আফতাব খান আমাকে ডেকেছেন তার বাসায়। এলাকার সবচেয়ে প্রভাবশালী শিক্ষক তিনি। গতরাতে আমার বাসায় তার ছাত্র এসে বলল, ‘স্যার তোকে ডেকেছে’। ওই ছাত্রের নাম আসলাম। সেও এলাকার ছেলে।
স্যার ডাকছে শুনে তো আমার হাঁটু কাঁপা কাঁপা অবস্থা। এই ভদ্রলোক আমাকে কেন ডেকে পাঠালো? টেনশনে ঘুম হারাম। তার সঙ্গে আমার বিশেষ পরিচয় নেই। তিনি ফিজিক্সের নাম করা শিক্ষক। বয়স হবে পঞ্চাশের কাছাকাছি।
বিষয়টা শুনে দৌড়ে গেলাম মোবিনের বাসায়। তার বাসা স্যারের বাসার পাশেই। আমার বাসা খানিক দূর। তবে সবাই আমরা একই এলাকার। মোবিনকে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ঘটনাটা কী?
কেমনে বলি! ঘটনা কী। আমারও তো ডাক পড়ছে। মোবিন জানালো। বুঝলাম বিষয়টা নিয়ে কাঁপাকাঁপি অবস্থা শুরু আমার না, তারও একই কেস। তবে মোবিনের কেসটা আরও ভয়াবহ, কারণ স্যারের বাসা তো মোবিনের পাশেই।
দুজন মিলে বহু চিন্তা করলাম, কী করা উচিত। যাওয়া উচিত, নাকি চেপে যাবো। মোবিন বলল, ‘চেপে যাওয়া ঠিক হবে না, শালা বাসাতেও হাজির হতে পারে’। তারপর একটা আইডিয়া দিলো।
বলল, ‘এই শালা আসলাম এখানে এন্ট্রি মারলো কেমনে? তারে জিজ্ঞেস করা যায়। নাকি?’
আমি তৎক্ষণাৎ বললাম, চল।
মোবিন আর আমি মিলে রওনা দিলাম আসলামের বাসায়। ওর বাসাও দুই বিল্ডিং পরে।
গিয়ে দেখি শালা হাফ পেন্ট আর সেন্ডো গেঞ্জি পরে নিচে দাঁড়িয়ে আছে। মোবিন দেখেই জিজ্ঞেস করলো, ‘চুদির ভাই, ঘটনা বল। ডাকছে কেন?’
আসলাম হাসে আর বলে, ‘আমারে জিগাও কেন? আকাম তো তোমরা করছো। আমি এসবে তো ছিলাম না।’
মোবিন তাকায় আমার দিকে, আমি তখন আসলামের দিকে তেড়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করি, ‘আকাম করছি মানি কী? মুখ সামলা শালা?’
আসলাম আবার হাসে। বলে, ‘এহ, পার্ট মারাইতে আইছে। কালকে গিয়া জবাব দিবা আকামের। আমার লগে ঝারি মারাইতে আইসো না…’
বুঝলাম, আসলাম ঠিক মতো কথা বলবে না। সে মুখ খুলবে না। ওর সঙ্গে গেজানোর কোনও মানে নাই। আমি মোবিনকে বললাম, ‘ধুর এই শালা ক্লিয়ার করবে না। তুই যা তোর বাসায় আমি যাই আমার বাসায়। সকালে দেখা যাবে। কী বাল হবে দেখে নিব নে।’
মোবিন তার বাসার গেটে গিয়ে আমাকে বলল, ‘হারামি সব তোর জন্য। মানা করছিলাম। শুনলি না।’
আমি কিছুই বললাম না। হাঁটা ধরলাম বাসার দিকে। ওর এসব ফালতু আলাপ শোনার টাইম নাই।
বাসায় গিয়ে সোজা নিজের রুমে চুপ করে বসে রইলাম। ভাবতে থাকলাম, কালকের আলোচনার বিষয়টা নিয়ে নিজেকে কিভাবে ডিফেন্ড করা যায়। কিভাবে এই উটকো ঝামেলাটা থেকে নিজেকে রক্ষা করা যায়। এ থেকে তো সারভাইভ করতে হবে। বাই হুক ওর বাই ক্রুক।
নিজে নিজে নিজের সঙ্গে কথা বলা শুরু করলাম। এটা করতে গিয়ে মনে পড়লো আফতাব স্যারের বাসার স্পেসের কথা। পাঁচ তলা বিল্ডিং। তিনি থাকেন তৃতীয় তলায়। ঢুকেই ডাইনিং স্পেস, সেটা পার করে সম্ভবত বেড রুম, পর্দা দেওয়া- তাই দেখা যায় না। মেইন দুটি দরজা আছে। এক দরজা দিয়ে ঢুকলে ডাইনিং স্পেস, আরেক দরজার সঙ্গে ড্রয়িং রুমটা কানেকটেড। ড্রয়িং রুমটাকেই তিনি বানিয়েছেন ক্লাস রুম। ওখানে ব্যাচে স্টুডেন্ট পড়ে।
আমরা যখন এসএসসির পর কলেজে ঢুকলাম তখন ওই একবারই স্যারের বাসায় গিয়েছিলাম। ব্যাচে পড়তে।
পড়তে গেলাম আমি আর মোবিন। তাও মোবিন রাজি হয় না। অনেক জোর করে মোবিনকে পটিয়ে রাজি করালাম।
ফিজিক্স বিষয়টা ব্যাচে না পড়লে হবে না। ওটা তোকে ব্যাচেই পড়তে হবে, রেগুলার এক্সাম দিতে হবে, তবেই না এত বড় বড় ইকুয়েশন তোর আয়ত্তে আসবে। নইলে তো ব্যাটা আন্ডা পাবি।
আমার এসব পট্টিমারা কথা মোবিন বোঝে। সে শুধু বলে, তুমি ব্যাচে পড়বা নাকি কী করবা সে আমি বুঝছি। আগেই বলি, ক্যাচালে পড়বি।
তবুও মোবিন রাজি হলো। তো, আমরা যেদিন গেলাম, সেদিন স্যারের ছোট মেয়ে নিশু দরজা খুলে দিল। সে মোবিনকে চেহারায় চেনে। যেহেতু প্রতিবেশী। নিশু ভেবেছে এলাকার কোনও বিষয় নিয়ে আমরা কথা বলতে এসেছি। সে আব্বু আব্বু বলে দৌড়ে গেলো ভেতরে। সেদিনই দরজার বাইরে থেকে দাঁড়িয়ে ঘরের স্পেস সম্পর্কে আইডিয়া পেয়েছিলাম।
দূর থেকে সম্ভবত সেটা বেড রুম ছিল। আফতাব স্যার সেখান থেকে হেঁটে হেঁটে আসছেন। পরনে লুঙ্গি, গায়ে শার্ট। তবুও লোকটাকে অসম্ভব স্মার্ট মনে হয়। লুঙ্গি পরেও একটা লোককে যে পরিপাটি লাগতে পারে সেটা সেদিন প্রথম বুঝলাম। লুঙ্গিতেও আভিজাত্য ভাব আছে, এটা অনেকেই তো বলে।
যাই হোক, তিনি মোবিনকে দেখে খুবই বিরক্তবোধ করলেন। উনি এসে দুজনের চোখের দিকে তাকালেন। কিন্তু আমি কেন যেন স্যারের চোখের দিকে তাকাতে পারছিলাম না। পুরো অস্বস্তি লাগছিল। মনে হচ্ছিল, উনি চোখ দেখে আমাদের মতলব বুঝতে চাইছেন।
শুনেছি স্যার নাকি গেলেই ব্যাচে স্টুডেন্ট নেন না। কারণ হলো দুই মেয়ে। বড় মেয়ে মিশু আর ছোট মেয়ে নিশু। মিশু এবার মেট্রিক দেবে, নিশু পড়ে সিক্সে।
মেয়েদের কারণে উনি সবসময় সিকিউরিটি বিষয়টা মাথায় রাখেন। বদ-খত ছেলে এমনকি দুষ্টু মেয়েদেরও ব্যাচে নেন না। যাকে ভালো লাগে না, সরাসরি বলে দেন স্টুডেন্ট ওনার পছন্দ না।
তবে স্যারের চোখ মাশাল্লাহ। আমি যতবার ওনার চোখের দিকে তাকিয়েছি ততবারই খেয়াল করেছি, কী তীব্রতা ওনার চোখে। যেন মুখের ভাষা নয়, পড়ছেন চোখের ভাষা।
আসলে আমি কিন্তু স্যারের চোখ ফাঁকি দিতে গিয়েছিলাম। কলেজে পড়ার রোমাঞ্চকর মুহূর্তে আমার প্রেম বড় জরুরি। ভাবলাম, যদি মিশুর সঙ্গে একটু বন্ধুত্ব করতে পারি, কম কিসে। যদিও মোবিন চায় না মিশুর সঙ্গে আমার প্রেম হোক। মোবিন প্রেমে-টেমে বিশ্বাসী না। তার কাছে ওসব নাকি একটা ফালতু নেকামো বিষয়। সে নাকি ডাইরেক্ট অ্যাকশনে বিশ্বাসী। মানে বিয়ে। তো, আমরা তো সবে পড়ি কলেজে। এই বয়সে বিয়ের কথা ভাবা একটা পাকামো, এটা বড়রা বলে। আমাদের কিন্তু ভাবতে বড়ই জমপেশ ফিলিংস লাগে।
রোমান্টিক রোমান্টিক ভাব, বিয়ে হবে, বউয়ের সঙ্গে দুষ্টামি হবে, আমি বউকে আদর করবো, বউ আমাকে আদর করবে, দুজন মিলে এই শহরে রিক্সা দিয়ে ঘুরে বেড়াবো, আইসক্রিম খাবো বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে, বউ অভিমান করবে, আমি তার অভিমান ভাঙাবো। এসব ভাবতে কিন্তু খারাপ লাগে না। তবে রাতে যখন আমার কোল-বালিমশটা জড়িয়ে ধরি তখন যেন একাকিত্ব আমাকে জড়িয়ে ধরে। মনে হয়, শালার এই কোল বালিশটা না থেকে যদি আমার বউ হতো- কত নিশ্চিন্তে দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরে আরামে এক ঘুমে রাত পার হতো। তবে বউ কে হবে সে তো যোজন যোজন দূরের আলাপ।
এই প্রেম ভালোবাসার বিষয়টা আমরা হিন্দি সিনেমায় দেখে শিখেছি। ওখানে নায়ক নায়িকারা যেভাবে জড়া-জড়ি করে, ওটা দেখে নিজের শরীরে আলোড়ন অনুভব করেছি।
প্রেম সম্পর্কে আমাদের কারও বাস্তব অভিজ্ঞতা ছিল না। শুধু ওই সিনামাই ছিল আমাদের প্রেম শিক্ষার একমাত্র ক্লাস। আমরা সব বন্ধুরা ছিলাম ওই ক্লাসের মনোযোগী ছাত্র। যদিও অনেকেই হিন্দি সিনামা বাদ দিয়ে নিষিদ্ধ সিনামার ক্লাসে যোগ দিয়েছিল। আমার কেন যেন ওসব ভালো লাগে না। কেন লাগে না এ বিষয়ে নিজেও জানি না। দু’জন মানুষ লেঙটা হয়ে আছে, বিষয়টা আমার মধ্যে সাড়া জাগায় না, কারণ ওখানে আমি প্রেম দেখি না, আবেগ দেখি না, ভালোবাসাও দেখি না।
তবে সিনামার বাইরেও আমাদের আরেকজন শিক্ষক ছিল। তিনি আমাদের এলাকার মোকলেস ভাই। তিনি বিবাহিত। আমাদের এলাকায় তিনি ‘বিয়াত্তা মকু’ নামে পরিচিত।
তিনি ঢাকা কলেজে অনার্স সেকেন্ড ইয়ারে পড়েন। সেকেন্ড ইয়ারে উঠেই বিয়ে করে ফেলেছেন।
অনেকে ভাবতে পারেন, স্টুডেন্ট কেন বিয়ে করলো! করেছে তার ভেতরও প্রেম কাহিনি আছে। কাহিনিটা হলো, আমাদের আড্ডায় তো মোকলেস ভাই মানে মকু ভাইও ছিল। আমরা যখন আড্ডা দিতাম কোনও না কোনোভাবে কোনও এক মেয়ের গল্প চলে আসতো। সেটা এলাকার মেয়ে হতে পারে, কোন কোন মেয়েকে নিয়ে আলোচনা হয়েছিল সেটা তো আপনাদের জানার দরকার নেই। সেই আলাপে যখন হাসি তামাশা চলতো তখন আস্তে আস্তে কে কে নিষিদ্ধ সিনেমা দেখেছে সেটারও গল্প হাজির হতো। এসব কেন যেন মকু ভাইয়ের সহ্য হলো না। তিনি তার উত্তেজনা কমানোর জন্য প্রেম করার সিদ্ধান্ত নিলেন।
আমাদের এলাকার সবচেয়ে নামকরা কনফেকশনারি হলো, ইলিয়াস কনফেকশনারি। ওটার মালিক ইলিয়াস পাটোয়ারী। তার একমাত্র মেয়ে মোনিকার প্রেমে পড়ে গেল মকু ভাই। মকু ভাইয়ের মতো হ্যাংলা পাতলা, গাঞ্জুট্টি টাইপ একটা ছেলের প্রেমে ইলিয়াস সাহেবের মেয়ে মোনিকা কেন পড়লো, সে আমাদের কাছে আজও এক রহস্য। মকু ভাই আসলে কীভাবে কী করেছিল তা কারও জানা নাই। মোবিন অবশ্য মাঝে মাঝে বলে, মকু ভাই মনে হয় তাবিজ কইরা পটাইছে।
এটা মকু ভাইয়ের সামনে বলেই খেপাতো মোবিন। মকু ভাইকে আমরাও খেপাতাম। মাঝে মাঝে দেখলেই ‘মোনিকাআআ ওই মাই ডারলিং’ গানটা গেয়ে উঠতাম। মকু ভাই শুরুতে লজ্জা পেত। কিন্তু যখন প্রেম তার গভীর হয় তখন সে এই গান শুনলেই আমাদের দিকে তেড়ে আসতো।
মোনিকা আর মকু ভাই প্রেম করতে যেতো চন্দ্রিমা উদ্যানে। চন্দ্রিমা উদ্যান নামটা শুনলেই প্রেম প্রেম ভাব আসে। ওখানে নাকি সবাই প্রেম করতে যায়। মকু ভাইয়ের সঙ্গে তার প্রেমের গল্প শুনতে গেলে আমরাও মনে মনে সিদ্ধান্ত নেই একদিন আমাদেরও প্রেম হবে তখন আমরাও চন্দ্রিমা উদ্যানে যাবো। তবে সেখানে কিভাবে প্রেম করতে হয় তা মকু ভাই কখনও কাউকে বলে নাই। তাই চন্দ্রিমা উদ্যান আমাদের কাছে হয়ে রইলো এক প্রেম রহস্য হয়ে। যে রহস্য আমরা ভেদ করবো প্রেম করার পরে। শুনেছি স্কুল-কলেজের ছেলেপেলে ওখানে গেলে নাকি পুলিশ ধরে নিয়ে যায়। এটাও বলেছিল মকু ভাই। তাই প্রেম রহস্য পড়ে যায় পুলিশি আতঙ্কে।
যাইহোক, একদিন মোবিন দৌড়ে আমার বাসায় আসলো। বললো, ‘দোস্তো চলো তাড়াতাড়ি’।
আমি বললাম, ‘কোথায়?’
সে বলে, ‘আরে জানস না? মকু ভাই হাউয়ার পো নাকি ঘুমের ওষুধ খাইছে। এটেম টু সুইসাইড। এই মাত্র তারে ঢাকা মেডিক্যাল নিয়ে গেছে।’
আমি বললাম, ‘বলিস কী? কেন এমন করলো?’
এমন সিরিয়াস সময়ে মোবিন বলে, ‘হালার মনে হয় প্রেমরোগ সহ্য হয় নাই।’
আমরাও তখন এলাকার সবাই দলবল মিলে রওনা দিলাম ঢাকা মেডিক্যালে। সেখানে গিয়ে শুনতে পাই মকু ভাই এখন আশঙ্কামুক্ত।
আমরা নিশ্চিত ছিলাম, মোনিকাকে পাওয়ার জন্য সে এক ফাঁদ পেতেছে। যেখানে পা দিয়েছে তার বাবা মোসলেহ উদ্দীন এবং মোনিকার বাবা ইলিয়াস পাটোয়ারী।
কারণ হাসপাতালে ইলিয়াস চাচাও আছে। এবং সেখানে দুই পিতার এক অনবদ্য আলাপও আমরা শুনে ফেললাম। যেখানে মোসলেহ সাহেব বলছেন, ‘ইলিয়াস ভাই আমি হাত পাতি, আপনার মাইটারে আমার ঘরে তুইলা দেন। নাইলে আমার পোলা বাঁচবো না’।
আর আতঙ্কগ্রস্ত ইলিয়াস চাচাও সায় দিচ্ছে। কারণ সেদিন সেখানে পুলিশও উপস্থিত ছিল। যদি দুই পিতার সমঝোতা না হতো তবে তো জেলেও যেতে হতে পারে কাউকে না কাউকে। পুলিশকে কে না ডরায়?
এরপর মকু ভাই থেকে ‘বিয়াত্তা মকু’ হয়ে গেলো। আমাদের সঙ্গে মকু ভাইয়ের মেলামেশাও কমে গেলো। কারণ মকু ভাই নাকি মোনিকাকে বলে দিয়েছে, আমরা তাকে দেখলে কোন গানটা গাই। শুধু তাই না, এখানে অনেকেই নিষিদ্ধ সিনেমা দেখে, সেটাও মকু ভাই বলে দিয়েছে। এই শুনে মোনিকার নির্দেশ- আমাদের সঙ্গে না মিশতে; আমরা এলাকার খারাপ ছেলে।
তবে বিয়ের কয়েকমাস পর থেকেই মকু ভাই বিষাদে থাকে। একদিন রাতে তাকে দেখি টং দোকানে বসে সিগারেট ফুকছে।
আমি তাকে গিয়ে বলি, ‘মকু ভাই খবর কী? মোনাকি ডার্লিং ভালো আছে?’
মকু ভাই আনমনে থাকলেও মুচকি হাসি দিয়ে বলে, ‘হারামজাদা তোরা মানুষ হবি না?’
আমিও হাসলাম, বললাম, ‘ভাবি কি বাইর কইরা দিছে? মন খারাপ কইরা বইসা আছেন কেন?’
তিনি কিছু বলেন না। চুপ করে থাকেন। আমি একটা সিগারেট ধরালাম। হঠাৎ তিনি বলে উঠলেন, ‘বুঝছোস, বিয়ার আগে বুঝি নাই বিয়া কী জিনিস। বিশাল দায়িত্বের বিষয়। এত দায়িত্বের ভেতর নিজেকে মনে হয় একটা কুয়ো ব্যাঙ’।
আমি আর কিছু বলি নাই।
ভাবলাম এখান থেকে সরে যাওয়া ভালো। মকু ভাইয়ের মন খারাপ। যেই মোনিকার জন্য ফাঁদ পেতে ছিল মকু ভাই। সেই মোনিকার সঙ্গে সংসার করতে গিয়ে মনে হয় প্রেমের তেল ফুরিয়ে গেছে। এখন হয়ত সংসারকে তার ফাঁদ মনে হয়। আমার মনে হলো আর কী। আমার তো আর প্রেম-বিয়ার অভিজ্ঞতা নাই।
২.
কোথায় যেন ছিলাম? ওহ্ আফতাব স্যারের বাসায় ছিলাম।
স্যার মোবিনকে গম্ভীর হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী চাই?’
মোবিন বলল, ‘স্যার আমরা দুই জন বন্ধু আছি। কলেজে পড়ি। আপনার ব্যাচে পড়তে চাই।’
তিনি কী যেন বলতে গিয়ে বললেন না। পরে আমাদের মেট্রিকের রেজাল্ট জানতে চাইলেন। কী লজ্জার বিষয়। আমাদের রেজাল্ট শুনে উনি খুবই বিরক্ত হলেন মনে হলো।
তারপর জানালেন এই মুহূর্তে কোনও ব্যাচে ওনার সিট খালি নেই।
মোবিন বলল, ‘স্যার আমাদের নিয়েই একটা ব্যাচ যদি করতেন ভালো হতো।’
এটাতেও উনি বেজায় বিরক্ত হলেন, বললেন, ‘আমার ক্লাসে সিট ২০ টা। জীবনে শুনেছো ২ জনের ব্যাচ হয়?’
আমরা মন খারাপ করে ফিরে এলাম।
৩.
মিশুকে আমি প্রতিদিনই তো দেখতাম। কিন্তু ঠিক কবে কখন কিভাবে হঠাৎ মনে মনে মিশুর প্রেমে পড়ে গেলাম। মনেই পড়ে না।
জানতাম মায়েদের চোখ ভয়ঙ্কর। এখন তো দেখি বাপদের চোখও ভয়ঙ্কর। আমাদের মতো কু-মতলবীদের মতলব তারা চোখের দিকে তাকিয়েই টের পেয়ে যায়। আমরা সেদিন মন খারাপ করে যার যার ঘরে চলে গেলাম। কিন্তু মিশু আমার মনের গভীরে ঠিকই রয়ে গেলো।
ভাবলাম ঘরে ঢুকে না হোক, বাবা- মা’র শৃঙ্খল ভেদ করে আমাকে পৌঁছাতে হবে মিশুর কাছে। সে যে করেই হোক।
আমি প্রতিদিন রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকি। যখন মিশু যাবে আমি মিশুকে দেখবো। ১০ থেকে ২০ সেকেন্ডের মধ্যে দ্রুত বেগে রিকশা যায়। মিশু ও তার মা। ওই দেখাই আমার জীবনের প্রধান এবং একমাত্র কাজ হয়ে দাঁড়ালো। মাথায় তখন ফিজিক্স-ক্যামিস্ট্রি-ম্যাথ-বাংলা-ইংরেজি কিছুই নাই। শুধু আছে মিশু, মিশু, মিশু।
মিশুকে আমি শকুন্তলা নাম দিয়েছিলাম মনে মনে। কারণ এই এলাকার অলিগলি ঘুরে আমি মিশুকে আবিষ্কার করেছি। আমি রাজা দুষ্মন্ত। এই তপবনে আমি যার সন্ধান পেয়েছি, সেই তো আমার শকুন্তলা।
একদিন আমার প্রেম কাহিনি তৈরি করতে শহীদ নামে এক বন্ধু পাশে এসে দাঁড়ায়। সে আমাকে একটা ফোন নম্বর দেয়। বলে, ‘এটা আফতাব স্যারের বাসার টেলিফোন নম্বর’। আমি এক সরকারি কর্মচারীর ছেলে। কোথায় পাবো টিঅ্যান্ডটি ফোন? কিভাবে কথা বলবো? ওই নম্বর পকেটে নিয়ে নিয়ে ঘুরি। কলেজ ততদিনে মাথায় উঠেছে। শুধু ভাবি কিভাবে ফোন দিব। রাস্তা দিয়ে হাঁটার সময় যখন দেখি দোকানে লেখা, ‘এখানে টেলিফোন করা যায়’– তখন বুকটা চিনচিন করে। ইচ্ছা করে দোকানে ঢুকে শকুন্তলাকে ফোন দেই। ফোন দিয়ে বলি, আমি সকল বাধা ডিঙিয়ে তোমার বুকের মাথা রেখে প্রেমের তৃষ্ণা মেটাবো।
আমি যখন মিশুকে দেখতে এলাকার মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকি। তখন একদিন ঠিকই খেয়াল করলাম মিশু আমাকে আড় চোখে দেখে। আমি ভেবে পাই না, আসলেই সে আমাকে দেখে নাকি শুধু শুধু আড় চোখে তাকায় অন্য কোথাও, আর আমি ভাবি আমার দিকে। এরপর আমি প্রতিদিন দাঁড়িয়ে খেয়াল করি মিশুর তাকানোর ভঙ্গি। একদিন, দুইদিন, তিনদিন- আবিষ্কার করলাম ঠিকই মিশু আমাকে দেখে। একদিন তার মা পাশে বসা তবুও আমার দিকে তাকিয়ে এক মিষ্টি হাসি দেয় মিশু। সেদিন মনে হচ্ছিল এই পৃথিবী এক বিশাল সমুদ্র, আর আমি উত্তাল ঢেউয়ে ভেসে বেড়াচ্ছি। মিশু আছে সেই অনেক দূর এক জাহাজে। আমাকে সাতরে যেতে হবে জাহাজ পর্যন্ত। সে কতদূর, কতদূর, কতদূর…
একদিন ঠিকই আফতাব স্যারের বাসায় ফোন দিলাম। তাও সে ব্যবস্থা করে দিল মকু ভাই। এলাকার যে ফোনের দোকানটা আছে, সেটা ওনার বন্ধুর বড় ভাইয়ের। মকু ভাই ইদানিং সে দোকানে বিকালে বসে। কারণ বিয়ে যেহেতু করেছে তাই তার কিছু ইনকাম দরকার। সে জন্যই সিলিকন এন্টারপ্রাইজ হয়ে ওঠে তার অফিস। মিশুকে যখন প্রথম ফোন দেই দুরু দুরু বুকে, যখন ভাবছিলাম ফোনটা ধরবে আফতাব স্যার কিংবা তার স্ত্রী কিংবা তাদের ছোট সন্তান নিশু। যদিও কারও গলা আমার চেনা নয়, এমনকি মিশুর গলাও। তবুও এক কাঁপা কণ্ঠস্বর যখন বলে উঠলো, ‘হ্যালো’। তখন মনে হলো, চারিদিকে বৃষ্টি হচ্ছে আর ঝুমঝুম শব্দ ভেদ করে আমার বুকের ভেতর একটা চাপ অনুভব করাচ্ছে। আমি বললাম, ‘শকুন্তলা?’
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললো, ‘সরি রং নম্বর’। আমার তখন জ্ঞান হয়। শকুন্তলা বললাম কেন? আবার ডায়েল করি। এবার পুরুষ কণ্ঠ। রেখে দেই। সেদিন আর ফোন দেওয়ার সাহস হয়ে ওঠে না। পরদিন বিকালে আবার ফোন দেই। আমি চুপ করে থাকি। আমি জানি এটা মিশু। মন বলে। দেখি মিশু কিছু বলে নাকি। মিশু বলে ওঠো, ‘কথা বলেন, আমি মিশু’।
আমি বলি, ‘না তুমি শকুন্তলা’।
মিশু হেসে ওঠে। আমার মনের ভেতর তখন উত্তাল ঢেউ আছড়ে পড়ে। কী রিনঝিন শব্দের হাসি। মাতাল করা হাসি। আমি আবার বলি, ‘চিনেছেন?’
মিশু আবার হাসে। তবে এবার সাবধানে, ফিসফিস করে হেসে হেসে বলে, ‘এভাবে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকো কেন? আম্মুও কিন্তু বোঝে।’
সেদিন যে শুরু হলো কথা। আর তো শেষ হয় না। চলে আমাদের প্রেমের জাহাজ। দুরন্ত বেগে। স্যারের একটা ব্যাচ শুরু হয় ৪টায়। শেষ হয় ৫টায়। ওসময় ওদের মা ঘুমে থাকে। তাই মিশুই বলে দেয় প্রেমের সময় মাত্র এক ঘণ্টা।
এভাবে বিকাল ৪-৫ পর্যন্ত সিলিকন এন্টারপ্রাইজ হয়ে ওঠে আমার চন্দ্রিমা উদ্যান। আমাদের প্রেমের এক ইতিহাস হতে থাকে সিলিকন ইন্টারপ্রাইজ। আমি যখন কথা বলতাম শকুন্তলার সঙ্গে তখন মকু ভাই ওয়াকম্যানে গান শুনতো। আমি জানি না, মকু ভাই আমাদের প্রেমের আলাপ শোনে কিনা। কিংবা শুনলেও আমার কিছু যায় আসে না। কারণ আমি তখন রাজা দুষ্মন্ত।
দুষ্মন্ত কাউকে ভয় পায় না।
এই প্রেমের তীব্র হাওয়ায় কখন ইন্টার পরীক্ষা চলে এলো টেরই পেলাম না। পড়াশোনা বাদ দিয়ে প্রেম সাগরে ভেলা চালাই সিলিকন এন্টারপ্রাইজে। সকাল হলে অপেক্ষা কখন বিকাল ৪টা বাজবে। বিকাল ৫টার পর আবার অপেক্ষা পরদিন বিকালের। এই অপেক্ষায় মাত্র ১ ঘণ্টার উত্তাল সমুদ্রে নিজেকে ভাসানোর আর্তনাদ করতে করতেই ভুলে যাই- আমি সবে কলেজে পড়া এক খোকা।
৪.
পরীক্ষার যখন এক মাস বাকি ঠিক তখনই আফতাব স্যারের বাসায় আমার ডাক পড়লো। মোবিন কিছু জানে না, শুধু জানে আমার সঙ্গে তাকেও যেতে বলা হয়েছে। আমি তো বুঝি ডাক কেন এলো। শকুন্তলা এবার ধরা খেয়েছে পিতার সূক্ষ্ম চোখে। এবার নিস্তার নাই। কিভাবে ধরা খেলো সেটা জানারও উপায় নেই। আফতাব স্যারের বাসায় যাওয়ার আগে দুইবার মকু ভাইকে দিয়ে ট্রাই করেছি ফোনে। রিং হয় কিন্তু কেউ ফোন ধরে না। বড় অনিশ্চিতভাবে যাত্রা শুরু আফতাব স্যারের বাসার দিকে।
বুঝি না যাওয়া ঠিক হবে কী হবে না। এই প্রেম খেলায় আমি তো নতুন খেলোয়াড়।
অতপর বাসায় গেলাম। এক পিনপতন নিরবতায় আমি আর মোবিন। যেন দুই আসামিকে নিয়ে বসেছে পুলিশ। এলাকার প্রভাবশালী শিক্ষকের মেয়ের সঙ্গে পিরিত! কত বড় সাহস আমার।
মাথা নিচু করে আমিও অপরাধী ভাব ধরে বসে আছি। আর এদিক সেদিক খোঁজার চেষ্টা করি শকুন্তলাকে। সে নাই। হয়তো সে বন্দি। প্রেম করা তো এই সমাজে অপরাধ। তাও এই বয়সে।
আফতাব স্যার আমাকে প্রশ্ন করলেন না। শুধু শোনালেন। বললেন, ‘তোমার কলেজের প্রিন্সিপাল আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। সামনে পরীক্ষা। অ্যাডমিট কার্ড এখনও তো পাওনি। আমি চাই না তোমাদের জীবন নষ্ট হোক। বাসায় গিয়ে পড়াশোনা করতে বসো। জীবন এখনও শুরুই হয়নি। সামনে অনেক লম্বা পথ।’
আফতাব খান নিপাট ভদ্র লোক। তার মেয়ের সঙ্গে প্রেম করছি এটা অন্য বাপ হলে পিটিয়ে তক্তা বানিয়ে ফেলতো। কিন্তু তিনি ঠাণ্ডা মাথায় হুমকি দিলেন। বোঝালেন ওনার এক কথায় আমাদের অ্যাডমিট কার্ড দেওয়া হবে না। আমরা পরীক্ষা দিতে পারবো না। আর যে ছেলে মেট্রিক কিংবা ইন্টার পরীক্ষা দিতে পারে না তাদের জীবন নষ্ট হওয়ার আগেই এই সমাজ নষ্ট করে দেয়। এক কুয়ো ব্যাঙে তারা পরিণত হয়। কেউ তাদের গোনায় ধরে না। আমাদেরও কেউ গোনায় ধরবে না।
ওই বাসা থেকে নামার সময় মোবিন বলল, ‘দোস্ত আর ক্যাচাল করিস না। কাইছিলাম এসবে ঢুকিস না। হুদাই তুই আমারেও গ্যাঞ্জামে ফালাইলি। কিন্তু প্রশ্ন হলো, ধরাটা খাইলো কেমনে, জানোস?’
আমি শুধু মাথা নাড়ালাম। বোঝালাম জানি না।
আমি বাসায় আসলাম। রাজা দুষ্মন্ত আজ অসহায়। তার বন আজ খাঁখাঁ করছে। বনে আজ শকুন্তলা নেই। এক বিষাদগ্রস্ত বনে পরিণত হয়েছে। কারণ জীবনের হিসাব-কিতাবে শকুন্তলা হারিয়ে যাচ্ছে।
গল্প-উপন্যাসে পড়েছি, সিনামায় দেখেছি বিচ্ছেদের গল্প। এই প্রথম বিচ্ছেদের সঙ্গে দেখা হলো। কেউ জানে না এ জগতে আমার আর শকুন্তলার প্রেম কাহিনি। শুধু জানে সিলিকন এন্টারপ্রাইজ। আরও জানে শকুন্তলাদের ছাদের সিঁড়ির করিডোর। যেখানে প্রথম আমাদের দেখা হয়েছিল। সেদিন এমনই ঝুম বৃষ্টিরকালে শকুন্তলা ছুটে এসে আমার বুকে মাথা দিয়েছিল। আমি শক্ত করে জড়িয়ে ধরেছিলাম। আবেগে আপ্লুত হয়ে আস্তে আস্তে মুখটা নিচে আসছিল আমার। এক হয়েছিল দুজনার ঠোঁট। কী এক মধুর সুধা যেন পান করি দু’জনে। ওই করিডোরও হয়ে উঠেছিল আমাদের প্রেম বাগান।
আমি বিছানায় শুয়ে যাই। মনে পড়ে আমার শকুন্তলাকে। যে বলেছিল, ‘কখনও ছেড়ে যেও না’। আজ কেন তবে ওই একটা সামান্য হুমকির কাছে রাজা দুষ্মন্ত থেকে কুয়ো ব্যাঙ হয়ে গেলাম? আমার বিছানার কোল-বালিসটা জড়িয়ে ধরি। দেখি সমুদ্র শুকিয়ে কাঠ। মিশুকে দেখা যায় না। জাহাজও নেই। দূর দূরান্ত ফাঁকা ময়দান। আর আমার চারিপাশে শুধু ব্যাঙ, বিরাট গর্তে পড়ে যাচ্ছে, একে একে। যেন আমি তাদেরই জাত…
পরদিন মোবিন জানালো, আসলামকে ব্যাচ থেকে বের করে দিয়েছেন আফতাব খান।