অন্য পর্বগুলো
আমার মা আমার দেখা সবচাইতে extrovert মানুষ। বেশিরভাগ সময়ই সে এমন এমন কাজ করে থাকে যা আমি কখনোই করার সাহস সঞ্চায় করে উঠতে পারবো না। সবসময়ই অবাক হয়ে ভাবি, ইশ! আমি যদি এই মানুষটার মতো সাহসী হতে পারতাম!
১।
হুট করেই ডিসিশনটা নেয়া হলো। যশোরে ছিলাম, সন্ধ্যার সময় মাকে বললাম, মা চলো কলকাতা থেকে ঘুরে আসি। সঙগে সঙগে মা চিতকার করে বললো, আমার কি মাথা খারাপ হয়েছে যে তোর সাথে বেড়াতে যাবো!!! তোর সাথে গেলে তুই আমাকে হাটায়ে হাটায়ে মেরে ফেলবি! আমার যখন “এটাওটা” যা খাইতে ইচ্ছা করবে তুই তা খাইতে দিবি না! “টুকটাক'” কিছু কিনতে চাইলে তুই চিল্লা-পাল্লা করবি! আমি তোর সাথে যাবো না।
অনেক সাধ্য-সাধনার পর তিনি রাজী হলেন। ফলাফল স্বরুপ পরদিন ভোরবেলা আমরা বেনাপোল বর্ডারে। ইন্ডিয়ান ভিসা প্রাপ্তি এখন বোধহয় বেশ সহজ হয়েছে, কারণ এই ভোর সাড়ে ছটাতেও বিরাট লম্বা লাইন। বাংলাদেশ অংশের কাজ খুব দ্রুতই শেষ হলো। একটা ভালো ব্যাপার হচ্ছে যে বাংলাদেশ অংশে এবার সেরকমভাবে দালালের কোন উতপাত দেখিনি। কাস্টমস এবং ইমিগ্রেশন কর্মকর্তারাও বেশ হেল্পফুল। নো-ম্যান্স ল্যান্ড পা রাখলাম আমি ষষ্ঠবারের মতো, আর মা প্রথমবার।
প্রথমবার বিদেশ ভ্রমনের যে উত্তেজনা থাকে তার ছিটেফোঁটাও মায়ের ভিতরে নেই। তবে তিনি তার স্বভাবমতই অস্থির। আমি বিরাট লম্বা লাইনের শেষে দাঁড়িয়ে আছি আর মা না বাংলাদেশ না ভারত এই জায়গাটাতে ঘুরঘুর করছেন। বর্ডার এলাকা সবসময় আমারে স্নায়ুর উপর প্রচন্ড চাপ তৈরী করে। আমার অতীত অভিজ্ঞতা ভালো না। একবার আমাকে দেড় ঘন্টা আটকে রেখেছিলো। তারপর থেকেই আমার “বর্ডার ফোবিয়া” হয়েছে। অথচ মা নির্বিকার ভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। নো-ম্যান্স ল্যান্ডের ভিক্ষুকগুলোকে ভিক্ষা দিচ্ছেন, তারা কোন দেশের অধিবাসী সেসব খোজখবর নিচ্ছেন। এই অ-মালিকানার জায়গায় ঘুরঘুর করা একগাদা কুকুর আর ছাগল কিভাবে কোথা থেকে এলো সেগুলো জানার ব্যাপারে তার অপরিসীম কৌতূহল। আমি হতাশ চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছি।
আমার মায়ের শরীরে ইনফেকশন আছে। বেশ ঘনঘন তার ওয়াশরুমে যাবার প্রয়োজন পড়ে। তিনি প্রথমে দায়িত্বরত মহিলা বিজিবি সদস্যের কাছে গেলেন যে ওয়াশরুমে কোথায় জানার জন্য। কিন্তু বিজিবি সদস্যা তার অপরাগতা প্রকাশ করলেন। তখন মা বিএসএফ সদস্যের কাছে গেলেন। বিএসএফ এর ভদ্রলোক খুবই হেল্পফুল। তিনি সঙ্গে সঙ্গে মাকে একজন বেসামরিক কর্মকর্তার কাছে নিয়ে গেলেন। সেই কর্মকর্তা তখন মাকে পাসপোর্ট সহ ইন্ডিয়াতে প্রবেশ করিয়ে দিলেন। মার কাছে তখন কোন মোবাইল নেই এবং আমার কাছে যে মোবাইল আছে তার সিম কোন নেটওয়ার্ক পাচ্ছে না। নো-ম্যান্স ল্যান্ডে আমি লাইনে দাঁড়িয়ে আছি আর মা ইন্ডিয়াতে ঢুকে পড়ছেন। দূর থেকে হাত নেড়ে ইশারায় আমাকে জানালেন যে তিনি কিছুক্ষণের মধ্যেই আসছেন। আমরা দুজনে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলাম।
সাপের মতো একেবেকে লম্বা লাইন ধীরে ধীরে এগোচ্ছে। আমি দুশ্চিন্তায় অস্থির হয়ে গেছি। আধাঘন্টা হয়ে গেছে, অথচ মায়ের দেখা নেই। সেতো কিছুই চিনে না। কোথায় কি করতে হবে তা একেবারেই জানে না। তার যা স্বভাব নিশ্চয় কোন প্যাচালে পড়েছে, এজন্য আর আসতে পারছে না। আইরে আল্লাহ!! বিদেশ বিভুয়ে কোন দুর্ঘটনা ঘটলে কিভাবে সামাল দেব! সমান তালে আয়াতুল কুরসি পড়ছি। নিজের উপরেই রাগ হচ্ছে, কেন যে মাকে আনলাম! আর যদিও আনলাম তাহলেও কেন নিজের কাছছাড়া করলাম! মনেহলো গলা ছেড়ে কাঁদি। যখন দুশ্চিন্তার একেবারে শেষ সীমায় পৌছে গেছি আর দরদর করে ঘামছি তখন দেখি মা হেলতে-দুলতে ফিরে আসছেন, তার মুখ হাসিহাসি। মাকে দেখে এতো স্বস্তি আমি জীবনেও পাইনি।
দেরী হবার কারণ হিসাবে মা আমাকে যে কৈফিয়ত দিলেন তাতে আমার আক্কেল গুড়ুম। অফিসের ভিতরে ইন্ডিয়ান কাস্টমস কিভাবে ব্যাগ চেক করছে আর দালালরা ১০০ টাকার বিনিময়ে কিভাবে যাত্রীদের লাইনে না দাড় করিয়ে কাস্টমস পার করে দিচ্ছে এতোক্ষন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সেইসব মজার দৃশ্য দেখছিলেন। বোঝো অবস্থা!! আমি এদিকে দুশ্চিন্তায় মরি আর মা এইসব “মজার” দৃশ্য দেখে বেড়াচ্ছেন। এই মানুষটার সাথে আমার একয়দিন ঘুরতে হবে!! আমার বুক ফেটে আবারো কান্না আসছে।
সত্যিই ব্যাপারটা অপমানজ্বনক। দালালকে টাকা দিয়ে লাইনে না দাঁড়িয়ে কাস্টমস পার হওয়া। এবং এভাবে পার হচ্ছে শুধুমাত্র বাংলাদেশীরা। কোন ইন্ডিয়ান যাত্রীকে এভাবে পার হতে দেখিনি। তারা সুশৃঙ্খলভাবে লাইনে দাঁড়িয়ে ধীরে ধীরে পার হচ্ছে। অসুস্থদের জন্য বিশেষ ব্যাবস্থা আছে, তাদের লাইনে দাড়ানো লাগে না। কিন্তু যেসব মানুষেরা দালালকে টাকা দিয়ে লাইনে না দাঁড়িয়ে দ্রুত যারা পার হচ্ছে তারা সবাই বাংলাদেশী। সব বাংলাদেশী কিন্তু এভাবে পার হচ্ছে না। ইয়াং বাংলাদেশী ছেলেগুলো যারা তারুণ্যে ভরপুর, যাদের শরীরে খুবই সুন্দর দামী ফ্যাশনেবল টিশার্ট-জিন্স, পিঠে দামী ব্যাগ-প্যাক, পায়ে ঝকঝকে জুতো তারাই মূলত দালালদের কাস্টমার। এইসব প্রাণ-প্রাচুর্যে ভরপুর তরুন বাংলাদেশি ছেলেরা লাইনে না দাঁড়িয়ে আইন ভাঙ্গার ক্ষেত্রে বিশেষ পারঙ্গম। আচ্ছা, দিনদিন কি আমরা আরো অধঃপতনে যাচ্ছি! ভারতীয় যাত্রীরা এই ছেলেগুলোকে দেখিয়ে নিজেদের মধ্যে ব্যাঙ্গ বিদ্রুপ করছে। নিজেকে প্রচন্ডভাবে অপমানিত লাগছে।
২।
ইন্ডিয়ান লোকাল ট্রেনগুলোতে প্রচন্ড পরিমানে ভীড় থাকে। বনগা থেকে আমরা লোকাল ট্রেনে উঠেছি। ট্রেন ছাড়ার কিছুক্ষন পর ভীড়ের চোটে অবস্থা খারাপ হয়ে গেল। প্রচন্ড চাপাচাপিতে একেবারে ভয়ঙ্কর অবস্থা। গায়ের উপরে লোক উঠে গেছে। এ পর্যন্ত হলেও মানা যেত। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে এইসব ট্রেনের ধামসা ধামসা পুরুষগুলো গ্যাক গ্যাক করে চিল্লায়ে চিল্লায়ে গল্প করে। এমন জোরে গল্প করে যেন তারা এক বগি থেকে অন্য বগির লোককে তাদের গল্প জানাতে চায়। এদের সেন্স অব হিউমার বোধহয় কিছুটা নিন্মমানের। খুব সাধারণ ছোটখাটো ব্যাপারগুলো নিয়ে এরা ভ্যাকভ্যাক করে আসে এবং মজার ব্যাপার হচ্ছে একই ব্যাপার তারা চার থেকে পাচবার রিপিট করে আর প্রতিবারই ভ্যাকভ্যাক করে হাসে। মহিলা যাত্রীরা কিন্তু এমন করে না। তারা খুবই শান্তশিষ্ঠ।
এদের এই চিতকার চেচামেচিতে মাথা ধরে যায়। বাপরে! তোরা গল্প করবি আস্তে আস্তে কর। তা না। একটা সময় মনেহলো মা বোধহয় এখনই কারো সাথে মারামারি বাধিয়ে বসবে। তার ভাবভঙ্গি বেশি সুবিধার ঠেকছে না। চোখ বড় বড় করে মার দিকে তাকিয়ে আছি। আমার চাহনিতে হুমকি স্পষ্ট। ট্রেনে ওঠার আগে বারবার তাকে বলে দিয়েছি সে যেন এই দেড়টা ঘন্টা একটু ধৈর্য সহকারে বসে থাকে। কিন্তু মনেহচ্ছে সে আমার কথা মানবে না। যেকোন সময় কেলেঙ্কারি অবস্থা শুরু হয়ে যাবে। মনেমনে আয়াতুল কুরসি পড়ছি।
মার ভাবভঙ্গি দেখে সবচাইতে চিল্লিয়ে গল্প করা যাত্রীটি নিজেকে কিছুটা সামলে নিলেন। তিনি কিছুটা কৈফিয়তের সুরে মাকে বোঝালেন যে দেখুন সারাদিনের প্রচন্ড কর্মব্যাস্ততায় ট্রেন যাত্রার এই গল্প করাটুকুই আমাদের একমাত্র বিনোদন। মা বোধহয় ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছেন। তিনিও নিজেকে কিছুটা সামলে নিলেন। আমি বিরাট হাফ ছেড়ে বাচলাম।
৩।
আমি আর মা উদ্দেশ্যহীন ভাবে কলকাতা ঘুরে বেড়িয়েছি। নিজেদের মতো করে। আমরা চড়েছি লোকাল ট্রেনে, মেট্রোতে, লোকাল বাসে, ট্রামে, শেয়ার অটোতে, হাতে টানা রিক্সায়। তবে সবচেয়ে বেশি ঘুরেছি হেঁটে। মে মাসের প্রচন্ড গরমে আমরা মাতা-পুত্র দুজনে কলকাতার পথে পথে হেঁটে বেড়িয়েছি। পুরানো কলকাতার ট্রাম রাস্তা, সরু অলিগলি, পুরানো অন্ধকারাচ্ছন বাড়িগুলো, ছোট ছোট মন্দির, পুরানো মসজিদ, কাঁচাবাজার, ফুলের বাজার, গঙ্গার ধার থেকে শুরু করে সাহেব পাড়া পর্যন্ত। এতো আনন্দ আগে কোন কিছুতেই পাইনি। ময়দানের পাশের ট্রাম রাস্তা ধরে আমরা হেঁটে চলেছি। একপাশে খোলা মাঠ আর অন্যপাশে বেশ চওড়া রাস্তা মাঝখানে পুষ্পরাজি শোভিত বৃহৎ বৃক্ষের সারি। এর মাঝখান দিয়ে বয়ে চলেছে দুসারি ট্রাম রাস্তা। এত্তো ভালো লাগে জায়গাটা। অনেকক্ষন দাড়িয়েও কোন ট্রামের দেখা পেলাম না। এক ঝালমুড়িওয়ালা বললো যে এই রুটে এখন আর ট্রাম চলে না। কি যে আফসোস লাগলো! আহারে! অনেক কিছুই দিনদিন বদলে যাচ্ছে।
কোথাও কোন যানযট নেই। রাস্তাগুলো ঝকঝকে তকতকে। ফুটপাত দিয়ে আরাম করে হেঁটে যাওয়া যাচ্ছে। মানুষ যেখানে সেখানে প্রস্রাব করছে না। কোন এলাকার রাস্তা খোড়াখুড়ি হচ্ছে না। আইন শৃঙ্খলা মেনে চলার প্রবণতা অনেক বেশি। বিশেষ করে সবাই ট্রাফিক আইন মেনে চলছে। এতো হাটাহাটি করছি অথচ সেভাবে ক্লান্তি অনুভব করছি না, তারমানে এখানকার আবহাওয়া অতোটা দূষিত না। আসলে আমি একদিনের পর্যটক, খারাপ কোন কিছু সেভাবে চোখে পড়েনি। তবে যারা দীর্ঘদিন ধরে এই শহরটাতে থাকেন তারা নিশ্চয় অনেক ভালো-মন্দ বলতে পারবেন।
প্রথম মেট্রোতে ওঠার সময় মা ঠিক বুঝে উঠতে পারেননি। পরে তিনি আমাকে বলেছিলেন ট্রেনটা আসার আগে প্ল্যাটফর্মে একগাদা মানুষ দাঁড়িয়ে ছিলো। ট্রেনটা এসে থামলে তিনি দেখেন যে প্ল্যাটফর্মে একটা মানুষও দাঁড়িয়ে নেই এবং ফাকা ট্রেনটা একেবারে ভরে গেছে, একটা সীটও খালি নেই। এতোগুলো মানুষ কখন কিভাবে হুড়মুড় করে মেট্রোতে উঠে পড়লো আর বসার জায়গা দখল করলো সেটা তিনি নাকি প্রথমে বুঝতেই পারেননি।
কিন্তু ওই একবারই। কারণ এরপর থেকে যতোবারই আমরা মেট্রোতে চড়তে গিয়েছি ততোবারই দেখেছি মা দৌড়ে আগে উঠে বসার জায়গা দখল করতে পেরেছে আর পাশের যাত্রীর সাথে গল্প শুরু করে দিয়েছে। একবারও আমি মেট্রোতে বসার সিট পাইনি, কিন্তু প্রতিবারই মা বসার জায়গা দখল করতে পেরেছে আর আমার দিকে বিজয়ী প্রতিযোগীর হাসি দিয়েছে।
সাইন্স সিটিতে গিয়েছি এতো সকালে যে তখনো সেটা খোলেনি। মূল চত্বরের বাগানে বসে আছি। কি সুন্দর ফলজ গাছ। হঠাত দেখি মা গাছ থেকে জামরুল পারা শুরু করে দিয়েছে। যতোসব উদ্ভট কাজকর্ম। এখানকার লোকেরা দেখলে কি বলবে তা কে জানে! কপালে যে কি খারাবী আছে! কিছুক্ষন পর দেখি সাইন্স সিটির কর্মচারীরা ছুটে আসছে। এবারে মান-সম্মান সব গেল। ওমা! এই লোকগুলো দেখি কাছে এসে মার সাথে জামরুল পারায় যোগদান করলো। এই বিস্বাদ ফল মানুষ এতো আগ্রহ সহকারে খায় কিভাবে তা আল্লাহই জানে!
সাইন্স সিটির দরজা খোলার সাথে সাথে আমরা দৌড়ে গিয়ে ঢুকে পড়েছি। এখানে সুন্দর একটা জায়গা আছে, নাম সাইন্স পার্ক। সাইন্স পার্কে নানারকম খেলার সরঞ্জাম আছে। খুবই মজাদার একটা জায়গা। আমরা দুজনেই দৌড়ে গিয়ে ওখানকার দোলনায় চড়েছি। আর সাথে সাথেই ধপাস!! হি হি। দুজনেই হেসে গড়াগড়ি, কারোরই ব্যাথা লাগেনি। আমাদের দোলনা থেকে পড়ে যাওয়া কেউ দেখলো কি দেখলো না এসব ছোট-খাটো ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামিয়ে আমরা কখনোই আমাদের মজা নষ্ট করি না।
মিরর হাউজের মধ্যে একটা গোলক ধাধা আছে। এই জিনিসটা মাকে বাচ্চাদের মতো খুশি করে তুলেছিলো। কতোবার যে সে এই গোলকধাঁধার মধ্যে দিয়ে যাওয়া-আসা করেছে আর আনন্দে হো হো করে হেসে উঠেছে। শুধু তাই না। এইদিনে একটা খ্রীষ্টান মিশনারি থেকে কতোগুলো অনাথ প্রতিবন্দী বাচ্চাকে সাইন্স সিটি পরিদর্শনে আনা হয়েছিলো। এইসব বাচ্চাগুলোর বেশিরভাগই হয়তো চোখে দেখে না অথবা একা চলাফেরা করতে অক্ষম কিংবা বুদ্ধি প্রতিবন্দী। মা অনেকগুলো বাচ্চাকে হাত ধরে এই মিরর হাউজ ঘুরিয়ে দেখিয়েছে। মায়ের সাথে বাচ্চাগুলোও সে কি খুশি। যেসব বাচ্চারা চোখে দেখতে পায়না তারা হাত দিয়ে দিয়ে সবকিছু অনুভব করছে। বেশিরভাগ সময় তারা মার কাছে অনেককিছুর বিবরণ জিজ্ঞাসা করছে ইংরেজি অথবা হিন্দিতে। মা নিজের মতো করে বাংলায় এগুলোর বর্ণনা দিচ্ছে, বাচ্চাগুলো তা শুনে হেসে কুটিকুটি। সত্যি কথা বলতে কি নির্মল পবিত্র ভালোলাগার মুহূর্তগুলোতে ভাষা কোন বাঁধা হয়ে দাড়াতে পারে না।
মায়ের মধ্যে ন্যাকামি ব্যাপারটা একেবারেই নেই। 'পারবো না' এই কথাটি আমি তার মুখ থেকে কখনোই শুনিনি। আমরা পুরোটা ট্যুরে একবারও ট্যাক্সিতে উঠিনি। লোকাল বাস, ট্রেন, ট্রাম অথবা মেট্রোতে চড়েছি। বাংলাদেশ থেকে যারা কলকাতা বেড়াতে যায় তাদের অধিকাংশই ট্যাক্সি ছাড়া চলতেই পারে না। অথচ মা খুব সাবলীল ভাবেই দৌড়ে লোকাল বাস অথবা ট্রামে চড়েছে। মাঝ রাস্তায় বাস থামিয়ে কন্ট্রাকটারের কাছে শুনেছে যে এই বাসটা আমাদের গন্তব্যপথে যাবে কিনা।
একবার একটা রিক্সা দেখে মায়ের খুবই পছন্দ হলো। কেমন যেন পালকি ধরনের রিক্সা। সাথে সাথে রিক্সা থামিয়ে তাতে উঠে বসে মা আমাকে বললো তাড়াতাড়ি সুন্দর করে একটা ছবি তুলে দে। দুহাতে ব্যাগ, কিভাবে ছবি তুলি!
জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়িতে গিয়েছি। প্রধান ফটকে দাঁড়িয়ে মা কিছুটা আবেগ-আপ্লুত হয়ে গেলেন। সর্বশ্রেষ্ঠ বাংলা সাহিত্যিকের বাড়িতে আমরা দাঁড়িয়ে আছি এই ব্যাপারটা তাকে প্রচন্ড পরিমানে রোমাঞ্চিত করেছে। তখন তাকে দেখিয়ে দিলাম যে এই এলাকার কেউই বাংলায় কথা বলছে না, এমনকি এই বাড়ির গেটের সামনে যে কতোগুলো পিচ্চি ক্রিকেট খেলছে তারাও হিন্দিতে উল্লাস করছে। হা কপাল!! দুনিয়ার সবচাইতে শ্রেষ্ঠ বাংলা সাহিত্যিক মানুষটার পাড়ার লোকেরাই বাংলা পারে না!
বরাবরের মতো এবারো আমার ভাগ্য খারাপ। আমি বোধহয় এই নিয়ে চতুর্থবারের মতো রবীন্দ্রনাথের বাড়িতে এলাম। কিন্তু কখনোই আমি এই বাড়ির অন্দরমহলে ঢুকতে পারিনি। ২৫ শে বৈশাখ উপলক্ষ্যে বাড়ির সংস্কার চলতেছে। এজন্য ভিতরে যাওয়া নিষেধ। শুধু রবীন্দ্রনাথের গাড়ির গ্যারেজ পর্যন্ত যেতে পারলাম। মা দেখি ততোক্ষণে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের এক কর্মকর্তার সাথে বসে বকবক শুরু করে দিয়েছেন। এবং সেই বকবকটা মোটামুটি তর্ক। আমরা সুদূর বাংলাদেশ থেকে এসেও কেন রবীন্দ্রনাথের বাড়ির ভেতরে যেতে পারবো না! কর্মকর্তা মার সাথে তর্কে মোটামুটি হেরেই গিয়েছিলেন। কারণ শুধুমাত্র আমরা মাতা-পুত্র দুজনে ঠাকুর দালান পর্যন্ত যাবার অনুমতি পেয়েছিলাম।
সন্ধ্যার পর আমরা হাওড়া ব্রীজে দাঁড়িয়ে থেকেছি। প্রচন্ড বাতাস, নীচে বিপুলা নদী, দূরে আলোয় রঙ্গীন বিদ্যাসাগর সেতু, আর পাশ দিয়ে ছুটে চলা ব্যাস্ত মানুষের স্রোত। অসাধারণ অনুভূতি। সময়গুলো কোথা দিয়ে যে উড়ে যাচ্ছিলো আমরা একেবারেই টের পাইনি।
তবে মাকে সবচেয়ে বেশি মুগ্ধ করেছিলো হাওড়া স্টেশন। ছুটে চলা প্রতিটি মানুষকে ঘিরেই যেন গল্প আছে। আমি আর মা মুগ্ধ চোখে এই গল্পগুলো দেখছিলাম। এতো এতো মানুষ তবুও সবকিছু যেন সুশৃঙ্খল। সবাই ধারাবাহিকভাবে যাচ্ছে। প্রতি মিনিটেই কয়েকটা করে ট্রেন আসছে আর যাচ্ছে। লোকাল ট্রেনগুলোতে প্রচন্ড ভীড়। এই লোকাল ট্রেনগুলোই কলকাতাকে বাচিয়ে রেখেছে তার উপর চাপ সৃষ্টি না করে। প্রতিদিন ৩০ লক্ষেরও বেশি মানুষ লোকাল ট্রেনে করে কলকাতা যাতায়াত করে। এই পরিমান মানুষ যদি প্রতিদিন যাওয়া-আসা না করে কলকাতা শহরেই বসবাস করতো তাহলে শহরটার উপর কি বিপুল পরিমানে চাপ পড়তো! বিভিন্ন রকমের লোকাল ট্রেন আছে কলকাতায়। সুপার লোকাল, গ্যালোপিং লোকাল, সাধারণ লোকাল, সার্কুলার রেল, মাতৃভূমি স্পেশাল ইত্যাদি। ভাড়াও খুব কম। ২০০ কিমি পর্যন্ত ভাড়া ৪৫ রুপি।
আমি আর মা বিশাল এই হাওড়া স্টেশন ঘুরে ঘুরে দেখেছি। পুরো ২৩ টা প্ল্যাটফর্ম। কালকা মেল দাঁড়িয়ে আছে ৯ নম্বর প্ল্যাটফর্মে, এটাতে উঠলাম কিছুক্ষণের জন্য। আমার খুব প্রিয় একটা ট্রেন। ১৫১ বছর ধরে ট্রেনটা চলছে। এই উপমহাদেশের প্রথম আন্তনগর ট্রেন এটি। ট্রেনটাতে উঠে মনে হচ্ছিলো যে আর না নেমে এটাতে করেই সিমলায় চলে যাই। মাও একই মনোভাব ব্যাক্ত করলো।
হাওড়া স্টেশনের একপাশে বিরাট কর্মযজ্ঞ হচ্ছে। মেট্রো ট্রেনের লাইন পরিবর্ধিত হচ্ছে। নগর পরিবহন ব্যাবস্থার অংশ হিসাবে কলকাতার মূল শহর থেকে এই হাওড়া স্টেশন পর্যন্ত মেট্রো রেলের সম্প্রসারণের কাজ চলছে। লাইনটা যাবে গঙ্গা নদীর নীচ দিয়ে। অর্থাৎ কলকাতা থেকে মেট্রো ট্রেনে চেপে গঙ্গা নদীর নীচ দিয়ে টানেলের মধ্যে দিয়ে হাওড়া স্টেশনে আসা যাবে। বুকে কেমন চিনচিন ব্যাথা অনুভব হলো। ঢাকাতেও মেট্রো রেলের কাজ শুরু হয়েছে। কিন্তু সেই কনস্ট্রাকসনের কাজ কি যথেষ্ট মনোযোগ সহকারে হবে! আরেকটা মালিবাগ-মৌচাক ফ্লাইওভারের মতো মানুষের দুর্ভোগ সৃষ্টিকারী কিছু হবে নাতো!
সারাদিন ঘোরাফিরা করে বেশ রাতেই হোটেলে ফিরে এলাম। আর তখনই মনেপড়লো যে আমরা কোন সিম কিনিনি এবং বাবাকে ফোনে জানানো হয়নি যে আমরা ঠিকঠাক আছি।কাছাকাছি কোন আইএসডি দোকান নেই যে সেখান থেকে ফোন করা যাবে। হোটেলের আশেপাশের অনেকগুলো মোবাইলের দোকান ঘুরলাম, কিন্তু সেরকম কোন সুবিধা করতে পারলাম না। শেষমেষ আবার হোটেলেই ফিরে এলাম।
হোটেলে ফেরত আসার পর মা একটা রুমের দরজা ধাক্কা দিলেন। রুম থেকে একজোড়া বয়স্ক দম্পতি বের হয়ে আসলে মা তাদেরকে জিজ্ঞাসা করলো যে তারা বাংলাদেশ থেকে এসেছে কিনা। তারা হ্যা বলায় মা বললো যে আমাদের একটু বাংলাদেশে ফোন করা দরকার। তাদের ফোনটা আমরা ব্যাবহার করতে পারি কিনা। তারা সানন্দেই তাদের ফোনটা এগিয়ে দিলেন।
আমি অবাক হয়ে ভাবছি কোন অপরিচিত লোকের কাছ থেকে এভাবে ফোন নিয়ে কোথাও কল করার সাহস আমার কি জীবনেও হতো!!
৪।
রাত প্রায় সাড়ে এগারোটা বাজে এসময় আমরা ট্রেন থেকে নেমেছি। স্টেশন থেকে আমাদের হোটেলে বাসে যেতে ছয় মিনিট মতো লাগে। কিন্তু এতো রাতে আর কোন বাস নেই। শুধু বাস কেন আর কোন বাহনই নেই হোটেলে যাবার মতো। বেশখানিকক্ষণ যাবত দাঁড়িয়ে আছি। অনেকক্ষণ পর রাস্তা দিয়ে একটা প্রাইভেট কার যাচ্ছিলো। মা হাত তুলতেই সঙ্গে সঙ্গে গাড়িটা থেমে গেল। মা ড্রাইভারকে আমাদের হোটেল পর্যন্ত পৌছে দেবার অনুরোধ জানিয়ে বললো যে এজন্য কতো দিতে হবে। ড্রাইভার তখন মিষ্টি হেসে জানালো যে সে আমাদেরকে অবশ্যই নামিয়ে দেবে আর এজন্য তাকে কোন টাকা দিতে হবে না। আমরা তখন তার গাড়িতে উঠে পড়লাম। ড্রাইভার তখন করলো কি, আরো তিনজন মানুষ দাঁড়িয়ে ছিলো তাদেরকে ডাকলো। তারপর সেই তিনজনেক বললো যে চলুন আপনাদেরকেও পৌছে দিয়ে আসি। মজার ব্যাপার হচ্ছে বাকী তিনজন মানুষও বাংলাদেশী। আমরা একই এলাকার হোটেলে উঠেছি।
ড্রাইভার ভদ্রলোক যেটা করলেন সেটা হচ্ছে কোন সুস্থ এবং নিরাপদ শহরের একটি খুব বড় বৈশিষ্ঠ্য। তিনি কতোগুলো বিপদগ্রস্থ মানুষকে সহায়তা করেছেন। তিনি আমাদের হোটেল পর্যন্ত লিফট দিলেন এবং আমাদেরকে নামিয়ে দিয়ে খুব সুন্দর করে হেসে বিদায় সম্ভাষণ জানালেন। তার প্রতি কৃতজ্ঞতা।
আচ্ছা, ঢাকা শহরে কি কখনো এরকম সাহায্য পাওয়া সম্ভব?
হুম, সম্ভব। কারণ আমি একবার পেয়েছি।
৫।
যে হোটেলটাতে উঠেছিলাম তাতে ছোট্ট একচিলতে ছাদ আছে। রাত ১২ টার পরে আমি আর মা সেখানে দাঁড়িয়ে থাকতাম। ছাদ থেকে উকি মেরে দেখতাম নীচে রাস্তায় একজন মহিলা তার বাড়ির সামনে দেয়া দোকানে কাজ করে চলেছে। সে যেভাবে পরিশ্রম করে আমি আর মা মুগ্ধ হয়ে তাই দেখতাম। হোটেলের একপাশে হাইওয়ে , হুশহাশ করে গাড়ি ছুটে চলেছে। একটা বিরাট বিলবোর্ডের ঝকঝকে আলো চারপাশ রঙ্গিন করে তুলেছে। মা আর আমি বিভিন্ন বিষয় নিয়ে গল্প করতাম। মা দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়াতেন। অদ্ভুত এই আলোতে মাকে আরো সুন্দর দেখাতো। সবকিছু কেমন যেন স্বপ্নাচ্ছন্ন মনে হতো। এই স্মৃতিটুকুই সঞ্চিত ভালোবাসা।
৬।
তিন দিনের ট্যুর শেষে আমার মা প্রচন্ড পরিমানে সাম্প্রদায়িক একটা কথা বলেছেন। কথাটা সাম্প্রাদায়িক হলেও প্রচন্ড পরিমানে সত্য। মা আমাকে বলেছিলেন, “যে কাজটা মুসলমানদেরর শহর ঢাকার করা উচিত অথচ সেখানে নেই কিন্তু সেটা হিন্দুদের শহর কলকাতায় আছে”। খাবার পানি নিয়ে মা একথা বলেছিলেন। কলকাতার পথে পথে কিছুদূর পরপরই খাবার জন্য বিশুদ্ধ পানির ব্যাবস্থা আছে। ঠান্ডা পানি আর নর্মাল পানি দুটোই। মে মাসের প্রচন্ড গরমে আমরা কলকাতার রাস্তায় রাস্তায় হেঁটে বেড়িয়েছি, প্রচন্ড তৃষ্ণার্ত হয়ে পড়ছিলাম। অথচ খাবার পানির জন্য আমাদের একেবারেই হা-হুতাশ করতে হয়নি।
শুধু খাবার পানিই না। কলকাতায় কিছুদূর পরপরই পাবলিক টয়লেট। আগেই বলেছি যে আমার মায়ের শরীরে ইনফেকশন আছে, কিছুক্ষণ পরপরই তাকে ওয়াশরুমে যেতে হয়। একজন নারী নির্ভয়ে পাবলিক টয়লেটে যেতে পারছে এটা সেই শহরের নিরাপত্তা এবং সমৃদ্ধির বড় একটা লক্ষণ। ঢাকা শহর এইরকম কোন বৈশিষ্ঠ্য থেকে যোজন যোজন পিছিয়ে আছে। আহারে!! প্রিয় ঢাকা শহর!!
৭।
এখনো পর্যন্ত আমার জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ ট্যুর ছিলো এটি।(যদিও একবার পুলিশের হাতে ধরা খেয়েছিলাম এবং মা আমাকে ছাড়িয়ে এনেছিলো )। মা এই প্রথমবার ভারতে গেল, অথচ ভারতের অনেক বিষয় আমি তার কাছ থেকেই শিখলাম। আমার দেখা সর্বশ্রেষ্ঠ ট্রাভেলার হচ্ছে আমার মা। সৌন্দর্য দেখা এবং অনুভব করার মতো বিশেষ ক্ষমতা তার মধ্যে আছে, যে ক্ষমতাটা আমরা অন্যান্য মানুষেরা দিনদিন হারিয়ে ফেলেছি।
অন্য পর্বগুলো
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই জুলাই, ২০১৭ রাত ১১:০৮