এক -
সমান্তরাল লাইন দুটির একটিতে ভারসাম্য রেখে হেঁটে যাওয়ার অবিরত চেষ্টা করে যাচ্ছে পার্থ। খানিকটা এগোনোর পর ভারসাম্য হারিয়ে পরে যাচ্ছে লাইন থেকে। আবার উঠে দাঁড়াচ্ছে,আবার হাঁটার চেষ্টা করছে। আজ অনেকদিন পর পার্থ আবার একা বেরিয়েছে নিজেকে কিছু সময় দেওয়ার জন্য। সারা সপ্তাহের ক্লান্তি, জীবনের যত না পাওয়া, যত আক্ষেপ সব সে ভুলে যায় এই সময়টাতে। এই অভ্যাসটা তার অনেকদিনের পুরনো। হঠাৎ করেই মন চাইলেই পার্থ বেরিয়ে পরে একা। কখনও নদীর পাশ ধরে, কখনও সোডিয়াম আলোয় রাজপথের একটি কোণ ধরে আবার কখনও বা নদীর ওপারের গ্রামটার সরু রাস্তা ধরে আপন মনে হেঁটে যায় সে। আজ সে বেঁছে নিয়েছে পাশাপাশি নিরন্তর সমান্তরাল বয়ে চলা রেল-লাইনকে। বিকেল থেকে সে একটি লাইন ধরে হেঁটে যাচ্ছে। অনেক চেষ্টা করছে ভারসাম্য রেখে হাঁটা চালিয়ে যাওয়ার কিন্তু পারছে না মাঝে মাঝে না চাইতেও লাইন থেকে পরে যাচ্ছে তবুও আবার উঠে দাঁড়াচ্ছে আবার হেঁটে চলছে। জীবনটা বোধহয় এমনই, যতই ভারসাম্য বজায় রেখে চলার চেষ্টা করা হোক, কোন এক সময় এসে অজান্তেই জীবন ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে। তবুও মানুষ বাঁচে। বাঁচার জন্যই তো জীবন তাই মানুষ আবার উঠে দাঁড়ায় জীবনটাকে সাজিয়ে নেওয়ার জন্য।
হাঁটার মাঝে মাঝে লাইনের উপর বসে পরে পার্থ আর আশেপাশের মানুষের কর্মব্যস্ততা দেখতে থাকে আপনমনে। পার্থর এই একলা ভ্রমনের সবচেয়ে আকর্ষণীয় বিষয়টা হল তার ভ্রমণসঙ্গী। না কোন প্রিয় মানুষ নয় কিংবা কোন বন্ধুও নয়, তার ভ্রমন সঙ্গী হয় কিছু অচেনা মানুষ যাদের সাথে এর আগে তার কখনও দেখাও হয়নি। তার ভ্রমণসঙ্গীর তালিকায় কখনও থাকে পথশিশু, কখনও বা বৃদ্ধ, কখনও কোন এক ভবঘুরে আর কখনও বিভিন্ন পেশার মানুষ। এসব অচেনা মানুষদের সাথে কথা বলা,তাদের জীবন যুদ্ধের কাহিনী জানা ইত্যাদি আরও এমন উদ্ভট কাজ করে অন্যরকম আনন্দ পায় সে। আজ বিকেল থেকেই পার্থর চোখদুটো খুঁজে যাচ্ছে এমন কাউকে কিন্তু খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তাই অনেকক্ষণ ধরে রেললাইনের উপর বসে বসে দূর থেকে বেশ কিছু মানুষকে পর্যবেক্ষণ করে যাচ্ছে কিন্তু সামনে গিয়ে কথা বলার জন্য কাউকেই তার মনে ধরছে না। খানিকটা সময় পর দূর থেকে আসা ট্রেনের হুইসেল শুনতে পেল পার্থ, লোকজন দ্রুত সরে যাচ্ছে রেললাইন থেকে। পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করে একটি কয়েন বের করল পার্থ আর তারপর সেটিকে লাইনের উপর রেখে দূরে সরে আসলো।
দুই -
একমনে ট্রেনের পু ঝিক ঝিক করে চলে যাওয়া দেখল পার্থ। তারপর লাইনের উপর রাখা কয়েনটি হাতে তুলে নিল। কয়েনটা চ্যাপ্টা হয়ে পাতের আকার ধারন করেছে। আনমনে হাসি ফুটে উঠল পার্থর মুখে। ছোটবেলায় এই কাজটা প্রায়ই করত সে। ট্রেনের আওয়াজ শুনলেই দৌড়ে ছুটে যেত তারপর লাইনের উপর কয়েন বসিয়ে দিত। সেই পুরনো স্মৃতি মনে করে কিছুটা নষ্টালজিক হয়ে পরল পার্থ। হঠাৎ করে একটি আওয়াজ পার্থর মনোযোগের ব্যাঘাত ঘটাল,
--- ভাইয়া আমারে এই কয়েনটা দিবেন?
পার্থ ঘুরে তাকাল। একটি ৮-১০ বছরের ছেলে, যার পরনে একটি শার্ট যেটার বোতামগুলো সব ছেঁড়া আর ময়লায় পরিপূর্ণ হাফ প্যান্ট, মাথার চুলগুলো উস্কখুস্ক কিন্তু মুখে ভুবন ভুলানো হাসি। ছেলেটিকে দেখেই পার্থর পছন্দ হয়ে গেল।
--- কি নাম তোর?
--- সবুজ।
--- আগে পরে কিছু আছে?
--- জানি না।
--- হুম, এই কয়েনটা দিয়ে কি করবি?
--- কিছু করুম না।ভালো লাগসে তাই চাইতে আইলাম।
--- হুম। এটা তো ৫টাকার কয়েন ছিল। আমি যে এটা তোকে দিব বিনিময়ে তুই আমাকে কি দিবি?
পার্থর কথা শুনেই ছেলেটা পিছন ফিরে দৌড় দিল। পার্থ অনেক ডাকল কিন্তু ছেলেটি শুনল না। মনটা খারাপ হয়ে গেল পার্থর। কত সুন্দর এই ছেলেটাকে আজকের ভ্রমনসঙ্গী বানান যেত কিন্তু তার এই কথার জন্যই হয়ত ছেলেটি চলে গেল। নিজেকে দোষারোপ করে উঠতে যাবে এমন সময় পার্থ লক্ষ্য করে সেই ছেলেটি আসছে হাতে লম্বা একটি লাঠি যাতে শোভা পাচ্ছে রঙবেরঙের অনেক পতাকা। ছেলেটিকে আসতে দেখে খুশি মনে পার্থ আবার বসে পরল।
--- ভাইজান কি চইলা যাইতেসিলেন?
--- না তোর জন্য বসে ছিলাম। কই গেসিলি দৌড় দিয়ে?
--- এই যে এইগুলা আনতে গেসিলাম, হাতের পতাকাগুলো দেখিয়ে বলল ছেলেটি।
--- এগুলা কার?
--- জি আমার। সামনে যে স্টেশনটা আসে ঐহানে আমি পতাকা বিক্রি করি।
--- বাহ! কয়টা দেশের পতাকা আছে তোর কাছে?
--- ৪-৫ টা দেশের হইব।
ব্যাগ থেকে একটি ছোট পতাকা বের করল ছেলেটি। লাল সবুজের দেশের পতাকা।
--- এই লন। এইটা আপনার লাইগা। এইবার ঐ কয়েনটা দিবেন তো?
--- আরে ধুর পাগল আমি তো দুষ্টুমি করছিলাম। এই নে কয়েনটা আমি তোকে এমনিতেই দিলাম, বিনিময়ে কিছু লাগবে না। তা তুই থাকিস কই?
--- স্টেশনের পিছে যে বস্তিটা আছে ঐহানে।
--- আর কে কে আছে তোর ঘরে?
--- বাবা আর মা।
--- উনারা কিছু করেন না? তোকে এই বয়সেই কাজে লাগায় দিসে!
--- মা মাইনসের বাসায় কাম করে আর এই পতাকার ব্যবসা আগে বাবা করত কিন্তু এহন অসুস্থ থাকায় এই ব্যবসায় আমি নামসি।
--- পড়ালেখা করিস না?
--- আমগো আবার পড়ালেখা! মা কয় গরীব মাইনসের পড়ালেখা করতে নাই। ঠিক মত খাইতেই তো পারি না। তয় টাকা-পয়সার হিসাবটা জানি। বাবা শিখাইসে।
--- কতদিন ধরে তুই এই ব্যাবসা করছিস?
--- এইতো প্রায় মাস ছয়েক।
--- কেমন বিক্রি হয় পতাকা?
--- এমনিতো পতাকা কেউ কিনতে চায় না। তয় কিছু বিশেষ দিনে হেব্বি বিক্রি হয়।
--- বিশেষ কোন দিনগুলোতে?
--- ঐ যে আছে না, কি জানি কয়?? উমমমম হ্যাঁ হ্যাঁ মনে পরসে ঐ যে ২১ ফেব্রুয়ারী, ২৬ মার্চ, ১৬ ডিসেম্বর এই দিনগুলা।
--- হুম, তা এই দিনগুলা কেন বিশেষ সেটা কি জানিস?
--- হ কিছু কিছু জানি তয় পুরা জানি না।
--- কি জানিস? দেখি বলত ২১শে ফেব্রুয়ারী তে কি হয়েছিল?
--- (প্রশ্ন শেষ হওয়ার আগেই মুখের থেকে কথা কেড়ে নিয়ে ছেলেটি বলে উঠল) আরে জানমু না! এই দিনে আপনার মত কিছু ছাত্র নিজেগোর জীবন দিসিল।
--- হুম ঠিক বলেছিস। কেন জীবন দিয়েছিল বলতে পারবি?
--- হে হে হে এই যে আমি আপনি এত বিন্দাস কইরা কথা কইতাসি যে ভাষায় হেই ভাষা অর্জনের লাইগা।
--- যারা জীবন দিয়েছিলেন তাদের নাম জানিস?
--- সালাম ভাই আর রফিক ভাইয়ের নাম জানি। আর তো জানি না।
--- আরে তুই তো অনেক কিছু জানিস। এবার বল দেখি ২৬শে মার্চ আর ১৬ই ডিসেম্বর কি?
--- ২৬ মার্চ হইল বঙ্গবন্ধু নামক এক লোক যুদ্ধ ঘোষণা করসিল পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে। আর ১৬ ডিসেম্বর সেই যুদ্ধ আমরা জিইতা গেসিলাম। এতটুকই জানি আর তো কিছু জানি না।
--- এত কিছু তুই কেমনে জানিস? তুই তো পড়ালেখা করিস না তাহলে কে শিখিয়েছে তোকে এত কিছু?
--- বাবা শিখাইসে। আগে আমি বাবার লগে প্রতিদিন বিকালে এই স্টেশনে আইতাম। তখন বাবা মাঝে মাঝে আমারে এইগুলা কইত। ঐখান থেইকা শিখসি। বাবা আরও কইত এই পতাকা নাকি অনেক কষ্ট কইরা অর্জন করা হইসে।
--- হুম তোর বাবা ঠিক বলেছেন।
--- এই দেহেন (পতাকা দিয়ে সাজানো লাঠিটা দেখিয়ে) বাবা সবসময় এই লাঠিটাতে আমাগো দেশের পতাকা সবার উপরে রাখত আর আমারে কইত সবার আগে নিজের দেশের পতাকা। আমিও তাই এহন সবসময় সবার উপরে আমগো দেশের পতাকা রাখি।
ছোট এই ছেলেটি আর তার বাবার পতাকার প্রতি এত শ্রদ্ধা এত ভালবাসা দেখে পার্থর বুক গর্বে ফুলে উঠল। কিছুই বলল না সে শুধু ছোট একটা হাসি দিয়ে ছেলেটির মাথায় পরম মমতায় হাত বুলিয়ে দিল।
--- ভাই আমি এহন যাই গা? সন্ধ্যা হইয়া গেসে।
--- চলে যাবি? আচ্ছা ঠিক আছে কিন্তু যাওয়ার আগে আমাকে একটা পতাকা দিয়ে যা।
--- আপনি নিবেন! জানেন আইজকা সারাদিন একটাও দেশের পতাকা বিক্রি করতে পারি নাই।
--- (একটি ছোট হাসি দিয়ে পার্থ বলল) হ নিমু, সবচাইতে বড় যে পতাকাটা আছে হেইটা নিমু।
ছেলেটি ব্যাগ থেকে খুঁজে খুঁজে সবচেয়ে বড় পতাকা বের করে দিল। তার চোখেমুখে অন্যরকম হাসি। পার্থ ঠিক বুঝতে পারছিল এই হাসি সবচেয়ে বড় পতাকা বিক্রি করে বেশি টাকা পাওয়ার আনন্দে নয়, এই হাসি দেশের পতাকা বিক্রি করতে পারার আনন্দের হাসি। নিজের ছলছল চোখদুটিকে সামলে নিল পার্থ তারপর ছেলেটিকে টাকা দিয়ে তার কাছ থেকে বিদায় নিল। খুশি মনে ছেলেটি তার ঘরের দিকে পা বাড়াল। একমনে বসে বসে সবুজের চলে যাওয়া দেখছে পার্থ।
আনমনে হঠাৎ তার মুখে তাচ্ছিল্যের হাসি ফুটে উঠল। হ্যাঁ তাচ্ছিল্যের হাসি, এই হাসি সেই মানুষগুলোর জন্য যাদেরকে গতরাতে সে দেখেছিল ফেসবুকে শেয়ার করা একটি ভিডিওতে। ২১শে বইমেলাতে ঘুরতে যাওয়া সেই মানুষগুলোকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল ২১শে ফেব্রুয়ারী কি? সেদিন কি হয়েছিল? শিশু, মডার্ন তরুণ কিংবা বয়স্ক মানুষ কেউই সে উত্তর দিতে পারেনি। অথচ লেখাপড়া না জানা সবুজ কত সহজেই এই উত্তরটা দিয়ে গেল। নুন আনতে পান্তা ফুরানো এই পরিবারটির দেশের প্রতি ভালবাসা সবার কাছেই একটি দৃষ্টান্ত হওয়া উচিত। সবুজ আর তার বাবার কাছ থেকে এইসব হাই সোসাইটির মানুষদের কিছু শিখা উচিত।
না, সেইসব মানুষদের কথা চিন্তা করে আজকের এই সুন্দর বিকেলটা মাটি করতে চায় না পার্থ। উঠে দাঁড়ায় সে, তারপর রেললাইনের উপর দাঁড়িয়ে আরেকটাবার দেখতে চেষ্টা করে সবুজকে। অনেক চেষ্টা করেও সবুজকে ঠিকমত দেখা যাচ্ছে না তবে তার লাঠির সবচেয়ে উপরে পতপত করে উড়তে থাকা লাল সবুজের পতাকাটা স্পষ্ট চোখে পরছে। পকেট থেকে হেডফোনটা বের করে কানে গুঁজে দেয় পার্থ। তারপর নিজের কেনা পতাকাটা গায়ে জড়িয়ে বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। কানে বাজছে শিরোনামহীনের বাংলাদেশ গান, সামনে নিরন্তর সমান্তরাল বয়ে চলা রেললাইন আর পিছনে অস্তমিত সূর্য, তার সাথে সবুজের গল্প।
“যখন কিশোরীর হাতে সুতোয় বোনা সবুজ গ্রাম
যখন রংতুলিতে আঁকা বাংলার মুখ অবিরাম
যখন গান এখানেই শুধু শরতের রঙে হয় শেষ
সেই শুভ্র কাশফুল ঘিরে রেখে যায় সবুজের দেশ
মেঘে মেঘে কিছু ভেজা পাখির দল
মেঘ হারিয়ে নীল ছাড়িয়ে খুঁজে ফিরে বাংলাদেশ
যেখানে লাল সূর্যের রঙে রাজপথে মিছিল
যেখানে কুয়াশার চাদর আকাশ থাকে নীল
যেখানে রিমঝিম বৃষ্টি শুকনো মাটির টানে
অবিরাম ঝরে সবুজ সাজায়
মেঘে মেঘে কিছু ভেজা পাখির দল
মেঘ হারিয়ে নীল ছাড়িয়ে খুঁজে ফিরে বাংলাদেশ
যখন একচোখে ঘুম ঘুম একচোখে নীলরাত আমায় ভাবিয়ে যায় যখন
একহাতে রোদ্দুর,একহাতে গোলাপ সবুজ ছুঁয়ে ভাবায় আমায়
একদিকে নীল নীল,একদিকে কাশফুল দুচোখ যেখানে শেষ
একপ্রান্তে সবুজ,একপ্রান্তে লাল আমার বাংলাদেশ”
পরিশিষ্টঃ
না এভাবে গুছিয়ে গল্প লেখার ক্ষমতা আমার নেই, তবে ভালো গল্প পড়তে ভালো লাগে অনেক। গল্পটি লিখেছে আমার এক বন্ধু, সত্যজিৎ রায়।
প্রায়ই লিখে সে, আনমনে একা একা, কিছু পড়ি আর কিছু এখনো পড়া বাকি। আপনাদের কেমন লেগেছে জানি না, তবে এই লেখাটা আমার অনেক পছন্দের তাই অনেকটা আবেগের বশেই শেয়ার করে ফেললাম। ভাবলাম অনেক অনেক সিরিয়াস লেখাই তো পড়ে থাকে ব্লগার ভাইরা, এবার না হয় একটু কাব্যিক লেখাই পড়ুক।
ওহ ভুলেই গিয়েছিলাম, লেখাটি এবারের ঈদ গল্প লেখা প্রতিযোগিতায়ও অংশ নিয়েছে। তাই যদি মনে করে থাকেন যে গল্পটি আসলেই ভালো তবে এখানে গিয়ে আপনার ভালো লাগা জানিয়ে আসতে পারেন। নাহ কোনরুপ প্রচারণা নয়, আপনার নিতান্তই ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত এটি। লিংকটি আমি শেয়ার করেছি মূলত মূল লেখার উৎস প্রদানের লক্ষ্যে। এটুকুই বলার ছিল, অনেক ধন্যবাদ আপনাকে এবং শুভরাত্রি।


সর্বশেষ এডিট : ০২ রা আগস্ট, ২০১২ রাত ১২:১৬