১
ডাক্তার হিসেবে আমার চেম্বার প্র্যাক্টিস আহামরি কিছু না। আবার নেহাত কমও না। আসলে আমাদের, আই মিন সার্জনদের আসল ইনকাম হয় অপারেশান থেকে। তবে কার্ডিয়াক সার্জারী যেহেতু কেবল শুরু হচ্ছে, তাই এখনও সেভাবে কেউ আমাদের কাছে করাতে চায় না। একটু পয়সা থাকলেই ইন্ডিয়া দৌড়ায়। সরকারী হাসপাতালে হাত পাকাচ্ছি। বাইরে থেকে বছর দুয়েকের ট্রেনিংও নিয়ে এসেছি। আর সম্প্রতি নিজে প্রাইভেটলি অপারেশান শুরু করেছি। গ্রুপে অবশ্য আগে থেকেই করতাম।
এনিওয়ে, আজকে স্পেশাল দিন। আমাদের ছোটবেলার বন্ধু নাদিম ইউ এস থেকে ফিরেছে। সেই উপলক্ষে বন্ধুরা আজ একটা গেট টুগেদার অ্যারেঞ্জ করেছি। সেই উপলক্ষ্যে চেম্বারে আগে থেকেই ফোন করে জানিয়ে দিয়েছিলাম, যেন বেশি সিরিয়াল না রাখে। আজকে অপারেশানও রাখিনি। আমাদের টিমের একটা ওপেন হার্ট ছিল, বারণ করে দিয়েছি। বলেছি, এই উইকটা আমি অ্যাভেইলেবল না।
যাই হোক, তাড়াহুড়া করেই রুগীগুলো দেখছিলাম। দুএকটা সার্জিক্যাল কেস ছিলও। বিভিন্ন ইনভেস্টিগেশান দিয়ে এক সপ্তাহ পরে ডাকলাম। আমার অ্যাটেন্ডেন্ট জানাল, আর একটা রুগী আছে। এমন সময় রুবেলের ফোনটাও আসল।
রুবেল এখন আছে একটা ব্যাঙ্কে। ব্র্যঞ্চ ম্যানেজার। তাগাদা দিতে ফোন করেছে। জানাল সবাই নাদিমের বাসায় পৌঁছে গেছে। আমিও জানালাম ‘অনলি হাফ অ্যান আওয়ার।‘
আসলে আমাদের এই ফ্রেন্ডগ্রুপটা বেশ অনেকদিন পরে একসাথে হচ্ছি। আমাদের গ্রুপের মধ্যমণি ছিল নাদিম। যাকে বলে ড্যাশিং হিরো। ইন্টারমিডিয়েটের পরে আমি আর সোহেল চলে আসি মেডিকেল লাইনে। খোকন যায় ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে। আর বাকী সবাই ইউনিভার্সিটিতে। আলদা আলদা হয়ে গেলেও, একে অন্যের এলাকায় প্রায়ই ঢুঁ মারতাম।
বেশিরভাগ আড্ডা মারতে যেতাম ইউনিভার্সিটিতে। নাদিম তখন রীতিমত প্লেবয় লাইফ লিড করছে। আজ এই মেয়ের সাথে ঘোরে তো কাল আরেকজনের সাথে। হ্যান্ডসাম তো ছিলই। সাথে বাপের ছিল অগাধ পয়সা। নিজে কার ড্রাইভ করে ভার্সিটিতে আসত। দামী হোটেলে ট্রিট দিত। ফলে ওর সাথে ঘোরার জন্য মেয়ের অভাব কখনই হত না।
সেই নাদিম এখন রীতিমত স্ত্রৈণ কিসিমের স্বামী। যাকে বলে বউয়ের কথা ওঠবস করা, সেই টাইপ। স্মোক করা যাবে না, ড্রিংক করা যাবে না, সময় করে বাসায় ফিরতে হবে। ভয়ঙ্কর অবস্থা। সেই বউ আজ নিজের বাপের বাসায় থাকবে। সুযোগটা মিস করার প্রশ্নই ওঠে না। আমি নিজেও অস্থির হয়ে দরজার দিকে তাকিয়ে আছি। কখন শেষ রুগীটা দেখব, আর কখন বেরোব।
২
মহিলাকে কেমন চেনা চেনা লাগছিল। কোথায় যেন দেখেছি। পিন পয়েন্ট করতে পারছিলাম না। এদিকে মহিলার চাহনিতে কিছু একটা ছিল। মনে হল, আমাকে চিনতে পেরেছে। নট আনলাইকলি। হাসপাতাল আর চেম্বার মিলিয়ে প্রতিদিন এতোজন রুগী দেখি। হতেই পারে আগে হয়তো কখনো কোন রুগীর সাথে এসেছিল। পুরনো রুগীও হতে পারে। কিংবা ট্রেনিং করার সময়ে কখনো এর চিকিৎসা করেছি।
যাইহোক, এনিয়ে মাথা ঘামাবার মত অবস্থায় আমি এখন নেই। আর তাছাড়া, এধরনের সিচুয়েশান হ্যান্ডল করার জন্য আমার নিজস্ব একটা ফর্মুলা আছে। সাধারণতঃ আমি আগ বাড়িয়ে ‘চেন চেনা লাগছে’ টাইপ কথা বলতে যাই না। রুগী ক্লু দিলে, বা মনে করিয়ে দিলে, তখন স্মৃতি আরেকবার ঝালিয়ে নেয়ার চেষ্টা করি।
মহিলা তেমন কিছু করলেন না। সব রুগীকেই আমি সালাম দিয়ে আমার ইন্টারভিউ শুরু করি। উনারা রুমে ঢোকার পরে হাতের ইশারায় উনাদের বসতে বললাম। মহিলার পোশাক আশাক বলে দিচ্ছে, মধ্যবিত্ত ফ্যামিলির।
জানতে চাইলাম, ‘সমস্যা কার?’
উত্তর পেলাম। মহিলা রুগী না। রুগী উনার ছেলে। একজন কার্ডিওলজিস্ট রেফার করেছেন। উনার প্রেসক্রিপশানে ডায়াগনসিস লেখা আছে। হার্টে ছিদ্র আছে। পরীক্ষাও বেশ কিছু করা ছিল। আমার ধারনা মহিলা জানেন, কি হয়েছে তাঁর ছেলের। তারপরও কথাটা জিজ্ঞেস করলাম। উনি মাথা ঝুঁকিয়ে সম্মতি জানালেন।
সো, অপারেশান করতে হবে জেনেই এসেছেন। এই ছিদ্র রিপেয়ারে আমি মোটামুটি অভিজ্ঞ। বাংলাদেশে যারা এই অপারেশান পারে, আমি তাদের মধ্যে সবচেয়ে কম টাকা চার্জ করি। সেকারণেই সম্ভবতঃ এই মহিলার আগমন। জানালাম,
--অপারেশান করতে হবে। সরকারী হাসপাতালে করলে তিনমাস পরে ডেট পড়বে। আর ছেলেটার যা অবস্থা, বেশি দেরি করলে, অপারেশান করেও আর লাভ হবে না।
--প্রাইভেটে করলে কত পড়বে?
হাসপাতালের কার্ডটা এগিয়ে দিয়ে বললাম
--অনেক ধরনের প্যাকেজ আছে। ওদের সাথে কথা বলে ফাইনাল করুন।
আমার কথার ভেতরে একটা নির্মমতা ছিল। বুঝিয়ে দিয়েছিলাম, টাকার ব্যাপারে আমি কনসেসান করব না। ব্যাপারটা মনে হয় উনি বুঝলেনও। মহিলা কিছুটা অসহায়ভাবে আমার দিকে তাকিয়ে থাকলেন। এই চাহনির মানে, ‘আমার এতো টাকা নেই’। আমারও তেমন কিছু করার নেই। বারগেইনিং এর কাজটা আমার খুব বিরক্তিকর লাগে। তাই প্রাইভেট যে হাসপাতালে আমি অপারেশান করি, সেই হাসপাতালের ঠিকানা দিয়ে ভর্তি হয়ে যেতে বলি। টাকার কথাবার্তা রিসেপশানিস্ট করে রাখে। আমার জন্যও ব্যাপারটা সুবিধার।
এটাই যেহেতু শেষ রুগী ছিল, তাই রুগী বেরিয়ে যাওয়ার পরে দ্রুত সবকিছু গুটাতে শুরু করলাম। অ্যাপ্রনটা খুলে কোটটা পড়ে নিলাম। বেল বাজিয়ে আমার রুম অ্যটেন্ডেন্টকে ডাকলাম। জিজ্ঞেস করলাম, --শেষ যে রুগীটা দেখলাম, উনি কি চলে গেছে?
মাথা দুদিকে নেড়ে, না সূচক উত্তর দিল। ওর হাতে একটা ডিসকাউন্ট কার্ড ধরিয়ে দিলাম। কোন রুগী যদি হাসপাতালে এই কার্ড দেখায়, তবে তার জন্য আরও টুয়েন্টি ফাইভ পারসেন্ট ডিসকাউন্ট থাকে। অ্যান্ড দ্যাট ওয়াজ অল আই কুড ডু। ছেলেটা বেরিয়ে গেল।
দ্রুতপায়ে যখন চেম্বার থেকে বেরোচ্ছি, তখন দেখি মহিলা বাইরে চেয়ারে বসে আছেন। আমার দিকে এক ঝলক তাকাল। মনে হল আরও কিছু বলতে চায়। আর সম্ভব না। যা করার করেছি। এই চোখের পানির ফাঁদে একবার পড়লে, আর বেরোতে পারা যায় না। প্রথম দিকে পা দিতাম, এখন আর পা দিই না। ‘ঘোড়া ঘাস সে দোস্তি কারেগা তো খায়েগা ক্যা?’।
এদের সবারই কিছু না কিছু দুঃখের গল্প থাকে। আর বোঝাতে গেলেই এরা পেয়ে বসে, ধরেই নেয়, ডাক্তার নরম হয়ে এসেছে। ‘জমি বেচে এই কয়টা টাকাই পেয়েছি’ আর নয়তো ‘স্যার আমরা খুব গরীব’ টাইপ ব্যাপারগুলো এখন তাই বিরক্তিকর লাগে। এধরনের কথাবার্তার তো আসলে কোন উত্তর হয় না। তাই মহিলার দিকে আর না তাকিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম।
কাজটা করলাম ঠিকই, কিন্তু চাহনিটা মনে আঁটকে গেল। ‘ওকে কোথায় দেখেছি’ চিন্তাটা মাথা থেকে সরাতে পারলাম না। কোথায় দেখেছি এই মহিলাকে। গাড়িতে উঠে সিটে হেলান দিয়ে আবিষ্কার করলাম, মাথায় ঝড় শুরু হয়েছে। মন বলছে, রুগী সম্পর্কিত ব্যাপারে না। অন্য কোনভাবে চিনি এই মহিলাকে।
বাচ্চার বয়স আট। সো অ্যারাউন্ড টুয়েন্টি থ্রি ফোরে যদি বিয়ে হয়ে থাকে, তাহলে অ্যারাউন্ড থার্টি টু থ্রি হবে। দ্যাট মিনস, বয়সে আমাদের সমসাময়িক বা দুএকবছরের ছোট হবে। বাট কোথায়? কবে? মনে আসি আসি করেও আসছে না।
এসব ভাবতে ভাবতে দেখলাম একসময় নাদিমের বাসায় পৌঁছে গেছি। অনেকগুলো গাড়ী রাস্তার ধার ধরে পার্ক করা। মনে হচ্ছে সবাই এসে গেছে। আমি নামলাম।
অনেকদিন পরে নাদিমের বাসায় আসা। যেবার ও লাস্ট এসেছিল, তখন এমন জমায়েত হয়েছিল। সেটাও পাঁচ বছর তো হবেই। নাদিমের বাসাটা ছিল তখন দোতলা। আর তিনতলায় ছিল একটা রুম। উইথ অ্যাটাচ বাথ। তিনতলার এই রুমটায় নাদিম থাকত। সেই সঙ্গে, এটা ছিল আমাদের আড্ডাখানা।
বেশ অনেকখানি এলাকা নিয়ে ওদের এই বাসাটা। মূল বাসাটা রেখে দিয়ে বাকী অংশটা ডেভেলপারকে দিয়েছিল। সেখানে বিশাল অ্যাপার্টমেন্ট হয়েছে। তবে নাদিমের বাবা মা উনাদের আগের বাসাটাতেই থাকেন। আজকের আড্ডাটাও হচ্ছে নাদিমের চিলেকোঠার সেই রুমে।
উত্তেজনার কারনেই বোধহয়, দ্রুত সিঁড়ি দিয়ে উঠতে শুরু করলাম। ফলে তিনতলায় যখন পৌঁছলাম, আমি তখন রীতিমত হাপাচ্ছি। দরজা খোলাই ছিল। বিছানায় নাদিম আধশোয়া হয়ে আছে। বাকীরা সবাই ওকে ঘিরে গল্প করছে। দৃশ্যটা দেখে একটা ঘটনাই ঘটল। মনে পড়ে গেল মহিলাকে কোথায় দেখেছি।
৩
আননোন নাম্বার থেকে ফোন। ধরব কি না একবার ভাবলাম। বেশ কয়েকজন ডাক্তারের কাছে থ্রেটনিং কল আসবার পরে এমন আননোন নাম্বার থেকে আসা ফোন ধরা বন্ধ করে দিয়েছি। আর তাছাড়া এমন জমজমাট আড্ডায় ফোন ধরতে কার ভাল লাগে? ফোনটা কেটে দিলাম। কিছুক্ষণ পরে আবার আসল। মনে হয় না থ্রেটনিং কল। ইউজুয়ালি আমি কোন রুগীকে পারসোনাল নাম্বার দিই না। তারপরও কেমন করে যেন যোগাড় করে ফেলে এরা। আমার গেটের অ্যাটেন্ডেন্ট সম্ভবতঃ কাজটা করে। টাকা পেলেই দিয়ে দেয়। আমার গাট ফিলিং বলছে, এটা কোন রুগীর ফোন।
আবার কেটে দিলাম। ফোনটা সুইচড অফ করে রাখা দরকার। অন্ততঃ এই আড্ডার সময়টা। কাজটা করতে যাব, এমন সময় ম্যাসেজটা ভেসে উঠল মোবাইলের স্ক্রিনে। ঐ একই নম্বর থেকে এসেছে ম্যাসেজটা। দুটো শব্দ লেখা। ‘আমি সোফিয়া’।
বুকটা ধক করে উঠল। তার মানে মেয়েটাও আমাকে চিনতে পেরেছে। আর চিনে থাকলে ঘটনাটাও ভুলে যাওয়ার কথা না। ব্যাপারটা জানাজানি হলে কি হবে, ভাবতেই হাত পা গুটিয়ে আসবার যোগাড় হল। ভয়ে পাংশু হয়ে যাওয়া মুখটা সবার চোখেই পড়ল। তবে সোহেল প্রশ্নটা করল
--কি হল?
উত্তরে কিছু না বলে ফ্যাকাশে একটা হাসি দিলাম। এরপরে নাদিমের দিকে তাকালাম। সেই দৃষ্টিতে কিছু একটা ছিল, নাদিম বুঝে ফেলল, আই অ্যাম ইন ট্রাবল। বিছানা ছেড়ে উঠল। হাসি হাসি মুখ করে আমার দিকে এগিয়ে আসল। জড়িয়ে ধরে গ্রিট করল। আর মুখটা কানের কাছে এনে চাপা স্বরে জানতে চাইল
--এনি প্রব্লেম?
আমিও চাপা স্বরে বললাম
--ছাদে আয়।
এরপরে রুমের বাকী সবাইকে ‘এঞ্জয় ইয়োরসেলফ’ বলে আমি আর নাদিম বাইরে ছাদে বেরিয়ে আসলাম। ‘কেমন আছিস’ টাইপ কথা বলার মুডে আমি নেই। নাদিমও সেদিক দিয়ে গেল না। চুপ করে সামনে দাঁড়িয়ে থাকল। আমি ধীরে ধীরে চোখ তুলে ওর দিকে তাকালাম। অস্ফুটে কোনরকমে বললাম
-- একবার আমার বার্থডেতে তোর এক গার্লফ্রেন্ড আমাকে গিফট করেছিলি, মনে আছে? আমরা সবাই মিলে রেপ করেছিলাম মেয়েটাকে।
শেষ
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই অক্টোবর, ২০১৮ বিকাল ৪:৪৬