প্রিয় ভ্রমণসঙ্গী ও পুরানো ঢাকা (দুই-তৃতীয়াংশ)
প্রিয় ভ্রমণসঙ্গী ও পুরানো ঢাকা (তিন-তৃতীয়াংশ)
অন্য পর্বগুলো
-“হ্যালো সারাফাত, আমি তোমার ভার্সিটির সামনে দাঁড়িয়ে আছি।”
-“১০ সেকেন্ড, আমি আসছি।”
গতোদিনের হোলির রঙ ছড়ানো ছিলো পথজুড়ে। সেগুলো মাড়িয়ে আমি যখন পৌছালাম আমাকে দেখে স্বস্তির একটা হাসি ফুটে উঠলো তার ঠোটে। হোলীর লাল-নীল-হলুদ-সবুজ রঙগুলো যেন তুচ্ছ হয়ে গেল এক নিমিষেই।
সোহেল ভাইয়ের সাথে আমার পরিচয় পর্বটা ছিলো অদ্ভুত। ফেসবুকে আমাদের আলাপ হয়েছিলো এবং সেসময় আমি তার সাথে চরমভাবে অভদ্রতা করেছিলাম। অভদ্রতার পরিমান এতো বেশি ছিলো যে সেটা বেয়াদবির পর্যায়ে পৌছে গিয়েছিলো। সোহেল ভাই আমাকে বেশ কয়েকবার সতর্ক করে দিয়েছিলেন, কিন্তু আমি আর সেগুলোতে গুরুত্ত্ব দিইনি। হঠাত একদিন তিনি বলেছিলেন, চিটাগাং ভার্সিটির চেয়ারম্যান পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে জগন্নাথে আমাদের ডিপার্টমেন্টে নূতন যোগদান করেছেন সাজ্জাদ স্যারকে আমি চিনি কিনা। আমি হ্যা বলায় তিনি বললেন যে সাজ্জাদ স্যার তার বন্ধু। তার কথা শুনে আমি ভয়ানকভাবে তব্দা খেয়ে গিয়েছিলাম। আইরে আল্লাহ!! এই মানুষটা আমার শিক্ষকের বন্ধু আর আমি তার সাথে এতোদিন ঠাট্টা করেছি!! সেদিন খুব করে মাফ-টাফ চাইলাম সোহেল ভাইয়ের কাছে। তিনি অবশ্য ততোদিনে বোধহয় আমাকে ক্ষমাশীল দৃষ্টিতে দেখা শুরু করেছেন।
সোহেল ভাই, ঢাকা মেডিকেলের একজন শিক্ষক। আমি এখনো জানি না যে তিনি কোন বিষয়ে স্পেশালিষ্ট। মাঝে মাঝে মনে হয় তিনি বুঝি শিশু বিশেষজ্ঞ, এত্তো সুন্দর নরম করে কথা বলেন তিনি। আবার মাঝে মাঝে মনেহয় গাইনোকোলজিস্ট হলেই বুঝি তাকে বেশি মানাবে। নারী পেশেন্টরা চিকিৎসা শুরুর আগে তার হাসি দেখলেই অর্ধেক সুস্থ হয়ে যাবে। নিজের সম্পর্কে তিনি প্রায় কিছুই বলতে চান না, অধিকাংশ সময় তার সম্পর্কে আমার ধারণা করে নিতে হয়।
আমরা প্রায়ই একসাথে ঘোরাঘুরি করি এবং আমাদের প্রিয় একটা জায়গা হচ্ছে শীতলক্ষ্য। আমরা দুজনে প্রায়ই গিয়ে শীতলক্ষ্যা নদীর পাড়ে বসে থাকি। আজকেও বোধহয় সেরকম প্ল্যান ছিলো। কিন্তু হঠাত তিনি ঢাকা মেডিকেল থেকে ফোন করে আমাকে বললেন যে ক্লাস শেষ আমি যেন আমার ক্যাম্পাসেই থাকি। আজকে আমরা পুরানো ঢাকা ঘুরবো।
বাহাদুর শাহ পার্কের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। সোহেল ভাই বললেন, ‘চলো নর্থব্রুক হল থেকে শুরু করি’।
বাহাদুর শাহ পার্ক
ঢাকাতে বসবাসরত আর্মেনীয়রা সময় কাটানোর জন্য বিনোদনের মাধ্যম হিসাবে বিলিয়ার্ড খেলতে পছন্দ করতো। বিলিয়ার্ডের সাদা বলগুলোকে ঢাকাবাসীদের কাছে মনে হয়েছিলো “আন্ডা”। এই আন্ডা কালের বিবর্তনে হয়ে গেল আন্টা। যেহেতু বিলিয়ার্ড একটা ঘরের মধ্যে খেলা হতো তাই সেখানকার নাম হয়ে গেল “আন্টাঘর”। এটাই ছিলো বাহাদুরশাহ পার্কের আদিরূপ। উনিশ শতকের গোড়ার দিকে ইংরেজরা আর্মেনীয়দের কাছ থেকে আন্টাঘর কিনে নিয়েছিলো। তারপর তারা এটাকে ভেঙ্গে ফেলে ছোট একটা ময়দান মতো তৈরী করলো। জায়গাটার নাম হয়ে গেল আন্টাঘর ময়দান।
আন্টাঘর ময়দান কুখ্যাতি অর্জন করেছিলো ১৮৫৭ সালে। সিপাহী বিদ্রোহ আন্দোলনের সাথে যুক্ত থাকার অভিযোগে বেশ কয়েকজনকে ফাসি দেয়া হয়েছিলো এখানে। তাদের লাশ নাকি বেশ কয়েকদিন ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিলো। এই ঘটনাটি বিভিন্ন ধরনের ভৌতিক কাহিনী জন্ম দেয়, যার ফলে স্থানীয় মানুষেরা এই ময়দানের ধারে-কাছে ঘেসতে ভয় পেত।
ওই বছরই মহারানী ভিক্টোরিয়া ভারতের শাসনভার নিজের হাতে তুলে নেয়। তার এই শাসন ভার গ্রহনের ঘোষনাপত্র ঢাকাবাসীর জন্য আন্টাঘর ময়দান থেকে পাঠ করে শোনানো হয়। আর তার সম্মানার্থে জায়গাটার নাম বদলে রাখা হয় “ভিক্টোরিয়া পার্ক”।
তবে পাকিস্তান আমলে ১৯৫৭ সালে সিপাহী বিদ্রোহের শতবার্ষিকী পালন উপলক্ষ্যে ভিক্টোরিয়া পার্কের নাম বদলে রাখা হয় ‘বাহাদুর শাহ পার্ক”। সেইসব বীর সিপাহীর স্মৃতি রক্ষার্থে এখানে একটা স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়েছে।
বাহাদুর শাহ পার্ককে পাশ কাটিয়ে আমরা নর্থব্রুক হল রোড ধরে এগিয়ে চললাম। অপ্রশস্থ পথ, রিকশার সমারোহ আর দুপাশে ছোট ছোট দোকান জায়গাটাকে ঘিঞ্জি করে তুলেছে।
সোহেল ভাই গল্প করছেন, আমি মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনছি। মানুষটা ডাক্তার অথচ তার গল্পগুলো সব ইতিহাস নিয়ে। একটা পুরানো ভাঙ্গা বাড়ি দেখিয়ে তিনি বললেন যে কিছুদিন আগে নাকি এখানে দুজন জার্মান লাইটিং শো করেছিলো।
অবশেষ আমরা পৌছালাম নর্থব্রুক হলে।
নর্থব্রুক হল
১৮৭২ থেকে ১৮৭৬ সাল পর্যন্ত ভারতের বড়লাট ছিলেন লর্ড নর্থব্রুক। দায়িত্ত্বপালন করার সময় ১৮৭৪ সালে তিনি ঢাকা এসেছিলেন। তার এই আগমনকে স্মরনীয় করে রাখা উপলক্ষ্যে ঢাকার ইংরেজচাটুকর জমিদার ও ধনীকশ্রেণী “শুভ প্রাসাদ সৃষ্টির সংকল্প” গ্রহণ করেছিলেন। তারই ফসল হচ্ছে নর্থব্রুক হল। ১৮৮০ সালের ২৪শে মে এটির উদ্বোধন করা হয়েছিলো।
সোহেল ভাই আমাকে আরেকটা জিনিস দেখাতে নিয়ে গেলেন। নর্থব্রুক হলের পিছনে আরেকটা ভবন।এটি হচ্ছে নর্থব্রুক হলের লাইব্রেরী ভবন। বর্তমানে ভবনটির অবস্থান খুবই জরাজীর্ণ, সতর্কীকরণ নোটিশ ঝুলছে যে ভবনটি ঝুকিপূর্ণ। মর্মাহত হলাম। সামনে দেখি কয়েকটা বাচ্চা ক্রীকেট খেলছে।
আমরা আবার নর্থব্রুকের সামনে এলাম। দুজন দেখি এখানে প্লাস্টিকের চেয়ারে বসে গল্প করছে। ভবনটি বোধহয় এখন সিটি কর্পোরেশনের স্থানীয় অফিস। বিশাল রান্না-বান্নাও চলতেছে, বোধহয় এই ভবনের কিছু অংশ কমিউনিটি সেন্টার হিসাবে ব্যাবহার করা হয়।
তবে সবকিছু ছাপিয়ে যায় এটা ভাবলে যে রবীন্দ্রনাথ এখানে এসেছিলেন। ১৯২৬ সালে ঢাকা মিউনিসিপ্যালিটি তাকে এই নর্থব্রুক হলেই সংবর্ধনা জানিয়েছিলো। এই ব্যাপারটাই আমাকে প্রচন্ডভাবে মুগ্ধ করে। আমি মনেমনে এখনো এখানে রবীন্দ্রনাথের উপস্থিতি অনুভব করি।
নর্থব্রুক হল দেখা শেষে আমরা এগোলাম রুপলাল হাউজের দিকে। আমাদের দুজনের মনটাই বিষন্ন হয়ে গেল, কারণ আমরা জানি ঢাকার অসাধারণ সৌন্দর্যমন্ডিত এই ভবনটির এখন কি বেহাল দশা।
রুপলাল হাউজ
ঢাকার নবাব বাড়ির সবচেয়ে বড় প্রতিপক্ষ ছিলো এই রুপলাল হাউজ। ১৮৮৮ সালে লর্ড ডাফরিন যখন ঢাকাতে এসেছিলেন তখন তার আপ্যায়নের জন্য আহসান মঞ্জিলকে হারিয়ে ভোটে জিতে গিয়েছিলো এই রুপলাল হাউজ। ঢাকায় বসবাসরত অভিজাত ইংরেজ সম্প্রদায় রুপলাল হাউজকে দুদিনের জন্য ভাড়া নিয়েছিলো।
বাড়িটি ছিলো আর্মেনীয় জমিদার আরাতুনের। ১৮৪০ সালে রুপলাল এই বাড়িটি ক্রয় করে। তারপর সেটাকে ভেঙ্গে পূননির্মাণ করে। গ্রীক স্থাপত্যের অনুকরণে তৈরী হওয়া বাড়িটি ঢাকাকে এক অনন্য মর্যাদা প্রদান করে। দ্বোতলায় প্রায় ৫০ টি কক্ষ আছে, যার মধ্যে সবচেয়ে আকর্ষণীয় হচ্ছে পশ্চীম দিকের নাচঘরটি।
আমরা দুজন আরো মন খারাপ করে ফেললাম। অসাধারণ এই ভবনটি এখন পেয়াজ-রসুনের বিরাট আড়ত। কি পরিমাণ যে দৃষ্টিকটু দেখাচ্ছে। মনেহচ্ছে অসাধারণ কোন সুন্দরী রমনীকে কোন পাষন্ড এসিডে ঝলসে দিয়েছে।
মসলার ঝাঁঝে টিকতে পারছি না। সোহেল ভাই মুখে মাস্ক পড়েছেন, কিন্তু আমার অবস্থা বেশ খারাপ। বিষণ্ণতা সঙ্গী করে দ্রুত এই ভবন এলাকা থেকে বের হয়ে এলাম।
রাস্তা ধরে হেঁটে যাবার সময় কতোগুলো দোকানকে দেখিয়ে সোহেল ভাইকে বললাম যে এটা হচ্ছে বিখ্যাত জুবিলি স্কুল। তিনি বোধহয় কিছুটা অবাক হলেন। অবাক হওয়াটাই স্বাভাবিক। আগে থেকে জানা না থাকলে স্কুলটি খুজে পেতে বেশ কষ্টকরই হবে, চারপাশ জুড়ে এতো দোকান।
কিশোরী লাল জুবিলি হাই স্কুল
১৮৫৮ সালে ঢাকায় ব্রাহ্ম স্কুল প্রতিষ্ঠিত হলো। প্রতিষ্ঠার বেশ কয়েক বছর পর স্কুলটি ভয়াবহরুপে আর্থিক সঙ্কটে পড়ে। ১৮৭২ সালে মানিকগঞ্জের বালিয়াটির জমিদার কিশোরী লাল রায় চৌধুরী ব্রাহ্ম স্কুলটি কিনে নিয়ে সেটার নাম বদলে তার বাবার নামে রাখেন ‘জগন্নাথ স্কুল’। জগন্নাথ স্কুলের হেডমাস্টার ছিলেন গোপীমোহন বসাক। তার সময়ে স্কুলটি আর্থিক ও মর্যাদাগত দিক দিয়ে খুবই লাভবান হয়ে উঠেছিলো। স্বভাবতই গোপীমোহন এই আর্থিক লাভের অংশীদার হতে চেয়েছিলেন। এর থেকেই মালিকের সাথে শুরু হয়েছিলো বিরোধ। যার ফলাফলে এক সকালে গোপীমোহনকে কর্মচ্যুত করা হলো। আর সে যেন ক্ষতিপূরন চেয়ে মামলা করতে না পারে এজন্য রাতারাতি স্কুলের নাম বদলে ফেলা হলো। স্কুলের মালিক নিজের নামে নাম রাখলেন, কিশোরী লাল জুবিলি হাই স্কুল।
স্কুলটিকে পাশ কাটিয়ে আমি আর সোহেল ভাই হেঁটে চলেছি। সোহেল ভাই গল্প করছেন, ইতিহাসের গল্প। উত্তর আর দক্ষিন ভারতের ইতিহাস, মোঘলদের ইতিহাস, পাঠানদের ইতিহাস, পশতুদের ইতিহাস, আর্যদের ইতিহাস, সুলতানদের ইতিহাস, নবাবদের ইতিহাস। আমি কিছুটা হিংসিত, এই মানুষটা এতো কিছু জানে কিভাবে?
কথা হচ্ছে বিখ্যাত অলঙ্কার দরিয়া-ই-নূর নিয়ে। দরিয়া-ই-নূর পৃথিবীর দ্বিতীয় দামী রত্ন দিয়ে তৈরী করা হয়েছে। পৃথিবীর সবচেয়ে বিখ্যাত কোহিনূর রত্নের পরেই এর অবস্থান। এই দরিয়া-ই-নূর সংরক্ষিত রয়েছে সদরঘাটের সোনালী ব্যাঙ্কের ভল্টে। ব্যাপারটা ভাবতেই ভালো লাগে। হেসে বললাম, শুনেছি বাংলাদেশে যে অলঙ্কারটি রয়েছে সেটা নাকি নকল, আসলটি নাকি ইরানে রয়েছে। সোহেল ভাইও হেসে বললেন যে, পৃথিবীর সব দামী অলংকার নিয়েই এরকম অনেকগুলো সম্ভাব্য স্থানের কথা শোনা যায়। সবাই দাবী করে যে তাদেরটাই আসল।
বাংলাবাজার দিয়ে হেঁটে চলেছি। খুবই ঘিঞ্জি অবস্থা। সরু পথ, রিকশার ছড়াছড়ি। এখানকার বইয়ের দোকানগুলো দেখলে শ্রদ্ধা জাগেনা, বই যে শুধুই ব্যাবসার বস্তু তা শুধু এখানে এলেই মনেহয়।
বাংলাবাজার
বাংলাবাজার হচ্ছে ঢাকার সবচেয়ে পুরাতন এলাকা। অনেকেই মনে করেন যে বাংলা বই ছাপানো হয় বলেই বোধহয় এখানকার এমন নাম, কিন্তু ব্যাপারটি সেরকম নয়। অন্য কোন কারনে এই জায়গাটার নাম এরকম। আসলে বাংলাবাজার সম্পর্কে খুব কম তথ্য পাওয়া যায়।
অন্য পর্বগুলো
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে মে, ২০১৭ বিকাল ৫:৩২