১
তিথির সাথে দেখাটা হঠাৎ করেই। চিনতে অসুবিধে হয়নি। দেখতে একেবারে আগের মতই আছে। সেই ফিগার, সেই শার্প চেহারা। বরং একটু সুন্দর হয়েছে মনে হচ্ছে। চুলে বব কাট দিয়েছে। সেটায় আরও বেশি মানিয়েছে মনে হচ্ছে। স্মার্ট তো ছিলই। এখন তার সাথে যোগ হয়েছে সেক্সিনেস। সব মিলিয়ে দারুণ লাগছে। যাকে বলে অপ্রতিরোধ্য সুন্দরী। ওর দিকে তাকিয়ে সঙ্গে সঙ্গে চোখ ফেরানো, রিয়েলি টাফ।
এনিওয়ে, তিথির ছোট্ট একটা ইন্ট্রো দিয়ে নিই। তিথির সাথে পরিচয় কলেজ লাইফে। বয়েজ স্কুল শেষ করে কো এডে আসা কিশোর তখন আমি। একই কলেজে, একই সেকশানে। এমন পরিস্থিতিতে যা হয়, আমরা ছেলেরা যথারীতি হামলে পড়েছিলাম ওর উপরে। ‘হামলে' নট ইন ব্যাড সেন্স, ইন্টেরেস্টেড টাইপ। কেউ প্রেমের প্রস্তাব নিয়ে হাজির হয়েছিলাম, কেউ এগিয়ে গিয়েছিল ‘জাস্ট ফ্রেন্ড’ হতে। পেটে পেটে সবারই ইচ্ছে ছিল। কেউ সরাসরি বলে, ধাক্কা খেয়েছিল, আর কেউ মনে মনে ইচ্ছে পুষে রেখে, ‘জাস্ট ফ্রেন্ড’ রিলেশানশিপ নিয়ে কাটিয়ে দিচ্ছিল। আমি ছিলাম থার্ড ভ্যারাইটির। রোড সাইড রোমিও। আসতে যেতে ইভ টিজিং। আর ভবিষ্যৎ বাণী, ‘এই মেয়ে জীবনে সুখী হবে না’।
দেন হ্যাপেন্ড দ্যা আনথিঙ্ক্যেবল। ইংরেজির জন্য ব্যাচে প্রাইভেট পড়তে গিয়ে আবিষ্কার করলাম, আমি ঘণ্টা খানেকের জন্য স্বর্গের টিকিট পেয়েছি। স্যার ছিলেন শহরের নাম্বার ওয়ান ইংলিশ টিচার। তাই আগে থেকে সিরিয়াল দিয়ে রাখতে হত। উনি ডেকে নিতেন। আমার যখন ড্যাক পড়ল, দেখলাম, সেই আটজনের ব্যাচে, চারজন ছেলে আর চারজন মেয়ে। অ্যান্ড গেস হোয়াট, ইয়েস, শি ইজ ওয়ান অফ দেম। যথারীতি পড়াশুনা শিকায় উঠল। ভণ্ড প্রেমিকরা যা করে, সেসব শুরু করলাম। ফ্যালফ্যাল করে না তাকিয়ে, অন্যদিকে তাকানো শুরু করলাম। হাবভাব দেখাতাম, ‘আই অ্যাম নট ইন্টেরেস্টেড।’
পৃথিবীর তাবৎ সুন্দরী মেয়ের মত তিথিও ট্রিকটা জানে। ব্যাপারটায় শী অলসো ডিডন’ট রিয়াক্ট। কিছুদিন পরে দেখা গেল, আমি ছাড়া বাকীদের সাথে বেশ বন্ধুত্ব হয়ে গেল। আমি মাঝে মাঝে কথা বলতে গেলও, উত্তর পেতাম না। ইচ্ছে করেই কাজটা করত, আই থিঙ্ক। আমি তখন বেশ কনফিউজড। অপমান গুলো গিলে ফেলব? না… নো ওয়ে। অন্য অপশানটা মাথায়ও আনিনি। আই হ্যাভ টু ফাইন্ড অ্যা ওয়ে।
এরপরের গল্প পরে কখনও বলব। আপাততঃ এটুকু জানলেই হবে, উই ওয়ার কাপল। ইয়েস। ড্রিম কাম ট্রু টাইপ ব্যাপার। দুজনেই মেডিকেলে ভর্তি হই। আর এবারও একই ব্যাচে। এরপরের কাহিনী টিপিক্যাল মেডিকেল প্রেম। প্রথমে রিডিং পার্টনার, পরে সফটনেস। অ্যান্ড দেন…। ইয়েস। বিয়ের পিঁড়ি।
এরপরে শুরু হয় আমাদের ম্যারিড লাইফ। ছাত্র খারাপ ছিলাম না। সো, লেগে পড়লাম ডিগ্রী অর্জনে। তিথি অতোটা অ্যাম্বিশাস না হলেও, বাসায় বসে থাকা টাইপ ছিল না। সে ও লেগে পড়ল, তবে পাবলিক হেলথে। ওর ডিগ্রী আগে হল। একটা এনজিওতে ঢুকে গেল। আমি তখনও পড়াশোনার মাঝপথে।
যাইহোক। আজকের ঘটনায় ফিরি। আজ প্রায় এক বছর পরে ওর সাথে দেখা। তাও আবার আমি যখন থাইল্যান্ড যাওয়ার জন্য শাহ জালালে ওয়েট করছি, তখন।
বোর্ডিং পাস নিয়ে ভেতরে বসে আছি। আমাদের অ্যানাউন্সমেন্ট এখনও হয়নি। বড়সড় একটা টিম যাচ্ছে। ডাক্তারদের টিম। বাই দ্যা ওয়ে, আমার পুরো পরিচয় দেয়া হয়নি। নাম সেলিম। পেশায় হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ। অ্যান্ড বিবাহিত। একটা মেয়ে আছে। আরেকজন পথে। উনার জেন্ডার এখনও জানি না। ওয়াইফ সীমা। সুন্দরী। গৃহিণী টাইপ।
সো? কাহিনীতে মুভ অন করি। আমরা, গ্রুপের ডাক্তাররা যখন লাউঞ্জের চেয়ারে বসে ফ্লাইটের জন্য যখন ওয়েট করছি, তখন পাশের প্যাসেজ দিয়ে তিথি এগিয়ে যাচ্ছিল। সানগ্লাসটা মাথার ওপরে তোলা। পড়নে ফতুয়া আর জিনস। অদ্ভুত সেক্সি লাগছে। কিছুক্ষণ তো নষ্ট হল হতবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতে গিয়ে। যেহেতু এক্সিটের দিকে যাচ্ছে, তাই বুঝতে অসুবিধা হল না বাইরে কোথাও থেকে আসল। নিজের হ্যান্ডব্যাগ নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিল।
এগিয়ে না গিয়ে, 'এগিয়ে যাব কি না' ভাবনাটা যে মনে এসেছিল, তার কারণ, শি ইজ ম্যারিড। কিছুটা হেজিটেশান তাই কাজ করছিল। আর মনে মনে যা করছিলাম, তা হচ্ছে, ও একা, না সাথে আর কেউ আছে, ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা। মনে হচ্ছে একা। পাশের পুরুষটা মনে হচ্ছে না ওর সাথে আছে। বুঝতে কিছুটা সময় লাগলেও, বোঝার পরে আর দেরী করলাম না।
ছুট দিলাম। আমার বাকী সবকিছু লাগেজে দিয়ে দিয়েছি। সঙ্গে কেবল আমার হ্যাভারস্যাকটা। পাশের কলিগকে ‘এক্সকিউজ মি’ বলে সেটা নিয়েই এগিয়ে গেলাম। খুব একটা সামনে এগোয়নি। সো, একটু দ্রুত হেঁটে কিছুক্ষণের ভেতরেই পাশে চলে আসতে পারলাম। কিছুটা হাঁপাচ্ছিলাম। পাশে আমার উপস্থিতি টের পেয়েই তিথি আমার দিকে তাকাল। আমি তখনও কথা বলিনি। তিথি তখনও আমার দিকে তাকিয়ে আছে। মনে হল, ঠোঁটের কোণে একটা হাসি। আর কিছু প্রয়োজন নেই। আই গট দ্যা সিগন্যাল। মুখে হাসি টেনে জানতে চাইলাম
— চেনা যাচ্ছে?
তিথি চমকে উঠবে ভেবেছিলাম। ‘কতদিন পরে দেখা’ টাইপ কিছু বলে একটা অবাক এক্সপ্রেশান এক্সপেক্ট করছিলাম। তেমন কিছু হল না। বেশ শান্তভাবেই দৃষ্টি আবার সামনের দিকে ফিরিয়ে নিল। এরপরে বেশ গম্ভীরভাবেই বলল
— যাচ্ছিস? না আসলি?
রেগে আছে বলে মনে হল না। তবে আমাকে দেখে এমন ঠাণ্ডা রেসপন্সও আশা করিনি। এমন ভাব যেন, কথা বলতে হয় তাই বলা। কিছুটা খারাপও লাগলেও, নিজেকে নিরুৎসাহিত হতে দিলাম না। ও ঠিক কোথায় থাকে, জানি না। সো, আজকের এই সুযোগ মিস করলে আবার কখনও সুযোগ পাওয়া যাবে কি না কে জানে। অপমানটা তাই গিলে ফেললাম। মুখে তাই হাসি টেনে বললাম
— যাচ্ছি। একটা কনফারেন্স আছে।
ঠোঁটে বাঁকা হাসি টেনে বলল
— ওষুধ কোম্পানির টাকায় ঘুরতে যাওয়া বল।
তিথি নিজেও ডাক্তার। আর তাই আমরা ক্লিনিকাল সাইডে থাকা ডাক্তাররা যে বিভিন্ন ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানির টাকায় বিদেশ সফরে যাই, ব্যাপারটা ওর অজানা না। তবে ব্যাপারটা নিয়ে খোঁচা দেয়াটা জরুরী ছিল না। তারপরও দিল। জেলাসি হতে পার, আবার হতে পারে ঘৃণা।
তিথির পোস্ট গ্র্যাজুয়েশান পাবলিক হেলথে। ছাত্রী ভালোই ছিল। এই ফিল্ড কেন চুজ করল কে জানে। তবে করে খারাপ করেনি। প্রথমে কিছু এনজিও তে কাজ করে। পরে সুযোগ পেয়ে যায়, হু’র একটা প্রজেক্টে। এরপরের খবর অবশ্য আর জানি না। সেটাও আজ থেকে বছর খানেক হবে। এখনও নিশ্চয়ই ভাল কোথাও আছে। বিদেশ থেকে যখন ফিরছে।
পাবলিক হেলথ ফিল্ডে, যোগ্যতা, এক্সপেরিয়েন্সের সাথে আরেকটা ব্যাপার খুব কাজে দেয়। স্মার্টনেস। মেয়ে হওয়াটাও একটা অ্যাডভান্টেজ। তিথির এগুলোর সবটাই ছিল। বাঙ্গালি মেয়ে হিসেবে ও অনেকটা বেশিই স্মার্ট। চুপচাপ বসে থাকবার মেয়ে ও না।
যাই হোক, এখন তর্ক করার মুড নেই। খোঁচাটা মেনে নিলাম। অভিযোগটা স্বীকার করে নিলাম
— তা বলতে পারিস।
এক ঝলক আমার দিকে তাকিয়ে আবার সামনের দিকে তাকিয়ে এগিয়ে যেতে লাগল। এর মানে কি? ‘গুড বাই?’ তিথি যে জাতের ঠোঁটকাটা মেয়ে, কথাটা বলা অসম্ভব না। কথা অন্য কোনদিকে যেন না গড়ায়, দ্রুত তাই কথাটা জিজ্ঞেস করে ফেললাম
— তোর খবর?
আমি আর এগোতে পারব না। বুক ঢিপঢিপ করছে। আবার যোগাযোগের কোন টিপ দেবে কি না। এমন সময় হাতে যেন আকাশের চাঁদ পেলাম। তিথি থেমে গেল। আমার দিকে তাকিয়ে ভ্রু নাচাল। ঠোঁটে হাসি। স্মাইল না, দুষ্টুমির হাসি। এরপরে কথাটা বলল।
— এগেইন সিঙ্গেল।
বুকের ভেতরে অ্যাড্রেনালিন রাশটা টের পেলাম। হার্ট অনেক বেশি জোরে আওয়াজ শুরু করেছে। হার্ট বিট এক ধাক্কায় একশ বিশ ছুঁই ছুঁই করছে আই গেস। মনের ভাবটা লুকিয়ে রাখবার আপ্রাণ চেষ্টা করলাম। ব্যার্থ যে হলাম, তা বুঝতে পারলাম তিথির পরের কোথায়।
— অ্যাড্রেস চাই?
তিথি এরকমই। টু দ্যা পয়েন্ট। আমার চোখের চাহনি বুঝতে ওর সমস্যা হয়নি। কি চাইছি, সেটাও ও জানে। ইনফ্যাক্ট ‘অ্যাড্রেসে'র কথাটা ও সেজন্যই বলল।
এবার আমার রেসপন্সের পালা। ‘হ্যাঁ' বলাটাই উচিৎ ছিল। বাট পারলাম না। ভণ্ড প্রেমিকদের যা হয়, সবকিছু লুকিয়ে রাখতে চায়। ‘হ্যাঁ' সূচক উত্তরটা তাই দিলাম না। কিছুটা ভ্যাবাচ্যাকা দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলাম। এর মানে হচ্ছে, ‘চাই, তবে মুখে বলব না।'
আমার এই অপ্রস্তুত অবস্থার একটা কারণ অবশ্য আছে। আই অ্যাম অলসো নট সিঙ্গেল। তিথির সাথে ব্রেকাপের পরে, আমি নিজেও জীবনে এগিয়ে যাই। বিয়ে করি। সীমা নন মেডিকেল। টিপিক্যাল হাউজ ওয়াইফ। টিপিক্যাল মিনস টিপিক্যাল। ‘আজ এতো দেরী হল যে?’ টাইপ। সো, তিথির ব্যাপারটা ও জানতে পারলে, আইগেস, সংসারে ভয়ানক তোলপাড় শুরু হবে। ‘কি সম্পর্ক ওর সাথে?’ টাই প্রশ্ন করে করে আমাকে অতিষ্ট করে মারবে।
এদিকে তিথির প্রতি দারুণ এক আকর্ষণ অনুভব করছি। আর তাই ‘অ্যাড্রেস চাই’ প্রশ্নের উত্তর দিতে আমাকে আসলে খুব শক্ত একটা সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তিথির সাথে আবার সম্পর্কে জড়াবো? না জড়াবো না। আর সেটাই নিতে পারছি না।
নিতে পারছি না, বলাটা অবশ্য অনুচিত। আসলে মনে মনে চাইছি, কিন্তু মুখে স্বীকার করতে চাইছি না। আর এমন পরিস্থিতিতে যে অবস্থানটা নিলে সব কুল রক্ষা পায়, তা হল, আমি তো চাইনি। আর এখনও তাই চাইছি। ও নিজে থেকেই দিক। আমি না চাইলেও দিক। মোট কথা, সুযোগটা যেন মিস না হয়।
ব্যাপারটা তিথি বুঝল। আমি যখন কি করব ভাবছি, তখন মাথা থেকে সানগ্লাসটা চোখের উপর নামিয়ে নিল তিথি। এরপরে ঠোঁটে বাঁকা একটা হাসি ফুটিয়ে জানতে চাইল
— তোর সেল নম্বর কি আগেরটাই?
বুকের আওয়াজ আবার মাত্রা ছাড়াল। তবে মাথা এখনও কাজ করছে। পিছিয়ে আসবার এটাই শেষ সুযোগ। উত্তরে হ্যাঁ বললে কি অঘটন শুরু হবে, তা আমি জানি। তারপরও নিজেকে সংযত রাখতে পারলাম না। মাথা ঝুঁকিয়ে জানিয়ে দিলাম, ‘হ্যাঁ'। তিথি আর কথা না বাড়িয়ে এক্সিটের দিকে এগিয়ে গেল। সেই এগিয়ে যাওয়া পথের দিকে তাকিয়ে থাকলাম।
তিন বছর আগে, এভাবেই একদিন ও আমার জীবন ছেড়ে বেরিয়ে যায়, আদনানের সাথে। ঠিক বেরিয়ে যায় না, আমিই বের করে দিই। শী ওয়াজ ডুয়িং অ্যাডাল্ট্রি। অ্যান্ড ওয়াজ কট রেড হ্যান্ডেড।
আর আজ? মনে মনে হাসলাম। নিজেকে জিজ্ঞেস করলাম, অ্যাম আই ডুইং দ্যা সেম?
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা অক্টোবর, ২০১৮ দুপুর ১:১৫