ইউএস বাংলা নিয়ে একটু খচখচানি আছে নেপালের দুর্ঘটনার পর থেকেই। যদিও ওই দুর্ঘটনার পর চট্টগ্রাম গিয়েছি এই প্লেনেই। তবুও আতংক ভর করে থাকে। ২৯ ডিসেম্বর কসমস থেকে জানানো হলো আমাদের ফ্লাইট ছিল সাড়ে নয়টায়, সেটা পিছিয়ে ১২ টায় নেওয়া হয়েছে। সুতরাং দেরি করে গেলেও হবে।
আমরা সকাল ১০ টায় বের হয়ে এয়ারপোর্টে গেলাম। সেখানে ইমিগ্রেশন ক্রস করে বসে আছি তো আছিই। আর কিছুক্ষণ পরপর স্ক্রিনে দেখছি। ইউএস বাংলার কোনো খবরই নেই। শেষমেষ বেলা দুইটায় প্লেনের কাছ পর্যন্ত যেতে পারলাম। আর প্লেনে উড়াল দিলাম।
খুব বিরক্ত লেগেছিল এজন্য যে প্লেনটা দেরি করছে। যে প্লেন সোয়া নয়টা থেকে সাড়ে নয়টায় যাওয়ার কথা সেটা বলল ১২ টায়। এরপরে সেটা উড়াল দিতে বাজালো দুপুর দুইটারো বেশি। খুবই হতাশাজনক। অনেক প্যাসেঞ্জার খুবই ক্ষুব্ধ ছিলেন। তারা বলছিলেন, ১২ টায় রিশিডিউল হয়েছে এটা তাদের জানানো হয়নি। তারা কেউ এসেছেন ৬টায় কেউ বা সাড়ে সাতটায়। এসে শুনলেন ১২ টায়। এখন ২ টাতেও প্লেন ছাড়েনি। খুবই বিরক্ত ছিলেন।
যাইহোক, শেষমেষ প্লেন তো উড়লো।
সূবর্ণভূমি এয়ারপোর্ট:
ইউএস বাংলা নেমে পড়লো সূবর্ণভূমি এয়ারপোর্টে। তখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে, অন্ধকার নেমে আসছে। আমার যতদ্দূর মনে পড়ে তখন মনে হয় ৬টা কিংবা তার কিছু বেশি বাজে। নেমেই দ্রুত হাঁটা শুরু করতে হলো কারণ বেল্ট ছেড়ে দেবে। আগেই শুনেছি এয়ারপোর্টটা অনেক বড়। ইমিগ্রেশন পর্যন্ত পৌঁছাতে কিছু সময় লাগে।
তবে যতটা শুনেছি ততটা নয়। আর ইমিগ্রেশনের কাছে পৌঁছাতেই এক কর্মকর্তা আমাদের ডান দিকে যেতে বললেন। আমি গিয়ে বললাম, ওদিকে কেন যাবো? ইমিগ্রেশন তো বাম দিকে। তিনি হেসে ডান দিকে হাত দিয়ে বললেন, এখানে যাদের সঙ্গে বাচ্চা আছে তাদের জন্য। তোমরা এখানে যাও। দ্রুত কাজ হবে।
বিষয়টা বেশ ভালো লাগলো। সত্যি সত্যিই দেখলাম শিশু আছে এমন সবাইকে এই লাইনে দাঁড় করানো হয়েছে অযথা ঝক্কি যেন পোহাতে না হয় সে জন্যই এই ব্যবস্থা। ইমিগ্রেশন অফিসার একজন নারী ছিলেন। ইমিগ্রেশন ক্রস করার সময় মহিলাটা বলল, ওয়েলকাম টু থাইল্যান্ড স্যার।
বেল্ট থেকে লাগেজ নিয়ে আমাদের দু’টি কাজ করতে হবে। প্রথম, একটা সিম কিনতে হবে। দ্বিতীয়ত, কসমসের ওখানকার প্রতিনিধি আরিফ নামে একজনকে ফোন দিতে হবে। তিনি গাড়ির ব্যবস্থা করে রেখেছেন। কোথায় গেলে গাড়ি পাবো সেটা জানাবেন।
আমরা সিম কিনলাম। কিছুক্ষণ রেস্টও নিলাম। বাচ্চারা অনেকক্ষণ প্লেনে থেকে কিছুটা ক্লান্ত হয়ে পড়ছিল। তাদের একটু ফ্রেশ করে নিলাম। রীভানকে খাইয়েও নিলাম। এরপর আরিফ সাহেবকে ফোন দিলে জানালো ২ নম্বর গেটে আমাদের পৌঁছাতে; সেখানে প্ল্যা-কার্ড নিয়ে একজন দাঁড়িয়ে থাকবেন।
আমরা হাঁটতে হাঁটতে সত্যিই সত্যিই প্ল্যা-কার্ড সহ একজন কম বয়সী তরুণীকে দেখতে পেলাম। মজার বিষয় হলো, সে আমাদের হাতে প্ল্যা-কার্ড দিয়ে ছবি তুলে কাকে যেন পাঠালো। বুঝলাম, হয়তো তাদের এখানকার এজেন্সিকে নিশ্চিত করার জন্যই ছবি পাঠাবে।
এরপর গাড়ির কাছে নিয়ে গেলো। বিস্ময়কর এক মাইক্রাবাস। ভিতরে রঙ-বেরঙের আলো। আছে টেলিভিশন। আমরা ওঠামাত্র সে টেলিভিশন ছেড়ে দিল। বাচ্চারা কার্টুন দেখা শুরু করে দিল।
আমাদের ড্রাইভারের নাম ছিল নিও। ইংরেজি খুবই অস্পষ্ট। গাড়িতে ওঠার আগে সে বারবার একটা প্রশ্ন করছিল। আমি কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলাম না। কিছুক্ষণ পর বুঝলাম সে পাতায়াতে আমাদের হোটেলের নাম জিজ্ঞেস করে বলছে, সিজন পাতায়া?
আমি বোঝা মাত্র বললাম, হ্যাঁ হ্যাঁ সিজন পাতায়া যাবো।
তাকে জিজ্ঞেস করলাম, কতক্ষণ লাগবে?
নিও বললো, দুই ঘণ্টা।
‘সেক্স সিটি’ পাতায়া
যখন পাতায়া রওনা দিলাম তখন অন্ধকার নেমে এসেছে। ইউএস বাংলা ঠিকঠাক সময় আসলে বিকেলের আগেই পাতায়া পৌঁছানোর কথা। তাদের এই দেরির কারণে আমাদের যাত্রা তো বিলম্ব হলোই সঙ্গে পুরো একটা দিন মাটি হয়ে গেলো। পাতায়াতে আমরা থাকবো ৩ রাত, ২ দিন। অর্থাৎ ৩০, ৩১ ডিসেম্বর ও ১ জানুয়ারি। আমাদের পরিকল্পনা ছিল বিকেলে পাতায়া পৌঁছে রেস্ট নেব। আর রাতে ঘুরতে বের হবো। পুরো পরিকল্পনাতেই ছাই ঢেলে দিতে ইউএস বাংলা ব্যাপকভাবে সহযোগিতা করলো।
অন্ধকারে ব্যাংকক পার হচ্ছি। খুব কিছু দেখাও যাচ্ছে না। ক্লান্তিও অনেকটা ছেয়ে গেছে সবাইকে। সবাই গা এলিয়ে ঝিমাচ্ছে। বিশেষ করে ফাহিম তো মহা ঘুমে চলে গেলো। রীভও খেয়ে দেয়ে দিয়েছে ঘুম। সুবর্ণভূমি থেকে পাতায়া যেতে লাগবে পাক্কা দুই ঘণ্টা।
সত্যি সত্যিই একটা সময় খেয়াল করলাম গাড়ি পাতায়াতে ঢুকে পড়েছে। আমি সঙ্গে সঙ্গে গুগল ম্যাপ অন করে দেখতে থাকলাম হোটেলের লোকেশন। তখন দেখাচ্ছিল ২০ মিনিটের মধ্যে হোটেলে পৌঁছে যাবো।
আমাদের হোটেলের নাম সিজন পাতায়া। ছিমছাম পুরোনো হোটেল। ওখানে নেমে পড়লাম। লাগেজ নামিয়ে আমি হোটেলটা কেমন বুঝার চেষ্টা করছিলাম। হঠাৎ দেখি ড্রাইভার গুড বাই বলেই চলে গেলেন। যাইহোক, গাড়িটা ঠিক করে দিয়েছিল কসমস হলিডে। খরচপাতি সব আমাদের প্যাকেজের মধ্যেই। সুতরাং টাকা পয়সা নিয়ে ঝামেলা হবে না।
আমরা ভেতরে ঢুকে রিসিপশনে বুকিং কাগজ দিলাম। ফর্ম দেওয়া হলো সেটা পূরণ করলাম। তখন বলা হলো, একশ ডলার জমা দিতে হবে। চেক আউটের সময় সেটা ফেরত দেবে। এটা হলো সিকিউরিটি মানি। আপনি যদি হোটেলের কোনো ক্ষতি করেন তারা সেই হিসেবে টাকাটা রাখে। তবে চাবি বুঝিয়ে দিতে গিয়ে এক গাদা নিয়মের কথা বলে দিলো। সেগুলো হলো, রুমে সিগারেট খাওয়া যাবে না। সিগারেট খেলে ২০০০ বাথ জরিমানা। রুমে কিছু ভাঙলে ৫০০ বাথ জরিমানা। চাবি হারালে ২০০০ বাথ জরিমানা। প্রতিদিন রুমে দুই বোতল পানি দেওয়া হবে। সেই পানি ছাড়া তাদের এক্সট্রা বোতল আছে রুমে। সেটা খেলে ২৫ বাথ দিতে হবে। ইত্যাদি ইত্যাদি। পরে শুনলাম, এই হোটেলটিতে নাকি বাঙালি ও ভারতীয়দের বিচরণ বেশি। এজন্য এত নিয়ম-কানুন। তারা নাকি নন স্মোকিং রুম হওয়া সত্ত্বেও সিগারেট খায়। রুম নোংরা করে, অনেকে চাবিও হারায়। এজন্য এত নিয়ম-কানুন তারা জারি করে রেখেছে।
যাইহোক, রুমে গিয়ে বেশ তৃপ্তি পেলাম। রুমটি সুন্দর, ছিমছাম। সম্ভবত ১৪ তলায় আমাদের রুম ছিল। কাঠের মেঝে, ডাবল বেড, দুটি সোফা আছে, মিনি ফ্রিজ, চা কফি, বিয়ার, মদ, ভদকা এমনকি এক প্যাকেট ডিউরেক্স কনডমও রুমে রাখা। বিষয়টা দেখে আমি আর নিতু হাসতে হাসতে শেষ। এরা কনডমও রুম সার্ভিসে প্রোভাইড করে রেখেছে।
লাগেজ-পত্র গুছিয়ে ফ্রেশ হতে হতে রাত ১০টার মতো বেজে গেছে। খিদেও পেয়েছে। ক্লান্তিকর একটা দিন সবার জন্যই। বাচ্চারাও ক্লান্ত। আবার এখন রাতে খেতে যেতে হবে। ম্যাগডোনাল্স যাবো সেটাই সিদ্ধান্ত হলো।
ফাহিম গুগল ম্যাপ বের করে ম্যাগডোনাল্সের লোকেশন বের করলো যেটা এত রাতেও খোলা আছে। সেই অনুযায়ী হাঁটা শুরু করে দিলাম। হাঁটছি তো হাঁটছি প্রায় ২০-২৫ মিনিট পর দেখলাম দূর থেকে একটা ম্যাগডোনাল্স দেখা যাচ্ছে। সেখানে গিয়ে চিকেন, বার্গার, কোক আমরা খেয়ে নিলাম। খরচ সম্ভবত ২০০-৩৫০ বাথের পড়েছে। এখন মনে হচ্ছে খরচের বিষয়গুলো লিখে রাখলে ভালো হতো। যারা ভবিষ্যতে যাবেন তাদের কাজে দিত। তবে এতটুকু বলতে পারি, আপনারা ম্যাগনোডালসে খেলে ২০০-৩০০ বাথের মধ্যে খেতে পারবেন।
ম্যাগনোডালসে একটা মজার ঘটনা বলি। ক্যাশে থাকা একজন নারী ছিলেন। তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করছিলেন, কোয়া অর স্পা? আমি বুঝতে পারছিলাম না। বার বার জিজ্ঞেস করছি। সেও বলছে, কোয়া অর স্পা। পরে বুঝতে পারলাম সে জিজ্ঞেস করছে, কোক নেব নাকি স্প্রাইট নেব। এটা নিয়ে হাসাহাসি করলাম অনেক। ওদের ইংরেজিটা বোঝা একটু কষ্টই হবে মনে হচ্ছে।
পাতায়ার সবচাইতে বড় সমস্যা হলো, সেখানে গাড়ি সার্ভিস খুব অপ্রতুল। পরিবার নিয়ে গেলে আপনাকে প্রচুর হাঁটতে হবে। এছাড়া টুকটুক আছে, আমাদের দেশের টেম্পুর মতো। সেটার রুট বোঝা মুশকিল। অনেক সময় খালি থাকলে পুরোটা আপনি ভাড়া করতে পারবেন। কিন্তু এক্ষেত্রে তারা যথেষ্ট ঠকায়। সামান্য রাস্তার জন্য এরা ২০০-২৫০ বাথ চেয়ে বসে। বাধ্য হয়ে কয়েকবার আমরা উঠেছিও।
ম্যাসাজ পার্লার ও বার:
পাতায়ার সবচাইতে ইন্টারেস্টিং বিষয় হলো, অলি-গলিতে কিছু পরপরই হলো মিনি বার ও ম্যাসাজ পার্লার। রমণীরা নানা রঙে সেজে গুজে বারগুলোতে বসে থাকছে। কেউ কেউ হাসছে, কারো কারো চোখে যেন বিষাদের ছায়া। ছোট ছোট কাপড় পরে কেউ কেউ, কেউ আবার খুব পরিপাটি। অনেক মেয়েকে দেখলাম, রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়া কোনো তরুণকে টিজ করছে, তাকে ডাকছে, দল বেধে তার সঙ্গে ফ্লার্ট করার চেষ্টা করছে।
পাতায়ার রাস্তা ও গলিগুলো ঢাকার মতই। কোথাও নোংরা, কোথাও পরিচ্ছন্ন। তবে বলতে হয় মানুষগুলো অন্যরকম। এই যে বারে কিংবা মাসাজ পার্লারে নারীরা দাঁড়িয়ে থাকে, এরা কিন্তু বুঝে-সুঝে ব্যবহার করে। যখন দেখবে আপনি আপনার পরিবার নিয়ে চলাচল করছেন, তখন সে আপনাকে কোনো ধরনের ইঙ্গিত দেবে না। কোনো ফ্লার্ট করার চেষ্টা করবে না। তবে পাতায়ার টুকটুক ও ট্যাক্সি ড্রাইভারদের বলতে হয় খুবই দুই নম্বরি। এরা সারাক্ষণ আপনাকে ঠকানোর চেষ্টায় থাকবে। আমরা একবারও টেক্সিতে যাতায়াত করিনি। তবে টুকটুক বাধ্য হয়ে মাঝে মাঝে ব্যবহার করেছি।
পাতায়া নিয়ে আরো কিছু যোগ করবো লেখায়। তার আগে পাতায়া তো সমুদ্রঘেঁষা শহর। এর সঙ্গে আছে কোহলার্ন আইল্যান্ড। যদিও বাঙালিরা এটাকে কোরাল আইল্যান্ড বলে। কোহলার্ন-এর বাংলা কি কোরাল? এটা অবশ্য আমার জানা নেই।
কেমন দেখলাম কোহলার্ন আইল্যান্ড?
কসমস হলিডে থেকে আমাদের প্যাকেজের আওতায় ছিল প্লেন টিকিট, হোটেল ও এয়ারপোর্ট-পাতায়া, পাতায়া-ব্যাংকক, ব্যাংকক-এয়ারপোর্ট ট্রান্সপোর্ট। আর হলো কোহলার্ন আইল্যান্ড প্যাকেজ। এছাড়া আর কোনো প্যাকেজ আমরা তাদের কাছ থেকে নেই নি। আমার যদিও নেওয়ার আগ্রহ ছিল। কিন্তু ফাহিমের বুদ্ধিটা ছিল, আমরা জানি না ওখানে আমাদের টাইমিংটা কী হবে। আরেকটা বিষয় তুমি বাচ্চাদের নিয়ে যাচ্ছো, তাদেরও তো রিল্যাক্সের বিষয় আছে। দেখা গেলো, প্যাকেজ যেটা নিলা ওটা সকাল ছয়টায়। তখন তো ঝামেলায় পড়তে হবে।
ফাহিমের সাজেশন শুনে আমরা শুধু কোহলার্নই নিলাম। আর কোনোটাই নেই নি।
ফাহিমের ধারণাটা অনেকাংশেই সত্য। আমরা ৩১ তারিখ সকালে ছিল কোহলার্ন আইল্যান্ড যাত্রা। আমাদের জানানো হলে, সকাল ৮ টায় গাড়ি আসবে। সেটাতে চড়ে যেতে হবে বিচে। সেখান থেকে স্পিডবোটে করে যাবো কোহলার্ন।
ঠিক ঠিক সকাল ৮ টায় আমার মোবাইলে ফোন। ড্রাইভার বলল, তিনি চলে এসেছেন। আমি নিচে নেমে আসলাম। দেখি একটা টুকটুক। তাকে বললাম, আমার দুই বন্ধু আসবে একটু অপেক্ষা করো। সে কোনোভাবেই অপেক্ষা করতে রাজি না। সে বলছে, তার আরো ট্রিপ আছে। আট টায় সময় দেয়া হয়েছে। এখন ৮টা পাঁচ বেজে গেছে।
আমি তাকে অনুরোধ করলাম ১০ মিনিট অপেক্ষা করো। আমার ‘লেটপাট্টি’ ফাহিম আর নদী ১০ মিনিটেও নিচে নামতে পারছিল না। কমপক্ষে ১৫-২০ মিনিট লাগলো। এতক্ষণে ওই ড্রাইভার আমার মাথা খেয়ে ছেড়েছে। নদী নেমে বলল, লিফট ফাঁকা পাচ্ছিল না তাই পরে ১৪ তলা থেকে সিড়ি বেয়ে নামতে দেরি হয়েছে। তো, উঠলাম সবাই টুকুটুকে। নিয়ে যাওয়া হলো বিচ রোড। সেখানে নেমে আমাদের গ্রুপ ছবি তোলা হলো। হাতে একটা সিল মারা হলো। উঠানো হলো স্পিডবোটে। এক টানে সমুদ্র্যের মধ্যবর্তী একটা জায়গায় নামানো হলো। সেটা প্যারাস্লাইডিং যারা করতে চায় তাদের জন্য।
আমার উপরে উঠে নিচে তাকানোর অভিজ্ঞতা খারাপ। অজ্ঞান হয়ে যেতে পারি। তাই প্যারাস্লাইডিংয়ের আগ্রহ ছিল না। নিতু আগ্রহ নিয়ে উঠবে বলল। খরচ জানতে গেলে বলল, শুধু প্যারাস্লাইডিং ৫০০ বাথ। প্যাকেজ ১ হাজার বাথ। আমি জানতে চাইলাম প্যাকেজে কী আছে? বলল, প্যারাস্লাইডিং এবং আন্ডারওয়াটার সঙ্গে একটা ছবি। যাহোক, আমরা প্যারাস্লাইডিং নিলাম। নিতু ও নদী দুজনেই প্যারাস্লাইডিং করে নিলো।
সবাই স্পিডবোটের লাইনে দাঁড়িয়ে গিয়েছে। এটা দেখে আমি তার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে এলাম। স্পিডবোট আবার টান দিয়ে কিছুদূর গিয়ে একটা ছোটখাটো জাহাজে ওঠালো। সেখানে হলো আন্ডারওয়াটার। আন্ডারওয়াটার হলো ৭০০ বাথ। আর যদি প্যাকেজ নেন প্যারাস্লাইডিংয়ের সঙ্গে তাহলে ১০০০ বাথ। আগেই বলেছি।
আন্ডারওয়াটারে যাওয়ার জন্য রীতিমত ১০ মিনিটের ক্লাস করতে হবে। আমরা দূর থেকে ক্লাসটা দেখছিলাম। কী করতে হবে, কিভাবে যেতে হবে। এসব ট্রেইনিং দেওয়া হচ্ছে। সবাই মনোযোগ দিয়ে শুনছে। আমরা যেহেতু আন্ডারওয়াটার যাবো না। তাই কিছু বোরিং সময় কাটালাম।
যাইহোক প্রায় আধাঘণ্টা-চল্লিশ মিনিট কাটানোর পর আবার স্পিডবোটে উঠে পড়লাম। এবার যাত্রা কোহলার্ন আইল্যান্ড।
আমি ব্যক্তিগতভাবে আপনাদের বলবো, যদি পরিবার নিয়ে যান তবে চেষ্টা করবেন কোহলার্নে জাহাজে যাওয়ার জন্য। সেটা নিরাপদ ও আরামদায়ক হবে। সাশ্রয়ী তো হবেই। অ্যাডভেঞ্চার চাইলে স্পিডবোট ঠিক আছে। আমি দুই বাচ্চা নিয়ে ভয়ঙ্কর এক সমুদ্র স্পিডবোটে পার হয়েছি। ভয় লেগেছে, মজাও লেগেছে। সমুদ্রের ঢেউগুলো কিছুটা উত্তাল। স্পিডবোট ড্রাইভারগুলো ভাবে সবাই এখানে অ্যাডভেঞ্চারের জন্য এসেছে। এজন্য তারা খুব বেপোরোয়াভাবে চালায়।
আমি আমাদের গ্রুপের দায়িত্বে যেই মহিলা ছিলেন, তাকে জিজ্ঞেস করে নিলাম, ‘এভাবে যে চালায় দুর্ঘটনা ঘটে না’। উনি বললেন, বছরে একবার দুইবার হয়। তাও নাকি কোনো মারা যাওয়ার ঘটনা ঘটেনি। কারণ ড্রাইভাররা যথেষ্ট সচেতন।
আমি মনে মনে হাসলাম। সচেতন যদি এটাকে বলে তাহলে সচেতনটা কী?
স্পিডবোট থেকে নামার সময় আরেক বিড়ম্বনায় পড়তে হলো। স্পিডবোটটা থেমেছে সৈকত থেকে বেশ কিছু দূরে। এই পুরো পথটা প্লাস্টিক দিয়ে বানানো হয়েছে পানির ওপরেই। ঢেউয়ের সঙ্গে সঙ্গে এটা দুলতে থাকে। এক বাচ্চা কোলে, আরেক বাচ্চাকে হাতে শক্ত করে ধরে রাখতে হচ্ছে। তারওপর বাচ্চাদের কাপড় ও খাওয়ার ব্যাগ তো আছেই। এক মহা বিপাকে পড়তে হলো। বড় বড় ঢেউয়ে একটু ব্যালেন্স হারালেই পানিতে পড়তে হবে। অনেকে এনজয় করছে। আমিও হয়তো করতাম। কিন্তু বাচ্চাদের জন্য চিন্তা তো করতে হবে। এটা সব পর্যটকের জন্য নয়। উদ্যোক্তাদের মাথায় রাখা দরকার বলেই মনে হয়। যাইহোক, সেই ঢেউয়ের দোলায় পাড়ি দিয়ে ধীরে ধীরে হেঁটে হেঁটে তীর পর্যন্ত আসলাম।
আমাদের জানানো হলো ঠিক দেড় ঘণ্টা তারা আমাদের সময় দেবেন। এরপর আবার বোটে করে রওনা দিতে হবে।
সময়টা খুবই অল্প মনে হলো। আমরা তাই বিচেই একটা জায়গায় বসে পড়লাম। রীভানকে খাওয়ানো, নিজেদেরও কিছু খেয়ে নেওয়া। রীভকে নিয়ে আমি সমুদ্রে একটু পানিতেও ঝাপাঝাপি করলাম। সে মহাখুশি। এসব করতে করতেই কখন দেড় ঘণ্টা পার হয়ে গেলো টের পেলাম না। এখন রীভ সম্পূর্ণ বালু মাখা। তাকে গোসল করাতে হবে পরিষ্কার পানি নিয়ে। আমি দেখলাম, বিচের এক কোণায় শাওয়ারের ব্যবস্থা আছে। নিতু গিয়ে ফিরে এসে বলল, হাত ধুতে ১০ বাথ, গোসল করতে ৪০ বাথ। আমি বললাম, করে ফেলো।
যাইহোক, আবার স্পিডবোট চেপে ফিরে এলাম পাতায়া বিচ রোড।
কোহলার্ন আইল্যান্ডে তেমন কিছুই দেখা হলো না। এমনকি সেখানে আমরা কোনো ছবিও তুলতে পারিনি। নদী-ফাহিম ফাঁকে ছবি তুলে নিয়েছে।
আইল্যান্ডটার ব্যবস্থাপনা নিয়ে কিছু বলতেই হয়। আমি কক্সবাজার যাই নিয়মিত। সেন্টমার্টিনও গিয়েছি। কিন্তু এত যত্ন আমি নিজ দেশে দেখিনি। অস্বাভাবিক যত্নবান সেখানকার প্রশাসন। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখছে। কক্সবাজারে বহু বছর আগে বিচের কাছে রেস্টুরেন্ট খোলা হয়েছিল। পরে পরিচ্ছন্ন থাকে না বলে সেগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়। আমার এখনও মনে পড়ে সন্ধ্যায় বন্ধুরা সহ বিচে রেস্টুরেন্টে বসেছি নিচে ঢেউ এসে আছড়ে পড়ছিল। অসাধারণ একটা অনুভূতি ছিল। আর কোহলার্ন আইল্যান্ডেও অসংখ্য মানুষ, সৈকত ঘেঁষেও অসংখ্য রেস্টুরেন্ট কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে কোনো অপরিচ্ছন্নতা নেই। জায়গায় জায়গায় ময়লা ফেলার বিন আছে। প্রতিটি মানুষ তাদের খাবারের প্যাকেট, কোক কিংবা বিয়ারের ক্যান সেই বিন বা ডাস্টবিনেই ফেলছে। এমনকি সিগারেটের খোশাটা পর্যন্ত তারা ডাস্টবিনে ফেলে। এই যে নিয়মতান্ত্রিকতা এটা আমার দেশে থাকলে কক্সবাজার হতো বিশ্বের সেরা পর্যটনকেন্দ্র। আমার দেশের সমুদ্র সৈকতের মতো সুন্দর আর কোথাও নেই আমি নিশ্চিত। আমি শ্রীলঙ্কার মাউন্ট ল্যাভানিয়া সমুদ্রসৈকত দেখেছি। সেটাও আমাদের কক্সবাজারের মতো সুন্দর নয়। আমরা একমাত্র পিছিয়ে আছি ব্যবস্থাপনায়। আসলে আমাদের মানুষদেরও দোষ আছে। আমরাও সেখানে অপরিষ্কার করি। সচেতন নই। আমাদের পানিগুলোও ধুসর রঙ হয়ে গেছে। অথচ কোহলার্নের পানি অস্বাভাবিক স্বচ্ছ। এটা কেন? এত মানুষ আসছে-যাচ্ছে, ছোট জাহাজ চলছে, স্পিডবোট চলছে তবুও তাদের পানিকে ধুসর করতে পারেনি। অথচ আমাদের সেরা কক্সবাজারের পানিটাকেও আমরা নোংরা করে ফেলছি। খুব খারাপ লাগে এসব ভাবতে।
তো, এবার বিচ রোডে এসে আমাদের একটা ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্টে নিয়ে যাওয়া হলো। এটা প্যাকেজের সঙ্গেই ছিল। ৩০০০ টাকা পার হেড খরচ ছিল এই প্যাকেজের। কোহলার্ন আইল্যান্ড আসা-যাওয়া এবং লাঞ্চসহ। খাওয়াটা খুব একটা পছন্দ হয়নি। তবুও খেয়ে নিলাম সবাই। খেয়ে-দেয়ে হোটেলে গিয়ে আমরা একটু ঘুমিয়ে নিলাম। কারণ রাতে আমাদের একটা দাওয়াত আছে, সঙ্গে আছে থার্টি ফার্স্ট দেখা। দাওয়াতটা দিয়েছে ওখানকার এজেন্ট। অর্থাৎ কসমস হলিডে যে এজেন্টের সঙ্গে থাইল্যান্ডে কাজ করে সেই এজেন্ট আরিফ সাহেব আমাদের ডিনারের জন্য দাওয়াত দিয়েছেন। যদিও তিনি থাকেন ব্যাংকক তবুও রেস্টুরেন্টে ওনার গাড়ি এসে নিয়ে যাবে। সঙ্গে এও জানালেন, ওই রেস্টুরেন্ট বিচের কাছে সুতরাং আমরা খেয়ে দেয়েই চলে যেতে পারবো বিচে।
রাত ৯ টায় আমাদের গাড়ির ড্রাইভার ফোন দিলেন। বাংলাতেই কথা বললেন ফোনে। বুঝলাম তিনি বাঙালি। নিচে নেমে এসে দেখলাম একটা টয়োটা গাড়ি। আমরা উঠে বসেই জিজ্ঞেস করলাম, তিনি কবে থেকে এখানে কাজ করছেন। বললেন, ১ বছরের মতো তিনি পাতায়াতে কাজ করছেন। থাইল্যান্ড নিয়ে তিনি বেশ কিছু তথ্য দিলেন, যেমন, প্রয়োজন ছাড়া এখানে হর্ন দেয়া নিষেধ। পুলিশ দেখলে জরিমানা করবে। আর মানুষরাও নাকি মাইন্ড করে হর্ন দিলে। তাই প্রয়োজনেও তিনি হর্ন দিতে অস্বস্তিবোধ করেন। আরো বললেন, আজকে রাত ১০ টার পর পাতায়া শহরের সব রাস্তা ব্লক হয়ে যাবে। এত মানুষ আর গাড়ি থাকবে। তিনি বললেন, ‘আপনাদের হেঁটে হেঁটে যেতে হতে পারে’। বিষয়টা খুব একটা পাত্তা না দিলেও পরে ঠিকই বুঝেছি ঘটনা সত্য।
যাইহোক, রেস্টুরেন্টটার নাম হলো মহারানি রেস্টুরেন্ট।
থার্টি ফার্স্ট নাইট উদযাপন:
আমি এমন থার্টি ফার্স্ট উদযাপন করেছি বহু বছর আগে কক্সবাজার বিচে। অসাধারণ অনুভূতি ছিল। একই অবস্থা ছিল পাতায়ায়। অসংখ্য মানুষ চারিদিকে। হোটেলে ফেরার পথে মানুষের ভীড়ে হাঁটার জায়গা নেই। এত মানুষ। যানচলাচল থমকে যায়। ঠিক একই অবস্থা দেখলাম পাতায়ায়। ১২ টা বাজার ঠিক আগ মুহূর্তে থেকে বিরতিহীন আতশবাজি আকাশে ফুটতে শুরু করলো। বিচে আমরা বসারও জায়গা পাচ্ছিলাম না। পরে ৬০ বাথ দিয়ে একটা পাটি কিনে সেটা বিচে বিছিয়ে আমরা আতশবাজি উপভোগ করতে থাকি।
সেখানে প্রচুর বিদেশিরা এসেছে। বিভিন্নদেশ থেকে। সবচাইতে বেশি দেখা যায় ভারতীয় ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশের লোক। রাশিয়ানও আছে প্রচুর।
বিচে আমরা প্রচুর ভারতীয় দেখলাম। অনেককে দেখলাম ব্যাগ নিয়ে বসে আছে। বড় বড় কাপড়ের ব্যাগ। মনে হলো, এরা শুধু থার্টি ফার্স্ট দেখতেই এসেছে। হোটেলে হয়তো উঠবে না। আমরা যখন ফিরছিলাম তখন রাত প্রায় পৌনে দুইটা। তখন দেখলাম এরা যে ব্যাগ নিয়ে এসেছে সেটা মাথার নিচে দিয়ে বিচেই ঘুমিয়ে পড়েছে। ভারতীয়দের থাইল্যান্ডের লোকজন খুব অপ্যায়ণ করে। জায়গায় জায়গায় দেখেছি ভারতীয়দের আলাদা গুরুত্ব দেয়। সম্ভবত ভারতের প্রচুর পর্যটক প্রতি বছর এখানে আসে। এজন্যই এত খাতিরদারি। তারা বাঙালিদেরও ভারতীয় মনে করে। আমাদেরও ভাবে ভারতীয়। জিজ্ঞেস করলে বলতে হয় বাংলাদেশ।
পাতায়ার কিছু খুটিনাটি:
১. খাবার-দাবারের কোনো কষ্ট পাতায়াতে হয়নি। প্রচুর ফ্রুটস আছে। খুবই ফ্রেশ এগুলো খেতে পারবেন। এছাড়া বাঙালি রেস্টুরেন্টও পাবেন। একটু খুঁজে নিতে হবে। আমি যে ঠিকানা দিলাম সেখান থেকেও খোঁজ করতে পারেন। তবে মাথায় রাখবেন বাংলা খাবারে আপনার খরচ বেশি হবে। এজন্য আমি বলি, ম্যাগডোনাল্স ও কেএফসি হলো খরচ কমানোর বেস্ট পদ্ধতি।
২. ডলারের দাম পাতায়াতে একটু পড়তিই মনে হয়েছে। ব্যাংককে আমি সর্বোচ্চ এক ডলারে ৩১ বাথ পেয়েছি। কিন্তু পাতায়াতে ২৮-২৯ বাথ পাওয়া গেছে প্রতি ডলারে। ছোট ছোট বুথে মানি এক্সচেইঞ্জার আছে। খুঁজে পেতে সমস্যা হবে না।
৩. একটা বিষয় মাথায় রাখবেন সেটা হলো পাসপোর্ট সবসময় সঙ্গে সাবধানে রাখার চেষ্টা করবেন। এটা আপনার সিকিউরিটি হিসেবেই কাজ করবে।
৪. যাওয়ার আগে হোটেল সব সময় বিচের কাছে নেয়ার চেষ্টা করবেন। এতে সব দিক থেকেই আপনার জন্য সুবিধা হবে।
৫. টুকটুক ব্যবহার না করে হাঁটার চেষ্টাই সবচাইতে ভালো হবে। তবে বন্ধু-বান্ধব কিংবা বড় গ্রুপ নিলে টুকটুক নিতে পারেন। আরেকটা বিষয় হলো, মোটরসাইকেল বা স্কুটি ভাড়া পাওয়া যায়। সেটাই করতে পারেন।
চলবে...
ভ্রমণ ডায়েরি পর্ব ১: থাইল্যান্ডের পরিকল্পনা কীভাবে হলো?