ফ্লু কিংবা ইনফ্লুয়েঞ্জা- এই শব্দগুলোকে আমরা ভয়ই পেতাম না। সাধারণ জ্বর, সর্দি, কাশি নিয়ে পৃথিবীর সাধারণ মানুষ খুব একটা চিন্তাও করেনি। অথচ কী আশ্চর্য! কোভিড-১৯ পুরো বিশ্বকে থমকে দিয়েছে। জীবন তো যাচ্ছেই সঙ্গে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে বিশ্ব অর্থনীতি।
তবে মহামারির গল্প আমরা তো বহু শুনেছি। এও শুনেছি, এক সময় বাংলায় গ্রামের পর গ্রাম খালি হয়ে যেত কালা জ্বর, কলেরা কিংবা গুটি বসন্ত রোগে। গুটি বসন্ত বাদে বাকি রোগ এখনও হয়, তবে টিকা ও প্রতিষেধকের শক্তিতে মানুষই জয়ী। এসব স্থানীয় পর্যায়ের মহামারির গল্প অনেকটাই ঢেকে রেখেছিল ১৯১৮ সালে শুরু হওয়া ‘স্প্যানিশ ফ্লু’র কথা। অনেকেই এই মহামারি নিয়ে তেমন কিছুই জানতেন না। তবে পূর্ণরূপে ‘স্প্যানিশ ফ্লু’ আলোচনায় ফিরে এসেছে কোভিড-১৯ আসার পরই। অথচ মাইক্রোসফটের প্রতিষ্ঠাতা বিল গেটস ২০১৫ সালের টেড টকে অনুমান করে বলেছিলেন, খুব শিগগিরই পৃথিবী আক্রান্ত হতে পারে একটি রেসপিরেটরি ভাইরাসে। যার জন্য আমরা মোটেও প্রস্তুত নই। তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেছেন, ওই মহামারিতে প্রায় ৩০ মিলিয়ন মানুষ মারা যাবে। আর এজন্য অনুরোধ করেছিলেন, যুদ্ধের জন্য যেমন আমরা প্রস্তুতি নিচ্ছি ঠিক তেমনি মহামারি মোকাবিলার প্রস্তুতিও আমাদের নিয়ে রাখতে হবে।
যাইহোক, আমার এই লেখাটি কোনো জ্ঞানগর্ভ লেখা নয়। আমি শুধু খুঁজে দেখার চেষ্টা করেছি তৎকালীন সময় এই ভূখণ্ডের অবস্থাটি কেমন ছিল। কী করেছিল আমাদের ভূখণ্ডের মানুষ। তখন তো এই বৃহৎ ভূখণ্ড ছিল ব্রিটিশদের কলোনি। বলা হতো, ‘ব্রিটিশ-ইন্ডিয়া’। এই বৃহৎ অঞ্চলের গরিব-দুঃখিরা কী করে সামাল দিয়েছিল কথিত স্প্যানিশ ফ্লু? সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে কিছু তথ্য সামনে নিয়ে আসা।
‘স্প্যানিশ ফ্লু’ নামকরণ বিতর্ক:
তখন প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলছে। শোনা যাচ্ছে এক অজানা রোগ আঘাত হেনেছে সেনা ক্যাম্পগুলোতে। কিন্তু আমেরিকা, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জার্মানি- এই দেশগুলোতে ছিল কঠোর মিডিয়া সেন্সরশিপ। যখন অজানা ঠাণ্ডা-জ্বরে সৈন্যরা আক্রান্ত হওয়া শুরু করেছে তখন তারা ভাবলো জনমনে এই খবর ছড়ালে মনোবল ভেঙে যেতে পারে। এমনকি সৈন্যদেরও মনোবল ভেঙে যেতে পারে। এজন্য কঠোরভাবে তারা তথ্য ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করে গেলো। তবে এক্ষেত্রে স্পেন ছিল খুবই স্বচ্ছ। তারা নিয়মিতভাবে মিডিয়ায় সততার সঙ্গে সব কিছু প্রকাশ করে গেছে। যুদ্ধ এবং ফ্লু- দুটি নিয়েই তারা বিস্তর প্রতিবেদন করে চালু রেখেছিল। ফ্লুতে আক্রান্ত সেনাদের আক্রান্ত হওয়া এমনকি মৃত্যুর তথ্যের অবাদ প্রবাহ জারি রেখেছিল স্পেন। এ থেকেই বিশ্বেবাসীর ধারণা হলো, স্পেনেই এই রোগের বিস্তার সবচাইতে বেশি এবং এ দেশ থেকেই রোগটি ছড়াচ্ছে। ব্যস! হয়ে গেলো নাম ‘স্প্যানিশ ফ্লু’।
সত্যি কথা বলতে এখনও এই ফ্লু’র উৎপত্তিস্থল নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। কেউ কেউ বলেন, ফ্লু প্রথমে আঘাত হানে ফ্রান্সের সেনা ক্যাম্পে। কেউ বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের কানসাস ক্যাম্পে প্রথম আঘাত হানে। আবার অনেকে বলেন, এই ফ্লু তার আগের বছর (১৯১৭) থেকেই শুরু হয়েছে ধীরে ধীরে। এজন্য সঠিক মৃত্যুহার নিয়ে রয়েছে নানান তত্ত্ব ও বিশ্লেষণ।
যেখান থেকেই ছড়াক। বাস্তবতা হলো এই মহামারি দুই বছর ধরে স্থায়ী হয়েছে এবং ৫০ কোটির বেশি লোক সংক্রমিত হয়েছে (আনুমানিক সংখ্যা ধরা হয়)। এই সংখ্যাটি তখনকার বিশ্বের জনসংখ্যার এক তৃতীয়াংশ। ধারণা করা হয় ২ কোটি থেকে ১০ কোটি মানুষ এই ফ্লুতে মারা যায়। যার মধ্যে ভারতীয় উপমহাদেশেই মারা গেছে ১ কোটি ২০ লাখ মানুষ। এসব নিয়েও রয়েছে প্রচুর দ্বিধা-বিভক্ত তথ্য। যেমন, অনেকেই বলেন ১ কোটি ৭০ লাখ-৫ কোটি মানুষ বিশ্বব্যাপী মারা গেছে। আবার অনেকে বলে থাকেন সর্বোচ্চ সংখ্যা ১০ কোটিও হতে পারে। তাই মৃত্যু সংখ্যা নিয়ে খুব বেশি বড় নির্ভরশীল তথ্য আমি দিতে পারছি না।
কী হয়েছিল ভারতীয় উপমহাদেশে?
‘স্প্যানিশ ফ্লু’ সম্পর্কে অনেকেই বলেন, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়েই ছড়িয়েছে। তাই এ অঞ্চলে সমুদ্রপথে সৈন্যদের মাধ্যমেই প্রবেশ করেছিল। ইতিহাসবিদদের মতে জুন মাসের কোনো এক সময় ভারত ও চীনে এই ভাইরাসের আগমন ঘটে। তার আগে বলে নেই, ‘স্প্যানিশ ফ্লু’র ওয়েভ মূলত দুটি। যদিও অনেকে চারটি ভাগে ভাগ করে থাকেন। চারটি ওয়েভ বলি কিংবা দুটি- সবচাইতে বড় ধাক্কা আসে সেকেন্ড ওয়েভে।
যাইহোক, ১৯১৮ সালের প্রথম ওয়েভকে ধরা হয় জুন থেকে আগস্ট মাস পর্যন্ত। এরপরের ওয়েভটা শুরু হয় আগস্টের শেষ দিকে। যা ১৯২০ পর্যন্ত যায়। পরের ওয়েভটাই ছিল সবচাইতে ভয়ঙ্কর আগেই বলেছি। বলা হয়, দানব হয়ে উঠেছিল এই ফ্লু। যুক্তরাষ্ট্রের মারিস্ট কলেজের একটি রিপোর্টে তারা প্রথম ও দ্বিতীয় ওয়েভের মধ্যে পার্থক্য তুলে ধরতে গিয়ে বলে-
১. প্রথম ওয়েভের এই ফ্লু ছিল সাধারণ জ্বর-শর্দি-কাশির মতো। তিনদিনের মতো ভুগে অনেকেই সুস্থ হয়ে গেছেন। যাদের ইমিউনিটি ভালো ছিল।
২. দ্বিতীয় ওয়েভ ছিল খুব বিপদজনক। প্রতি ১ হাজার মানুষের মধ্যে ৮০০ জন রোগীর অবস্থাই ছিল আশঙ্কাজনক। আর বাকি ২০০ জনের মধ্যে ছিল ফুসফুস সংক্রান্ত জটিলতা, এর মধ্যে ১২০ জন অত্যাধিক অসুস্থ হয়ে পড়ে কিংবা মারা যায়।
যাইহোক, ভারতে ফিরে আসি।
ভারতে কী পরিমাণ আক্রান্ত হয়ে মারা গিয়েছিল তার একটা হিসাব নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড সেন্টার ফর পপুশেন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের গবেষক কিনেথ হিলের একটি গবেষণা রয়েছে।
সেখানে ১৯০১ থেকে ১৯১১ সময়কালে ভারতের আদমশুমারি এবং নাগরিক নিবন্ধভুক্তির রুটিন ডেমোগ্রাফিক তথ্যগুলো ১৯১৮ সালের মহামারির প্রভাবের আকার এবং আঞ্চলিক অবস্থা মূল্যায়ণের চেষ্টা করা হয়েছে। গবেষণায় তিনি দেখেছেন, যে ১ কোটি ৭০ লাখ -২ কোটি ২০ লাখ মানুষের মহামারিতে মৃত্যুর কথা যে বলা হয় এটা আসলে অনেক বেশি সংখ্যা। তার হিসেবে মৃত্যুর সংখ্যা হবে ১ কোটি ১০ লাখ থেকে ১ কোটি ৩৫ লাখ কিংবা তার কিছু কম। একইসঙ্গে তার পর্যবেক্ষণে দেখা যায় ১৯১৮ সালের আগস্ট থেকে ১৯১৯ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত মৃত্যুহার ছিল সবচাইতে বেশি। এসময় প্রতি ১ হাজার মানুষের মধ্যে ৩০ জন মারা গেছে। এছাড়াও তারা দেখেছে ১৯২২ সালের দিকে জন্মের হারও সাধারণ সময়ের চেয়ে কমে গেছে।
এছাড়াও ১৯১৮ সালে দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলে এমনিতেই বর্ষায় ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে দুর্ভিক্ষের মতো পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছিল। ভারতের দু’টি প্রদেশ মধ্য প্রদেশে (আজকের মহারাষ্ট্র, ছত্তিশগড় ও মধ্য প্রদেশের কিছু অংশ অন্তর্ভুক্ত) আনুষ্ঠানিকভাবে দুর্ভিক্ষ ঘোষণা করা হয়েছিল। অন্যদিকে বর্ষার অভাবে মুম্বাইয়ের অঞ্চলগুলোকে মারাত্মকভাবে ক্ষতি করেছিল। এই দুর্ভিক্ষগ্রস্থ অঞ্চলগুলোও এই রোগে সবচেয়ে মারাত্মকভাবে আক্রান্ত হয়।
এখন দুর্ভিক্ষ ও মহামারিতে মৃত্যুর সংখ্যাকে আলাদা করা খুব কঠিন বলেই আমার কাছে মনে হয়। আবার মহামারি কারণে অর্থনৈতিক অবনতির জন্য না খেয়ে মৃত্যুও যে ঘটেনি সেটাও বা বলি কোন তথ্যের ভিত্তিতে। এজন্য মৃত্যুর সংখ্যাটা বোঝা খুব মুশকিল।
এমনিতেই যুদ্ধকালীন সময়ে মুদ্রাস্ফীতি সংকট ছিল তুঙ্গে। তার মধ্যে পণ্য সংকট, আর্থিক জটিলতা এবং করোসিনের মতো প্রয়োজনীয় পণ্যও বাজারে উচ্চদামে বিক্রি হচ্ছিল। বাজার ব্যবস্থা হয়ে পড়েছিল অস্থির। সব মিলিয়ে এক জটিল অবস্থায় ছিল এই অঞ্চল।
সেন্ট্রাল প্রদেশগুলোতে এই রোগের কারণে প্রতি ১০০০ লোকের মধ্যে সর্বোচ্চ মৃত্যুর হিসেব আছে ৬৮ জন। তার পরে মুম্বাই প্রেসিডেন্সি প্রতি হাজারে ৫৪ জন, এবং ইউনাইটেড প্রদেশসমূহ ৪৭ জন। মাদ্রাজে ১৬ জন, বার্মা ১৬ জন।
ওই সময়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল সবচাইতে বেশি নিম্নবর্গীয় ও হিন্দু ধর্মের নিম্নগোত্রের মানুষ। তাদের পক্ষে না ছিল চিকিৎসা, না ছিল জীবিকা, না ছিল খাদ্য। এসব মিলিয়ে বড় আঘাতের শিকার মূলত তারাই হয়।
কোভিড ১৯ এর ক্ষেত্রে বলা হচ্ছে, তরুণদের থেকে বৃদ্ধরা সবচাইতে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। যদিও এই রোগের বিস্তার বুঝিয়ে দিয়েছে কেউই এই রোগ থেকে নিরাপদ নন। তবে ১৯১৮ সালের মহামারিতে ভারতীয় উপমহাদেশে সবচাইতে বেশি আক্রান্ত হয় ২২-৪০ বছর বয়সের তরুণরাই।
কী ব্যবস্থা নিয়েছিল ব্রিটিশ সরকার?
মহামারি এলে মানুষ আক্রান্ত হবেই। বিষয়টা হলো, মহামারিকে রাষ্ট্র কতটা মনোযোগ দিয়ে মোকাবিলা করবে? সেক্ষেত্রে ব্রিটিশ শাসকরা শুরুতে ভারতের ভেতরে মহামারিকে খুবই হাল্কাভাবে নেয়। ফলে সেপ্টেম্বরের মধ্যে পরিস্থিতি সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। বিশেষ করে মুম্বাই শহর হয়ে পড়ে মহামারির ইপিসেন্টার। ধারণা করা যায়, এই শহরটি তখন ছিল ব্যবসার কেন্দ্রস্থল। ১৯১৮ সালের সেপ্টেম্বরের ১৯ তারিখ ইংরেজি দৈনিকে বলা হয়, ২৯৩ জন এই ফ্লুতে মারা গেছে।
অন্যদিকে ভারতীয় পত্রিকার রিপোর্টে বলা হয়, ‘প্রতিদিন ১৫০-২০০ মরদেহ সৎকারের জন্য আনা হচ্ছে’। একই রিপোর্টে বলা হয়, সমাধিস্থল গুলো লাশ দিয়ে ভরে গেছে। প্রচুর লাশ সৎকারের অপেক্ষাতেও রয়েছে।
তবে এই ফ্লু সবাইকে সমানভাবে আক্রান্ত করেনি। ব্রিটিশ কলোনি বলে প্রচুর বিদেশি তখন ভারতে অবস্থান করতো। তাদের অনেকে সরকারি কাজে কিংবা ব্যবসার কাজে এই ভূমিতে বাস করতো। ওই সময়ে ব্রিটিশ পরিবারগুলো সেভাবে আক্রান্ত হয়নি। একইসঙ্গে ভারতের উচ্চশ্রেণি অর্থাৎ ধনী পরিবারগুলোও কিছু ঝুঁকিমুক্ত ছিল। এর প্রধান কারণ হলো তাদের বাড়িগুলো ছিল বিশাল জায়গা নিয়ে। এবং তাদের গৃহকর্মীরাও একই জায়গায় অবস্থান করতো। ফলে তাদের আক্রান্তের হার ছিল খুবই কম। অন্যদিকে খেটে খাওয়া মানুষরাই সবচাইতে বেশি আক্রান্ত হয়েছে।
লকডাউন কিংবা আইসোলেশন কি সম্ভব হয়েছিল?
মহামারিকে ঠেকানোর সবচাইতে বড় পদ্ধতি হলো এলাকা লকডাউন এবং আক্রান্তের আইসোলেশন। আগেই বলেছি, ভারতে এই ব্যবস্থা ছিল খুব দুর্বল। নিম্নবর্গের হিন্দুরা ছিল নিতান্তই গরিব। একটি গরিব জনগোষ্ঠীকে সামাল দেওয়া খুবই দুর্বদ্ধ বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। ধনী পরিবারগুলো নিজেদের আলাদা করে রাখতে পারলেও দরিদ্র ও খেটে-খাওয়া মানুষের পক্ষে আইসোলেশনে থাকা সম্ভব ছিল না। লকডাউনের উদাহরণ ভারতে না হলেও আইসোলেশনের ব্যাপক তৎপরতা চালানো হয়। বিশেষ করে, ভারতীয় পত্রিকাগুলোতে চলে ব্যাপক প্রচার প্রচারণা। মানুষকে সাবধান হতে জনসমাগম এড়িয়ে চলার প্রচারণা চালায়। এছাড়াও পত্রিকায় বলা হয়, প্রত্যেকে যেন বদ্ধ ঘরে থাকার চাইতে একাকী বাতাস চলাচল করতে পারে এমন কক্ষে অবস্থান করেন। তবে এসব প্রচারণা শুধুমাত্র শিক্ষিত শ্রেণির নজরেই বেশি আসে। বিশাল দরিদ্র ও খেটে খাওয়া মানুষ এসব প্রচারণার বাইরেই থেকে যায়। তবে প্রচুর সাধারণ মানুষ একে অপরের সহযোগিতায় ঠিকই এগিয়ে আসে। দরিদ্রদের মাঝে খাবার বিরতণ, ওষুধ বিতরণসহ বেশ কিছু পদক্ষেপও তারা নেয়। নাগরিকরা এলাকায় এলাকায় অ্যান্টি ইনফ্লুয়েঞ্জা কমিটি গঠন করে। এর মাধ্যমে তারা এলাকার মানষের সেবায় এগিয়ে আসে। ফান্ড গঠন করে ছোট ছোট চিকিৎসা সেবা কেন্দ্রও গঠন করে মানুষের সেবা দিতে থাকে।
দরিদ্রদের এই মহামারি নিয়ে সচেতন করতে সবচাইতে বড় ভূমিকা রাখে এই অ্যান্টি ইনফ্লুয়েঞ্জা কমিটিগুলো।
লকডাউনের গুরুত্ব এই সময়ে আমরা বুঝতে পারলেও তৎকালীন সময়ে এ নিয়ে ভারতে তেমন আলোচনা হওয়ার তথ্য-প্রমাণ পাইনি। যদিও বিভিন্ন শিল্প-প্রতিষ্ঠান, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল।
তৎকালীন লকডাউনের প্রভাব বলতে গেলে যুক্তরাষ্ট্রের উদাহরণ আনা যেতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রে ফ্লু সর্বপ্রথম শনাক্ত হয় ১৭ সেপ্টেম্বর ১৯১৮ (এই তারিখ নিয়েও অনেক দ্বন্দ্ব আছে, অনেকে মনে করেন তার আগেই ফ্লু যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করেছে এবং ভাইরাসটি উৎপত্তিস্থলও যুক্তরাষ্ট্র বলেও অনেকে মনে করেন)। এরপর পেনসিলভেনিয়ার সবচাইতে বৃহৎ শহর ফিলাডেলফিয়া এই ফ্লুর আক্রমণে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। এর প্রধান কারণ হিসেবে দেখা হয়, প্রথম শনাক্তের ১০ দিন পর সেখানে একটা প্যারেড অনুষ্ঠান হয়েছিল। ওই অনুষ্ঠানে যোগ দেয় প্রায় দুই লাখ মানুষ। ব্যস! এই বিপদ থেকে উঠে দাঁড়াতে পারেনি ফিলাডেলফিয়া। তাদের প্রতি একলাখে মৃত্যু সংখ্যা ৭৪৮ জন।
যুক্তরাষ্ট্রের সেন্ট লুইস শহরে প্রথম শনাক্তের দুইদিন পরই পুরো শহরকে শাট-ডাউন করা হয়। আমরা যেটাকে বলছি লকডাউন। এখন লকডাউন কিন্তু মহামারি রুখে দেওয়ার অন্যতম পথ নয়। এমন বক্তব্য যেমন এ সময়ের বিশেষজ্ঞরা দিচ্ছেন, ওই সময়েও সেটাই বলা হয়েছিল। শাট-ডাউন হওয়ার ফলে ইনফ্লুয়েঞ্জার গতি ছিল লুইস শহরে খুবই ধীর। এটার প্রমাণ হলো, প্রতি এক লাখে সেখানে মারা গেছে ৩৫৮ জন মানুষ। এর অর্থ হলো ধীর গতি হলেও মৃত্যু ঠেকিয়ে রাখা সম্ভব হয়নি।
যুক্তরাষ্ট্রের সবচাইতে বড় উদাহরণ হিসেবে ছিল সানফ্রান্সিসকো। তারা সোশ্যাল ডিসটেন্সিং, আইসোলেশন, হাইজিন ব্যবস্থা, মাস্ক পরা এসব নিয়মতান্ত্রিকভাবে করেছে। তারপরও ওই বছরের অক্টোবরের শেষ নাগাদ দেখা যায় আক্রান্তের ২০ হাজারের মধ্যে মারা গেছে ১ হাজার মানুষ।
এখন যেমন, অনেকেই বলেন, সব খুলে দিতে হবে। স্বাস্থ্য বিধি মেনে চললেই হবে ইত্যাদি ইত্যাদি। এর কারণ হলো মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক নিরাপত্তার কথা ভেবেই বলা হয়। তখনও আমেরিকাতে প্রচুর আন্দোলন হয়েছে অর্থনৈতিক নিরাপত্তার জন্যে সব খুলে দেওয়ার জন্য। সানফ্রান্সিসকোর মেয়র বাধ্য হয়ে স্বাস্থ্য বিধি মেনে সব খুলে দিতে বললেন। এরপর দ্বিতীয় ওয়েভের সবচাইতে বড় ধাক্কাটা আসে এই শহরেই।
দ্বিতীয় ওয়েভটি আসে ডিসেম্বরের ৭ তারিখ, ১৯১৮ সালে। আর তখনই লণ্ডভণ্ড হয়ে যায় সমস্ত ব্যবস্থা। ওই শহরের ৪৫ হাজারের ওপর মানুষ আক্রান্ত হয় এবং ৩০০০ মানুষ প্রাণ হারান।
আক্রান্ত গান্ধী ও ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের নতুন মোড়:
১৯১৮ সালের আগস্টে মহামারির সময়ে গান্ধী গুজরাটে তার সহযোদ্ধা বল্লভ ভাই প্যাটেলের সঙ্গে অবস্থান করছিলেন। সেখানে কৃষিজমির ক্ষয়ক্ষতির ফলে ল্যান্ড ট্যাক্স বাতিলের আন্দোলন গড়ে তোলা নিয়ে কৃষকদের ঐক্যবদ্ধ করার চেষ্টা করছিলেন। সেখানেও অহিংসা আন্দোলনের বিষয়ে ব্যাপক ব্যস্ত ছিলেন গান্ধী। এই ব্যস্ততার মধ্যেই তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। এমনকি তিনি যেখানে বাস করতেন সেখানে তার সকল সঙ্গী আক্রান্ত হন। অনেকের লেখাতেই পাওয়া যায় গান্ধী এই মহামারিতে আক্রান্ত হয়েছিলেন। ‘HEALTH FILE OF MAHATMA GANDHI: His Experiments with Dietetics and Nature Cure’- রিপোর্টেও দেখা যায় ১৯১৮ সালের ১১ আগস্ট গান্ধী অস্বাভাবিক অসুস্থ হয়ে পড়েন।
এই মহামারি ব্রিটিশদের দুর্গে চিঁড় ধরায়। ভঙ্গুর স্বাস্থ্য ব্যবস্থা, খাদ্যের অভাব, জীবিকার অভাব, মানুষের মৃত্যু ও অসুস্থতা সব কিছু মানুষের ভেতর তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি করে। এমনই সময় ১৯১৯ সালের ১৩ এপ্রিল ঘটে জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড। এটাকে অনেকে অম্রিতসার হত্যাকাণ্ড বলে থাকেন। অম্রিতসার শহরের জালিয়ানওয়ালাবাগ উদ্যানে নিরস্ত্র জনগণের উপর গুলিবর্ষণ করেছিল ব্রিটিশ সৈন্যরা। এতে অসংখ্য নিরিহ মানুষ নিহত হয়। দাবানলের মতো আগুন ছড়িয়ে পড়ে পুরো ভারত জুড়ে। একে তো মহামারির নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতা তার মধ্যে দিয়ে স্বৈরাচারি কায়দায় নিরিহ মানুষকে হত্যার মধ্যে দিয়ে এ দেশের জনগণের হৃদয়ের স্ফূলিঙ্গ ছড়িয়ে পড়ে সারা ভারতীয় উপমহাদেশে। এই হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ইংরেজ সরকারের দেওয়া ‘নাইটহুড’ উপাধি ত্যাগ করেন। পরের বছর গান্ধীর অসহোযোগ আন্দোলন শুরু হয়।
মোদ্দা কথা হলো, মহামারি ব্রিটিশ শাসকদের মনোবলে বড় আঘাত হানে। ইতিহাস ঘাটলেই দেখা যায় এর পরের সময়টা আন্দোলন দমানো এবং রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে শুধুমাত্র টিকে থাকারই চেষ্টা করেছে ব্রিটিশরা। মহামারি ছাড়াও দুটি কারণ হলো, প্রথম বিশ্বেযুদ্ধে ভারতীয়দের বাধ্য করা হয় ব্রিটিশদের পক্ষে যুদ্ধ করার জন্য। এ নিয়ে জনমনে যথেষ্ট ক্ষোভ ছিল। দ্বিতীয় কারণটি হলো আম্রিতসার হত্যাকাণ্ড।
এসব যে ব্রিটিশরা বুঝতে পারেনি তা নয়। বুঝেছে। আর এ জন্য নানাভাবে স্বাস্থ্যখাতে মনোযোগী হয়ে ওঠে মানুষের সমিহ পাওয়ার উদ্দেশে।
বাংলায় কী হয়েছিল?
আমার পড়াশোনা শুরু হয় বাংলার অবস্থা জানার জন্যই। অন্তর্জাল জগত থেকে বাংলার চিত্র বলতে কলকাতার কিছুটা পাওয়া গেলেও তৎকালীন পূর্ব বাংলা অঞ্চলের তেমন কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। ভবিষ্যতে যদি কখনো তথ্য পাওয়া যায় তাহলে অবশ্যই এই বিষয়টি নিয়ে আলাদাভাবে গবেষণার দাবি রাখে।
সর্বশেষ ৮ মে আনন্দ বাজার পত্রিকায় আশিস লাহিড়ী ‘ ‘যুদ্ধজ্বর’ হানা দিয়েছিল রবীন্দ্র-পরিবারেও, মনে করাল বিষণ্ণ ২৫শে বৈশাখ’ শিরোনামে একটি প্রবন্ধ লেখেন। সেখানে তিনি উল্লেখ করেন, খোদ রবীন্দ্রনাথের পরিবারেও হানা দিয়েছিল ভয়ানক এই ফ্লু। তবুও রবীন্দ্রনাথের রচনায় কেন স্পেনিশ ফ্লু অনুপস্থিত সেটাকে একটা বড় প্রশ্ন হিসেবে হাজির করেছেন তিনি। আশিস লাহিড়ী অবশ্য স্প্যানিশ ফ্লু শব্দটি ব্যবহার করেননি। তিনি এটার নাম দিয়েছেন ‘যুদ্ধ জ্বর’। কারণ হিসেবে বলেছেন, যুদ্ধের ময়দান থেকেই এই ফ্লুর বিস্তার।
যারা আক্রান্ত হয়েছিলেন তাদেরও একটি বর্ণনা পাওয়া যায় লেখায়। লেখার হুবহু অংশটি তুলে দিলাম-
‘…সাক্ষাৎ শান্তিনিকেতনে, বড় এবং ছোট অর্থে রবীন্দ্র-পরিবারে, জোর হানা দিয়েছিল যুদ্ধজ্বর। ২ জানুয়ারি ১৯১৯ প্রাণ গিয়েছিল দ্বিজেন্দ্রনাথের কনিষ্ঠ পুত্র কৃতীন্দ্রনাথের স্ত্রী সুকেশী দেবীর। স্বয়ং প্রতিমা দেবী মরণের মুখ থেকে ফিরে আসেন। সাংঘাতিক ভাবে আক্রান্ত হয়েছিলেন হেমলতা দেবীও, তিনিও কোনও মতে সেরে ওঠেন। ‘ক্যাশবহি’তে ‘‘অকসিজেন গ্যাসের জন্য’’ খরচের সাক্ষ্যর উল্লেখ করেছেন রবিজীবনীকার।
শুধু শান্তিনিকেতন নয়, ‘মীরা দেবী পুত্র নীতীন্দ্রকে নিয়ে হায়দ্রাবাদে ছিলেন। সেখানে তাঁর কনিষ্ঠ দেবর শান্তির ইনফ্লুয়েঞ্জা রোগে মৃত্যু হয়। এর পরে মীরা দেবী ও নীতুও এই রোগে আক্রান্ত হন।’
রক্তের সম্পর্কে অনাত্মীয়, কিন্তু রবীন্দ্রনাথের আত্মার আত্মীয় অজিতকুমার চক্রবর্তীরও মৃত্যু হয়েছিল এই রোগেই, ছত্রিশ বছর বয়সে। তিনি অবশ্য তখন শান্তিনিকেতন-ছাড়া। ২৯ ডিসেম্বর ১৯১৮ রবীন্দ্রনাথ লেখেন, ‘অজিতের অবস্থার কথা শুনে মন বড় উদ্বিগ্ন হল। বুঝতে পারচি কোনও আশা নেই এবং এতক্ষণে হয়ত জীবনাবসান হয়ে গেছে। অল্প বয়স থেকে ও আমার খুব কাছে এসেছিল – ও যদি চলে যায় ত একটা ফাঁক রেখে যাবে।’
এছাড়াও তিনি লেখায় বলেন ভারতে অন্তত ১ কোটি ২০ লক্ষ মানুষ মারা গিয়েছিল। যা মোট জনসংখ্যার পাঁচ শতাংশ।
স্বাস্থ্য খাতে ব্রিটিশদের উদ্যোগ:
১৯১৮ সালের মহামারিতে অস্বস্তি আর আন্দোলনের মুখে পড়া ব্রিটিশ সরকার ১৯২০-২১ সালের মিউনিসিপালটি অ্যান্ড লোকাল বোর্ড অ্যাক্ট পাস করে। এর আওতায় সকল জায়গায় চিকিৎসা ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নয়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়। আরও পরে ১৯৩৭ সালে তারা সেন্ট্রাল অ্যাডভাইজারি বোর্ড অব হেলথ গঠন করে। একইসঙ্গে একজন পাবলিক হেলথ কমিশনারও নিয়োগ করা হয়। যার কাজই ছিল সেনিটেশন ও ভ্যাকসিনের মাধ্যমে সুরক্ষা নিশ্চিত করার কাজ তদারকি করা।
শুধু তাই নয়, বাংলা, মাদ্রাজ এবং মুম্বাইয়ে সিভিল সার্জন নিয়োগ করা হয়। তাদের কাজ ছিল প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলগুলোতে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার তদারকি ও নিশ্চিত করা