শুরুটা ১৫ই ডিসেম্বর, ২০১৪ইং তারিখ রাত ১১:৩০ মিনিটের সময় টেলিভিশনের সংবাদ দিয়ে- একটা ফুটফুটে মেয়ে নবজাতক শিশুকে (বয়স আনুমানিক ২১ দিন) র্যাব-০৩ উদ্ধার করেছে এবং শিশু পাচারকারী দলের চার (০৪) জন মহিলা সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
বাচ্চাটাকে দেখে অন্তরটা কেঁপে উঠল। মাত্র পাঁচ (৫) মাস আগে আমি আমার বহু কাঙ্খিত একমাত্র পুত্র সন্তানকে হারিয়েছি। জন্মের ৯ম দিনেই সৃষ্টিকর্তা আমার সন্তানটিকে তাঁর কাছে নিয়ে গেছেন। শোকে পাথর হয়ে গিয়েছি আমরা। হঠাৎ টেলিভিশনে দেখানো শিশুটির সাথে আমার সন্তানের যেন মিল খুঁজে পেলাম। আমার স্বামীকে বিষয়টি বলা মাত্রই তিনি র্যাব-০৩ এর টিকাটুলিস্থ কার্যালয়ে রাত আনুমানিক ১২:৪৫ মিনিটে উপস্থিত হলেন। সেখানকার দায়িত্বরত কর্মকর্তাকে বিষয়টি অবহিত করলে তিনি লালবাগ থানায় যোগাযোগ করতে বলেন। তিনি তৎক্ষনাৎ লালবাগ থানার উদ্দেশ্যে রওনা হলেন, রাত তখন আনুমানিক ১:৩০ মিনিট (১৬ই ডিসেম্বর ২০১৪ইং)।
এমতাবস্থায় দু'জনই সিদ্ধান্ত নিলাম, শিশুটিকে তার অধিকার ফিরিয়ে দিব, তাকে আমাদের সন্তান হিসেবে বড় করব। র্যাব, পুলিশ উভয়ই আমাদের জানালেন যে, একমাত্র মহামান্য আদালতের মাধ্যমেই আইনগতভাবে শিশুটিকে আপনারা পেতে পারেন। তারা সবাই আমাদের সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানালেন এবং সকল প্রকার সহায়তার আশ্বাস দিলেন।
তাদের দেখানো পথেই হাঁটা শুরু করলাম। একদিন, দু'দিন করে পুরোটা মাস থানা ও সিএমএম কোর্টে দৌড়াতে দৌড়াতে দু'জনের অবস্থাই শোচনীয়। নিজেদের কর্মক্ষেত্র ও সংসার সককিছু ঠেলে একদিকে সরিয়ে দিয়ে শিশুটিকে পাওয়ার আশায় ছুটছি। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে শিশুটি যতদিন ছিল ততদিনের ভরন-পোষনও আমরা দিয়েছি। নিয়মানুযায়ী এরপর শিশুটি চলে গেল সমাজসেবা অধিদপ্তরের অধীনে "ছোটমনি শিশু নিবাস" -এ। সেখানকার উপ-তত্ত্বাবধায়ক জনাবা ফেরদৌসী আক্তারের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানালেন যে, একমাত্র আদালতের রায় নিয়ে এলেই তিনি শিশুটিকে আমাদের কাছে হস্তান্তর করবেন।
অত:পর মহামান্য আদালতের ৫-৬টি শুনানী ও দীর্ঘ যাচাই বাছাইয়ের পর গত ১২ই জানুয়ারী ২০১৫ইং তারিখে শিশুটিকে আদলতে হাজির সাপেক্ষে আমাদের পক্ষে রায় প্রদান করেন। সিএমএম কোর্টের বারান্দায় যখন শিশুটিকে আমরা কোলে তুলে নিলাম তখন মনে হল আমার সন্তানটি যেন আমার কোলে ফিরে এসেছে। প্রাপ্তির আনন্দে এতদিনের কষ্ট সব বেমালুম ভুলে গেলাম। আমাদের জিম্মায় দেয়ার আদেশ দেয়া হয় এবং উক্ত আদেশের মূলকপিটি "ছোটমনি শিশু নিবাস" -এর উপ-তত্ত্বাবধায়ক জনাবা ফেরদৌসী আক্তারের দপ্তরে পৌঁছানো হয়।
এরপর আদালতের রায় মোতাবেক যখন শিশুটিকে "ছোটমনি শিশু নিবাস" থেকে আমাদের কাছে হস্তান্তর করার কথা তখন থেকেই শুরু জটিলতা। প্রতিষ্ঠানটির উপ-তত্ত্বাবধায়ক জনাবা ফেরদৌসী আক্তার তার ব্যক্তি স্বার্থে রায়টি মানতে নারাজ। তিনি অফিসে উপস্থিত হন খুব কম দিন তার উপরে তাকে মুঠোফোনে পাওয়াটা দুষ্কর। রায়ের বিষয়ে তার স্ব-স্বীকৃতি -"আমি যদি না দেই তবে কোন আদালতের রায়ই এখানে কার্যকর হবে না।" উল্লেখ্য, ইতোমধ্যে তার অধিনস্থ কর্মচারী দ্বারা আমাদেরকে বিভিন্ন কৌশলে আদালতে না গিয়ে তাদের সাথে সমঝোতার ভিত্তিতে অর্থনৈতিক লেন-দেনের মাধ্যমে বিষয়টি ফয়সালা করতে বলেছিলেন। তাদের ভাষ্য, আদালতে গিয়ে কি লাভ, শুধু শুধু কোর্ট-থানা দৌড়াদৌড়ী না করে তাদের সাথে লিয়াজো করে সহজে আমরা বাচ্চাটা পেতে পারি। আর এই অশুভ লিয়াজোর কাজটি করেন তার অধিনস্থ কতিপয় কর্মচারীদের দ্বারা। আমরা তাদের দেখানো অবৈধ পথে যাইনি। মহামান্য আদালতের মাধ্যমে এগিয়েছি। আমাদের পক্ষে রায়ও পেয়েছি। তাই ক্ষিপ্ত হয়ে শুরু করেছে হয়রানি।
মানবতা বলতেও তো মানুষের কিছু থাকার কথা। একটি শিশুর ভাল ভবিষ্যত হবে তা কে না চায়! অবৈধ অর্থের লোভে, ব্যক্তি স্বার্থের জন্য, শিশুটিকে নিয়ে যে নোংরা খেলায় নেমেছেন "ছোটমনি শিশু নিবাস" -এর উপ-তত্ত্বাবধায়ক ফেরদৌসী আক্তার তা কিভাবে মেনে নিতে পারি? তাহলে কি র্যাব, পুলিশ, মাহামান্য আদালতের রায় সব মিথ্যা, সব বানোয়াট? আইনগতভাবে না এগিয়ে যদি অবৈধভাবে টাকা দিয়ে শিশু কিনতাম তাহলেতো এভাবে কষ্ট করতে হত না!
নিজের কাছে আজ নিজেই হেরে গিয়েছি। এই আমাদের মানবতা! মানবতায় বাঙালী জাতি নাকি শ্রেষ্ঠ! বলতে পারেন এই হয়রানির শেষ কোথায়? শিশুটির বাবা-মায়ের অধিকার কি কেউ দিতে পারবেন? নাকি একজন অর্থ পিপাসু কর্মকর্তার কারনে পুরো সরকারী কর্মকর্তারা চিহ্নিত হবেন অমানবিক হিসেবে? অবুঝ শিশুটি মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইন -এর ভিকটিম হওয়ায় আমরা কি কেউই তার পাশে দাঁড়াবো না?
ভাই, অনেক দৌড়িয়েছি, আর পারছি না। আমরা দু'জনই অনেক ক্লান্ত ও অবসন্ন। শিশুটিকে আমাদের কোলে তুলে দিন। সমাজের সর্বস্তরের সহায়তা আমাদের কাম্য। মানবতাকে সম্মান জানান। আইনের উধ্বের্ কেউ নয়, মানবতাই মানুষের শ্রেষ্ঠ ধর্ম -প্রমান করুন।
ধন্যবাদ।
শারিয়া মোস্তাফিজ সিমি
মোস্তাফিজুর রহমান রাসেল
আপডেট: ২০।০১।২০১৫
অনেক আশায় বুক বেঁধে পূর্ব নির্ধারিত সময় অনুযায়ী গতকাল (সোমবার, ১৯/০১/১৫ইং) গিয়েছিলাম সমাজসেবা অধিদপ্তরের সদর দপ্তরে (আগারগাঁও), মহাপরিচালক মহোদয়ের সাথে দেখা করতে। তিনি আমাদের সাদরে গ্রহন করলেন, সবকিছু শুনলেন। বললেন, এতিমখানায় বড় না হয়ে একটি পরিবারে এধরনের শিশুরা বড় হলে সেটাই সর্বোত্তম। একটি পরিবারই পারে শিশুর মানসিক বিকাশে পূর্ণ সহায়তা করতে। সাথে সাথে গতকালই বিষয়টি সমাধান করে আমাদের হাতে শিশুটিকে তুলে দেয়ার জন্য অধিনস্থ কর্মকর্তাকে নির্দেশ দিলেন। আমাদেরকে তিনি সম্পূর্ণ আশ্বস্ত করে গতকালই দুপুর ৩:০০ টায় উপ-পরিচালক সমাজসেবা অধিদপ্তর (ইস্কাটন) কার্যালয়ে যেতে বললেন।
অনেক খরার পরে যেন বৃষ্টি হল। আমরা দু’জনই সমস্ত শঙ্কামুক্ত হলাম। শুভানুধ্যায়ীদেরকে জানালাম –বাবুকে আমরা পেতে যাচ্ছি।
অতপর দুপুর ৩:০০ টায় পৌছালাম ইস্কাটন কার্যালয়ে। উপ-পরিচালক মহোদয় যেন বসে ছিলেন আমাদের অপেক্ষাতেই ১০/১২জন লোক নিয়ে। তিনি জানালেন যে, তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন আমাদেরকে শিশুটিকে দিবেন না। কারন শিশুটি রাষ্টীয় সম্পদ।
প্রশ্ন করলাম তাকে - তাহলে গত এক মাস আগে যখন ফেরদৗসী আক্তারের (সমাজসেবা অধিদপ্তরের অধীনে "ছোটমনি শিশু নিবাস", উপ-তত্ত্বাবধায়ক) -এর সাথে যোগাযোগ করেছিলাম তখন কেন বলেছিলেন যে আদালতের রায় নিয়ে আসা মাত্র তিনি শিশুটিকে দিয়ে দিবেন? তাহলে মহাপরিচালকের মত সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তার নির্দেশনাও কি লোকদেখানো? রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি (?) বলেই কি এসব শিশুরা পিতা-মাতার স্নেহ ও মমতা ছাড়া বড় হতে বাধ্য? তাহলে সতি্যই মহামান্য আদালতের রায় মূল্যহীন? তিনি কোনও উত্তর দিতে অপারগতা প্রকাশ করে বললেন পারলে আদালতে গিয়ে প্রশ্ন করেন।
দু’দিন আগের উপ-পরিচালক মহোদয় আর আজকের উপ-পরিচালক মহোদয়ের বক্তব্যে ও আচরনে আকাশ-পাতাল তফাৎ! রুচিতে বাঁধলো বাবার বয়সী এই মানুষটার সাথে আর কথা বাড়াতে। তার অফিসের নিচে নেমে আমরা ঠিক করলাম- এর শেষ না দেখে ফিরব না। সেদিন মহামান্য সিএমএম কোর্টের বারান্দায় শিশুটিকে আমরা কোলে তুলে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম তাকে তার বাবা-মার অধিকার দিব।
আমাদের মত আমজনতার দেয়ালে পিঠ ঠেকলে কোথায় যায়? কথা শোনার কোন না কোন মানুষ বা প্রতিষ্ঠান নিশ্চয়ই আছে। তাই আমরা চলে গেলাম জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের প্রধান কার্যালয়ে। না, তারা ফিরিয়ে দেননি। আমাদের কথা তারা গুরুত্ব সহকারে শুনেছেন, অত:পর শুধু পরবর্তী দিকনির্দেশনাই দেননি বরং এ বিষয়ে যেকোন ধরনের সহায়তার প্রয়োজন হলে তাও প্রদানের আশ্বাস দিয়েছেন।
এতকিছুর পরেও আবার আমাদেরকে মহামান্য আদালতের শরনাপন্ন হতে হবে। অনেক প্রশ্ন, আক্ষেপ, অভিমান ও ক্লান্তিতে শরীর আর চলতে চায় না, শুধু শিশুটিকে দেয়া প্রতিজ্ঞা ও আপনাদের অনুপ্রেরনাকে শ্রদ্ধা জানাতে আজ পুনরায় আদালতের দ্বারস্থ হয়েছি।
আর একটি অনুরোধ, দয়া করে শেষ পর্যন্ত সাথে থাকবেন।লড়াইটা শুধু এই শিশুটির জন্য নয়, সমাজের সর্বস্তরে এ বার্তা পৌঁছে দেয়া –ডাস্টবিনে ফেলা আর বিক্রি হয়ে যাওয়া শিশুরাও মানুষ, তাদেরও অধিকার আছে একটি পরিবারে মমতায় বড় হওয়ার। ঘৃনা নয়, তাদের ভালবাসতে শিখুন, আপন করুন। ওই শিশুটির জায়গায় আপনি কিংবা আপনার সন্তানও হতে পারত!
ধন্যবাদ।
শারিয়া মোস্তাফিজ সিমি
মোস্তাফিজুর রহমান রাসেল
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে জানুয়ারি, ২০১৫ সকাল ১০:১৯