ব্লগে অনেকে বলে থাকেন যে ধর্ম বা সৃষ্টিকর্তায় বিশ্বাস করলে বিজ্ঞানচর্চা বৃথা। তারা বলতে চান যে আস্তিক মানুষের মন মানসিকতা বিজ্ঞানচর্চার অনুকুল না। তারা বিজ্ঞানে ভালো করতে পারেন না তাদের ধর্মীয় বিশ্বাসের কারণে। কিন্তু আমরা যদি পৃথিবীর বিজ্ঞানীদের ধর্ম বিশ্বাস বিশ্লেষণ করি তাহলে দেখব যে এখনও অন্তত ৫০% বিজ্ঞানী সৃষ্টিকর্তায় বিশ্বাস করেন। আসলে বিজ্ঞানী বলে কথা না, বর্তমান যুগে সাধারণ মানুষও অধিক মাত্রায় নাস্তিকতার দিকে যাচ্ছে। বিজ্ঞানীদের নাস্তিকতাও আগের চেয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে। উভয় ক্ষেত্রেই এটার কারণ হিসাবে শুধু বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রাকে দায়ী করা যাবে না। আরও অনেক কারণ আছে।
বিজ্ঞান চর্চা ও ধর্ম চর্চা দুইটাই যে একসাথে করা যায় এটা প্রমান করার জন্য আমি এই পোস্টে বিশ্বের কয়েকজন বিখ্যাত বিজ্ঞানীকে নিয়ে আলোচনা করেছি যারা একই সাথে বিজ্ঞান ও ধর্ম চর্চা করেছেন।
১। ফ্রান্সিস কলিন্স ( ১৯৫০- এখনও জীবিত)
একজন অ্যামেরিকান জীনতত্ত্ব বিশেষজ্ঞ এবং ডাক্তার। তিনি অনেক রোগের সাথে সংশ্লিষ্ট জীন আবিষ্কার করেছেন এবং যুক্তরাষ্ট্রের হিউম্যান জেনম প্রজেক্টের প্রধান ছিলেন। বর্তমানে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের National Institute of Health (NIH) এর ডাইরেক্টর। উনি জিন শিকারি হিসাবে বিখ্যাত। তিনি প্রেসিডেন্ট মেডাল অব ফ্রিডম এবং ন্যাশনাল মেডাল অব সাইন্স পদক পেয়েছেন। তিনি বিজ্ঞান, চিকিৎসাশাস্ত্র ও ধর্মের উপর অনেক বই লিখেছেন। তার একটা বিখ্যাত নিউইয়র্ক টাইম বেস্ট সেলার বইয়ের নাম হোল The Language of God: A Scientist Presents Evidence of Belief। ভ্যাটিকান সিটির বিজ্ঞান একাডেমীর তিনি একজন সদস্য। তিনি ধর্ম এবং বিজ্ঞানের মধ্যে সেতুবন্ধনে বিশ্বাসী।
স্কুলে পড়ার সময় তিনি একজন নাস্তিক ছিলেন। হাসপাতালের একজন রোগীর অনুপ্রেরনায় তিনি ধর্ম নিয়ে চিন্তা শুরু করেন। তিনি বিভিন্ন ধর্ম এবং সৃষ্টিতত্ত্ব নিয়ে পড়াশুনা শুরু করেন এবং অবশেষে খৃস্টধর্মে বিশ্বাস স্থাপন করেন। তিনি বিশ্বাস করেন যে মানুষ শুধু যুক্তি ও তর্ক- বিতর্কের দ্বারা ধর্মের দিকে ঝুকতে পারে না বরং তার জন্য প্রয়োজন বিশ্বাস। তিনি নিজেকে একজন নিষ্ঠাবান খ্রিস্টান মনে করেন। তিনি তার বই The Language of God: A Scientist Presents Evidence of Belief বইয়ে বলেন যে বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারগুলি মানুষের জন্য প্রার্থনার সুযোগ তৈরি করে দেয়। তিনি মনে করেন যে শরীরের ডিএনএ হোল একটা নির্দেশনাপত্র অথবা একটা সফটওয়্যার যা কোষের নিউক্লিয়াসে অবস্থিত। এই বই লেখার উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলেন যে অধিকাংশ মানুষ ধর্ম এবং বিজ্ঞানের মধ্যে একটা সমন্বয় খোঁজে কিন্তু এই সমন্বয়ের সমর্থনে আলোচনা কম হয়। এই বইয়ে তিনি সমন্বয়ের চেষ্টা করেছেন।
২। ওয়ারনার হেইজেনবার্গ ( ১৯০১- ১৯৭৬)
একজন জার্মান পদার্থ বিজ্ঞানী, কোয়ান্টাম বলবিদ্যায় যার উল্লেখযোগ্য অবদান আছে। ১৯৩২ সালে কোয়ান্টাম বলবিদ্যার উপর গুরুত্বপূর্ণ ও সফল গবেষণার জন্য পদার্থবিদ্যায় নোবেল পুরস্কার পান। হেইজেনবার্গ একজন সর্বজন স্বীকৃত এবং প্রভাবশালী বিজ্ঞানী যিনি নিউক্লিয়ার পদার্থবিদ্যা, কণা পদার্থবিদ্যা এবং কোয়ান্টাম ফিল্ড থিউরিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। কোয়ান্টাম বলবিদ্যার সূচনাপর্বে ওনার গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা ছিল।
হেইজেনবার্গ একজন নিবেদিতপ্রাণ খৃস্টান ছিলেন। আলবার্ট আইনস্টাইনকে লেখা তার শেষ চিঠিতে হেইজেনবার্গ লেখেন যে “ আমরা সান্ত্বনা পেতে পারি এই কারণে যে, প্রভু ঈশ্বর সাব-এটমিক কণাগুলির অবস্থান জানেন, যার মাধ্যমে ঈশ্বর Causality Principle (যে নীতি অনুসারে প্রত্যেক ঘটনার অবশ্যই একটা কারণ আছে) এর গ্রহণযোগ্যতা নিশ্চিত করবেন”।
৩। আরনেস্ট ওয়ালটন ( ১৯০৩ – ১৯৯৫)
উনি একজন আইরিশ পদার্থবিজ্ঞানী যিনি ১৯৫১ সালে নিউক্লিয়ার পদার্থবিজ্ঞানে যৌথভাবে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। উনি সর্ব প্রথম ‘High energy’ particle accelerator তৈরি করেন। এই আবিষ্কার আইনস্টাইনের E = mc^ সুত্রের ভর ও শক্তির সাম্যকে (Equivalence) সমর্থন করেছে। ওয়ালটন একজন নিবেদিতপ্রাণ মেথডিস্ট খৃস্টান ছিলেন।
৪। স্যার রোনালড ফিশার (১৮৯০ – ১৯৬২)
একজন ব্রিটিশ পরিসংখ্যানবিদ, জীনতত্ত্ব গবেষক এবং শিক্ষাবিদ। ওনাকে একজন প্রতিভা হিসাবে গণ্য করা হয় যিনি বলতে গেলে একাই আধুনিক পরিসংখ্যানবিদ্যার ভিত্তি নির্মাণ করেছেন। তিনি গানিতিক মডেল ব্যবহার করে ম্যানডেলিয়ান জীনেটিক্স এবং ডারউইনের ন্যাচারাল সিলেকশনের মধ্যে সমন্বয় করেন। ফলশ্রুতিতে বিংশ শতাব্দিতে ডারউইনের বিবর্তনবাদের পুনরুজ্জীবন ঘটে এবং আধুনিক সিনথেসিসের জন্ম হয়। পপুলেশন জীনেটিক্সের তিনি অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। তিনি ব্রিটিশ রয়াল সোসাইটির ( বিজ্ঞান চর্চার একটি কেন্দ্র যা বিশ্বের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ছিল) সদস্য ছিলেন এবং ১৯৫২ সালে রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ তাকে নাইট খেতাব প্রদান করেন।
তিনি একজন নিবেদিতপ্রান অ্যাংগলিকান খ্রিস্টান ছিলেন এবং চার্চের জন্য প্রবন্ধ লিখতেন।
৫। জর্জ লেমাইত্রি (১৮৯৪- ১৯৬৬)
তিনি একজন বেলজিয়ান ক্যাথলিক ধর্মযাজক, গণিতবিদ, জ্যোতির্বিদ এবং ক্যাথলিক ইউনিভারসিটি অফ লভেনের পদার্থবিজ্ঞানের প্রফেসর ছিলেন। ১৯২৭ সালে আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতার সুত্র নিয়ে কাজ করতে গিয়ে মহাবিশ্বের সম্প্রসারণের ধারণা উনিই প্রথম প্রকাশ করেন যা পরবর্তীতে এডউইন হাবল নিশ্চিত করেন। ফলে তার এবং হাবলের নামে ‘হাবল-লেমাইত্রি ল’ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যা মহাবিশ্ব সম্প্রসারণের কারণ ও প্রকৃতি ব্যাখ্যা করে। জর্জ লেমাইত্রি প্রথম বিগ ব্যাং থিউরিরও ধারণা দেন। ১৯৩৪ সালে তিনি ফ্রাঙ্কুইজ পুরস্কারে ভূষিত হন যা বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে বেলজিয়ামের সর্বশ্রেষ্ঠ পুরস্কার।
৬। চার্লস হার্ড টওনেস (১৯১৫-২০১৫)
একজন অ্যামেরিকান পদার্থবিজ্ঞানী। তিনি ও তার সহকর্মীরা ১৯৫৩ সালে Maser নামক একটি যন্ত্র আবিষ্কার করেন যার সাহায্যে ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক তরঙ্গ সৃষ্টি করা যায়। ১৯৬৪ সালে তিনি যৌথভাবে পদার্থ বিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পান। তিনি ১৯৪৫ সালে থেকে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টা ছিলেন। ফলে প্রেসিডেন্ট ট্রু ম্যান থেকে শুরু করে বিল ক্লিনটন পর্যন্ত সকল ইউ এস প্রেসিডেন্টের সাথে ওনার পরিচয় ছিল। চাঁদে প্রথম মানুষের পদার্পণ হয় অ্যাপলো লুনার প্রোগ্রামের মাধ্যমে। উনি এই প্রোগ্রামের জন্য গঠিত রাষ্ট্রীয় কমিটির ডাইরেক্টর ছিলেন। আমাদের মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির কেন্দ্রে অবস্থিত ব্ল্যাক হোল উনিই প্রথম আবিষ্কার করেন।
চার্লস হার্ড টওনেস একজন ধার্মিক খ্রিস্টান ছিলেন। উনি মনে করতেন যে বিজ্ঞান ও ধর্ম, মহাবিশ্বের প্রকৃতি ও উদ্দেশ্য জানার ক্ষেত্রে এক বিন্দুতে মিলিত হয়ে কাজ করছে। তিনি ইউনাইটেড চার্চ অব ক্রাইস্টের সদস্য ছিলেন। তিনি বলেন “ বিজ্ঞান এবং ধর্ম অনেকটাই সমান্তরালভাবে চলছে এবং অনেক মিল এই দুইয়ের মধ্যে আছে যদিও অধিকাংশ মানুষ এই ব্যাপারে বিপরীত মত পোষণ করে। একসময় বিজ্ঞান ও ধর্ম এক বিন্দুতে মিলিত হবে।“
বারকেলির প্রফেসর রেইনহার্ড গেনজেল ওনার সম্পর্কে বলেন “ ওনার শক্তি ছিল ওনার অনুসন্ধিৎসা এবং দৃঢ় আশা যার ভিত্তি ছিল খ্রিস্টবাদে ওনার গভীর আধ্যাত্মিকতা।“
সারাংশ হোল যে ধর্ম পালন করে এবং সৃষ্টিকর্তায় বিশ্বাস করেও বিজ্ঞানচর্চা করা যায় যা উপরের বিজ্ঞানীরা তাদের কর্মের মাধ্যমে দেখিয়ে গেছেন। মুসলমানরা বিভিন্ন কারণে বিজ্ঞানে পিছিয়ে এটা আমরা সবাই জানি। তারপরও অনেক মুসলমান বিজ্ঞানী আছেন এবং অনেকে নোবেল পুরস্কারও পেয়েছেন। এই ব্যাপারে আলাদা পোস্ট দেয়ার ইচ্ছা আছে।
সুত্র -
Werner Heisenberg
ফ্রান্সিস কলিন্স - উইকিপিডিয়া
Ronald Fisher
Georges Lemaître
Charles H. Townes
Ernest Walton
ছবি- huffpost.com