বাঙালির ইতিহাসে সবচাইতে ভয়ঙ্কর দিনটির নাম ১৫ আগস্ট। এটাকে ভয়ঙ্কর না বলে বরং কলঙ্কের দিন বলা উচিত বলে আমি মনে করি। এই ভয়ঙ্কর দিনটির বিবরণ আমাদের অনেকেরই জানা। আমরা শুনেছি, পড়েছি হেন কোনো ব্যাখ্যা নেই। অনেকেই এই গল্প বলেছেন কিংবা লিখেছেনও।
এবার লেখক ও গবেষক মহিউদ্দিন আহমদ খুব ভিন্নভাবে এই দিনটির বর্ণনা নিয়ে হাজির হলেন তার ‘৩২ নম্বর পাশে বাড়ি: ২৫ মার্চ ১৫ আগস্ট’ গ্রন্থের মাধ্যমে।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট নিয়ে যখনই আমরা জানতে চাই, আমরা রাজসাক্ষী কিংবা তৎকালীন সময়কার অনেক নেতাকর্মীদের কাছেও শুনে থাকি। তবে মহিউদ্দিন আহমদ সেদিনের সেই গল্পটি জানতে গেলেন বঙ্গবন্ধুর ৩২ নম্বরের বাড়ির পাশের বাড়িতে।
শুধু যে ৭৫ সালের ১৫ আগস্টের কথা এই গ্রন্থে আছে তা নয়, আছে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের সেই রাতের গল্পও।
পাশের বাড়ির গল্পটি একটি গ্রন্থে আবদ্ধ কীভাবে হলো তা ভূমিকাতেই সুন্দর করে বলে দিয়েছেন লেখক। মূলত বঙ্গবন্ধুর ফুফাতো ভাই মমিনুল হক খোকার লেখা একটি বইয়ের তথ্য অনুযায়ী ২৫ মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধুর পরিবার পাশের বাড়িতে আশ্রয় নেন। বইয়ে তিনি লিখেছেন ওই বাড়িতে থাকতেন সাবেক আমলা ও সংসদ সদস্য মোশাররফ হোসেন।
এই তথ্যটিই পরে মহিউদ্দিনের কাছে হাজির হয় ভিন্ন রূপে। তিনি তার বন্ধুর মাধ্যমে জানতে পারলেন ওই বাড়ির মালিক আবদুস সামাদ খান চৌধুরী। সেখান থেকেই আগ্রহ তৈরি হয় লেখকের। তিনি ছুটে যান পাশের বাড়িতে।
সেখানে তার সঙ্গে দীর্ঘ আলাপ হয় আবদুস সামাদ খানের ছেলে আবদুল আহাদ খান চৌধুরীর সঙ্গে। সেখান থেকে আমরা জানতে পারি, ৩২ নম্বর বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে ২৫ মার্চ রাতে যখন পাকিস্তানি সেনাবাহিনী তাঁকে নিয়ে তখনও বেগম মুজিবকে সাহায্যের কথা বললেও তিনি খুব একটা ঘাবড়ে যাননি বলেই মনে হয়, মনে হয় বেগম মুজিব কী পরিমাণ দৃঢ় ও সাহসী। তবুও বাড়ির মালিক আবদুস সামাদের ছেলে যখন বেগম মুজিবকে অনুরোধ করে বলে আসেন, যে কোনো বিপদে আমরা পাশে আছি। এভাবেই পরবর্তীতে সেই রাতেই বঙ্গবন্ধুর পরিবার দেয়াল টপকে চলে আসে সামাদ সাহেবের বাসায়। একটি রাত তারা সেখানেই কাটান। পরের দিন একটি গাড়িতে করেই চলে যান। এই গ্রন্থেই আমরা জানতে পারি, বঙ্গবন্ধুর বাড়ি ফাঁকা পেয়ে সেখানে চোর ঢুকেছিল। এমনকি চোরের উৎপাত থেকে কিছুটা রক্ষা পেতে সামাদ সাহেবের ছেলে বঙ্গবন্ধুর বাড়ির ফ্যানগুলো খুলে নিয়ে আসেন।
তবে এই গ্রন্থের এই পর্বটির মধ্যেই সবচাইতে মনযোগের জায়গাটা হলো, বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরে ঠিকই প্রতিবেশির কৃতজ্ঞতা স্বীকার করতে এতটুকু দ্বিধাবোধ করেননি। তিনি ঠিকই ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানান তার প্রতিবেশিকে।
গ্রন্থের এই পর্বটির পরই লেখক চলে যান ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের সেই ভয়ঙ্কর বয়ানে। এই দিনের গল্প বলতে গিয়ে সামাদ সাহেবের ছেলে আহাদ বেশ কিছু তথ্য হাজির করেন লেখকের সামনে। যেমন, সেদিন ভোরবেলা যখন বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে বিউগল বাজছিল তখন সেই বিউগলের সুরকে অনেক করুণ মনে হয়েছিল তার বাবা ডা. সামাদের। সেই বিউগলের আওয়াজ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শুধু গুলির আওয়াজ। তার আগে একটি লাইট পড়েছিল সামাদ সাহেবের বাড়ির পেছনের দিকে। যেটাকে তিনি এখন ধারণা করেন ওই জায়গাটিতে কয়েক সেকেন্ডের জন্য চেক করে নিয়েছিল ঘাতকরা।
আরও তথ্যের মধ্যে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ ছিল ঘাতকদের রেকির প্রসঙ্গ নিয়েও আলোচনা হয়েছে এই গ্রন্থে। এছাড়াও আহাদের ছোট ভাই সালমানের দাবি সম্ভবত শেখ কামাল সেদিন আবাহনী ক্লাব থেকে গভীর রাতে ঘরে ফিরছিলেন। তার ব্যাখ্যাটা এমন-
…আমি যতটুকু জানি, উনি হয়তো ক্লাব হয়ে এসেছেন। ভোরবেলা উনি যখন আসছেন টয়োটা চালিয়ে, বত্রিশ নম্বর রোডের ব্রিজ পার হওয়ার সময়, কর্নারে যে রাস্তাটা আছে না, তার উল্টোদিকের শেষ মাথায় আর্মির একটা জিপ ছিল। আর্মির জিপগুলোর বৈশিষ্ট্য হলো এগুলো হাইট বেশি, একটু বড়। উনি খেয়াল করলেন, জিপটা থেকে আছে। উনার তো মিলিটারি ট্রেনিং ছিল। উনি হয়তো বুঝতে পেরেছেন- একের সঙ্গে এক যোগ করলে দুই হয়। রাত বাজে সাড়ে চারটা। এ সময় এখানে মিলিটারির একটা জিপ থাকা ডালমে কুছ কালা হ্যায়। …
এই ঘটনাটিও নতুন করে হাজির হয় এই গ্রন্থে।
১৫ আগস্টের বিশদ আলাপ আছে মহিউদ্দিনের এই গ্রন্থে, যা পাঠককে নতুন এক ভাবনা কিংবা অনুভূতির খোরাক জোগাবে। বিশেষ করে এই গ্রন্থের শেষে কয়েকজন রাজসাক্ষীর বয়ান যুক্ত হয়েছে। এই বয়ান যে কোনো পাঠককে সেই ভয়ঙ্কর ভোরবেলার বিভৎসতা টের পাওয়াতে যথেষ্ট সাহায্য করবে। কিভাবে একে একে হত্যা করা হলো, কী করে শেখ রাসেলের মতো একটা শিশুকে হত্যা করা হলো- এর সব বিবরণ রয়েছে রাজসাক্ষীদের বয়ানে।
লেখক ও গবেষক মহিউদ্দিন আহমদ এখন পর্যন্ত বেশ কয়েকটি গবেষণামূলক গ্রন্থ রচনা করেছেন। তবে তার অধিকাংশ বইয়ে নিজের বিশ্লেষণের চাইতে অন্যের বয়ানই বেশি থাকে। যা যে কোনো পাঠককে ভিন্ন স্বাদ দেবে।
গ্রন্থটি প্রকাশ করেছে বাতিঘর। গায়ের মূল্য মাত্র ২০০ টাকা।
ছবিটি বাতিঘরের ফেসবুক পেজ থেকে নেওয়া