কাজী রকীবুদ্দিন আহমদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। থাকতেন ফজলুল হক হলে, ইস্ট হাউজে। অনেক বিখ্যাত ব্যক্তিই এই হলে সেই সময়ে বা কাছাকাছি সময়ে ছিলেন। আবদুল ওয়াজেদ মিয়া ফিজিক্সের সেরা ছাত্র ছিলেন। ছাত্রলীগের ছেলেরা দেখল নির্বাচনে এমন একজন দরকার যে বেশি শব্দ করবে না, তাদের কথা শুনবে, অথচ ভালো ছেলে হিসেবে বেশি ভোট পাবে। তাই ওয়াজেদকেই ছাত্র সংসদের ভিপি হিসেবে মনোনীত করল এবং তিনি সসম্মানে পাশ করে এলেন। ভালো ছাত্র দিয়ে ফজলুল হক হল পরিপূর্ণ। তখন আর সলিমুল্লাহ হলের নাম তত গুরুত্বপূর্ণ নয় ঐতিহ্য সত্ত্বেও। বিশেষ করে বিজ্ঞানের ছেলেরা দুই ক্লাসের ফাঁকে যে কয়েক মিনিট সময় পাওয়া যেত দুপুরে সে সময়েই কাছের হল থেকে লাঞ্চ শেষ করে আসতে বেশি উৎসাহী ছিল। তাই ফজলুল হক হল এবং শহীদুল্লাহ হলে (তখন নাম ঢাকা হল, আরো আগে লিটন হল) বিজ্ঞানের ছেলেদের ভীড় বেশি। রাজ্জাকও থাকতেন ফজলুল হক হলে। তোফায়েল সম্ভবত নতুন তৈরী ইকবাল হলে (এখন সার্জেন্ট জহুরুল হক হল) বিচরণ করতেন।
ফজলুল্ হক হলে কেমিস্ট্রির ভালো ছাত্র ছিলেন আকমল হোসেন। আকমল সম্ভবত ম্যাট্রিকে সারা দেশে দ্বিতীয় এবং ইন্টারে তৃতীয় হয়েছিলেন। তৌফিক-এ-এলাহী চৌধুরীও ( আমাদের জ্বালানী উপদেষ্টা) এই দুই পরীক্ষায় প্রথম দু তিনজনের মধ্যে ছিলেন। তিনি অর্থনীতিতে চলে যান এবং সলিমুল্লাহ হলে। এই ব্যাচে হলের সেরা ছাত্র ছিলেন, দেশের সেরা - সৈয়দ তোয়ারেক আলী, যিনি আর সব সেরা ছাত্রের মতই পদার্থবিজ্ঞানে ভর্তি হয়েছিলেন। তিনিও ফজলুল হক হলে ছিলেন - তবে ওয়েস্ট হাউজে। ১৯৫৬ সাল থেকে ১৯৬২ সালে যিনিই ম্যাট্রিকে প্রথম হয়েছেন, তিনি ইন্টারেও সেই অবস্থান অক্ষুণ্ণ রেখেছেন। মুনিবুর রহমান চৌধুরী, নৃপেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, শচীদুলাল ধর, তোয়ারেক আলী, আহমদ শফি, মাহবুব হোসেন খান, এবং শেষে বর্তমানে রাজনীতিবিদ আবদুল মঈন খান। মুনিবুর আর নৃপেন এখানকার পাঠ অসমাপ্ত রেখে জার্মানীতে গিয়ে ডিগ্রী করেন।
কাজী রকীবুদ্দিন আহমদ ছিলেন স্বল্পভাষী, মৃদুকন্ঠ গোবেচারা চেহারার মানুষ। এখনো তাই। তাঁকে সব দুপুরে দেখা যেত আরাম করে হলের ডাইনিং রুমে লুঙ্গী ঢিলা করে খেতে। তখন খাওয়া বলতে ছিল প্রতি দিন প্রতি বেলায় প্রায় একই - ভাত, একটা সবজি, একটা ছোট্ট কই মাছ, এবং প্রচুর ডাল। সেই ডাল পানির মত তরল এবং অফুরন্ত। ক্ষুধার্তকে পেট ভরাতে হতো ডাল দিয়ে। রকীব সাহেবের দিকে তাকালে দেখা যেত প্লেট উঠিয়ে কাত করে পরম তৃপ্তির সাথে ডাল খাচ্ছেন।
সেই ব্যাচে কেমিস্ট্রির সেরা ছাত্র ছিলেন মুহিবুর রহমান। তিনি অনার্স এম এস সি দুটিতেই প্রথম হন এবং কমনওয়েলথ স্কলারশিপ পেয়ে কেম্ব্রিজ থেকে পি এইচ ডি করেন মাত্র আড়াই বছরে। ঢাবিতে ফিরে এসে কিছুটা স্বতন্ত্র মেজাজের মুহিব কোন দল থেকেই ভালো সমর্থন পান নি। একবার ডীন নির্বাচনে একলা দাঁড়িয়ে পাঁচ ভোট পেয়েছিলেন।
রকীব সাহেব লীগের সমর্থক ছিলেন, কিন্তু সক্রিয় রাজনীতি করেন নি রাজ্জাক, তোফায়েলের মত। মুহিব বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরী পেলেন। আকমল, রকীব সিভিল সার্ভিসে গেলেন। দুজনেরই নিয়মিত উন্নতি হয়েছে, কিন্তু কখনোই খুব আকর্ষণীয় পদ পান নি। অবশেষে অবসর নেয়ার বেশ কিছু বছর পরে রকীবকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার পদে দেখে অনেকেই খুব বিস্মিত হয়েছে। সাঈদ বা শামসুল হুদা সাহেবের মত তাঁকে খুব ব্যক্তিত্বসম্পন্ন স্বকীয় চিন্তার অধিকারী মনে হয় নি। নিতান্তই গোবেচারা, ডাল-ভাত। এখনো মাঝে মাঝে টিভিতে যখন গলা উঁচু করে খুব দৃপ্ত ভঙ্গীতে কিছু বলার চেষ্টা করেন, নিজের ক্ষমতা ও স্বাধীনতা প্রমাণ করতে চান, গলা থেকে মিহি চিঁ চিঁ আওয়াজে ফজলুল হক হলের ইস্ট হাউজের প্লেট মুখে তুলে ডাল খাওয়া নিরীহ তরুণের কথাই অনেকের মনে পড়ে।
শেখ হাসিনা বিরাট ভুল করেছিলেন শাহাবুদ্দিনকে আবার কেয়ারটেকার সরকারের ভার দিয়ে। শাহাবুদ্দিন একজন বুদ্ধিমান কিন্তু সৎ সাহসী মানুষ ছিলেন। ব্যক্তিগত সম্পর্ক ভালো ছিল বটে, কিন্তু তিনি হাসিনার সাজানো নির্বাচনী লোকবলের চেহারা কয়েক ঘন্টার মধ্যেই বদলে দেন। গণভবন আনাড়িভাবে দখল করার চেষ্টা এবং অন্যান্য কারণে মানুষ অনুকূল ছিল না। তারা আবারো পরিবর্তন চাইল। খালেদা ক্ষমতায় এলেন ২০০১ সালে। এবার হাসিনা থিঙ্ক ট্যাংকে বিদেশী বন্ধু নিলেন। নিজেও কিছু বুদ্ধি অর্জন করেছেন। যে যায় ক্ষমতায় সে-ই হয় রাবণ, জনগন যদি এই রকম চিন্তা করে তাহলে সেই চিন্তা ব্যবহার করার সুযোগ ধ্বংস করে দিতে হবে। সুপ্রীম কোর্টের সিনিয়র বিচারক শাহ আবু নাঈমকে বাদ দিয়ে খায়রুল সাহেবকে করলেন প্রধান বিচারপতি। খায়রুল সাহেব কৃতজ্ঞতায় গলে গেলেন। এ ছাড়া প্রধান মন্ত্রীর রিলিফ ফান্ডের থেকে সাহায্য পেলেন। প্লট পেলেন। অনেক পরে আবার ল কমিশনের চাকরীও পেলেন। বিনিময়ে তাঁকে শুধু ঘোষণা করতে হলো কেয়ারটেকার সরকার অবৈধ। জনমত যাচাই করা হলো না। তাহলে বিপদ হতো। খায়রুল সব কাজ নিরাপদে করলেন। রায়ের দু লাইনে দুর্বল দ্ব্যর্থতা ছিল, পরে তা-ও সাফ করে দিলেন।
রকীবুদ্দিনের জন্য কি অপেক্ষা করছে? জনতার মঞ্চের আওয়ামী নেতা মিনমিনে গলায় প্রথমে বললেন - সেনাবাহিনী থাকবে ২৮ তারিখের স্থানীয় সরকার নির্বাচনে। ওপর থেকে খেলেন এক রাম ধমক। এবার ব্যাখ্যা করলেন - শহরের মাঝখানে ক্যান্টনমেন্ট, সুতরাং সেনা বাহিনীর জন্য ওটাই উপযুক্ত স্থান।
ডালে অনেক প্রোটিন আছে। কিন্তু পানির মত তরল ডালে না। আর প্রোটিন ডেফিশিয়েন্সীতে মস্তিষ্কের গঠন ব্যাহত হয়। রকীব সাহেব, আপনি হাসিনার কাছ থেকে যা-ই পান না কেন, মৃত মস্তিষ্ক সঞ্জীবক পাবেন না। অবশ্য যেদেশে ভাড়ায় খুন করার জন্য সেনাবাহিনীর মানুষও পাওয়া যায়, সেখানে আরো অনেক সস্তায় নির্বাচন জেতাবার ব্যবস্থাও হয়তো করানো সম্ভব। দুষ্টবুদ্ধির কেন্দ্র আর শহরের কেন্দ্র এক না-ও হতে পারে।
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে এপ্রিল, ২০১৫ সকাল ৭:৩৩
১. ২৭ শে এপ্রিল, ২০১৫ দুপুর ১২:৪০ ০