আগের পর্ব
পরের পর্ব
অন্য পর্বগুলো
শহর থেকে কিছুদূর ছাড়িয়ে শান্তিস্তূপা। এটা বৌদ্ধদের একটা বিশাল বড় মন্দির। দূর থেকে আমি মন্দিরটা দেখতে পারছি, কিন্তু যাবার পথ খুঁজে পাচ্ছি না। আসলে অনেকগুলো সরু সরু রাস্তা বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে গেছে বলেই এই সমস্যা।
যেহেতু পথ খুঁজে পাচ্ছি না এজন্য অসম্ভব সুন্দর আর স্মার্ট এক তরুনীকে দেখে এগিয়ে গেলাম তার দিকে। শান্তি স্তূপে যাবার রাস্তা কোনটা জিজ্ঞাসা করলাম। খুব সুন্দর করে সে আমাকে স্তূপাটিতে যাবার পথটা বুঝিয়ে দিলো। কিন্তু কিছু সামনে গিয়ে আবার গুলিয়ে ফেললাম। এবার জিজ্ঞাসা করলাম পথ দিয়ে হেঁটে যাওয়া তিনজন লোককে, মজার ব্যাপার হচ্ছে তারাও কিচ্ছু জানে না।
প্রত্যেক রাস্তার মোড়ে খুবই সুদৃশ্য সাইনবোর্ড। সেইসব সাইনবোর্ডে ওই রাস্তায় অবস্থিত সকল হোটেলের বিস্তারিত বর্ণনা খুব সুন্দর করে দেয়া আছে। আর সবকিছু এতো ঝকঝকে পরিচ্ছন্ন আর পরিপাটি যে বলার মতো নয়। কোথায় কোন ময়লা পড়ে নেই। ঝা চকচকে একটা পরিবেশ, আর সূর্যের আলোতে চোখ ধাধিয়ে যাচ্ছে।
আবার পিছন দিকে ফেরত এসে একটা স্কুলের দারোয়ানকে জিজ্ঞাসা করে আমার গন্তব্যের পথটা খুঁজে পেলাম। তারপর আবার হাঁটা শুরু করলাম।
শান্তি স্তূপা যাবার পথটি আমার কাছে এতো ভালো লেগেছে যে বলার মতো না। রাস্তার দুপাশে খুব সুন্দর সুন্দর বাড়ি আর বেশ ভালো মানের থাকার হোটেল। প্রত্যেকটা বাড়িতে বিভিন্ন ধরনের ফুলের বাগান। সেই বাগানগুলোতে আপেলগাছও রয়েছে, আর এইসব আপেলগাছে ঝাকে ঝাকে আপেল ধরে আছে। তবে লেহ শহরে সবুজের আধিক্য যে কারণে সেই গাছগুলো একটু যেন অদ্ভুত। পুরো লেহ শহর এই গাছে ভরা, লম্বাটে ধরনের গাছ যার ছড়ানো ছিটানো কোন ডালপালা নেই।
পথের দুপাশে অনেকগুলো বাইকের দোকান দেখতে পাচ্ছি। বাইক সম্পর্কে আমার কোন ধারণা নেই, তবে এই বাইকগুলো দেখেই মনে হচ্ছে যে এগুলো খুব শক্তিশালী। আর কেউ যখন এই বাইকগুলো চালিয়ে যাচ্ছে তখন বাইকের শক্তিশালী ইঞ্জিনের ভয়ঙ্কর শব্দে প্রাণ ওষ্ঠগত হবার উপক্রম। দোকানের এই বাইকগুলো লেহ থেকে বিভিন্ন জায়গায় বেড়ানোর জন্য ট্যুরিস্টদের কাছে ভাড়া দেয়া হয়। অনেক দুঃসাহসিক অভিযাত্রী নাকি মানালি অথবা জম্মু কিংবা শ্রীনগর থেকে ৭/৮শ কিঃমিঃ বাইক চালিয়ে এখানে ঘুরতে আসে। আবার অনেকে লেহ থেকে আরো দুর্গম কোন অঞ্চলে এই বাইক ভাড়া করে ঘুরতে যায়। ব্যাপারটা শুনতে অনেক সহজ, কিন্তু গড়ে ১৫ হাজার ফুটের উপর উঁচু ভয়ঙ্কর পাহাড়ি রাস্তা যেখানে অক্সিজেনের পরিমাণ খুবই কম যে অক্সিজেন কিনা আরোহী আর তার বাইকের ইঞ্জিন উভয়ের জন্যই অত্যাবশ্যকীয় আর বরফে মোড়ানো প্রবল বাতাসের ভয়ঙ্কর ঠান্ডা পথে বাইক চালানো অবশ্যই দুঃসাহস।
শান্তি স্তূপা যাবার সময় খেয়াল করলাম লেহ শহরের রাস্তার পাশে যে ড্রেন রয়েছে সেগুলো দিয়ে প্রবল বেগে পানির স্রোত ধেয়ে চলেছে। বুঝলাম যে এগুলো আসলে নর্দমার পানি না। বিভিন্ন ঝরনার পানিকে দুপাশে বাধ দিয়ে ড্রেনের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত করা হয়েছে।
মাঝে মাঝে ছোট ছোট রঙিন বৌদ্ধ মন্দির, আর সাদা রঙের স্তূপা। বেশ ভালো লাগে এগুলো দেখতে। তবে লেহ শহরের রাস্তা ঘাটে মানুষ আর কুকুর বাদে যে প্রানীটা সবচেয়ে বেশি চোখে পড়ে তা হচ্ছে গাধা। আমার কাছে মনে হয়েছিল যে গাধা বুঝি লেহ শহরের জাতীয় প্রাণী।
প্রায় আধাঘন্টা হাটার পর পৌছালাম শান্তি স্তূপা রয়েছে যে পাহাড়টায় তার পাদদেশে। কিন্তু সেখানে পৌছে আমার মাথায় চক্কর দিয়ে উঠলো। একগাদা সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠতে হবে। আমার তো মনে হলো মাইল মাইল সিঁড়ি ডিঙ্গাতে হবে। দেখেই ভয়ে বুক কেঁপে উঠছে। কিন্তু এতো কষ্ট করে এতোদূর এসেও তো জিনিসটা না দেখে ফিরে যাওয়া যায় না।
আল্লারে আল্লাহ! একি সোজা কথা! উঠছি তো উঠছিই। একটু খানি উঠি আর কুত্তার মতো জীভ বের করে হাঁপাই। তারপর আবার উঠি। আসলে এতো উপরে অক্সিজেনের স্বল্পতার কারণে সবাই খুব হাপিয়ে পড়ে। তারউপর আমি আবার ২৪ ঘন্টা কিছু না খাওয়া, তারউপর আবার এতোগুলো সিঁড়ি ভাঙতে হচ্ছে। আমার অবস্থা একেবারে খারাপ হয়ে গেল। নিজের উপরই রাগ হচ্ছে। মনে হচ্ছে শহরে আরো কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে দোকান খোলার পর কিছু খেয়ে তারপর রওনা দিলে হতো। কিন্তু এখন তো আর কিছু করার নেই, যা হবার তা তো হয়েই গেছে। আবার কষ্ট মষ্ট করে উপরে উঠতে লাগলাম। পরে নামার সময় আমি সিড়িগুলো গুনেছিলাম। কতোগুলো হয়েছিলো জানেন? ৫৯৫ টা সিঁড়ি আর মাঝে মাঝে ঢালু পথ।
তবে যতোই উপরে উঠছি, ততোই চারপাশের দৃশ্য দৃষ্টিগোচর হচ্ছে, আর আমি মুগ্ধতায় ততোই আচ্ছন্ন হয়ে পড়ছি।
চারপাশে ধূসর পাহাড়ঘেরা লেহ শহরটি লম্বা সবুজ গাছ দ্বারা আবৃত। দূরে বরফের ধবধবে চূড়া আর ঘন নীল আকাশের আচ্ছাদন। এতে মুগ্ধ না হয়ে কি পারা যায়!
ভয়ঙ্কর গাদাখানেক সিঁড়ি ভেঙে শেষ পর্যন্ত মন্দিরের চত্ত্বরটিতে উঠে এলাম। ততোক্ষণে আমার জীভ বের হয়ে গেছে। একটা চেয়ারে ধপাস করে বসে পরলাম। দেখি একজন বৌদ্ধ সন্যাসী একটি পুরো সাদা আর একটি পুরো কালো কুকুর সাথে নিয়ে রোদ পোহাচ্ছে। কোথাও আর কোন মানুষ নেই। আমার দিকে সন্যাসী সাহেব কোন গুরুত্বই দিলেন না, বোধহয় এরকম ধপাস করা মানুষ দেখে তিনি খুবই অভ্যস্থ।
এই চত্ত্বরটিতে একটা মন্দির আছে। কিছুক্ষণ জিরিয়ে নিয়ে জুতো খুলে মন্দিরের ভিতরে প্রবেশ করলাম। মন্দিরের ভিতরে দেখি খুবই জমজমাট করে সবকিছু সাজানো রয়েছে। কিন্তু একটা মানুষও নেই। বেশ খানিকক্ষন ধরে কতোগুলো ছবি তুললাম। ভিতরে যে কতোরকমের জিনিসপত্র আছে তার ইয়াত্তা নেই। দেখা শেষ হলে বের হয়ে এলাম।
আমি মন্দিরটিতে এসেছি পায়ে হাঁটা পথ ধরে সিঁড়ি বেয়ে। এছাড়া গাড়ি চলাচলের একটি রাস্তা আছে।সেই পথ দিয়ে গাড়িতে করে একেবারে মন্দিরের প্রাঙ্গণ পর্যন্ত উঠে আসা যায়। এখানে কমপক্ষে দুটি মন্দির আছে। আর আছে ধর্ম সংক্রান্ত কতোগুলো অফিস। এছাড়া মেডিটেশনের জন্য কয়েকটা কক্ষ রয়েছে।
নীচের মন্দিরটি দেখা শেষে আমি ঢালু পথ বেয়ে উপরে উঠলাম শান্তি স্তুপা দেখার জন্য। শান্তি স্তূপার পাশে দেখি কাঠের সুদৃশ্য একটা বাংলো তৈরী করা হচ্ছে। এই বাংলো তৈরী হয়ে গেলে এখানে রাত কাটানো নিশ্চয় একটা অবিস্মরণীয় অভিজ্ঞতা হবে।
আমি যখন শান্তি স্তূপা পর্যন্ত উঠলাম তখন দেখি একজন সাদা চামড়ার বিদেশী তার দামী ক্যামেরা দিয়ে বিভিন্ন ভঙ্গিমায় আশেপাশের ছবি তুলছে। আমাকে দেখে তাড়াহুড়ো করে সে চলে গেল। কেন তার এ আচরণ তা কে জানে! লোকটার নিশ্চয় কোন বদ মতলব ছিলো।
ঠিক এইরকম একটা বৌদ্ধ মন্দির আমি দার্জিলিং এ দেখেছি। হুবহু একই রকম। দার্জিলিঙয়ের বৌদ্ধ মন্দিরটি ছিলো জাপানীদের তৈরী।
দার্জিলিঙের জাপানিজ টেম্পল
লেহর শান্তি স্তূপাটাও মনে হয় জাপানীরা তৈরী করেছে। কেমন যেন সাদামাটা। এই জিনিস দেখতে মানুষ এতো কষ্ট করে এখানে আসে! এর চাইতে বাংলাদেশের বৌদ্ধ মন্দিরগুলি দেখতে কতো সুন্দর। বিশেষ করে বান্দরবানের স্বর্ণমন্দিরের তো কোন তুলনাই হয় না। হায় আফসোস! সারা পৃথিবীর লোকেরা যদি বান্দরবানের সৌন্দর্যের কথা সেভাবে জানতে পারতো!
বান্দরবানের স্বর্ণমন্দির
শুনেছি এইসকল স্তুপা গুলোর পাঁজরে নাকি জ্ঞান সংরক্ষণ করা আছে। কোন একসময় পুরো পৃথিবীর সকল সভ্যতা যখন ধ্বংস হয়ে যাবে তখন নাকি বৌদ্ধ এইসকল স্তূপা থেকে সংরক্ষিত জ্ঞানের মাধ্যমে পৃথিবী আবার আলোর পথে যাত্রা করবে।
তবে চারপাশের প্রকৃতি এতো মনোহর যে চোখ ফেরানো যাচ্ছে না। মাথার উপরে ঘন নীল আকাশ আর ঝকঝকে রোদ্দুর। আলোর ঝলকানি এতো বেশি যে চোখ থেকে সানগ্লাস খোলা একেবারেই সম্ভব না। শান্তি স্তূপা থেকে পুরো লেহ শহর পাখির চোখে দেখা যায়।
ব্যাপারটি সত্যিই অসাধারণ লাগে। পুরো সবুজ শহর আর চারপাশের খয়েরি ধুসর নীলচে পাহাড় যেগুলোর মাথায় বরফের চূড়া বসানো, সেগুলো থেকে চোখ ফেরানো সত্যিই কঠিন। হঠাৎ দূরে দেখি একটা উড়োজাহাজ উড়ে যাচ্ছে।
স্তূপা থেকে নেমে এসে ঢুকলাম মেডিটেশন রুমে। এখানেও কেউ নেই। সবকিছু খুব সুন্দর করে সাজানো। আমি যদি এখান থেকে কোন জিনিস পকেটে করে নিয়েও যাই তাহলে মনে হয় ধরা পড়ার কোন সম্ভাবনা নাই। স্যুভনির হিসাবে তো কিছু নিয়ে যাওয়া যেতেই পারে। রবীন্দ্রনাথের নোবেল পুরষ্কারটা যে চুরি করেছে তাকে কি চোর বলা উচিৎ? সে হয়তো সত্যিকার ভাবে রবীন্দ্রনাথকে ভালোবাসে অথবা সে যার কাছে সেটা পৌছে দিয়েছে তিনি হয়তো সত্যিকারের রবীন্দ্রপ্রেমী।
এসব ভেবে মনটা শক্ত করার চেষ্টা করছি, যেন পরে কোন অপরাধবোধে ভুগতে না হয়। তারপর মনে হলো, কী জানি বাবা!! কোন লুকানো ক্যামেরা আছে কিনা কে জানে!! ধরা পড়ে গেলে খবর আছে। পুরো একদিন না খেয়ে থাকা আমার দুর্বল শরীর বেশি মারধোর সহ্য করতে পারবে না। তারপর মারধোর শেষে যদি এতো উঁচু পাহাড় থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয় আবার বাপ-মা জীবনেও আমার লাশ খুঁজে পাবে না, তারা হয়তো জানবেও না যে আমি মারা গেছি। এসব সাত-পাচ ভেবে শেষ পর্যন্ত এই বিষটাতে ক্ষ্যান্ত দিতে হলো।
আশপাশ আরো কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি শেষে এবার ফেরার পালা। এবার আমাকে সিঁড়ি দিয়ে নামতে হবে। উফ!! কি শান্তি! গুনতে গুনতে সিঁড়ি দিয়ে নামা শুরু করলাম। বাপরে! সিঁড়ি বেয়ে নামাও কম কষ্টের না। একবার পা পিছলালে সব শেষ। একেবারে ভবলীলা সাঙ্গ। খুব সাবধানে ব্যালান্স করে নামতে হচ্ছে।
দেখি সিঁড়ি বেয়ে আট-দশজন সাদা চামড়ার বিদেশী উঠে আসছে। তাদের অবস্থা আমার চাইতেও খারাপ। পাশ কাটানোর সময় আমাকে বললো “জুলে।“ জুলে হচ্ছে লাদাখি একটা শব্দ। এর মানে হচ্ছে, সুপ্রভাত থেকে শুরু করে শুভরাত্রি, ধন্যবাদ, সালাম, সম্ভাষণ সবকিছু। একটা তিনকেলে বুড়ি যার নাক দিয়ে টপাস টপাস করে ঝোল পড়ছে, হাপাতে হাপাতে সেও আমাকে বললো জুলে। সাদা চামড়ার এই রীতিটা আমার খুব ভালো লাগে। তারা যখন যেখানে যায় সেখানকার সবচেয়ে ভদ্রজনোচিত শব্দটার অতিরিক্ত প্রয়োগ করে। বুড়ির কথার প্রত্যুত্তরে দাঁত বের করে হেঁসে আমিও বললাম জুলে।
৫৯৫ টা সিঁড়ি ভেঙে নীচে নামলাম। তারপর রওনা হলাম শহরের দিকে। খিদেয় তখন আমার প্রায় জান বের হয়ে গেছে। শান্তি স্তূপা থেকে শহর প্রায় ২০ মিনিটের হাঁটা পথ। আর ততোক্ষণে সকাল ১০ টা বেজে গেছে। আশা করি শহরে গিয়ে খাবার হোটেল খোলা পাবো।
শহরে পৌছে মসজিদের পাশ দিয়ে লেহ প্যালেসে যাবার গলি দিয়ে কিছুদূর এগিয়ে একটা পাঞ্জাবি ধাবা খুঁজে পেলাম। ঢুকে গেলাম সেটার ভিতরে। পরিচ্চন্ন এবং গোছানো একটা হোটেল।। হোটেলটার দুটো অংশ। একপাশে কাস্টমার বসার জায়গা, সেখানে টেবিলে টেবিলে প্লাস্টিকের ফুল সাজানো। অন্য অংশটাতে রান্না-বান্না হচ্ছে। সেখানে যে রান্না করছে সে আবার কয়েকজনের সাথে আড্ডাতে মত্ত। আড্ডারতদের মধ্যে অধিকাংশই মুসলমান, বোঝা যাচ্ছে তারা এই হোটেলের নিয়মিত কাস্টমার। চায়ের মগ হাতে নিয়ে হাসিখুশি অবস্থায় তারা গল্প করছে। সাধারণ একটা হোটেলে রান্নার জায়গা যতোটুকু দরকার এইখানে তার চেয়ে একটু বেশিই রয়েছে। বুঝলাম যে রাধুনি বেশ আড্ডাপ্রিয় মানুষ।
মজার ব্যাপার হচ্ছে, আমি চেয়ারে বসার পরপরই আমাকে দেখে রাধুনি তার বন্ধুদের রেখে রান্নাঘর থেকে বের হয়ে আমার পাশে এসে দাড়ালো। কি খাবো সেটা জানতে চেয়ে খাবারের মেনুকার্ড বাড়িয়ে দিলো। বুঝতে পারলাম যে যিনি রাধুনি তিনিই এই হোটেলের সর্বেসর্বা। মেনুকার্ড দেখে পরিচিতগুলোর মধ্যে খুঁজে পেলাম ডালপরোটার থালি। অচেনা কিছুর দিকে রিস্ক নিলাম না, এটারই অর্ডার দিলাম। হোটেলের খাবারের সুগন্ধে তখন আমার অবস্থা আরো কাহিল। একেবারেই দেরি সহ্য হচ্ছে না। সামনে বসে যে খাচ্ছিলো মনে হলো তার প্লেট ধরেই শুরু করে দেব কিনা।
কিন্তু আমাকে বেশিক্ষন অপেক্ষা করতে হলো না। খুবই গরম ডালপরোটা হাজির হয়ে গেল। একটা খোপ খোপ ওয়ালা প্লেটে একটা অংশে পরোটা, দুটো অংশে ডাল আর একটা অংশে টক দই। গ্রোগ্রাসে গিলতে লাগলাম। আমার খাওয়া দেখে সামনের ভদ্রলোক দেখি খাওয়া থামিয়ে আমার দিকে কিছুক্ষণ অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে কিছুটা ছোট্ট হাসি দিয়ে আবার তার খাওয়ায় মনোযোগ দিলেন। কিন্তু এইসব হাঁসির দিকে ভ্রূক্ষেপ দেবার মতো অবস্থা আমার নেই। প্রায় ১ দিন পরে সলিড কোন কিছু খাচ্ছি, এর যে আনন্দ তা বলে বোঝানো যাবেনা। চোখ দিয়ে প্রায় পানি এসে যাবার উপক্রম। এতো তৃপ্তি সহকারে আমি অনেকদিন খায়নি।
পরোটা শেষ করার পর দোকানি এসে আমার সামনে উপস্থিত। তিনি চায়ের অর্ডার নিতে এসেছেন। কিন্তু তাকে হতাশ করে বললাম যে আমি চা খাবোনা। একথা শুনে তার তো চোখ তো কপালে ওঠার উপক্রম। আমি শিওর যে, আমিই জীবনে তার হোটেলের একমাত্র কাস্টমার যে সকালে নাস্তার পরেও চা খাচ্ছি না। যাই হোক, পুরো ২৪ ঘন্টা পার করার পর যে খাবার খেলাম সেই ডাল-পরোটার বিল এলো মাত্র ৩০ রুপি।
খাওয়া-দাওয়া শেষে শহর পরিক্রমায় বের হলাম। আমার কাছে লেহ শহরটা খুবই ভালো লাগছে। দামী দামী কার্পেট, কারুকার্য খচিত পশমিনা শাল, বিভিন্ন ধরনের বৌদ্ধ এনটিক আর গহনা দ্বারা দোকানগুলো ভরপুর। পাশ দিয়ে যাবার সময় এইসব দোকানগুলোর দিকে মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাকিয়ে থাকতে হয়। আলী ভাই আমাকে বলেছিলেন কাশ্মীরের শ্রীনগরের চাইতেও লাদাখের লেহ শহরে বেশী ভালো পশমিনা শাল পাওয়া যায়। এখানকার দোকানগুলি রাতের ঝলমলে আলোতে ঝা চকচক করে।
তবে সবচেয়ে বেশি চোখে পড়ে বিভিন্ন ট্রাভেল কোম্পানির অফিস। অফিস না বলে এগুলোকে দোকান বলাই ভালো। এই এজেন্সিগুলো বেশ মোটা টাকার বিনিময়ে লাদাখের বিভিন্ন গহীন আর দুর্গম অঞ্চল ভ্রমণ করিয়ে থাকে। এইসব দোকানে ভয়ঙ্কর ভয়ঙ্কর মন খারাপ করানো সুন্দর সুন্দর ছবি টাঙ্গানো। দেখলেই লোভ লাগে।
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা আগস্ট, ২০১৬ দুপুর ১২:৫৩