
১
আজকে রাতে ঘুমটা খুব আরামদায়ক হওয়ারই কথা। দীর্ঘ দশ বছর পর আমার সেই ছেড়ে যাওয়া বাড়িতে এসেছি কিনা। সেই পুরনো আসবাবপত্র, পুরনো গন্ধ মাখা বিছানা, নড়বড়ে ঘুনে ধরা খাট। খাটের পাশে ঠিক মাথার পাশে দাদার কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া কাঠের আলমিরা। যে আলমিরাতে রাত হলে আরশোলারা কানামাছি খেলায় মেতে উঠে। আর দক্ষিণমূখী দু’ফুট বাই দু’ফুট জানালা। যে জানালা দিয়ে মৃদুমন্দ বাতাস ঘরের মধ্যে প্রবেশ করে এবং শান্ত শীতল করে তোলে শরীর। আবার সেই সঙ্গে সৃষ্টি হয়েছে সুন্দর একটা আবহ। কারণ সময়টা শরৎকাল। রাতের আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ উঠেছে। মেঘেরা পেজা তুলার মত ভেসে বেড়াচ্ছে। আধো আলো আধো ছায়ায় চোখ পুড়ে যাওয়ার ভয় নেই। যেমন নেই কোন অলৌকিক আশংকা। দু’একটা লক্ষী পেঁচার ডাক শোনা যায় বৈকি। তাতে ভয়ের চাইতে হাসি পায় বড্ড। কারণ বিগত দশ বছর আরও কত ভয়ের জগৎ জয় করে এসেছি কিনা। দূরে কিছু নিশাচর পাখির ডাক শোনা যায়। দক্ষিণা বাতাসে পাতায় পাতায় ঘর্ষণ লেগে যে শব্দের অবতারণা হচ্ছে তাতে মনে হয় কোন শান্ত নদী, আকশ্মিক বর্ষার পানি পেয়ে দ্রুত লয়ে পদক্ষেপ ফেলছে। ঝিঝি পোকার দল রিরি শব্দে মাতম তুলেছে। শব্দটা ক্ষণে ক্ষণে দমকা হাওয়ার মত বৃদ্ধি পাছে। আবার তারা হাঁফিয়ে উঠলে কিছুক্ষণ জিরিয়ে নিচ্ছে যেন। মৌসুমী ফল লোভী বাদুরেরা ডানা ঝাপটাচ্ছে। আর জোনাকরাও কম যায় না। বাতাসের মধ্যে যেন ডুব সাঁতার দিচ্ছে। এরকম একটা পরিবেশে জমপেশ একটা ঘুম না হয়ে যায়ই না।
২
হঠাৎ মায়ের ডাকে সকাল বেলা ঘুমটা ভেঙ্গে গেল। শীতের কাঁথা ছেড়ে উঠতে ইচ্ছে করছে না। মা কানের কাছে এসে ফিসফিস করে বললো, খোকা তোর জন্য পুলি পিঠা আর ভাপা পিঠা বানিয়েছি, খাবিনা? আমার পছন্দের খাবারের কথা শুনে লাফিয়ে উঠে বসলাম বিছানায়। মুখে পানি না দিয়েই নিঃশ্বাস বন্ধ করে গপাগপ পাঁচটা পুলি পিঠা, পাঁচটা ভাপা পিঠা খেয়ে নিলাম। মা বললো, খোকা তোর প্রিয় খেঁজুরের রসও নিয়ে এসেছি। কোথায় মা কোথায় রেখেছো? তাড়াতাড়ি দাও। আমার সময় খুব কম। কেন খোকা তোর আবার কি হলো? এত তাড়া কেন? না মা আমাকে খুব কম সময়ের জন্য ছুটি দেয়া হয়েছে। আজকে বেশীক্ষণ থাকতে পারবো না। আচ্ছা তাহলে তাড়াতাড়ি দিচ্ছি। তবে দু’ গ্লাস খাবি। এর বেশী খাবি না। হাহাহা-ঠিক আছে মা। জেবা আর রেবা ভাগে পেলেই হয়েছে তো! তোর তো আবার হুশ নাই বলতে চলে। বোনদের কথা কি আর খেয়াল থাকে। না মা এখন আর আগের মত খেতে পারিনা। ঠিক কতদিন না খেয়ে আছি। মনে পড়ে না মা, মনে পড়ে না। এখন আমার না খেলেও চলে। মনে কর যেন বাতাস খেয়ে থাকি। ইসরে আমার খোকা মনিটা। কতদিন না খেয়ে আছে। নে বাবা যত খুশী খা খেজুরের রস খা। মা আমার পরম মমতায় মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। আর আমি ধীর লয়ে দু গ্লাস খেঁজুরের রস পান করলাম। এ যেন অমৃত! এ যেন অমৃত! মাকে বললাম, মা আর এক গ্লাস দেয়া যায় না? খেয়ে তৃপ্তি মেটাতাম। আর কবে তোমার দেখা পাই কিনা! লক্ষী মা আমার দেরী না করে তৃতীয় গ্লাস দিতে যাবে, অমনি গ্লাসটা মেঝেতে পড়ে ভেঙ্গে গেল।
৩
নাহ! শান্তিমত যে মায়ের হাতে খেঁজুরের রস খাব তারও উপায় নেই! কতদিন মায়ের হাতের খাবার খাইনা। সে ভুলেই গিয়েছি। ঘুমটা ভেঙ্গে যাওয়ার সময় পেলি না? বালিশে কান পেতে শুনি এ বাড়িতে আরও কিছু নতুন অতিথি এসেছে। এক হিসেবে নতুন অতিথি বলা যাবেনা। কারণ আমার দাদা আর বাবার পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়। দাদা খড়ম পায়ে খটর মটর করে চলতেন। আর আমার বাবা পড়তেন নবীন মুচির নিজ হাতে বানানো চামড়ার স্যান্ডেল। পরিচিত আওয়াজ শুনে বোঝা যায়, দাদা আর বাবাই এসেছেন। কিন্তু তাদেরকে তো এই বাড়ির কেউ দাওয়াত করেনি। তাহলে এলোই বা কেন? হাহাহা--আমার মতই হয়ত উড়ে এসে জুড়ে বসেছে। আমার প্রচন্ড ঘুম পাচ্ছে। তাই আর আগ্রহ নিয়ে তাদের সাথে দেখা করতে গেলাম না। ভাগ্যিস এই ঘরটা পরিত্যক্ত। তা না হলে কে এসে আবার জুড়ে বসতো, তার কোন ঠিক ঠিকানা আছে? যাক বাবা আমি ঘুমাতে এসেছি ঘুমাই। দাদামশাই আর বাবা তোমরা আবার বিরক্ত করো না!
৪
আহা! মায়ের হাতের খেঁজুরের রস!
খেয়ে দেয়ে আরামসে শুয়ে আছি। কিছুক্ষণ পর নানীমা এসে হাত টেনে হিড়হিড় করে নিয়ে যাওয়া শুরু করলো। নানীমা তুমি আমায় কোথায় নিয়ে যাচ্ছো? কেনরে বান্দর! তুই না সরষে ইলিশ পছন্দ করিস। তাতে কি হয়েছে? তাতে কি হয়েছে মানে? তোর নানা তোর জন্য শখ করে পদ্মার নতুন ইলিশ নিয়ে এসেছে। আর আমি কষ্ট করে সরষে বেটে তোর জন্য সুন্দর করে রান্না করেছি। আর তুই খাবি না বলছিস? নানীমা আমি কি তোমার হাতের ইলিশ রান্না কখনও মিস করেছি? তা করিস নি! তবে আজকে খেতে চাচ্ছিস না কেন? হঠাৎ নানীমার ফোকলা মুখে পান চিবোনো দেখে হাসি পেল। নানীমার এই এক চেহারা সারাজীবন দেখেছি। সারা শরীর ভাজে ভরা, ফর্সা সুন্দর চেহারা আর ফোকলা দুটো গাল। মুখে পান ভরে সারাদিন অদ্ভুত ভঙ্গিতে চিবোবে। তাই দেখে পাড়ার দুষ্ট বালক-বালিকারা ভেংচি কাটবে। আর নানীমার নিত্য নতুন আবিস্কার করা গালিগুলো শুনে তারা হাসতে হাসতে লুটোপুটি খাবে।
আজকে দুষ্ট বালকেরা আামাকে দেখে মুরগী পড়ানি মাষ্টার বলে ডাকা শুরু করলো। কারণটা অবশ্য তেমন গুরুতর নয়। নানীমার বাড়িতে প্রত্যহ সকাল বেলা চা-নাস্তা খাই কিনা। আর তাদের বাড়ির মুরগী গুলোকে সকাল বেলা ক-খ, ক-খ পড়াই কিনা!
কিরে খোকা হাঁটা থামালি কেন? কই নানীমা এই তো যাচ্ছি। তাড়াতাড়ি চল। বাড়িতে উটকো বিড়ালের যা উৎপাত হয়েছে! এই বলে প্রথামত নানীমা কনু দিয়ে একটু জোরেই গুতা দিলো। এবার লাফিয়ে চলা শুরু করলাম। নানীমাদের বাড়িতে গিয়ে আবদার ধরলাম। নানীমা তোমার হামান দিস্তাটা দাও। পান সুপারি বেটে দেই। না আগে খেয়ে নে তারপর না হলে বেটে দিস। নানীমার হাত ফসকে জোড়পূর্বক হামান দিস্তা নিয়ে পান সুপারি বাটা শুরু করলাম। কিন্তু তার এক কথা আগে খেতে হবে, তারপর হামান দিস্তা। এই বলে হাত থেকে কেঁড়ে নিল সেটা। হামানটা পায়ের উপর ধপাস করে পড়ে গেল।
ধূর! এই ঘরে শুয়েতো স্বস্তি পাচ্ছি না। পায়ের উপর এসে পড়লো সিলিংয়ের ভাঙ্গা ইট-সিমেন্ট।
৫
পাশে বিশালাকার তিনতলা বাড়ি উঠেছে। নীচতলায় আমার এক ছেলে, এক মেয়ে আর পত্নী থাকে। মাত্র দশটি বছর। এরই মধ্যে সবাই ভুলে গেছে আমাকে। ভুলে যাওয়াই স্বাভাবিক! আমার মত হতচ্ছাড়া থাকা আর না থাকা একই কথা।
এলাকার লোকজন আমার নাম দিয়েছিল তারছেড়া বাবুল। বাবুল টা আমার বাবা-মায়ের দেয়া আদরের নাম। বাকীটা নিজ গুনে অর্জন করেছি। নিজ গুন বলতে! এলাকার কোন ব্যক্তি এসএসসি পাশ করতে পারেনি। পারেনি কী তারা কখন শিখতেও চাইনি, হালচাষ করাই তাদের পেশা। এর বিধিবাম হলে গুরুজনেরা জাত গেল জাত গেল বলে চিৎকার করতো। আমি কষ্ট করে পাঁচ ক্রশ দূরে রমা পন্ডিতের পাঠশালায় গিয়েছিলাম। পড়াশুনা করে এক চান্সে তৃতীয় বিভাগে উত্তীর্ণ হয়েছিলাম। এটুকু হলে মনে হয় তারছেড়া বাবুল উপাধিটা কপালে জুটতো না। একটু বিষদভাবেই বলি। আমার বিভিন্ন ধরনের শখ ছিল। যেমন পাখির মত উড়ার শখ ছিল, শখ ছিল নৌকার মধ্যে চাকা লাগিয়ে কিভাবে আরও দ্রুত ঘাগট নদী পাড় হওয়া যায়, আবার কিভাবে দু’চাকার উপর ভড় করে প্যাডেল মেরে তাড়াতাড়ি গঞ্জে যাওয়া যায়?
একটা ঘটনা বলি। একবার শাল কাঠের তক্তা দিয়ে ডানা আর বাঁশ দিয়ে বডি বানিয়ে দু’শত ফুট উচু লালছড়ি পাহাড় থেকে লাফ দিয়েছিলাম। উপর থেকে সোজা এক শ্যাওড়া ঝোপে ধপাশ করে পড়েছিলাম। তবে সে যাত্রায় বেঁচে গিয়েছিলাম। তখন থেকে এলাকার দুষ্ট জনেরা আমাকে তারছেড়া বাবুল বলে ডাকে --হাহাহা। এসব কাজ কারবার করে তো আর সংসার চলে না। গৃহিনীর হাঁড়িতে কোন দিন চাল উঠে কোন দিন উঠেনা। বড় ছেলেটা ইঞ্জিনিয়ারিং এ ফাইনাল ইয়ারে পড়ছে। আর ছোট মেয়েটা ব্যবসা প্রশাসনে থার্ড ইয়ারে। পৈত্রিক সম্পত্তি যা পেয়েছিলাম তা বেঁচতে বেঁচতে এক কানিতে এসে পৌঁছেছে। আমার শখ ছিল ডায়েরী লিখা। ডায়েরীর প্রথম পৃষ্ঠায় লিখেছিলাম, "পৃথিবীর প্রত্যেকটা মানুষের আলাদা দর্শন থাকে। সেই দর্শন খাতা বন্দী হতে পারে। আবার এটাই এক সময় ইতিহাস রচনা করতে পারে।" জানিনা এই কথাটি কে প্রথম বলেছে। যদি কেউ না বলে থাকে। তাহলে আমিই প্রথম বলেছি -- হাহাহা। যাই হোক এই ডায়েরীতে আমার চিন্তা-ভাবনাগুলো লিখে রাখতাম।
৬
বলছিলাম মাঝরাতে ছেলে মেয়েরা কথা বলছে। মাঝরাতে ঘুম ছুটে গেলে যা হয় আরকি! তখন পিন পতনের শব্দটিও যেন কানে লাগে। কি আর করা, কানপেতে ছেলে মেয়েদের কথা শুনতে লাগলাম। এই দশ বছরে এর আগে আসিনি তা বলা ভুল হবে। এসেছিলাম চুপি চুপি। এখনও যেমন আসি। কিন্তু কোনদিন তাদের মুখে আমার কথা বা প্রশংসা শুনিনি। যেমন শুনিনি আমার বাপ-দাদার কথা। একপ্রকার কষ্ট বুকে নিয়েই বারবার ফিরে গিয়েছি আমার গন্তব্যে। আজকে অবাক হয়ে গেলাম। অমনোযোগী থাকায় আগের কথাগুলো শোনা হয়নি। শুধু শুনলাম আমার স্ত্রী জোড় গলায় বলছে। তোদের বাবা এই ডায়েরীটা লিখেছিল বলেই আজকে তোরা এতদূর এগোতে পেরেছিস। অবশ্য ছেলে-মেয়েরা কখনও নাফরমানি করেনি। তাদের মায়ের কথা মাথা পেতে নিল। তারা সমস্বরে বলতে লাগলো, হ্যা মা আব্বা সাইকেল বানানোর ফর্মুলা ডায়েরীতে লিখেছিল বলেই তো আমরা আজকে "বাবুল সাইকেল এন্ড কোম্পানী দিতে পেরেছি"। এতদিনে আমাদের যা লাভ হয়েছে তা আমরা তার হেলিকপ্টার বানানোর ফর্মুলার পেছনে ব্যয় করবো। আমরা মনে করি এতে আমরা সাফল্য অর্জন করবো। এই কথা শুনে আমার স্ত্রী ঘর থেকে বের হয়ে বারান্দায় আসলো। তার দুচোখ বেয়ে অশ্রু ঝড়া শুরু করলো। ইচ্ছে হলো কাছে গিয়ে তার চোখের জল মুছে দেই। কিন্তু আমার যে শরীরই নেই। হাত নেই, পা নেই, এমনকি নেই কোন ছায়া। আমারো যে দুচোখ বেয়ে অশ্রু ঝড়তে চায় কিন্তু চক্ষুও তো নেই। এখন স্ত্রী, ছেলে মেয়ে সুখে আছে, এটাই তারছেড়া বাবুলের বড় সুখ। একটা সুখকর দীর্ঘশ্বাস বুকে করে গন্তব্যে চলে গেলাম।
ছবিসূত্রঃ আন্তজাল।
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে জানুয়ারি, ২০১৫ রাত ১২:৫৫