১।
দেশের ঠান্ডা চলে গেছে কিন্তু রেশ রেখে গেছে আমার ভিতরে। গত দুই সপ্তাহ ধরে গলা ব্যাথা। রাতে লাগে ঠান্ডা, সকালে উঠে কথা বলতে কষ্ট হয়। টানা দুই সপ্তাহ ধরে খুব অল্প ঘুমিয়ে অবিরাম কাজ করে শরীর আর চলে না। বিনিময়ে অবশ্য অনেক প্রশংশা পেলাম দেশী বিদেশী কলিগদের কাছ থেকে, তাতেই আনন্দ। এই ব্যস্ত ছূটে চলা জীবন খুব ভালো লাগে, এঞ্জয় করি পুরোটা। এইতো সামনের মাসে আবার দেশের বাইরে, হয়তো ইন্দোনেশিয়া, তার পরের মাসে আবারও অন্য দেশে-সম্ভবত মঙ্গোলিয়া। আগে দেশী স্টাফ ছিলাম চলছিলো ভালোই। এখন গ্লোবাল স্টাফ হওয়াতে টাকার সাথে সাথে ব্যস্ততা বেড়েছে বহু বহু গুন। কিছু দেশি কলিগ বলে আমি নাকি খুব বোকা, হাসি মুখে তেল মারলেই নাকি সব লোড ঘাড়ে নিয়ে কাজ করে দেই। আমি শুনে হাসি, বলি সমস্যা নেই, আমার দরজা থেকে কেউ সাহায্য চেয়ে ফিরে না গেলেই হল। আজ কোথাও যাইনি, সব বাদ, মিটিং, কাজ সব। মাঝে মাঝে লাইন ছেড়ে সরে যেতে ভালই লাগে। ঘরে শুয়ে শুয়ে গান শুনছি আর ব্রাঊজিং করে বেড়াচ্ছি। আজ আইজ্যাক আসিমভের একটা বই শেষ করবো।
২।
মানুষের চাওয়ার কোন শেষ নেই। যে যত পায়, তত চায়। আমি একজনকে চিনি, একটা সাইকেল কিনতে চাচ্ছিলো। বলল একটা ভালো সাইকেল হলে আর কিছু চাওয়ার নেই, ইচ্ছে মত ঘুরে বেড়াতে পারবো। এর ৬ মাস পরে মোটর বাইক কিনলো। ইদানিং বলছে, একটা গাড়ি হলে ভাল হত। সে আমাকে বলল, আপনাকে তো কখনও বলতে শুনিনা যে কিছু দরকার। আপনি কেন রিকশায় ঘোরা ঘুরি করেন? প্রতিদিন একগাদা টাকা খরচ করেন সি এন জির পিছনে। সেদিনও তো গুলশান থেকে অর্ধেক পথ হেটে এসেছেন। আপনি একটা গাড়ি কিনলে আমরাও ব্যবহার করতে পারতাম। আমি হাসি, সেই নিঃশ্চুপ হাসি। বলি, আমার চাওয়া পাওয়া কম। সৃষ্টিকর্তার কৃপায়, যা চেয়েছি তার চেয়ে অনেক অনেক বেশী পেয়েছি। এই শহরে গাড়ি হচ্ছে একটা যন্ত্রনা, যাস্ট ওয়েস্ট অব মানি, মেন্টাল এনার্জি এন্ড টাইম। হ্যাঁ চাইলেই গাড়ি কিনতে পারি। কিন্তু রিকশায় বসে আকাশ দেখার লোভ কখনও সামলাতে পারবোনা মনে হয়। এই শহরের মানুষ আকাশের দিকে তাকানো ভুলে গেছে, ওরা কেউ পাশেও তাকায় না। তাকিয়ে থাকে এক বদ্ধ ঘোর লাগা চোখে সাম্নের দিকে মাথায় থাকে হাজার টন চিন্তার বোঝা। রিক্সা ওয়ালার সাথে গল্প করতে করতে যখন আসি তখন মনে হয় গাড়ি কেনার কোন দরকার নেই। আর যখন হাটতে থাকি তখন শত শত লাইভ গল্প দেখতে দেখতে আসিঃ শো রুমের নতুন ডিজাইনের ফার্ণিচার, গাড়ি, আকুরিয়ামের নতুন মাছ, নতুন কোন বই, হকার, চকলেট শিশু, ভিখারির টাকা গোনা, বিশ্রামরত রিক্সাওয়ালার মোবাইলে হাসি মুখে কথা বলা, চায়ের দোকানীর ব্যস্ত হাতে কাঁচের কাপ ধোয়ার টুং টাং শব্দ, ফুল হাতে পিচ্চি মেয়েগুলোর দৌড়াদৌড়ি আরও কত কি। এই মানুষের মাঝেই আসল সুখ, এই ছোট্ট জীবনে সেটা হারাতে চাইনা।
৩।
আমার অনেক অনেক প্রিয় এক বড়ভাই সেদিন রোড আক্সিডেন্ট করলো, কপাল গুনে বেঁচে গেছেন। ভর্তি হয়েছেন এপোলো হাসপাতালে। প্রতিদিন এই জ্যাম ময় ঢাকা শহরে অনেক পথ পাড়ি দিয়ে ওনাকে দেখতে গিয়েছি। কারন আমি না গেলে উনি খেতে চাননা কিছুই, আমি গিয়েই ওনার ড্রেস চেঞ্জ করে দেই। নিজের অসহায়ত্ব উপলব্ধি করে কেদে ওঠেন ডুকরে। আমি অভয় দেই। ওনার ক্ষমতাধর, ধনী আত্মীয় স্বজনেরা ভ্রুকুটি করে তাকিয়ে থাকেন, হয়তো মনে মনে ভাবেন-এই ছেলের মধ্যে কি পাইলো আমাদের দীপু। একমাত্র ভাবী শুধু স্বাভাবিক ব্যবহার করেন। গতকাল ভাইকে ওপারেশনের জন্য বাইরে পাঠানো হল, উঠিয়ে দিয়ে আসলাম প্লেনে। আমাকে জড়িয়ে ধরে হাউ মাউ করে কান্না, বলে - তুমিও চল আমার সাথে, তুমি না গেলে আমার ভয় করবে ওখানে। তোমার ভাবিকে বলি তোমার টিকিট কেটে দিক, প্লিজ চলো। আমি প্রবোধ দেই, যে ভাই কিছু হবে না, আমার বন্ধু বান্ধব সবাইকে বলে রেখেছি ওখানে। ওরা অনেক ভালো, মনে হবে আমিই আছি আপনার পাশে। আমাকে কথা দিতে হল যে, আমি প্রতিদিন ২ বার করে ফোন দিব তাকে আর আমার নম্বর এক সেকেন্ডের জন্যও বন্ধ করবো না। আশ্চর্য, কেয়েক বছর আগে দেশের বাইরে পরিচয় এই ভাইয়ের সাথে। কিন্তু ভালোবেসে ফেলেছে পরিবারের থেকেও বেশী। বাসায় ফেরার পথে মনটা খুব খারাপ হল কেন জানি, শহরের সুন্দর লাইটিং গুলো সব মনে হলবিষাদময়। মানুষের জীবনটা বড় অদ্ভুত। এক নিমিষের মধ্যেই সব কিছু চেঞ্জ হয়ে যায়, সব প্লান ভেস্তে যায়। কিছুক্ষন পরে কি হবে আমাদের তাই আমরা জানি না- অথচ আমাদের কত প্লান, কত আয়োজন, কত ছোটাছুটি। সবই আসলে অর্থহীন যেখানে এক সেকেন্ডেরও কোন গ্যারান্টি নাই। আজ বাংলাদেশ সময় বিকাল ৫টায় ওনার অপারেশন। আশা করি সবকিছু ভালোভাবেই হবে।
৪। আজ ১৩ই মার্চ আমার ছোটবেলা বন্ধু ডাঃ সাইফুলের জন্মদিন। ফোন দিলাম ধরেনি, হয়তো সার্জারী নিয়ে ব্যস্ত। একটা মেসেজ পাঠিয়ে দিলাম। আজ থেকে ১০ বছর আগে এই দিনে আমার বিশ্ব বিদ্যালয়ের ১১ জন আর্কিটেক্ট সিনিয়র সুন্দরবনে পিকনিকে গিয়ে সমুদ্রে ডুবে মারা গিয়েছিলেন। সে মুখ গুলো ভোলার নয়, তাদের সারিবদ্ধ লাশগুলো এখনও চোখের সামনে ভাসে। তাদের মৃত্যুর আর কিছুদিন পরের তাদের ব্যচেলর ডিগ্রীর সার্টিফিকেট পাবার কথা ছিল। এক দূর্ঘটনা সেই সব স্বপ্ন কেড়ে নিল নিমেষেই। তাদের আত্মা শান্তিতে থাকুক। আজ শহীদ রাজু দিবস, যার নামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজু ভাষ্কর্য তৈরি হয়েছে। ১৯৯২ সালের এই দিনে বিশ্ববিদ্যালয়ে সন্ত্রাস বিরোধী মিছিলের সামনে থাকা এই ছেলেটি এক দলীয় সন্ত্রাসীর গুলিতে মারা গিয়েছিলো। কজন মনে রাখে এই হারিয়ে যাওয়া মেধাবীদের। সবাই শান্তিতে থাকুক।
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই মার্চ, ২০১৪ বিকাল ৪:২৫