অন্য পর্বগুলো
৩২ ঘন্টা ১৫ মিনিটের ট্রেন জার্নি ছিলো, লেট হয়ে সেটা সাড়ে ৩৫ ঘন্টায় ঠেকেছে। মাঝে ৭২টা স্টপেজ ছিলো। সনাতন ধর্মলম্বীদের কাছে দেবভূমী খ্যাত হরিদ্বার ষ্টেশনটিতে যখন নামলাম তখন জ্বরের কারণে আমার অবস্থা বেশ কাহিল। সকালের সূর্য বেশ কড়া রোদ ছড়াচ্ছে। অনেক বড় একটা স্টেশন, বেশ ঘুরে ঘুরে যখন আমি বাইরে এলাম তখন মনটা বেশ ভালো হয়ে গেল। বেশ পরিপাটি একটা জায়গা। দলবাধা তীর্থযাত্রীতে জায়গাটা গমগম করছে। অন্যান্য যাত্রীরা যখন স্টেশন থেকে বের হয়ে রিক্সা বা অটোতে করে শহরের দিকে চললো আমি আমার ভারী ব্যাগটা পিঠে ঝুলিয়ে ভালো করে শরীরের সাথে বেধে নিলাম, তারপর শহরের দিকে যাত্রা শুরু করলাম। পায়ে হেঁটে নূতন জায়গা দেখার রোমাঞ্চই অন্যরকম।
কিছুক্ষণ পর আমি যখন শহরটাতে পদার্পণ করলাম সঙ্গে সঙ্গে আমার মনে যে কথাটা ফুটে উঠলো তা হচ্ছে, “এটা তো পুরোই রুপকথার এক রাজ্য”।
অন্য সবাই কিভাবে দেখবে জানি না, কিন্তু আমি আমার নিজের মতো করে দেখেছি। প্রাগৈতিহাসিক একটা শহর, যার সভ্যতা কতো পুরানো তা কে জানে! সরু পথের শহর, সরু গলির শহর, পুরানো ভবনের শহর, পুরানো মানুষের শহর, মন্দিরের শহর, কাসা-তামা-পিতলের শহর, নিরামিষের শহর, জীভে জল আনা পথ খাবারের শহর, উপাচার সামগ্রীর শহর। তবে সবকিছুকে ছাপিয়ে যায় যে এটা সর্বোপরি গঙ্গার শহর। এখানকার গঙ্গা এক অন্যরকম গঙ্গা। অন্য কোনখানের সাথে এখানকার একেবারেই মিল নেই। সদ্য পাহাড় ছেড়ে সমতলে নেমে আসা চঞ্চলা নদীটি তার শরীরের বিস্তৃতি বাড়িয়ে গাম্ভীর্য ধারনের চেষ্টা করছে। পাহাড়ি দুরন্তপনা এখনো তাকে ছেড়ে যায়নি। তার যৌবনের উচ্ছলতাকে বেধে রাখার জন্য যথেষ্ট পরিমাণ চেষ্টা করা হয়েছে দু’তীর ঘেষে। এইরকম একটা শহরকে দেখে মুগ্ধ না হয়ে পারা যায়! ‘লাভ এট ফার্স্ট সাইট’ বলতে যা বোঝায় আমার ঠিক তাই হলো।
শহরের প্রধান পথ দিয়ে হেটে চলেছি। রাস্তার দুপাশে দোকান। দোকানে মালপত্র উপছে উঠছে। ক্রেতার সংখ্যাও কম নয়। নদী থেকে সদ্য স্নান করে আসা পূর্ণার্থীরা বিভিন্ন জিনিসপত্র দরদাম করছে। আশেপাশের মন্দিরগুলো থেকে ঘন্টা ধ্বনি ভেসে আসছে। সবচাইতে বিখ্যাত আর পূণ্যভরা ঘাট হর কি পৌরি থেকে কীর্তন শোনা যাচ্ছে। শহরজুড়ে প্রাচীন ধর্মশালা আর হোটেলের ছড়াছড়ি। সরু অলিগলি একেবেকে বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে পড়েছে। সবকিছু মিলিয়ে জমজমাট একটা শহর। আমার মনেহচ্ছে সময় পিছিয়ে আমি যেন ঠিক মধ্যযুগে এসে পড়েছি।
গাড়োয়াল এই রাজ্যে কোন কোন হোটেলের সাইনবোর্ডে বাংলা লেখাও দেখতে পাচ্ছি। সেরকম একটা হোটেলে ঢুকলাম। সরু একটা গলি তার প্রবেশপথ। একজন তরুন বসে আছে সেখানে। রুম লাগবে শুনে সে আমাকে চারতলার ছাদে নিয়ে গেল। ছাদের এককোনে পরিচ্ছন্ন একটা রুম। এটাস্ট বাথরুম। রুমের জানালা দিয়ে গঙ্গা দেখা যাচ্ছে, প্রচন্ড বাতাস। সবচাইতে বড় কথা রুমের সাথে এই এতোবড় ছাদ পুরোটাই ফ্রি। ডাবল বেডের এই রুমটার ভাড়া মাত্র ২০০ রুপি। মনটা খুশিতে ভরে উঠলো।
ফর্ম পূর্ণ করার জন্য নীচে নেমে এলাম। হোটেল মালিক তখন ডেস্কে বসে আছে। রুম খুবই পছন্দ হয়েছে শুনে হেসে সে আমার দিকে রেজিস্ট্রার খাতা এগিয়ে দিলো। সবকিছু পূরণ করছি। নাম, বয়স, ঠিকানা, সেক্স, আগমনের তারিখ, আগমনের কারন, প্রস্থানের সম্ভাব্য তারিখ। ধর্মের জায়গাটা পূরণ করলাম। মালিক জিজ্ঞাসা করলো, এটা কি লিখলে? বললাম, মুসলিম। তখন সে করলো কি আমার কাছ থেকে খাতাটা কেড়ে নিলো। তারপর আমি যে তথ্যগুলো পূরণ করেছিলাম সবগুলো খুবই হিজিবিজি করে কেটে দিলো। আমাকে বললো, এখানে কোন মুসলিমের জায়গা নেই। এক্ষুনি এখান থেকে বের হয়ে যাও। আমার মনেহলো আচমকা আমাকে কেউ যেন কষিয়ে চড় বসিয়ে দিয়েছে। দাত দিয়ে নীচের ঠোট কামড়ে নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করছি।
বের হয়ে আসলাম এই হোটেল থেকে। আচ্ছা্, আমার কি অপমানিত বোধ করা উচিত!
পাশের আরেকটা হোটেলে গেলাম। সেখানে বললাম, আমি একজন বাংলাদেশি মুসলমান হিসাবে আপনাদের হোটেলে কি থাকার জায়গা পেতে পারি? হোটেল ডেস্কে তিনজন বসে ছিলো। এরা মুখে জবাব দেবারও চেষ্টা করলো না। খুবই অবহেলার সাথে হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে যে ভঙ্গি করলো তার মানে হচ্ছে, ধুর!বিদায় হ!
রাস্তা দিয়ে হেটে চলেছি, এক দালাল এলো আমার কাছে। রুম লাগবে কিনা জিজ্ঞাসা করলো। বললাম, অবশ্যই লাগবে। সে বললো ভাড়া ৩০০ রুপি। জানালাম, আমি একজন বাংলাদেশী এবং মুসলমান। একথা শুনে সে আমাকে একটু অপেক্ষা করতে বলে কোথায় যেন ফোন করলো। তারপর তাদের ভাষায় কথা বললো, এটা বোধহয় গাড়োয়ালী ভাষা। ফোনে কথা বলা শেষে আমাকে জানালো ৭০০ রুপি পড়বে রুম ভাড়া। তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে আমি সামনে এগিয়ে চললাম।
আমার ততোক্ষণে রোখ চেপে গেছে। আমি একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছি। আমি আর তিনটা হোটেল দেখবো। সেখানেও যদি এরকম পরিস্থিতির সম্মুখীন হই তাহলে সঙ্গে সঙ্গে আমি প্রথম যে ট্রেন অথবা বাস পাবো সেটাতে চড়ে এই শহর ছেড়ে চলে যাবো। এই শহরের একফোটা পানিও মুখে দেব না। যতো দ্রুত পারি ইন্ডিয়া থেকে বের হবো। এবং জীবনে আর কখনোই ইন্ডিয়াতে আসবো না।
শহরের একেবারে প্রথমে চলে এলাম। এখান থেকেই শুরু করবো। প্রথম যে হোটেলটা চোখে পড়লো সেটাতে এগিয়ে গেলাম। একটা চ্যাংড়া ছেলে দাঁড়িয়ে ছিলো। তার সাজসজ্জ্বা বেশ কিম্ভূতকিমাকার। অন্যসময় হলে আমি নিশ্চয় হেসে ফেলতাম, কিন্তু এই মুহূর্তে আমি বিষন্ন। তাকে সেই একই কথার পুনরাবৃত্তি করলাম। আমি একজন মুসলমান, আমি একজন বাংলাদেশী। আমি কি থাকার জন্য তোমার হোটেলে জায়গা পেতে পারি? ছেলেটা হো হো করে হেসে বললো, তুমি মুসলমান এবং বাংলাদেশি তাতে সমস্যা কি?
২
উত্তরাখন্ডের অন্যান্য যে শহরগুলোতে গিয়েছি তার অধিকাংশ শহরেই আমাকে কোন পরিচয়পত্র তো দূরে থাক নামও বলতে হয়নি। তবে যে দু’য়েকটি জায়গাতে পরিচয়পত্র দেখানোর প্রয়োজন পড়েছিলো সেগুলোতে আমি আমার ভার্সিটির আইডি কার্ড শো করেছিলাম। আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম একজন হিন্দু দেবতার নামে মিলে যাওয়াতে আর কোন প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়নি।
৩
অথচ আমি ভুজবাসাতে হিন্দু আশ্রমে থেকেছি। সেখানকার সাধু নিজ হাতে পরিবেশন করে আমাকে খাইয়েছে। তপোবন নামে হিমালয়ের এক দুর্গম পাহাড়ে একজন সন্ন্যাসি তপস্যা করেন। এই মহাত্মা ১২ বছর কারো সাথে কোন কথা বলবেন না, এটা তার তপস্যার একটা অংশ। এই নির্জন অঞ্চলে তাকে ঘিরে বাসা বেধেছে কতোগুলো পাহাড়ি বন্য প্রানী। এখান থেকে সবচেয়ে কাছের অস্থায়ী শহরটাতে হেটে যেতে দু’দিন লাগে। এই মহাত্মা নিজ হাতে খিচুড়ি রেধে খাইয়েছিলেন। কেদারনাথ থেকে হেটে আসার সময় কেদারনাথ মন্দিরের এক পুরোহিতের সাথে আমার পরিচয় হয়েছিলো। প্রায় ১৯ কিলোমিটার পথ আমি আর সে একসাথে হেটে এসেছিলাম। পথে আমি তাকে ইসলামি বাংলা গজল শুনিয়েছি, সে আমাকে সূর্যশ্লোক শুনিয়েছিলো। আমার প্যাকেট থেকে বিস্কিট খেয়েছে সে, আমার বোতল থেকে পানি। গাড়িতে চড়ার সময় আমার ভাড়াটুকুও দিয়ে দিয়েছিলো সে। আমি পরে জোর করে ফেরত দিয়েছি। তারপর আমাদের পথ যেখান থেকে আলাদা হয়ে গেল সেখানে খুব যত্ন করে আমাকে গাড়িতে তুলে দিয়েছিলো সে।
৪
যমুনাত্রী নামের একটা জায়গা থেকে ফেরত আসছি। যমুনাত্রি হচ্ছে সেই জায়গা যেখানকার পাহাড়ের কতোগুলো ঝরনা থেকেই বিখ্যাত যমুনা নদী উৎপত্তি হয়েছে। এখানে হেটে যেতে হয়। সবচেয়ে কাছের জনপদটির নাম হচ্ছে জানকিচাট্টি। এই জানকিচাট্টি থেকেই জীপে উঠেছি বারকোট নামে একটা জায়গাতে যাবার জন্য। পাহাড়ী বিপদসংকুল পথ, বেশ কয়েক ঘন্টার জার্নি। জীপের পিছনের লম্বালম্বি সীটে উঠেছি। আমার মুখোমুখি বসেছে দক্ষিন ভারতের এক আশ্রম থেকে তীর্থে আসা একজন পৌড় সাধু। তার সঙ্গী বেশ কয়েকজন শিষ্য। সবার পরনেই সাদা পোষাক। ফতুয়া আর লুঙ্গি টাইপের পোষাক। লুঙ্গি ঠিক না, ধুতি পেচিয়ে পেচিয়ে লুঙ্গির মতো পরা। শ্মশ্রুমন্ডিত সৌম্য চেহারা সাধুর। আমি বাংলাদেশ থেকে এসেছি শুনে কৌতূহলী হয়ে আমার সাথে কথা বলা শুরু করলেন।
তার দেশ কেমন লাগছে জানতে চাইলেন। ভারত সম্পর্কে আমার বিভিন্ন অভিজ্ঞতাও শুনছেন গভীর মনোযোগ দিয়ে। তার নিজের দক্ষিণ ভারত নিয়েও কথা বলছেন। গল্প করতে করতে আমি আমার হরিদ্বারের ঘটনাগুলোর কথা বললাম। জানালাম যে মুসলমান এবং বাংলাদেশী হবার কারণে আমাকে কিরকম হেনস্থার শিকার হতে হয়েছিলো। এটা আমার জন্য তিক্তকর অভিজ্ঞতা। আমার কথা শুনে এই পৌড় সাধু যা করলেন এরকম কিছুর জন্য আমি একেবারেই প্রস্তুত ছিলাম না। তিনি হাত জোড় করে কপাল স্পর্শ করলেন, তারপর মাথা নিচু করে আমার হাঁটুতে ঠেকিয়ে বললেন, “ক্ষমা করো, ক্ষমা করো, ক্ষমা করো।পুরো ভারতবাসীর পক্ষ থেকে আমি তোমার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছি। যারা তোমার সাথে এমন ব্যাবহার করেছে তারা পাপ করেছে। তারা একেবারেই ধার্মিক নয়। ধর্ম মানুষকে বড় হতে শেখায়। তারা বড় হতে পারেনি, এটা তাদের ব্যর্থতা। এটা আমাদের ব্যর্থতা......।’’
সাধু আরো অনেক কথা বলেছিলেন। আমি সত্যিই সেইসব হোটেলওয়ালাকে মন থেকে ক্ষমা করে দিয়েছি।
৫
হরিদ্বার শহরের কতোগুলো ছবি.....
হরিদ্বার রেল স্টেশনের অভ্যান্তর
হরিদ্বার রেল স্টেশন
স্টেশন থেকে বের হলে শহরে যাবার জন্য এরকম টাঙ্গা চোখে পড়বে
ধর্শামলাগুলো এমন পুরানো
গলির শহর
কাসা-তামা-পিতল
অলি-গলির বাজার
গলির বাজার ও ক্রেতার ভীড়
নিরামিষ শহর, এজন্য মিষ্টির আধিক্য বেশি
কাসা-তামা-পিতল
কাসা-তামা-পিতল
শহর থেকে মনসা মন্দিরে যাবার কেবল কার
শহরের পবিত্র প্রানী। এগুলো যথেচ্ছ যেতে পারে।
অলঙ্কারের শহর
অলিগলিতে অলংকারের দোকান। এগুলো কিন্তু স্বর্ণ নয়।
বিভিন্ন সামগ্রীর দোকান। পুরো শহর জুড়েই এরকম দোকানের ছড়াছড়ি।
পূজার উপাচার সামগ্রী
গঙ্গা নদী
হর কি পৌরি ঘাট
হরি কি পৌরি ঘাটে স্নানরত পূর্ণার্থী
পুরুষদের স্নানদৃশ্য। সঙ্গত কারণেই নারীদের স্নানদৃশ্যের ছবি দেয়া হলো না।
গঙ্গাস্নান ও পূজাঅর্চনা
বাহারি সুস্বাদু মিষ্টি
পথ খাবার
কাসা-তামা-পিতল
ঘর সাজানোর সামগ্রী
পুরাতন শহরটির পথ
দরদামরত ক্রেতা
৬। আমি আরো একবার হরিদ্বার শহরে গিয়েছিলাম। আমি আবারো এই শহরটাতে যাবার জন্য অপেক্ষা করে আছি। এতো জমজমাট এবং গমগমে শহর আমি আর কোথাও দেখিনি।
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা অক্টোবর, ২০১৭ বিকাল ৩:১৭