১
সময় অতিদ্রুত পাশ কেটে চলে যাচ্ছে। কিংবা আমি সময়ের কাঁধে অশ্বারোহীর মত চেপে বসেছি। দুর্বার গতিতে লাগামহীনভাবে ছুটে চলেছে সে। কখনও সমান্তরালে, কখনও ডানে, কখনও বামে আবার কখনও বা খাদে। খাদে পড়ে কর্দমাক্ত হলে বা ধূধূ মরুভূমে ধূলো ধূসরিত হলে কিছু সময় হচ্ছে জিরোনোর জন্য ব্যয়িত।
অনেক দিন হলো আমার রুমে কেউ আসেনা। অসার, অপারগতার অজুহাতে কেউ আসার প্রয়োজনও বোধ করেনা হয়ত। রুমটাতে দেয়াল ভর্ত্তি কালিঝুলি। আর ঝুলে আছে মাকড়সার জাল, একটার পর একটা। অনেকগুলো মাকড়সা দিব্যি দোল খাচ্ছে আর চেটেপুটে খাচ্ছে পতঙ্গকূল। কয়েকটি টিকটিকি সিলিং এর এপাশ থেকে ওপাশে দৌঁড়ুচ্ছে। ঠিকঠিক শব্দে জানান দিচ্ছে, সব কিছু ঠিক আছে, আর প্রাগঐতিহাসিক দেয়াল ঘড়ি জানান দিচ্ছে আমি আছি, সময়ও আছে।
পূবের জানালা দিয়ে নিয়মিত সূর্যদয় দেখতে দেখতে দৈনিক নিরামিষ আহারের ন্যায় অরুচি ধরে গেছে। সূর্যাস্ত দেখিনা, সোনালী দৃশ্যপটের গোধূলী দেখিনা অনেকদিন। তবে অসার জীবনে এই জানালাটাই আমাকে দিয়েছে অপরিসীম আনন্দ। শুধু আনন্দ নয় আনন্দ অশ্রুও ঝরে পড়ে অনবরত, যতক্ষণ থাকি এই জানালার কার্নিশ ধরে, যতক্ষণ চেয়ে থাকি পূবের জানালার একটু ওপারেই খোলামাঠের দিকে। রুমের উত্তর আর দক্ষিণ দিকেও একটি করে জানালা আছে। তবে সেই জানালা দুটো এত দুর্বার আকর্ষনে টানেনা।
২
সকাল নয়টার মত বাজে। সূর্যদয় দেখতে দেখতে আর অলস সকালের রোদের ওম মাপতে মাপতে প্রায় অবসন্ন হয়ে পড়েছি। এমন সময় হুড়মুড় করে এক ঝাক ছোট্ট শিশু মাঠের মধ্যে নেমে এলো। একদিকে আমিনা, শিরিন, বেবী, শাহানা, পারভীন আর নূরজাহান বউচি খেলায় মত্ত আর অন্যদিকে আলম, শিপন, মাসুদ, জুয়েল, মিলন, হাসান, হালিম, হুমায়ুন, আশরাফুলরা ফুটবল খেলায় উন্মত্ত। বউচি খেলায় মত্ত আমিনা, শিরিন, নূরজাহানরা বেনী দুলিয়ে মাঠের মধ্যে দৌঁড়োদৌঁড়ি করছে, লুটোপুটি খাচ্ছে। আর আলম, শিপন, মাসুদরা ফুটবল নিয়ে মাঠের এপাড় থেকে ঐ পাড়ে দাপিয়ে বেরাচ্ছে। কখনোবা তারা মাটির দলা দ্বারা নির্মিত গোলপোষ্টে অহেতুক গোল নিয়ে উত্তেজনায় ভুগছে। এই নিয়ে দুই পক্ষের ঝগড়াঝাটি, মারামারি এবং মাঝমাঠে চিরশত্রু মাসুদ আর জুয়েলের গড়াগড়িও শুরু হয়েছে। অভিভাবক শ্রেণীর কিছু লোক এসে উত্তেজনা প্রশমিত করার কিছুক্ষণ পর স্কুলে যাওয়ার সময় আসন্ন হলে মাঠ পাশ্ববর্তী দীঘিতে তারা উলম্ব লম্ফন শুরু করে। আমিনা, শিরিন, নূরজাহানরাও ইতোমধ্যে দীঘির পানিতে পানকৌড়ির ন্যায় ডুবসাঁতার শুরু করেছে। ঘন্টাখানেক পর ত্যক্ত বিরক্ত হয়ে দীঘির মালিক সোলেমান মোল্লার বউ সফুরা বানু ঝাড়ু উচিয়ে দীঘির পাড়ে এসে দাঁড়ালে যে যার বাড়ির দিকে ছুটে পালায়।
৩
পূবের জানালায় বসে থাকতে থাকতে সূর্য মাথার উপর এসে গেছে। দূরের গাছপালা, মনুষ্য সমাজের বাড়ীগুলোর ছায়া লেগে আছে সেগুলোর শরীর বরাবর। মানুষগুলোই বা বাদ যাবে কেন? তাদের ছায়া আর কায়ার পার্থক্য খুব বেশী মনে হচ্ছে না। একে অপরের মাঝে বিলীন হয়ে গেছে, থেমে গেছে দৈনন্দিন কর্মযজ্ঞ। তারা এখন দূরের বট গাছের নীচে অথবা শাল মহুয়ার বনের সুশীতল ছায়ায় বিশ্রামরত, কেউবা ডিঙ্গি নৌকায়, কেউ আবার গাঙ্গের পাড়ে একলা ঘাটে। আর আমার দক্ষিণ দিকের জানালার নব দম্পতি সেগুন খাটে জিরোচ্ছে। মাঝে মাঝে উত্তপ্ত বাতাসের স্ফুলিঙ্গ আমার শরীর ঘামিয়ে দিয়েছে। যেরুপ তারা ঘর্মাক্ত এতক্ষণের জৈবিক ক্রিয়ায়। তারা নিবিড় আলিঙ্গনে পরস্পরের মেদ ঝরিয়েছে বেশ খানিকটা সময়, এখন ঝড়াচ্ছে সেই ফাগুন দিনের আগুন লাগা কৃষ্ণচূড়া বাগানে বসে বাদামের খোসা ছাড়ানোর কথা। বৃষ্টিতে ভীজে চুপসে একাকার হয়ে হাতে হাত রেখে দূর নীল নির্জনে পথ চলার কথা স্মরণ করছে। রোমন্থন করছে আঁকাবাঁকা হাঁটু পানির নদী পাড়ে বসে পূর্নিমা রাতে জোছনা মাখার কথা। স্কুল পালানো সেই দিনগুলোর কথা, আর রাত জেগে প্রেমপত্র লেখার কথা উঠে আসছে তাদের অচল ঠোটের কোন বেয়ে।
৪
আহ্নিক গতির প্রভাবে সূর্য তার বলয়ে ঘুরে পশ্চিম দিকে এগোচ্ছে। ছায়া আর কায়াও পরস্পরকে ছেড়ে দীর্ঘতর হচ্ছে, যেন একে অপরকে ছেড়ে যাওয়ার পায়তারা চলছে। সবাই যে যার কাজে আবারও বেড়িয়ে পড়েছে। কেবলমাত্র আমার কাঁধে কাজের বোঝা নেই, তাই আমার দু’চোখ বেয়ে সময় গড়াচ্ছে দ্রুত। পশ্চিম দিকে জানালা না থাকায় মেঘের কোলে সূর্যের শেষ হাসি আর স্বর্ণালী সন্ধ্যা উপভোগ হলোনা। সূর্যের দিকে বয়ে চলা সন্ধ্যা ঘনানো পাখির ঝাঁক দেখা হলো না। । তেমনি করে আজকের পূর্নিমার চাঁদটাও যেন অন্য আকাশে উঁকি দিচ্ছে। কানে আসছে ঝিঝি পোকার ডাক, দূরে কোথাও কোন পুরনো প্রাগঐতিহাসিক গাছে লক্ষীপেচার ক্রন্দন, নিশাচর প্রানী আর ডাহুকের ডাক। সেই সাথে ভেসে আসছে উত্তরের জানালা থেকে এক প্রাচীন দম্পতির আর্তনাদ। অতিপ্রাচীন একটি বাড়ীর জানালা বেয়ে কানে আসছে জীর্নতার বিলাপ। সন্তানাদি দূরে থাকার হাহাকার তাদের পুড়িয়ে খাচ্ছে। যেমন করে সময় খেয়েছে তাদের চর্মঘ্রান আর সৌন্দর্য, ঝুলে পড়েছে তাদের কঙ্কাল। অস্থিসার দেহাবশেষ জানান দিচ্ছে তারা বেশ ক্লান্ত আর বিধ্বস্ত।
৫
রাত বাড়তে থাকে, বাড়তে থাকে আমার চোখের ঘুম। কেউ যেন চোখের পাতা টেনে বন্ধ করে দিচ্ছে। ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছি ঘুমের কোলে। ঝিঝিপোকার ডাক বেড়ে যাচ্ছে, রাতখেকো পাখিরা উজ্জীবিত হয়েছে যেন, দূরে লক্ষীপেচা দম্পতি একটানা ডেকে চলছে, ডাহুকের কন্ঠেও উদ্যমতা। অকস্মাৎ একদল শিশুর আগমন ঘটলো আমার রুমে। যারা আমার পূর্ব পরিচিত এবং একান্ত আপনজন, ছোট্ট বেলার খেলার সাথী। কালের পরিক্রমায় হারিয়ে গেছে বসুন্ধরা থেকে। একান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও তারা হাসিমুখে আমাকে উর্ধ্বে তুলে টেনে নিয়ে চললো কোন এক অজানার দেশে। পেছন থেকে অমৃতসুধার ন্যায় কানে ভেসে আসছে "বাবা তুই সুপারি গাছে উঠলি কেন? ইসরে আমার লক্ষী বাছাধনটা গাছটা থেকে পড়ে গেল" । মরার গাছ তোর মায়া মহব্বত বলতে কিছুই নেই" । সেই কৃষ্ণচূড়া বাগানের একান্ত আলাপনের শব্দ গুলো কানে ভেসে আসছে। কানে ভেসে আসছে,"তুমি কোন দিনও আমাকে ছেড়ে চলে যেতে পারবেনা চন্দ্রযুবক।" প্রাচীন দম্পতির দীর্ঘশ্বাসগুলো জমাট বেঁধে গুমোট মেঘ হয়ে ভেসে আসছে আমার দিকে। পরক্ষণেই সব শব্দ এক হয়ে হারিয়ে যাচ্ছে পেছনে -- ক্রমশ দূর থেকে দূরে।