সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠতে একদমই ইচ্ছা করে না। এই শালার চাকরি এমন এক অভিশাপ যে সকালেই উঠতেই হয়। তার ওপর বউ যদি কুস্তাকুস্তি শুরু করে। সকালও হয়নি তখন। মানে সকাল হয়েছে, আমার জন্য তখনও সবে দিনের আলো ফুটতে শুরু করেছে। ঘড়িতে বাজে মাত্র সকাল সাতটা বিশ। আমি নয়টার আগে ঘুম থেকেই উঠতে পারি না। এটা জেনেও আমার বউ রুকসি বলতে গেলে ভোর থেকেই ঘ্যানঘ্যান করছে। ওহ! আমার বউয়ের সঙ্গে তো আবার আপনাদের পরিচয় নেই। বউয়ের সঙ্গে কী, আমার সঙ্গেই তো পরিচয় নেই। আমার নাম মনোয়ার ফেরদৌস। আর বউয়ের নাম রুকসানা খাতুন। আমি তাকে আদর করে রুকসি ডাকি। সমস্যা হলো আমার এই আদুরে ডাকটা একসময় শুধু আমার ছিল, এখন সেটা গণ হয়ে গেছে। আমার আত্মীয় স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, পাড়া-প্রতিবেশী সবাই তাকে রুকসি ডাকে। ওর এমন সমস্যা হয়েছে যে কখনও কখনও সেও নিজের পুরো নাম ভুলে যায়।
এই যেমন, একবার আমরা সিলেট যাবো। রুকসিকে বললাম, ‘তুমি অফিস থেকে আসার পথে বাসের টিকিট করে নিয়ে এসো। তোমার অফিসের কাছেই তো বাস কাউন্টার।’ রুকসি টিকিট কাটলো রুকসি নামে। আমি টিকেট দেখে তো অবাক। বললাম, ‘বাসের টিকিট কাটার সময় আসল নাম দিতে হয়, তুমি রুকসি দিলে কেন?’ সে হাসতে হাসতে বলে, ‘আর বইলো না, তারা আমাকে নাম জিজ্ঞেস করলো, হুট করে মাথায় নামটা আসছিলই না। তাই রুকসি বলে ফেললাম।’ আমরা দু’জনে তখন হাসতে হাসতে শেষ। যদিও রুকসিকে অফিসে সবাই রোকসানাই বলে। তবুও সেদিন যে ওর কী হয়েছিল কে জানে। যাইহোক, রুকসি বারবার গুতাচ্ছে, ঘুম থেকে ওঠার জন্য। রুকসির প্রচণ্ড শরীর খারাপ। আসলে শরীরটা গত সপ্তাহে বেজায় খারাপ ছিল। ওই যে মশার কামড়ে হয় না? চিকনগুনিয়া! এই মশা তো নাকি পুরো ঢাকা শহর কাঁপিয়ে গেছে। শালার এট্টুক মশার জোর কত বুঝছেন এবার? তো, আমার রুকসিকেও কখন যে মশা কামড় দিয়েছিল কে জানে। আমাদের ঘর অবশ্য একদম পয়পরিষ্কার। মশা মারতে আমরা কামান অবশ্য আনি নাই কখনও। মাঝে মাঝে মশার স্প্রে করেছি। তবে নিয়মিত মশারি ঠিকই টাঙানো হয়। তবুও কোন ফাঁকে যে কোন মশা আমার রুকসির শরীরে চিকনগুনিয়া দিয়া গেলো সেটাই এক বিস্ময়। প্রথমে প্রচণ্ড জ্বর। এই জ্বর তিন দিনে কমে গেলো বটে। কিন্তু এখন বউ না পরে উঠতে, না পারে দাঁড়াতে। তার নাকি হাঁড়ে ব্যথা। জয়েন্টে জয়েন্টে ব্যথা। আমাদের দেশের অনেক প্রভাবশালী লোকজন অবশ্য বলছেন, এই চিকনগুনিয়াতে ভয়ের কিছু নাই। সাধারণ জ্বর, তারপর ঠিক হয়ে যায়। ডাক্তারও একই কথা বলেছে রুকসিকে। রুকসির জ্বর কমার পর ডাক্তারের কাছে গেলাম। ডাক্তার বললো, এটা আসলে চিকনগুনিয়া। জ্বর কমে যাবে আরও। তবে হাঁড়ে ব্যথা থেকে যাবে। চারপাঁচ মাস অপেক্ষা করতে হবে। আরে ব্যাটা চারপাঁচ মাস কি কম নাকি? এমন ব্যথা নিয়ে বসে থাকা যায় ঘরে? রুকসি আমাকে আজ সকাল সকাল কেন উঠতে বলছে? বিষয়টা আমি ধরতে পেরেছি। তাই চোখ বন্ধ করে অভিনয়ের ভান করে শুয়ে আছি। রুকসি অনেকক্ষণ ডাকার পর বিষয়টা বুঝতে পেরে বলা শুরু করলো, ‘আচ্ছা তুমি পুরুষ হবা কবে? এইভাবে আর কতদিন? বিয়া করছো ৬ বছর হইয়া গেলো। এখনও তুমি পুরুষ হইতে পারলা না।’ তখন আমি কিঞ্চিৎ অপমানিত হই বটে, তবে তারপরও লজ্জাসমেত শুয়ে আছি। এক পর্যায়ে সে হাল ছেড়ে দিল। টয়লেটে গেলো, বের হয়ে আবার বিছানায় শুয়ে গেলো।
২. আসলে আজকে রুকসির পিরিয়ড শুরু হয়েছে। তার কাছে নাকি মাত্র একটা প্যাড আছে, মানে সেনিটারি ন্যাপকিন। একটাতে তো আর হবে না। তার আরও দরকার। এখন সমস্যা হলো আমি কখনও রুকসিকে এটা কিনে দিতে পারি নাই। আমি লজ্জা পাই। আমার মতো আপনারাও নিশ্চয়ই এই গল্প পড়তে লজ্জা পাচ্ছেন। কী করবেন। লজ্জা ভেঙে একটু এগিয়ে পড়তে পারেন। আমার এই লজ্জা নিয়ে রুকসি বহুবার আমার আত্মসম্মানে আঘাত করেছে। কিন্তু তবুও লজ্জা আমার ভাঙে নাই। অপমান সহ্য করেছি, তবুও ঠিকই বছরের পর বছর টিকে রয়েছে লজ্জা। আমার লজ্জা শুধু প্যাড কেনার ক্ষেত্রে নয়, কনডমেও একই অবস্থা। আমার বন্ধু উজ্জল থাকে পাশের বাসায়। সে হলো আমার কনডম সাপ্লাইয়ার। সেই আমাকে কিনে দিত, আসলে এখনও দেয়। উজ্জলও মাঝে মাঝে আমাকে লজ্জা দিত। বলত, ‘শালা বলদ, একটা কনডমও কেনার সাহস হয় নাই তোর।’ আপনারাই বলেন। আমি লজ্জা পাবো না? আমি তো একবার ঠিকই কনডম কিনতে গিয়েছিলাম। যখন গেলাম, ফার্মেসি দোকানদার আমার পা থেকে মাথা পর্যন্ত নজর দিলেন। ভাবখানা এমন যেন আমি মহা এক অন্যায় জিনিস আবদার করেছি, কিংবা আমার এখন কনডম কেনার বয়সই হয় নাই। তারপর তার প্রশ্ন ছিল, ‘কনডম বললে তো হবে না, কোন ব্র্যান্ড?’ ওই সময় আমার পাশে এক বয়স্ক মহিলা এসে দাঁড়ালো। এসেই বলল, ‘বাবা একটা প্যারাসিটামল দাও তো’। তারপর দোকানদার দেখি মহিলাকে দেখে আমাকে আর কনডম দিল না। আগে তাকে বিদায় করলো। আবার আমাকে জিজ্ঞেস করলো, ‘কোন ব্র্যান্ড?’ আমার আবার এই ব্র্যান্ড সম্পর্কে আইডিয়া খুবই কম। টিভিতে বিজ্ঞাপনে যা দেখি সেগুলোই চিনি। তবে যেহেতু আমি অতি লজ্জাবান একজন পুরুষ, তাই ব্র্যান্ড চয়েজটা তার ওপর ছেড়ে দিয়ে বললাম, ‘যেটা ভালো হয় সেটাই দেন ভাই।’ ফার্মেসি দোকানদার যে বয়স্ক তা না, তবে আবার আমার মতো ইয়াংও না। বয়স হবে ধরেন চল্লিশ-বেয়াল্লিশ। এরপর ওই ভদ্রলোক মজা নেওয়া শুরু করলো। যখনই আমি কোনও ওষুধ কিনতে তার দোকানে যাই, সে আমাকে দেখে মুচকি মুচকি হাসে। তারপর জিজ্ঞেস করে, ‘কী ভাই জিনিস ঠিক ছিল? লাগবো আরও?’ ইচ্ছা করে বেটার পাছায় একটা লাত্থি মারি। হারামজাদা। ঠিক ছিল না বেঠিক ছিল তোরে বলতে হবে? মনে মনে তাকে গালি তো দিতাম। কিন্তু সামনা-সামনি আমি কথাগুলো এড়িয়ে যেতাম। বোঝাতে চাইতাম, শালা তোমার সঙ্গে এসব আলাপে আমি আগ্রহী না। কিন্তু না, হারামজাদা একটা চালু মাল। যতবার গেলাম, ততবারই একই প্রশ্ন করে। পরে তার ফার্মেসিতে যাওয়াও বাদ দিয়েছি। শুধু তাই না, এলাকার কোনও ফার্মেসিতেই আমি আর যাই না কনডম কিনতে। তবে রুকসি এটা নিয়ে আমার সঙ্গে প্যাড কেনা নিয়ে খুব বেশি কিছু করে নাই। মাঝে মাঝে কথা শুনালেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে নিজের প্যাড নিজেই খরিদ করে এনেছে। রুকসি অনেক শক্তসামর্থ নারী। নিজের কাজ সে নিজে করতেই বেশি করে। যদিও মাঝে মাঝে মেজাজ খারাপ থাকলে একটু চিৎকার করে। কিন্তু ওটা আমি সহ্য করে নেই। কারণ আমি জানি রুকসি শুধু শুধু চিৎকার করে না।
আপনারা ভাবতে পারেন, আমি তার জন্য প্যাড কিনে আনি না বলে আমার ওপর কেন রাগ করলো না? বিষয়টা তা না। প্যাড তো সে নিজেরটা নিজেই কিনতে পারে। কিন্তু আমি কেন কিনতে লজ্জা পাই, সেই লজ্জা ভাঙানোর জন্য চিৎকার করে। তবে এটা নিয়ে খুব বেশি কিছু বলে না অবশ্য। তারও একটা গল্প আছে। আমাদের বিয়ের দ্বিতীয় দিনই হঠাৎ করে রুকসি বললো, তার পিরিয়ড হয়েছে। বিষয়টা নিয়ে আমি মোটেও বিচলিত ছিলাম না। এটা তো স্বাভাবিক বিষয়। কিন্তু রুকসি খুব বিচলিত। অস্থির। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘তুমি অস্থির কেন?’ রুকসি তখন কেঁদে আমাকে জড়িয়ে ধরলো। বলল, ‘খালা বলেছিল, ওষুধ খেয়ে নিতে, যেন পিরিয়ড না হয়। ডেটটা বিয়ে কাছাকাছি ছিল বলে। আমি আর খাইনি। তুমি প্লিজ রাগ করো না।’ আমি তো অবাক। নতুন বউ বলে কী? আমি তখন তাকে জড়িয়ে ধরে বললাম, ‘রাগ করবো কেন? এটা তো শরীরের একটা ঘটনা। এটা নিয়ে রাগ করার কী আছে?’ রুকসি সেদিন এক দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলেছিল। আমি বুঝিনি কেন। অনেকদিন পর মানে যখন প্রায় দেড় দুই বছর আমাদের বিয়ের বয়স হয়েছে, তখন একদিন রুকসির পিরিয়ডের সময় আমার ওপর মহা খেপা। আমি কেন তাকে প্যাড কিনে দেই না এটা নিয়ে সে মোটামুটি ঘর মাথায় উঠাচ্ছে। আমি চুপ করে বসে আছি। কী বলবো বুঝতে পারছি না। কারণ এটা তো হজম করতে হবে। হজম না করে তো উপায় নেই। আমি যাবো ফার্মেসিতে। ওই বদমাইশ আমার দিকে তাকিয়ে একটা বদমাইশি হাসি দেবে। জিজ্ঞেস করবে কোন ব্র্যান্ড। তারপর লুকিয়ে লুকিয়ে কাগজে পেচাবে। এমনভাবে আমার হাতে দিবে যেন আমাকে সে মহা গোপন একটা জিনিস দিচ্ছে। এই গোপন গোপন খেলা আমার একদমই ভালো লাগে না। মানে আমি স্বস্তি পাই না। খুবই অস্বস্তিকর লাগে। তারপর চিৎকার করতে করতে হঠাৎ দেখি রুকসি চুপ। কাঁদছে। আমি তাকে গিয়ে প্রশ্ন করলাম। ‘ঘটনা কী? আবার কাঁদছো কেন?’ রুকসি তখন হুট করে দৌড়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলো। কাঁদছে তো কাঁদছেই- থামছে না। তারপর বলল, ‘আমি যে মাঝে মাঝে এটা নিয়ে ঝামেলা করি তোমার খুব খারাপ লাগে?’ আমি বললাম, ‘না, লাগে না। দোষ তো আমারই। কিন্তু নিজের অস্বস্তির কারণে পারি না।’ রুকসি তখন বলল, ‘আমার প্রায়ই রাগ হয়, কিন্তু হজম করে ফেলি। কারণ, বিয়ের পরদিন আমার পিরিয়ড হওয়া নিয়ে যখন আমার মা-খালারা টেনশনে শেষ ঠিক সেই সময় তুমি এতই নিরুত্তাপ ছিলে এবং এত স্বাভাবিকভাবে নিয়েছিলে, তাই কিছু বলি না, কারণ তুমি খুব সাধারণ, আবার অসাধারণ।’ আমিও খুব অবাক। রুকসি জোরে জোরে হাসে। আমি রুকসিকে তখন জড়িয়ে ধরি। দু’জন জড়াজড়ি করে এভাবে সময় পার করি।
৩. তবে আজ মনে হচ্ছে পার হওয়ার কোনও উপায় নাই। রুকসি তো বের হতেই পারবে না। এখন প্যাডের ব্যবস্থাতো করতে হবে। কী ভয়ানক এক যুদ্ধ ময়দানে যেন দাঁড় করে দিল এই চিকনগুনিয়া। কে বলল, চিকনগুনিয়া শুধু জ্বর দেয়। তারপর যে হাঁড়ে ব্যথা দেয়, তারপর এই সময় যখন কোনও নারীর পিরিয়ড হয়, তখন তাদের অবস্থা কী ওই কর্তৃপক্ষ মহদয়রা জানেন না? আমি এসব বুঝি না। শরীরের কোন ওরগান কোন সময় কী আচরণ করবে সেটা কি কতৃপক্ষ জানে? আছেন ওনারা শুধু চাপাবাজিতে। খালি আশ্বস্ত বাণি।
তো, আমি বিছানা ছেড়ে উঠলাম শেষমেষ। আজ তো যেতে হবে। কিছু করার নেই। দাঁত ব্রাশ করছি।
রুকসি তখনও শুয়ে শুয়ে চিৎকার করছে আর বলছে, ‘তুমি কি পুরুষ? বউয়ের জন্য আজ পর্যন্ত একটা সেনিটারি ন্যাপকিন কিনতে পারলা না। পুরুষ কী, তুমি তো মানুষের পর্যায়েও পড়ো না। লজ্জা? কিসের লজ্জা তোমার? আর কত লজ্জা লজ্জা বইলা জীবনটা তুমি পার করবা। একটা সেনিটারি ন্যাপকিন কিনতে তোমার লজ্জা। রাস্তায় দাঁড়ায়া পেশাপ করতে লজ্জা লাগে না? তখন মানুষ যেমনে তাকায় তখন লজ্জা লাগে না?’
আমার তখন একটা কথা বলতে মন চাচ্ছিল। আমি বলতে চাচ্ছিলাম, ‘রুকসি আমি কখনও রাস্তায় দাঁড়িয়ে পেশাপ করি নাই। কারণ এটা করতেও লজ্জা লাগতো।’
তবে এই কথা বলার সাহস হয় নাই।
রুকসি তো এখন মহা খেপা। এটা বললে সে আরও খেপবে। কী দরকার। আর তাছাড়া রুকসি ছাড়া আমি কিন্তু অচল। এই যে দুজনের সংসার; এই পুরোটাই রুকসি সামাল দেয়। বাজার করা, বুয়া সামলানো, আমার কেনা-কাটা, সংসারের কেনাকাটা সবই রুকসি করে। আমি শুধু অফিস যাই আর আসি। রাতে শুয়ে শুয়ে টিভি দেখি। বউয়ের সঙ্গে একটু রং তামাশা করি, তারপর ঘুমিয়ে যাই।
এবার কিন্তু আর অন্য কোনও গতি নাই। যেতেই হবে। কোনও অপশন ফাঁকা নাই। একবার ভাবলাম আমাদের কাজের বুয়া মোমেনাকে বলবো নিয়ে আসতে। পরে ভাবলাম, রুকসি এটাতেও বেজায় খেপে যাবে।
দাঁত ব্রাশ শেষ করে মুখ মুছতে মুছতে রুকসিকে বললাম, ‘আমি নিয়ে আসছি এখনই। তুমি রেস্ট নাও। আর চিৎকার করো না।’
আমি যখন বের হবো দেখি মোমেনাও মুচকি মুচকি হাসে। তবে আমার কেন যেন আজ আর অস্বস্তিও হচ্ছে না। আমি বের হলাম। রাস্তা দিয়ে হাঁটছি, মাত্র সকাল হয়েছে। তবুও কত প্রাণচঞ্চল। বাবারা তাদের সন্তানদের নিয়ে স্কুলে যাচ্ছে, আবার কোনও মায়েরাও যাচ্ছেন সন্তানকে স্কুলে দিয়ে আসতে। কেউ রিক্সায় কেউ হেঁটে হেঁটে। অসংখ্য মেয়েদের সারি রাস্তায়। সেলোয়ার কামিজ পরা আর হাতে টিফিন বক্স, ঘুম ঘুম চোখ, তাড়া তাদের পায়ে। এরা নির্ঘাত গার্মেন্টে কাজ করে। আচ্ছা ওদেরও তো পিরিয়ড হয়। ওরা কি সেনিটারি নেপকিন ব্যবহার করে? ওরা যখন ফার্মেসি যায় তখন কি ওদের দোকানদার হেনস্তা করে? ওরা তখন কী করে? কী বলে? ওরাও কি আমার রুকসির মতো সাহসী? আচ্ছা আমার রুকসিকেও কি আমার মতো অপমানের শিকার হতে হয়েছে?
অনেক আগে ভারতের এক ভদ্রলোক তার বউকে পিরিয়ডের সময় নোংরা কাপড় ব্যবহার করতে দেখে চঞ্চল হয়ে উঠেছিল। লোকটা তামিল নাড়ুর। নামটা বড্ড কঠিন। সে নাকি একবার বলেছিল, আমার বউকে যখন নোংরা কাপড় সেনিটারি নেপকিন হিসেবে ব্যবহার করতে দেখি তখন আমি ভালো সেনিটারি নেপকিন কিনতে দোকানে যাই। গিয়ে দেখি অনেক দাম। এরপর আমি কম খরচে কিভাবে সেটা তৈরি করা যায় সেই গবেষণায় নেমে গেলাম। কারণ আমার ওতো টাকা ছিল না। ওই লোকটার এই পাগলামির কারণে বউ তাকে ডিভোর্স নোটিস পাঠায়, মা তাকে দূরে সরিয়ে দেয়, বোনরাও দূরে সরিয়ে দেয়। গ্রামের লোকজন তাকে পাগল বলে। কিন্তু সেই পাগল ঠিকই একদিন কম খরচে প্যাড বানিয়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেয়।
মানুষ কত কিছু পারে। দুনিয়া বদলে তো এরাই দেয়। আর আমরা সব সুযোগ পেয়েও এক লজ্জার সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে বউকে একটা প্যাড কিনে দিতে পারি না, পিরিয়ড নিয়ে কথা বলতে পারি না। চারিদিকে শুধু লজ্জা আর লজ্জা; কেন?
এই কেন প্রশ্নটা হঠাৎ আমার সামনে একটা বিরাট ডায়নোসারে পরিণত হলো। মনে হলো, শালার কিসের এত লজ্জা? আমি আরও জোরে জোরে হাঁটা শুরু করে দিলাম।
এই সমাজই আসলে অস্বস্তি তৈরি করে রেখেছে। আমরা ওই অস্বস্তির দেয়াল টপকাতে পারি না। এই যে গল্পটা পড়ে আপনারাও ভাবছেন, এটা গল্প লেখার কোনও বিষয় হলো? কিংবা আপনিও অস্বস্তিতে ভুগছেন। কিংবা আমার গল্পকে আরও তুচ্ছতাচ্ছিল্য করছেন। অথবা কেউ না কেউ বলবেন, দুনিয়া অনেক এগিয়ে গেছে। এখন আর লজ্জা তো কেউ পায় না।
ভাই, আমি পাই। আপনার কোনও সমস্যা?
তাই আমার কাছে এ এক বিশাল গল্প। বারবার প্যাড কিংবা সেনিটারি নেপকিন শব্দটা মাইকে বাজানো উচিত। যেন সমাজের সব দেয়াল, সব শৃঙ্খল ওই শব্দে ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। আমি আরও দ্রুত হাঁটি। আরও দ্রুত। আজ ওই ফার্মেসি দোকানে যাবো। জোরে জোরে বলবো, ‘প্যাড দেন’।
কোনও লজ্জা নাই। যদি আজ ব্যাটা কাগজে মোড়ানো শুরু করে। বলবো, ‘লাগবে না। লুকিয়ে দেন কেন? লুকানোর কী হলো?
আমি হাতে নিয়ে আসবো। মানুষ দেখবে। এভাবে দেখে দেখে একদিন তারাও আমার মতো দেখাবে। কিসের লজ্জা, কিসের কী? ভেঙে দেবো আজ, চুরমার করে দিব সব ট্যবুর দেয়াল।
আজ আমাকে ভাঙতেই হবে। না হলে আর ভাঙা হবে না। রুকসিকে আমি বোঝাবো, রুকসি আমি আসলে সমাজের ভাষায় যে পুরুষ, তেমন পুরুষ আমি কখনই হতে চাইনি। আমি মানুষ হতে চেয়েছি। নারী-পুরুষের দেয়ালের ফাঁদে আমি আটকে ছিলাম এতকাল। বরং আজ আমি সেই দেয়াল ভেঙে মানুষ হয়ে বের হয়ে এসেছি।
ফার্মেসি চলে এসেছে। ব্যাটা মাত্র দোকান খুলেছে। মানব দেহের এক স্বাভাবিক প্রক্রিয়াকে ওরাই তো লজ্জা আর অসুখের দেয়ালে বন্দি করে রেখেছে। এই দেয়াল আমাকে ভাঙতেই হবে। আমি ভাঙলেই আমার পরের প্রজন্ম ভেঙে দেবে। আমি ভাঙলেই আরও দশজন ভেঙে দেবে। সমাজ তো একদিনে বদলায় না জানি, ধীরে ধীরে দশজন দশজন করে হবে শত শত, তারপর হাজার-লক্ষ-কোটি।
আমি এগিয়ে যাই, দ্রুত। জোরে জোরে বলি, প্যাড দেন তো ভাই। সে বিস্মিত হয়। আমার কণ্ঠ শুনে এদিক-সেদিন তাকায়।
আমি তাকে আবার বলি, ‘কই তাকান? প্যাড দেন।’
সে আবার আমার দিকে তাকায়। গোপনে কাগজের প্যাকেটে মোড়ায়। আমি তাকে বলি, এভাবে দিচ্ছেন কেন? আপনার দোকানের ব্যাগেই দেন।
দোকানদার আবার তাকায়, এবার মনে হয় সে লজ্জা পায়। আমি নিশ্চিত হই একদিন তারও এই লজ্জার দেয়াল ভেঙে যাবে।
আমি ঘরে ফিরি চার প্যাকেট প্যাড নিয়ে। দুটা দেই রুকসিকে। আর দুটা মোমেনাকে দেই ডেকে। মোমেনা লজ্জা পায়। রুকসি আজ বিস্মিত।
মোমেনা বিব্রত হয়। বলি, লজ্জা পাস? কিসের লজ্জা? এখন থেকে বেতন থেকে প্যাডের টাকা আলাদা করে পাবি।
তামিল নাড়ুর ওই লোককে সবাই প্যাডম্যান ডাকে। কারণ সে কম খরচে প্যাড বানানোর মেশিন বানিয়ে বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে। সারা ভারতে ছড়িয়ে দিয়েছে তার আবিষ্কার। আমার আজ নিজেকেও প্যাডম্যান মনে হচ্ছে। আমি আজ লজ্জা আর অশ্বস্তির দেয়াল ভেঙে দিতে পেরেছি। আমি যেন নিজের কাছে নিজেই প্যাডম্যানের বড় হয়ে উঠেছি।
নিজের কাছে নিজে এতদিন, এতকাল একটা তুচ্ছ ছিলাম। আজ তা নেই, ভেঙে গেছে, গলে গেছে। হাওয়ায় মিশে গেছে সব।
আমি এক দীর্ঘ নিশ্বাস নেই। রুকসি আমার কাছে আসে। আমি রুকসিকে জড়িয়ে ধরি।
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা ডিসেম্বর, ২০১৮ রাত ৯:০৩