ওয়াক্ত হয় তখন, যখন আমাদের দেশে সকাল ৮টা , তাহলে সকাল ৮টায় ফজর নামাজ আদায় করা হয় না কেন? ?
(৩) আমাদের দেশে যখন সকাল ৭টা বাজে তখন সৌদি আরবের সেহেরির সময়, তাহলে কি আমরা সকাল ৭টায় সেহেরি কবর?
কেন নিজ নিজ দেশে চাঁদ দেখে ঈদ করবেন:
# হাজার বছর আগে কিছু সাহাবী এবং তাবেয়ীন ভারতে এসেছেন। তারা চাইলেও চাঁদ আরবে দেখা গিয়েছে কিনা তা জানতে পারেনি। তাই তারা ভারতেই চাঁদ দেখেই ঈদ করেছেন এটা নিচ্চিত।
# রাসূলের সময় অনেক সাহাবা চীন দেশে এসেছিলেন ইসলাম প্রচার করতে। তখন তারা চীনের সময়ের উপর নির্ভর করে রোজা ও ঈদ পালন করতেন। (চীনের মাটিতে আজও সাহাবী আবি আক্কাস (রা: ) এর কবর বিদ্যামান আছে) কারণ সেই সময় চীনে বসে খবর নেওয়া সম্ভব ছিল না, আজ সৌদির আকাশে চাঁদ উঠেছে কাল ঈদ। এ খবর চীন আসতে কয়েক মাস লেগে যেত তাহলে দুই ঈদ একসাথে পালন করতে হতো। যা কখনও সম্ভব নয়।
এখন সাহাবাদের সমস্যা না হলে আমাদের সমস্যা কোথায়?
এবং রাসূল সাঃ ঐ সময় জীবিত ছিলেন। তাহলে উপরের ঘটনা রাসূল কর্তৃক রেটিফাই কৃত।
# বাংলাদেশে যারা ইসলাম প্রচার করেছেন তারা এদেশে চাঁদ দেখে রোজা, ঈদ পালন করেছেন।সকল মুসলমান এই নিয়ম পালন করেছেন। তাই তারা একসাথে সকলেই ভুল ছিলেন, এটা ভাবা বোকামী। যেমন- শাহাজালাল রাঃ, শাহা পরান রাঃ, নাসীর উদ্দোন রাঃ, কুতুবুল আউলিয়া ইত্যাদি।
সাধারণত মুসলিম বিশ্বে চাঁদ দেখেই ঈদ করে। সে হিসাবে এটাও একটা দলিল এবং রেওয়াজ, এবং সাধারণ দলিলের চেয়ে দলিলগত শুদ্ধতার বিচাররে এটা বড় রকমের দলিল। কারণ এই দলিল নিয়ে বিভ্রান্তি ছড়ানোর কোন সুযোগ নেই।
রোজা, ঈদ এবং চাঁদ সম্পর্কে কোরআন ও হাদীস কি বলেঃ
“রমযান মাসই হল সে মাস, যাতে নাযিল করা হয়েছে কোরআন, যা মানুষের জন্য হেদায়েত এবং সত্যপথ যাত্রীদের জন্য সুষ্পষ্ট পথ নির্দেশ আর ন্যায় ও অন্যায়ের মাঝে পার্থক্য বিধানকারী। কাজেই তোমাদের মধ্যে যে লোক এ মাসটি পাবে, সে এ মাসের রোযা রাখবে। আর যে লোক অসুস্থ কিংবা মুসাফির অবস্থায় থাকবে সে অন্য দিনে গণনা পূরণ করবে। আল্লাহ তোমাদের জন্য সহজ করতে চান; তোমাদের জন্য জটিলতা কামনা করেন না যাতে তোমরা গণনা পূরণ কর”"
[বাকারা আয়াত ১৮৫]
অর্থাৎ, ২৯ শাবান চাঁদ দেখেই রমজানের রোজা শুরু করতে হবে। ওই দিন চাঁদ দেখা না গেলে শাবান মাসকে ৩০ দিন পূর্ণ করতে হবে। হাদিস, কোরআন ও ফেকাহ’র কিতাবগুলোতে কোথাও এ কথা বলা হয়নি যে, সৌদি আরবে চাঁদ উঠলেই বাংলাদেশে রোজা ফরজ হয়ে যাবে। স্মরণ রাখতে হবে, চান্দ্র মাস ২৯ ও ৩০ দিনে হয়, ২৮ বা ৩১ দিনে হয় না। বাংলাদেশের আকাশে ২৯ শাবান বা ৩০ শাবান রমজানের চাঁদ দেখা গেলে রমজানের রোজা ফরজ হয়।
এছাড়াও কোরআনে বলা হয়েছে,
• “‘লোকেরা তোমাকে জিজ্ঞেস করছে নবচন্দ্র সমূহের ব্যাপারে। বলে দাও যে, এটি মানুষের জন্য সময় সমূহের নিরূপক ও হজ্জের জন্য সময় নির্দেশক’ ”[সূরা বাকারা আয়াত ১৮৯]
এখানে ‘নতুন চাঁদ’ না বলে ‘নতুন চাঁদ সমূহ’ বলার কারণ হ’ল এই যে, সদা সন্তরণশীল চাঁদ প্রতি মিনিটে ও সেকেন্ডে পৃথিবীর নতুন নতুন জনপদে নতুনভাবে উদিত হয়। ফলে এক চাঁদ বহু নতুন চাঁদে পরিণত হয়। এর সাথে মিল রেখেই বলা হয়েছে‘মানুষের জন্য সময় সমূহের নিরূপক’ এর একবচন অর্থ ‘সময়’ বা ‘সময় নিরূপক’। বহুবচন আনার কারণ এই যে, চাঁদ যে অঞ্চলে ওঠে, সে অঞ্চলের সময় আগের অঞ্চল থেকে পৃথক। ফলে চাঁদ যত অঞ্চলে যখনই উদয় হবে, তত অঞ্চলে তখনই তার উদয়ের সময়কাল হিসাবে গণ্য হয়।
তোমরা (রমজানের) চাঁদ দেখে রোজা শুরু করবে এবং (ঈদের) চাঁদ দেখেই রোজা ছাড়বে। যদি আকাশ মেঘাচ্ছন্ন হয় (এবং চাঁদ দেখা না যায়) তাহলে মাসের ৩০ দিন পূর্ণ করে। অর্থাত্ আকাশ পরিচ্ছন্ন না থাকার কারণে চাঁদ দেখা না গেলে শাবান মাসের ৩০ দিন পূর্ণ করত রমজানের রোজা রাখা শুরু করবে।—সহিহ বুখারি ১/২৫৬, হাদিস : ১৯০৬
ছোট বেলায় এরকম চাঁদ দেখার মজার স্মৃতি অনেকেরই আছে।
অনেকে পলিটিক্যাল এনটিটি এবং আধুনিক তথ্য প্রযুক্তির কথা বলতে পারেন। তাদের জ্ঞাতার্থে:
সৌদি থেকে যারা +৩/৪ ঘন্টা থেকে +৬/৭ ঘন্টা দূরে তাদের সৌদি আরবের চাঁদের খবর বা সাক্ষ্য পাবার জন্য রাত ১২ টা থেকে ভোর ৪টা/৫টা পর্যন্তও জেগে থাকতে হতে পারে। চাঁদ দেখার সাক্ষ্য বা খবর পাবার জন্য এভাবে জেগে থাকার কোন দলীল পাওয়া যাবে কি? আর যদি তারা তাদের বিতরের নামায না পড়ে তারাবীহের পরে পড়বে ভেবে জেগে না থেকে ঘুমিয়ে পরে এবং সৌদিতে চাঁদ না ওঠায় তাদের কাছে কেউ চাঁদ দেখার খবর না পৌঁছায় তাহলে তাদের বিতরের নামাযের সাথে সাথে ফযরের নামাযও ছুটে যাবার আশঙ্কা থাকে। আর যাদের কাছে চাঁদ দেখার খবর সেহেরীর শেষ সময়ের এক/আধ ঘন্টা আগে পৌঁছবে, তারা তারাবীহ পড়বে না সেহেরী খাবার প্রস্তুতি নেবে এ নিয়ে বিশৃঙ্খলা দেখা দিতে পারে।
ধরা যাক,
জাপানের কোন মুসলিম সৌদির রাত ৯ টার চাঁদের খবর গ্রহন করার জন্য তাদের সময়ের রাত ৩টা পর্যন্ত জেগে থাকলো। (জাপানের সাথে সৌদির সময়ের পার্থক্য +৬ ঘন্টা) কিন্তু কোন কারনে সেদিন সৌদিতে চাঁদ দেখা গেলনা, এই খবর সে রাত ৩টা জানতে পেরে তার বিতরের নামায পড়ে ঘুমাতে গেল। এ অবস্থায় তার ফযরের নামায কাযা হবার ব্যপক আশংকা থেকে যাবে। আর পরবর্তী দিন যদি তার অফিস থাকে তাহলে সেখানেও তার দেরীতে পৌঁছা ও কর্মদক্ষতা কমে যাবার আশংকা থেকে যায়।
যেসব দেশের মুসলিমদের চাঁদের খবরের জন্য রাত ৩টা/৪টা কিংবা ভোর ৫টা পর্যন্ত জেগে থাকতে হবে তারা কি এই সময় পর্যন্ত জেগে থাকবে নাকি ঘুমিয়ে পরবে? যদি ঘুমিয়ে পড়তে বলা হয় তাহলে তারা চাঁদ দেখার খবর বা সাক্ষ্য কখন, কিভাবে গ্রহন করবে?
বি:দ্র:
আন্তর্জাতিক তারিখ রেখা একটি কৃত্রিম/ইসলাম পরববর্তী সময়ে আবিস্কৃত। দেখা যায় যদি সারা পৃথিবীতে সূর্যের হিসাবে একই সাথে ঈদ করে, তাহলে যখন হাওয়াইয়ের মানুষ যে দিন ঈদ করছে, ফিজির মানুষ তার আগের দিন ঈদ করবে। কারণ, হাওয়াইয়ে যখন সোমবার, ফিজিতে তখন মংগলবার। তাইলে একসাথে ঈদ কিভাবে সম্ভব ? হাওয়ায়ের আকাশে যে সূর্য একই সূর্য একই সময় ফিজিতে কিন্তু ফিজি একদিন আগে নিজেদের ধরে আর হাওয়াই একদিন পরে ধরে। চন্দ্র হিসাব করলেও অনুরুপ হবে।
আসলে নবী করীম (স: ) এর সময় ইসলাম শুধু আরবেই প্রতিষ্ঠিত ছিল। তখন আরবের এক জায়গায় চাঁদ দেখা গেলে অন্য যায়গায় ঈদ পালন করা হত। কিন্তু চার খলিফার আমলে ইসলাম বহি:বিশ্ব জয় করতে থাকে তখন ইসলাম একটি আর্ন্তজার্তিক ধর্ম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয় আর তখন প্রয়োজন পড়ে নতুন নতুন মাসয়ালা ও কর্মপন্থা। সেই লক্ষে চার ঈমাম বিভিন্ন দৃষ্টি কোন থেকে বিভিন্ন উত্তর দিয়েছেন কিন্তু তাদের উৎস ছিল কোরআন ও হাদীস।
যারা সৌদি আরবের সাথে মিল রেখে ঈদ পালন করেন তারা বেশির ভাগ পীর ব্যাবসায়ীর অনুসারী। বিষয়ট হয়ত আপনারা হয়ত খেয়াল করেছেন। তারা এমনটি করেছে নিজ মুরিদ কে সাধারণ মুসলমানদের থেকে আলাদা বুঝানোর জন্য। নিজের বুজুরগি জাহির করার জন্য। আশা করি বিষয়টি এতক্ষণে বুঝতে পেরেছেন।
এই ফ্যাসাদ সৃষ্টিকারীরা যদি ফিনল্যান্ড নরওয়ের মতো দেশে থাইকা ২২ ঘণ্টা রোজা পালন করত তাহলে ঠিকই লাইনে আসতো। সুখে আছে ত’ তাই ভূতে কিলায়।
এখন প্রশ্ন আসতে পারে,
পলিটিকাল এনটিটি অনুযায়ী নানা ভাগে বিভক্ত হয়ে ঈদ পালন করবো, না কি ধর্মীয় কেন্দ্র অনুযায়ী সমগ্র মুসলিম জাহান একই সময়ে ঈদ পালন করবো?
পৃথিবী যেহেতু ঘূর্ণনশীল তাই নির্দিষ্ট সময়ে অর্থাৎ একই দিন রোজা রাখ এবং ঈদ পালন করা সম্ভব নয়। আর রোজা এবং ঈদ পালন করার জন্য নিয়ত, প্রস্তুতির বিষয় জড়িয়ে আছে তাই এক্ষেত্রে দিন/তারিখ/সময় নির্দিষ্ট করে দিলে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হবে এবং ধর্মীয় মূল ভাবগম্ভীর্য থেকে সরে আসবে।
তাই আপনি যে দেশে আছেন সে দেশের নিয়ম/চাঁদ দেখে রোজা এবং ঈদ পালন করুন। এটাই আপনার জন্য কুরআন এবং হাদিসের বিধান।
## কিছু তথ্য অনলাইন থেকে পেয়ে উপকৃত হয়েছি। তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা। এবং এটা আমার ব্যক্তিগত অভিমত, ফতোয়া হিসেবে পালনের বাধ্যবাধকতা নেই।
ছবি: নেট থেকে।
সামহোয়্যার ব্লগের পক্ষ থেকে সকল কে অগ্রিম ঈদ মোবারক।
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে জুন, ২০১৭ বিকাল ৫:৩৩