সব ছবিরই নিশ্চয় গল্প থাকে, সে হোক হাতে আঁকা বা হোক ক্যামেরায় তোলা। আজ এক বন্ধু আমার প্রোফাইল ফটোতে কমেন্ট করলো, ছবিটির পিছনের ইতিহাস জানতে চেয়ে। তখনই মনে হল আসলেই সব ছবিরই ছোট হোক বা বড় হোক একটি ইতিহাস থাকে। আমাদের মত নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের জন্য পারপাস ছাড়া ছবি তোলার কথা কল্পনাই করা যেত না। ক্লাস থ্রিতে সেন্ট জোসেফস স্কুলে ভর্তির জন্য যে ছবি তুলেছিলাম সেটিই ক্লাস সিক্স পর্যন্ত চলে গেছে অবলিলায়। তারপর ক্লাস এইট এ বৃত্তি পরীক্ষা দেবার জন্য ছবি তোলা হল, আমি নিজে গিয়ে তুলালাম। খুব বাজে হল ছবিটা। এই ছবিটাই চালিয়ে দিলাম এস এস সি পর্যন্ত । এর পর কলেজে ঊঠে একটি ছবি তুললাম নতুন করে যা চালিয়ে দিলাম ইঊনিভার্সিটি পর্যন্ত । তার পর প্রয়োজন অপ্রোয়জনে অনেক ছবিই তোলা হয়েছে। সেগুলো আর প্রথম জীবনের গুলোর মত মনে নেই। এখন যেই ছবিটির কথা বলছি, তা ২০০৯ সালে উৎপত্তি।
তখন ঢাকার ধানমন্ডিতে একটি নামকরা ইংলিশ মেডিয়াম স্কুলে ট্রেনিং ইঊনিটে চাকরী করি। খুলনার মানুষ হয়েও যথারিতী অনেক বন্ধু প্রতিম কলিগ পেয়ে গেলাম। সেখানেই একটি স্বল্প শিক্ষিত ১৭/১৮ বছর বয়সী একটি ছেলে ছিল যে অফিস বয় হিসাবে কাজ করত। কেন জানিনা ছেলেটি আমাকে পছন্দ করতো। বার বার রুমে আসত, আর আমিও ঝাড়ি দিয়ে বাইরে পাঠিয়ে দিতাম। বলতাম, আমি ডাকলেই যেন ভিতরে আসে। প্রতিবার আমার ঝাড়িতে ওর চেহারাটা মলিন হয়ে যেত। প্রায় ওকে দেখতাম, অফিসের ছাদে ক্যাফেটেরিয়াতে কাজ করা পিচ্চি পিচ্চি মেয়েগুলো বা অফিসের সিস্টারগুলোকে ও নজরুল সঙ্গীত শুনাচ্ছে। ওর কণ্ঠে নজরুল সঙ্গিত শুনেই আমার নজরুল গীতির উপর কিছুটা ভক্তি তৈরী হল। প্রতি এক দুই মাস পর পর আমার কাছ থেকে নতুন টি শার্ট বা শার্ট পেয়ে ওর থেকে অবাক কেউ আর হতনা মনে হয় পৃথিবীতে। আমার রুমের সিস্টার কে নাকি বলত যে, স্যারকে বুঝি না, ওনার চোখ দেখলেই আমার ভয় করে, আমাকে পছন্দ করে না কিন্তু আবার আমাকেই গেঞ্জি, শার্ট গিফট করে, আর কাউকে না। কিন্তু স্যার কে আমার খুব ভালো লাগে প্রথম থেকেই, স্যার রাগী হলেও ভালো মানুষ। আমার রুমের সিস্টার সোনিয়ার মারফত আমি আমার সম্বন্ধে ওর ধারনা জানতে পারতাম।
১ বছর পর। আমার স্কলারশিপ হয়ে গেলো, অফিসে জানিয়ে দিলাম ১ মাস আগে যে আমি জব ছেড়ে দিব। অফিসের সবাই জেনেগেল, অনেকে আমাকে বিদায়ী গিফট দিয়ে যেতে লাগলো রুমে এসে। প্রায় ১০০ স্টাফের সবাই বিভিন্ন ফ্লোরে বা ক্যাফেতে দেখা হলেই খবরাখবর জানতে চাইতো, আমি চলে গেলে তাদের খারাপ লাগবে এই কথাই বেশীর ভাগ কলিগ বলতে থাকলো। প্রায় দেখতাম, ওই ছেলেটি আমাকে দেখেই কথা বলতে চাইতো কিন্তু সাহস করে পারতো না বা সু্যোগ পেত না। একদিন দুপুরে খাবার পরে দেখি দরজায় দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করছে,
-স্যার একটু আসবো।
-কেন কি চাই ? ওখানে দাঁড়িয়ে বল।
-স্যার একটু আসি, বলে ও দেখি দুরু দুরু পায়ে আমার রুমে ঢুকে আমাকে বলছে, স্যার আমি আপনাকে খুব ভালো বাসি স্যার , আপনি চলে যাবেন শুনে আমার খুব মন খারাপ।
- আচ্ছা, আমাকে কি তোর বান্ধবী যাদের গান শুনাস ওদের চেয়ে বেশি ভালো বাসিস না কম বাসিস ?
- না স্যার, ওদের সাথেতো স্যার একটু গল্প করি। ওরা আমার গান শুনতে চায়, বলে আমার গানের গলা নাকি ভালো।
- তাই নাকি? তা আমাকে এতো ভালোবাসিস একদিন গান তো শুনালি না। এখন একটা শুনা, শুনি।
- আচ্ছা স্যার। “আমায় নহে গো, ভালোবাস শুধু.. ভালোবাস মোর গান…………”
-বাহ তুই তো ভালই গাস। স্যার আপনি যদি, ১৫ দিন একটানা নজরুল সঙ্গীত শোনেন তাহলে আর কোন গান আপনার ভালো লাগবে না। নজ্রুলের স্যার ৩০০০ সুর করা গান আছে।
- আচ্ছা। জানতাম না। যাক আর একদিন সময় করে তোর গান শুনবো।
- স্যার, একটা অনুরোধ করবো। শেষ অনুরোধ, স্যার।
- কি ব্যাপার। বল।
- স্যার, আমাকে আপনার একটা ছবি দিবেন ? স্মৃতি হিসাবে রাখবো, আপনাকে তো আর পাবো না।
- আচ্ছা, ঠিক আছে দেবো। দেখি বাসায় ছবি আছে কিনা।
- না স্যার, অফিসের সার্ভারে আপনার ছবি আছে, বিপ্লব স্যার দেখতেছিলো সেদিনের প্রোগ্রামের ছবি। ওই খান থেকে একটা ছবি দেন স্যার।
- আচ্ছা, এই পাশে আয়, দেখ কোনটা নিবি।
- স্যার ওই যে ওইটা, নীল টাই পরা আর ক্রিম কালারের শার্ট। স্যার একটু প্রিন্ট করে দিয়েন, আমার পেন ড্রাইভ নাই।
- আচ্ছা ঠিক আছে, আমি পেন ড্রাইভে দিয়ে দিচ্ছি তুই প্রিন্ট করে নিয়ে আয়, ২/৩ কপি করিস।
এর পর ওর সাথে অনেক দিন দেখা নেই। অফিসের গোছ গাছ করতে সাথে নিজের টিকিট, ভিসা, মন্ত্রনালয় এইসব নিয়েই ব্যতিব্যাস্ত। অফিসেও ঠিক মত আসতাম না। আমার শেষ অফিস ডের আগের দিন, দেখি আমার মোবাইলে একটা অপরিচিত নম্বরের কল। ধরেই বুঝলাম যে আমার অফিসের সেই ছেলে। হ্যালো স্যার, আপনি কবে চলে যাবেন আজকেই? না, কেন ? থ্যাঙ্কু স্যার। স্যার আমি শুনছি আজকেই আপনি চলে যাচ্ছেন। স্যার আমি এখন পঞ্চগড়, কালকে সকালে আপনার সাথে দেখা করবো। আসসালামুয়ালাইকুম।
পরদিন একটু দেরি করে অফিস গেলাম। শেষ দিন। মনটা একটু ভরাক্রান্ত। কিছু ভালো মনের মানুষ পেয়েছিলাম এখানে। আর কিছু মানুষ ছিলো যারা আমাকে সত্যিকার অনেক ভালোবাসতো, তার মধ্যে আমাদের প্রধান বসও একজন। নীচতলায় সিড়ি দিয়ে ঊঠতেই এক কলিগের সাথে দেখা, বলল- আহসান ভাই, আপনার রুমে গেছেন? আমি বলি না যাচ্ছি, বলল যান চমক আছে। তিনতলা পর্যন্ত উঠতে উঠতে আরও কয়েকজনের সাথে দেখা, সবাই একই প্রশ্ন। আমি একটু অবাক, আর মনে মনে প্রস্তুত হলাম সারপ্রাইজড না হবার জন্য। ঢুকে দেখি ওই ছেলে দাঁড়িয়ে আছে, সাথে আর কয়েকজন কলিগ। আমি ঢুকতেই আরও কয়েকজন এসে হাজির। ছেলেটি আমাকে দেখেই, ওর সামনে পেপার দিয়ে ঢেকে রাখা একটি ক্যানভাস দেখিয়ে বলল, স্যার আপনার জন্য। পেপার সরাতেই আমি পাথর হয়ে গেলাম। পোস্টার সাইজ ক্যানভাসে আমার ছবিই কিন্তু নিখুত হাতে আঁকা। যেই ছবিটি আমি ওকে দিয়ে ছিলাম সেটিই। পাশ থেকে ও বলে যাচ্ছে, স্যার আপনাকে যে কত ভালবাসি, তার প্রমান। আপনি স্যার আমাকে সারাজীবন মনে রাখবেন। অনেক যত্ন নিয়ে স্যার ১২ দিন একটানা বসে আকছি। এই ছবি পানিতে ভিজালেও নষ্ট হবে না। আপনার চোখ আকতেঁ আমার ৭ দিন লাগছে। আপনার এই চোখে অনেক মায়া, সেই মায়াই আনতে পারতেছিলাম না। যদিও আপনার চোখে আবার ভয়ও আছে, ইচ্ছা করেই সেটা রাখিনি। আপনার চোখ স্যার আসলেই অনেক সুন্দর। স্যার নিচে আমার নাম লেখা আছে, রওশন-২০০৯। স্যার আমাকে মনে রাইখেন।
আমার এই ছোট্ট জীবনে অনেক প্রকার মানুষের অকুন্ঠ ভালোবাসা পেয়েছি। কিন্তু রওশন এর মত এই রকম পাইনি। ক্লাস ৫ পর্যন্ত পড়াশুনা করা উত্তরাঞ্ছলের দরিদ্র এই ছেলেটি আমাকে আসলেই স্তম্ভিত করে দিয়েছিল। পরে শুনলাম, ও ছোটবেলা থেকেই আকাআকি পছন্দ করে, রিক্সার পিছনে আর্ট করত একসময়। তারপর সরকারি স্কুলের দেয়ালে মীনা কার্টুন একেছে অনেক জেলায়। আর পোট্রেট আর্ট এই প্রথম, আমাকে দিয়েই। এখনও যতবার দেয়ালে টানানো ছবিটি দেখি, আমার সেই রওশনের ভীত মুখটি চোখের সামনে ভেসে ওঠে। ওকে আসলেই কখনও ভুলে থাকা যাবে না। আপুদের কাছে থেকে শোনা, আমি যখন দেশের বাইরে চলে গেলাম, আম্মা আমার রুমে এসে নাকি এই ছবির দিকে তাকিয়ে থাকতো প্রায় দিন। যেই আসে আমার বাসায় সেই, অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে এই সুন্দর শিল্পকর্মটির দিকে। এই ছবির কল্যানে কত শত বার যে আমার এবং আমার পরিবারের সবার রওশন এর কথা বলতে হয়েছে মানুষকে !!!
এক সময় হয়তো আমি থাকবো না এই পৃথিবীতে, আমার বা আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্ম হয়তো এই ছবির দিকে তাকিয়ে প্রথম প্রশ্ন করবে, কে একেছিল এটা ? হয়তো কেউ উত্তর দেবে, রওশন। ওথবা নিচে সাক্ষর করা নাম তারিখ দেখে জেনে নেবে ওর নাম। রওশন সফল, ও বেঁচে থাকবে আমার পরিবারের ও আমার মাঝে এই ছবিটির সাথে। কিন্তু যে অমুল্য ও নিঃসবার্থ ভালোবাসার প্রতিফলন এই ছবিটি তা একমাত্র আমার মাঝেই বেঁচে থাকবে আমৃত্যু। যেখানেই থাকিস ভালো থাকিস রওশন, তোর মত ভালবাসা হয়তো তোকে দিতে পারবো না কিন্তু কৃতজ্ঞচিত্তে তুই রয়ে যাবি আমার স্মৃতিতে অম্লান।