অন্য পর্ব
স্টেশনের প্রতিটি প্ল্যাটফর্মের ডিজিটাল বোর্ডে প্রদর্শিত হয় ট্রেনের কোন বগি কোথায় দাঁড়াবে। আমার বগির নম্বর হচ্ছে s 10 সিট নম্বর ৪৯। সেদিকে যাবার চেষ্টা করতেই দেখি একটা জায়গায় ইয়া লম্বা লাইন। রেল পুলিশ মারধোর দিয়ে লাইনটা ঠিক করার চেষ্টা চালাচ্ছে। আসলে হয়েছে কি প্রতিটি দূরপাল্লার ট্রেনে অসংরক্ষিত কিছু আসন থাকে, সেখানে যে আগে উঠতে পারবে সিটটা তার। আসন বিহীন যাত্রীরা আগে ওঠার জন্য হুড়োহুড়ি করে বলে পুলিশ একটা লাইন তৈরী করে দেয়।
s 10 লেখা ডিসপ্লে বোর্ডের সামনে দাঁড়াতেই ট্রেন এসে গেল। উঠতে গিয়ে দেখি দরজা বন্ধ। কিছুক্ষণ পর ট্রেনের লোক এসে ভিতর থেকে দরজা খুলে দিলো। হুড়মুড় করে উঠে পড়লাম। নিজের সিটটা দখল করে বসে রইলাম। তখন সবে সন্ধ্যা সাতটা বাজে। ট্রেন ছাড়তে এখনো চল্লিশ মিনিট বাকি আছে। প্রচন্ড গরম লাগছে। আশেপাশের সিটের সহযাত্রীরা ততক্ষণে আসা শুরু করেছে। বুঝতে পারলাম মোটামুটি একটু নিম্নবিত্তের মানুষেরাই স্লিপার ক্লাসে ভ্রমণ করে।
ট্রেন ছাড়ার ঠিক মিনিট দশেক আগে দুটো রাজপুত্র উঠে এলো। বিলাসিতা তাদের শরীর আর লাগেজ দিয়ে ঝরে ঝরে পড়ছে। পুরো বগিতে যা সম্পূর্ণ বেমানান। খুব সন্দেহ হলো। কাছে এসেই প্রথমে তারা আমার নাম ধরে ডেকে উঠলেন। অবাক হলাম না, কারণ প্রতিটি যাত্রীর নাম-ঠিকানা ট্রেনের দরজার পাশে সাঁটানো থাকে। নিশ্চয় সেখান থেকে আমার নাম দেখে এসেছে। যেচে এসে তারা যখন আমার সাথে পরিচিত হলো তখন আমার সন্দেহ সম্পূর্ণরূপে সঠিক প্রমাণিত হলো। তারা দুজনেই বাংলাদেশী। সেতু আর নিয়ন। ফেয়ারলি প্লেসে টিকিট কেটে বের হবার সময় তারা নাকি আমাকে দেখেছে। অবশ্য তারা নাকি তখন আমাকে ইন্ডিয়ান মনে করেছিল।
পরিচিত হওয়া মাত্রই তাদের সাথে বকবক শুরু করে দিলাম। আমার উপরের সিটদুটি তাদের। সারাটা দিন ইন্ডিয়ানদের উদ্ভট বাংলা উচ্চারণ শুনে শুনে মাথায় যে যন্ত্রণা শুরু হয়েছিল তা এক মিনিটেই কেটে গেল। আমার কথার যন্ত্রণায় নিয়ন ভাই কিছুটা দূরে সরে বসলেন, আর সেতু ভাই দূরে সরতে না পেরে অস্থির হয়ে গেলেন। কিন্ত আমি এসব গ্রাহ্যের মধ্যেই আনলাম না। আমার কথা চালিয়েই যেতে লাগলাম। নিজের ভাষায় বকবক করলে যে মাথা যন্ত্রণা সারতে পারে তা এই প্রথম জানলাম।
সেতু আর নিয়ন ইন্ডিয়া ঘুরতে এসেছেন। এখন যাবেন দিল্লিতে, সেখান থেকে আগ্রা, রাজস্থান এইসব দিকে। সিমলার দিকে যাবারও ইচ্ছা আছে। তাদের কাছে আমিও আমার ট্যুর প্লানের কথা শেয়ার করলাম। দিল্লীতে মেট্রোতে করে সাইট সিয়িং এর ব্যাপারে আমার একটা লেখা ছিলো। লেখাটার প্রিন্ট কপি বের করে তাদের দেখাতেই সেতু ভাই চাপনিছে সেটা গাপ করে দিলেন। মেট্রোতে দিল্লী ভ্রমণ
বকবকের ঠেলায় কখন যে ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে বুঝিনি। টের পেলাম গায়ে বাতাস লাগায়। আহ কি আরাম! শেকল দিয়ে লাগেজ বেঁধে থিতু হয়ে বসলাম। বকবকানি থামিয়ে টুকটাক কথা বলা শুরু করলাম। নিয়ন ভাই খুব চুপচাপ, কথা একেবারেই কম বলেন। ততোক্ষণে বেশ রাত হয়ে গেছে। সেতু ভাইরা খাবার জন্য এক বয়াম জেলি, এক প্যাকেট পাউরুটি আর কি কি যেন নিয়ে এসেছে। আমি আমার পাউরুটি আর মিষ্টি বের করলাম। আমার খাবারগুলোই ভাগাভাগি করে খাওয়া হলো। সারাদিন বেশ উত্তেজনা আর পরিশ্রম গেছে। খাওয়া-দাওয়া শেষে শুয়ে পড়লাম। প্রচন্ড বেগে ট্রেন ছুটছে। তাছাড়া চলন্ত ট্রেনের দুলুনিও আমার কাছে খুব ভালো লাগে। সহজেই ঘুমিয়ে গেলাম।
২০শে সেপ্টেম্বর’২০১৫
আমি সবসময়েই খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠি। ভারতে সবচেয়ে মজার দৃশ্য দেখা যায় ভোরবেলায়। এদেশের লোকজন ভোরবেলা ট্রেন রাস্তার দুপাশে উদোম হয়ে লাইন দিয়ে বসে পায়খানা করার জন্য। ট্রেনের যাত্রীরা যে তাদের এই খোলামেলা ভাবে পায়খানা করার দৃশ্যটি দেখছে এ ব্যাপারে তাদের কোন ভ্রূক্ষেপ নেই। কিছুক্ষন এই মজাদার দৃশ্য উপভোগ করলাম। তারপর ভীড় হবার আগেই টয়লেটের দিকে গেলাম। ইন্ডিয়ার ট্রেনের প্রতিটি বগিতে চারটে করে টয়লেট। তিনটিতে ভারতীয় রীতি আর একটিতে হাই কমোডের ব্যাবস্থা। কোনটিতেই বদনা অথবা মগ নেই, তবে কিছু বোতল রাখা আছে। প্রতিটি টয়লেটের ভেতরে ও বাইরে হাতমুখ ধোয়ার বেসিন রয়েছে। পরে দেখেছিলাম দিনের মধ্যে বেশ কয়েকবার এই টয়লেটগুলি পরিষ্কার করা হয়। শুধু তাই নয়, ট্রেনের প্রতিটি বগিই দিনে কয়েকবার করে ঝাড়ু দিয়ে ঝাঁট দেয়া হয়।
ঘণ্টা খানেক পর সেতু ভাই উঠলেন। একটা স্টেশনে ট্রেন থামা মাত্র আমি তাকে নিয়ে নিচে নামলাম। তিনি স্টেশনের কল থেকে হাতমুখ ধুলেন। তারপর আমরা এদিক ওদিক হাঁটাহাঁটি শুরু করলাম। দেখি নিয়ন ভাইও উঠে পড়েছেন। জানালা দিয়ে তিনি আমাদের ডাকাডাকি শুরু করলেন । কিন্তু আমরা কর্ণপাত করলাম না। বেশ কিছুক্ষণ পর আমরা যখন ট্রেনে উঠে আসলাম তখন দেখি নিয়ন ভাই ক্ষেপে ভোম হয়ে আছেন। আসলে তার জোর আকারে টয়লেট চেপেছে ,আর মালপত্র ফেলে রেখে তিনি টয়লেটেও যেতে পারছিলেন না। সেতুকে দেখতে পেয়ে গালাগাল দিতে দিতে টয়লেটের দিকে দৌড়ে গেলেন। শেষ পর্যন্ত যখন টয়লেট থেকে যখন বের হলেন ততোক্ষণে কিছুটা শান্ত হয়েছেন।
রামপেয়ারি চায়ের অনেক নাম শুনেছিলাম। নেয়া হলো তিন কাপ। আর তারপর আমি সেতু ভাইদের পাউরুটিতে ভাগ বসালাম। ইন্ডিয়ান স্টাইলে সকালের নাস্তা হিসাবে পাউরুটি আর চা মন্দ হলো না। কলকাতা থেকে কাশ্মির পর্যন্ত পুরো ইন্ডিয়া সফরে চা নিয়ে একটা মজার বিষয় লক্ষ্য করেছি, তা হচ্ছে, সকালে চা না খেলে ইন্ডিয়ানরা পাগল হয়ে যায়। একেবারে মারা যাওয়ার মতো অবস্থা হয় তাদের। ট্রেনের মধ্যে দেখি অন্যান্য যাত্রীরা উন্মাদের মতো চা চা করছে। যাই হোক সকালের নাস্তা শেষ করে সুস্থির হয়ে জানালার পাশে বসলাম।
বসলামতো কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যে অস্থির হয়ে গেলাম। ট্রেন বোধহয় ততোক্ষণে বিহারের মধ্যে দিয়ে যাওয়া শুরু করেছে। প্রচন্ড গরম। দুপাশে সবুজ আছে, কিন্তু বাংলাদেশের মতো চোখ জুড়ানো সবুজ নয়। কেমন যেন রুক্ষ সবুজ। চোখের আরাম না হয়ে কেমন যেন যন্ত্রণা হয়। সময়ের সাথে সাথে পাল্লা দিয়ে গরম বাড়তে লাগলো। অথচ তখন কেবল সকাল ন’টা বাজে। ভাবছি দুপুরে কি অবস্থা হবে! আমি তো দাঁতে দাঁত চেপে গরম সহ্য করছি, কিন্তু সেতু আর নিয়নের অবস্থা সুবিধার না। তারা প্রথমে টি-শার্ট খুলে ফেললো। তার কিছুক্ষণ পর প্যান্ট বদলে লুঙ্গি পড়লো। কিছুক্ষণ পর দেখি সেই লুঙ্গিও হাঁটুর বেশ অনেকখানি উপরে বিপদজ্জ্বনক জায়গায় উঠে গেছে। আর এদিকে কোন ঠান্ডা পানীয় বিক্রেতা গেলেই তাদের কাছ থেকে বিভিন্ন জুসের বোতল কিনতে লাগলো। আমিও সেই জুসের ভাগ পেতে লাগলাম।
কলকাতা থেকে কালকা পর্যন্ত ১,৭১৩ কিঃমিঃ যাত্রাপথে হয়তো অনেক নদী ছিল, কিন্তু আমার চোখে পড়েছে মাত্র দু’টি। একটির কি নাম জানিনা। তবে অন্যটি হচ্ছে গঙ্গা, যমুনা আর সরস্বতি নদীর মিলনস্থল। এই জায়গাটার নাম হচ্ছে সঙ্গম। আমাদের দেশে ট্রেন ভ্রমণে যেমন কিছুদূর পরপর নদী পার হতে হয়, এখানে কোন নদী তো দূরে থাক ছোট নালাও পার হতে হয় না। নদী দেখতে না পেরে শরীরের মধ্যে কেমন যেন খাঁ খাঁ অনুভূত হচ্ছে। প্রচন্ড দ্রুত বেগে ট্রেন ছুটে চলেছে। পাশাপাশি কমপক্ষে দুটো লাইন। একটি যাবার অন্যটি আসার। কিছুক্ষণ পরপর প্রচন্ড বেগে অন্য ট্রেন পাশ কাটাচ্ছে। যাত্রাপথে ছোটছোট স্টেশনগুলিও এতো বিশাল বিশাল যে অবাক হতে হয়। এই যাত্রাপথে আসানশোল, ধানবাদ, গয়া, মোঘলসরাই, এলাহাবাদ, কানপুর, আলীগড় এইসব বিখ্যাত স্টেশন পড়ে। মাঝে মাঝে যে স্টেশনগুলোতে দাড়াচ্ছে দৌড়ে গিয়ে বোতল ভরে ঠান্ডা পানি নিয়ে আসছি। এসব স্টেশনে নর্মাল পানির পাশাপাশি ঠান্ডা পানিরও ব্যাবস্থা আছে।
পরের পর্ব
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৬ সকাল ১১:১৫