পূর্বের পর্বগুলোর লিংক:
আগের সিরিজ: কানাডার স্কুলে একদিন (এক থেকে বাইশ): পর্ব বাইশ । পর্ব বাইশে অন্য সকল পর্বের লিংক রয়েছে!
আগের পর্ব: কানাডার স্কুলে একেকটি দিন (পর্ব ১) - বাংলাদেশীদের যেসব বিষয় বিদেশীরা অদ্ভুত মনে করে!
কানাডার স্কুলে একেকটি দিন (পর্ব ২) - মফস্বলের কন্যের বৈদেশে শিক্ষাগ্রহন; ঘটন অঘটন এবং আমাদের নিয়ে বৈদেশীদের দর্শন!
কানাডার স্কুলে একেকটি দিন (পর্ব ৩) - মফস্বলের কন্যের বৈদেশ ভ্রমণ; চলন ও বলন, এবং ভিনদেশ নিয়ে বৈদেশীদের দর্শন!
কানাডার স্কুলে একেকটি দিন (পর্ব ৪) - মফস্বলের কন্যের বৈদেশ ভ্রমণ; চলন ও বলন, এবং বৈদেশীদের নানা দর্শন!
কানাডার স্কুলে একেকটি দিন (পর্ব ৫) - ঈদ মোবারক সবাইকে! কিছু পাঠকের প্রশ্নের উত্তরে আজকের পর্ব : কেমন কাটে প্রবাসে ঈদ?
কানাডায় স্কুলে একেকটি দিন (পর্ব ৬): প্রেম পিরিতি: মফস্বল ও বৈদেশে সম্পর্কের ভাঙ্গন গড়ন এবং বৈদেশীদের চিন্তন দর্শণ!
শুরু করার আগে বলি, বাংলাদেশ ও দেশের সংস্কৃতিকে আলাদা করে অনেকেই জানেনা। ইন্ডিয়া, চায়নার মতো এশিয়ান দেশগুলোর ব্যাপারে জানে, এবং সেই স্টেরিওটাইপ নিয়ে বাংলাদেশীদেরও দেখে। যেমন আমরা ওয়েস্টার্ন কালচারকে এক দৃষ্টিতে দেখি। আমেরিকা, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, ডেনমার্ক, ইংল্যান্ড সব একই মনে হয় আমাদের কাছে। ছোটবেলার সেই ভাবনার মতো, পৃথিবীতে শুধু দুটো দেশ, ১) বাংলাদেশ; ২) বিদেশ! কানাডিয়ানরাও এশিয়া মানে এশিয়াই ভাবে, বাংলাদেশ, ইন্ডিয়া, জাপান, চায়না আলাদা করে ভাবার সময় অনেকেই পায়না। আমাদের কালচার এবং এশিয়ার অন্যান্য দেশের কালচার সবক্ষেত্রে এক নয়। আমি সেসব বিষয়ে বলব, যেসব ক্ষেত্রে কালচার এক। আমাদের কোন কোন বিষয় ওদের কাছে উইয়ার্ড বা অদ্ভুত সেসব আরকি!
-------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
হাতে থাকা ছোট্ট রিমোটটি টিপলাম। খুলল না। আবারো চেষ্টা করলাম, এবং খুলে গেল বিশাল গাড়ির পেছনের দরজাটি। পেছনে পরে থাকা বড় ও ভারী ব্যাগটি হাতে নিলাম। আসার সময়ে বেশ কয়েকবার চেক করলাম গাড়িটি ঠিকভাবে বন্ধ হয়েছে কিনা? তারপরে ব্যাগটি নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আশেপাশে তাকাতে থাকলাম। খুবই সুন্দর নিরিবিলি জায়গায় গ্যারেজটি। পা ভিজে যাচ্ছে শিশিরে। শীত আসি আসি করছে। সবকিছুতে নীরব স্নিগ্ধতা, একটা ভেজা ভাব! মিষ্টি একটা রোদ পরবে কিছুক্ষনেই। যে রোদে অস্বস্তিকর তাপ থাকেনা, কোমল একটি উষ্ণতা থাকে!
আমি তখন প্রথমবার টিএ হলাম স্কুলে E.S.L. ক্লাসে এক জার্মান টিচার এর আন্ডারে। তিনি বয়স্কা, মোটাশোটা, হাশিখুশি মহিলা ছিলেন। একদম ছোট থেকে কানাডায়। নিজের দেশে তেমন যাননি। একটি কারণে তাকে অনেকে পছন্দ করতনা। তিনি অন্যদেশের মানুষেদের মুখের ওপরে তাদের দেশের সমালোচনা করতেন। অন্যান্য বিদেশীরা হয়ত এসব মনে মনে ভাবে, কিন্তু মুখে ভদ্রতার খাতিরে কখনো আনে না। উনি আনেন এবং বেশ জোরেশোরেই আনেন।
ওনার হাতে দিলাম গাড়ির চাবি ও ব্যাগটি। আমাকে তার গাড়ি থেকে ক্লাসের জন্যে লাগবে এমন কিছু জিনিস আনতে দিয়েছিলেন। উনি থ্যাংকস বললেন। তারপরে কম্পিউটারের সামনে বসে ওনার দেওয়া কিছু কাজ করতে যাব তখন তিনি বললেন, "এদিকে এসো। আমরা নানা দেশের কথাবার্তার ধরন নিয়ে কথা বলছিলাম। একটু আগে কেরোলিন আর ভিক্টর নিজেদের ভাষায় কথা বলছিল। আমিতো ভাবলাম ঝগড়া করছে! পরে দেখি শপিং এ যাবার আলোচনা করছে!" এখানে বলে রাখা ভালো ওরা কলম্বিয়ার এবং কলম্বিয়ানরা জোরে কথা বলার জন্যে পরিচিত। তিনি বললেন, "এশিয়ানরাও তো তাই! একবার থাইল্যান্ডে গিয়েছিলাম। ওখানে রেস্টুরেন্ট, বাজারে, রাস্তায় দাড়ালেই মনে হতো কানের আশেপাশে মাছি ভনভন করছে। এত জোরে আর দ্রুত সবাই কথা বলে! কাইন্ডা উইয়ার্ড!" ওনাকে দেখে মনে হলো জোরে কথা বলার চেয়ে বিরক্তিকর কিছু আর নেই। যোগ করলেন, "আচ্ছা ব্যাংলাদেশে কেমন? তুমি তো বেশ সফটস্পোকেন, বাট আই বেট নট অল অফ ইউ আর!" বলে হো হো করে হেসে ফেললেন। আমি কিছু বললাম না। কিছুটা বিরক্তি লাগল। ওনার কথার মধ্যে খোঁটা দেবার প্রবণতা থাকত। অন্যদেশের যেকোনকিছু নিয়ে স্বত:স্ফূর্তভাবে অভিযোগ করতেন। আমরা এশিয়ানরা জোরে কথা বলি আর না বলি, ওনার তাতে কি?
কানাডিয়ানরা সবকিছু শান্তভাবে, ও বিনয়ের সাথে করতে পছন্দ করে। স্কুল হলে দুটো টিচার একে অপরের সাথে কথা বললে কানের কাছে মুখ নিয়ে ইশারায় আস্তে আস্তে বলতেন! আমি কাউন্সিলর বা টিচারের সাথে কোন কাজে তাদের অফিস রুমে গেলে একটা জিনিস খেয়াল করতাম। দরজাটা এত আস্তে বন্ধ করতেন মনে হতো একটু শব্দ হলে ভূমিকম্প হবে। আর কথা বলতেন এত মিহি সুরে যেন টেবিলে রাখা ফটো ফ্রেম/ডেকোরেশিন পিস ভেংঙ্গে পরবে একটু জোরে কথা বললেই! রাস্তা ঘাটে যতোই জ্যাম থাকুক আমাদের দেশের মতো প্যাঁ পুঁ শোনা যায় না। সবকিছুই নিরিবিলি। আমাদের কথা বলার পদ্ধতি এবং ভঙ্গিমা এজন্যে অনেক পশ্চিমি রুড মনে করে থাকেন। যদিও বিনয়ের দায়ে সেভাবে কিছু বলেন না। কিন্তু হাবেভাবে বোঝা যায়।
তখন সেমিস্টার ফাইনাল এসে কড়া নাড়ছে। এক মাস পরেই ফাইনাল। আমি খুব গুছিয়ে পড়াশোনা করতাম। ফাইনালের এক সপ্তাহ আগেই সব প্রস্তুতি শেষ করে রাখতাম। খুব রিল্যাক্সড রাখতাম নিজেকে পরীক্ষার আগে। লাস্ট মিনিটে পড়ে যারা পাস করে তাদের জন্যে আমার ভীষন সম্মান সবসময় ছিল, আছে। কেননা আমার পক্ষে তা কোনকালেই সম্ভব না। প্রায় বেশিরভাগ ক্লাসেই এসাইনেমন্ট সব শেষ করিয়ে রিভিউ করাচ্ছে। সময়টা একদিক দিয়ে খুব ব্যস্ত আবার একদিক দিয়ে খুব ফ্রি। পরীক্ষা আসছে আসছে ভাবনায় সবার মধ্যেই একটি চাঞ্চল্য দেখা যাচ্ছে। সবাই সিরিয়াসলি পড়ছে লাইব্রেরী ও স্কুলের নানা জায়গায় গোল হয়ে বসে। ফাঁকিবাজ ছাত্রদের হাতে অনেকদিন পরে বই নামক জিনিসটি দেখলাম এবং তারা এটিকে খুলতে জানে দেখে খুবই অবাক হলাম! হাহা। কিন্তু ব্যস্ততা কমও একদিক দিয়ে। কেননা সব এসাইনমেন্ট সাবমিট শেষ। কদিন পড়ে পড়ে টিচারদের অমক ডেটে ল্যাব, টেস্ট, এসাইনমেন্ট এসব শুনতে হচ্ছে না। জাস্ট নিজের মতো করে জানা জিনিসগুলো আবার জানা।
এরই মধ্যে E.S.L. ক্লাস টিচার মিসেস ডি আমাদের বললেন, "জানি তোমাদের পরীক্ষা এগিয়ে আসছে। এজন্যে এখন ট্রিপের আয়োজন করতে চাইনি, পরে মনে হলো ফাইনালের পরে ছুটি পরে যাবে। আর তোমরা এমেইজিং ট্যুরটা মিস করবে। আর একদিনই তো!" বলে উজ্জ্বলভাবে হাসলেন!
বাড়িতে এসে মা কে ফর্ম দিলাম যাতে সাইন করতে হবে যে স্টাডি ট্যুরে পাঠাতে রাজি। মা বলল, "কয়েক মাস আগেই তো ঠান্ডায় ট্যুরে গিয়ে জ্বর বাঁধিয়েছিলি। ফাইনালের আগে আগে আর শীতে পাঠাব না। ফাইনালে ভালো মার্ক জরুরি!" আমি হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লাম। পরেরদিন লাঞ্চ আওয়ারে মিসেস ডি কে বলতে গেলাম যে আমি যাচ্ছিনা। গিয়ে দেখি কিছু কোরিয়ান, জাপানিজ স্টুডেন্ট অলরেডি একই আর্জি নিয়ে দাড়িয়ে! আমিও ওদের সাথে দাড়ালাম। উনি বললেন, "লুক, স্টাডি ইজ নট এভরিথিং, এসব অভিজ্ঞতাও জরুরি।" বাকি ছেলে মেয়েরা তবুও মাথা নাড়ল যে যাবে না। আমিও তাই করতে চাচ্ছিলাম কিন্তু বেয়াদবী হবে কিনা ভেবে চুপ থাকলাম। উনি হতাশ হয়ে বললেন, "তোমাদের কালচার একটু অন্যরকম। আমরা সবসময় নতুন কিছু ট্রাই করতে পছন্দ করি। শোন মজার ঘটনা, একবার অস্ট্রেলিয়ায় গিয়ে একটি খাবার খাই, খুবই বাজে লেগেছিল প্রথমে। কিন্তু কবার মুখে নিয়ে খুবই টেস্টি লাগল, এডিক্টেড হয়ে গেলাম খাবারটিতে! কিন্তু চাইনিজরা অস্ট্রেলিায় গেলে প্রথমে চায়না টাউন খুঁজবে চাইনিজ ফুডের জন্যে। ইন্ডিয়ান, ব্যাংলাদেশীরা নিজ দেশী রেস্টুরেন্ট! ইটস উইয়ার্ড টু লিভ ইন আ কান্ট্রি এন্ড নট এক্সপেরিয়েন্স ইট!" ব্যাংলাদেশী বলার সময়ে আমার দিকে তাকালেন। আমি মনে মনে ভাবছি তোমাদের তেল মশলা ছাড়া খাবার ট্রাই করতে বয়েই গেছে! হাহা। তিনি মাথা নাড়তে নাড়তে বললেন, "এটা ঠিক না! কানাডিয়ান স্টুডেন্টরা লাফাতে শুরু করত এ সময়ে এমন একটা ট্যুর পেলে। তোমরা অনেক লাকি!" অসন্তুষ্ট হয়েছেন বুঝতে পারছিলাম। ভাবলাম যাই, একদিনই তো! কিন্তু বেশি স্নোফলের কারণে ট্যুরটা নিজেই ক্যান্সেল হলো!
প্রথম প্রথম কানাডিয়ানদের এই জোর করাটা বিরক্তি লাগত। সব টিচার এমন ছিলেন না, কিন্তু অনেকেই আমাদের এশিয়ান স্টুডেন্টদের পেছনে লেগে থাকতেন। তাদের মনে বদ্ধমূল ধারণা আমরা জীবনকে এনজয় করতে জানিনা। তাদের কাজ আমাদেরকে শেখানো। তাদের কাছে, "ট্রাই সামথিং নিউ!" শুনতে শুনতে কান পেকে যেত। ক্লাব, স্পোর্ট, ট্যুরে ধরেবেঁধে পাঠাতে চাইতেন। বাড়িতে বাবা মা তো এশিয়ানই, তারা একরকম চাইতেন। ঝকঝকে রিপোর্ট কার্ড হলেই তারা খুশি, আর কিছু না। আর স্কুলের টিচারেরা অন্যরকম। মার্ক কম হলেও আমরা যেন হাসিখুশি থাকি তাই চাইতেন তারা। দুটোতে ভালোই স্যান্ডউইচড হতাম আমরা। আমরা বলতে আমিই শুধু না, চাইনিজ, কোরিয়ান, জাপানিজ কালচার তো আমাদের চেয়েও স্ট্রিক্ট মনে হতো!
তেমনই এক সময়ে আমাদের ম্যাথ ক্লাসে ফাইনালের আগে স্টুডেন্টরা কত পেল সেটা একটা কাগজে প্রিন্ট করে ক্লাস দেওয়ালে টাঙ্গিয়ে দেওয়া হলো। সেই ক্লাসে ছিল একটা ছেলে নাম কোডি! খুবই বাচ্চা টাইপ ছেলে ছিল চেহারা ও আচরণে। চশমা পড়া, সাদামাটা চেহারা। ভীষনই দুষ্টু। টিচারদের সাথেও বন্ধুর মতো! ও সেদিন আমাকে মার্ক জিজ্ঞেস করল। বললাম। আমার পেছনেই বসা চাইনিজ ছেলেটিকে জিজ্ঞেস করল, সেও বলল। আমাদের মার্ক শোনার পরে বলল, "কুললল! তোমরা ফাইনাল না দিলেও পাশ করে যাবে!" আমি মুচকি হাসলাম। আর চাইনিজ ছেলেটা বেশ ভাবমার্কা হাসি দিল।
আর কোডির মাথায় মনে হয় কিছু দুষ্টুমি বুদ্ধি এলো। ও আমাদের ম্যাথ টিচার মিসেস: হলকে বলল, "এশিয়ান কিডস আর স্মার্টার দ্যান আস! তারা সবসময় বেস্ট মার্ক পায়। দিজ ইজ নট ফেয়ার!" টিচার বললেন, "সব জাতির নিজের নিজের প্রায়োরিটি থাকে। ওরা পড়াশোনাকে অনেক সিরিয়াসলি নেয়। কিন্তু আমরা কানাডিয়ানরাও কম না! আমরা জীবনকে এনজয় করি। উই আর নোন টু লিভ আওয়ার লাইফ টু ফুলেস্ট!" কোডি টিচারের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে আমাদের শুনিয়ে শুনিয়ে বলল, "তার মানে এশিয়ানরা স্মার্টার, আর আমরা মোর ফান?" আমি প্রতিবাদ করলাম, "নাআআ, আমরাও ফান!" ও তখন খিলখিল করে হেসে বলল, "তুমি বলতে চাচ্ছ মিসেস হল ভুল বলছেন?!" আমি ওর দিকে না তাকিয়ে টিচারকে বললাম, "মিসেস হল আমরাও জীবনকে এনজয় করতে পারি!" উনি হাসতে হাসতে বললেন, "আচ্ছা, এশিয়ানরা স্মার্ট, ফান দুটোই, আমরা কানাডিয়ানরা শুধু ফান, ওকে? হ্যাপি নাও?" আমি বললাম, "না, আপনারাও দুটোই!" সবাই হেসে ফেললাম তারপরে!
যতোই আমরা দুটোই দুটোই বলি, আসলেই সব জাতির আলাদা কিছু বৈশিষ্ট্য থাকে। কানাডিয়ানদের পুরো ভাবভঙ্গিতে একটা কুল এপ্রোচ থাকে। এখানে স্কুলে শিক্ষার্থীদের রোল নাম্বার থাকেনা। সেই প্রথম হবার কোন টেনশন কারোর মধ্যেই কাজ করেনা। বড় হয়েও কর্মক্ষেত্রে কাউকে পায়ের তলায় পিষে এগোনোর প্রবণতা থাকেনা। সবাই সবাইকে সাহায্য করে। প্রতি উইকেন্ডে দূরে কোথাও বেড়িয়ে আসে। টাকা জমানোর প্রবণতা কম, যা থাকে খরচ করে আজটাকে এনজয় করে। আমরা বাংলাদেশীরা কেমন তা তো আর বলতে হবেনা। এর উল্টোটা। ওরা খুবই উইয়ার্ড মনে করে আমাদের সবকিছুতে সেইফ থাকার প্রবণতাকে! নতুন খাবার হোক বা নতুন কোন ব্যাবসা/ক্যারিয়ার আমরা সচরাচর রিস্ক নিতে চাইনা!
মজার ব্যাপার হচ্ছে প্রথম প্রথম আমার কাছে মনে হতো ওরা এমন কেন? কিন্তু অনেকদিন থাকার পরে মনে হতো, আমরা এমন কেন? ওদের মতো সহজ সরলও তো হতে পারত আমাদের জীবনের প্রতিটি স্তর। কেন আমরা সবাই এত আলাদা? এক দুনিয়ার ভেতরে কেন এত দুনিয়া? আমার ব্রাজিলিয়ান বান্ধবী জের মনেও একই সব প্রশ্ন আসত।
সিনিয়ার ইয়ারে তখন আমি, পুরোন হয়ে গিয়েছি। পুরোপুরি এডজাস্টেড। মি: এম এর টি.এ. ছিলাম। জেও সেই ক্লাসে ছিল এবং একবার মি: এমকে মিষ্টি করে প্রশংসার সুরে জিজ্ঞেস করেছিল, "তোমরা কানাডিয়ানরা এত বিনয়ী কি করে? এত বেশি সফ্ট কি করে?" আমার মনের প্রশ্নটাই ও করল এবং আমিও মাথা নাড়লাম কি করে? এই প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে তিনি আমাকে ক্লাসের দেয়ালে টাঙ্গানো বিশাল ওয়ার্ল্ড ম্যাপটার কাছে নিয়ে গেলেন। ওখানে ইন্ডিয়া এবং চায়না খুঁজলেন। বাংলাদেশও খুঁজতে লাগলেন। ইন্ডিয়ার কাছেই থাকার কথা বিড়বিড় করতে করতে। আমার চোখে পরে গেল, আর দেখিয়ে দিলাম, মাই বাংলাদেশ বলে। জে ব্রাজিল দেখালো। যাই হোক, উনি চায়না ও ইন্ডিয়ার পপুলেশন বললেন। বাংলাদেশেরটা জিজ্ঞেস করলেন এবং জেনে অন্য যেকোন বিদেশীর মতো চোখ কপালে তুললেন। ম্যাপে দেখালেন, "এত ছোট ভূমিতে এত মানুষ। কিন্তু কানাডার এত বড় ভূমিতেও ততটা মানুষ নেই! বিশ্বের একটা বড় অংশই এক প্রান্তে! আর বাকি অংশ খালি! বিশ্বে জনসংখ্যা ওয়েল ডিস্ট্রিবিউটেড না। একদিকে রিসোর্চ পর্যাপ্ত নয়, অন্যদিকে সবকিছু প্রয়োজনের চেয়ে অনেক বেশি!" ম্যাপ থেকে চোখ সরিয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে বললনে, "পথে চলতে গেলে হয়ত তোমরা সবসময় একে অপরের সাথে ধাক্কা খাও। ট্রেইনে, বাসে, চাকরিতে সবখানে নিজের জায়গা প্রতিযোগিতার মাধ্যমে করে নিতে হয়! ভীরে নোটিশড হতে তো জোরে কথা বলতেই হয়! আমাদের দেশে তা নয়! কোন ভীড়, ধাক্কাধাক্কি, প্রতিযোগিতা নেই, এজন্যেই মানুষজন ঠান্ডা মেজাজের ও বিনয়ী!" উনি নিজের ডেস্কে হেঁটে আসতে আসতে বললেন, "প্রতি দেশের সংস্কৃতি এমনভাবে গঠিত যাতে তারা বেস্ট ওয়েতে সারভাইব করতে পারে। ইটস অল এবাউট সার্ভাইবাল! কিন্তু সবমিলে প্রতি জাতিরই নিজস্বতা আছে, অসাধারণ সব বৈশিষ্ট্য আছে। সেজন্যেই তো পৃথিবী এত রঙ্গিন, ও সুন্দর!" আমি মাথা নাড়তে নাড়তে তন্ময় হয়ে ওনার গোছানো কথা শুনছিলাম যা ততোটা গুছিয়ে লেখার সাধ্য আমার নেই!
মনকথা: আমরা বাংলাদেশীরা কথায় কথায় নিজেদেরকে নিয়ে অনেক অভিযোগ করি। আমরা অলস, লোভী, দূর্নীতিবাজ এই সেই। প্রবাসীর বৈঠক বা দেশীয় চায়ের দোকান সবখানে একটি কথা অনেক শুনি, দেশটার কিছু হবেনা। সবই খারাপ! নিজেদেরকে যদি এতটাই ছোট মনে করি তবে বিশ্ব আমাদেরকে নিয়ে কি ভাববে? নানা দেশ আমাদেরকে সম্মান করেনা কেননা আমরা নিজেদেরকে সম্মান করিনা অনেকসময়। একজন বাংলাদেশীকে অন্য বাংলাদেশীর সম্মান বজায় রাখতে হবে। একটা ভুল অপারেশনে মানুষ মরল, ব্যাস দেশের সব ডাক্তার কশাাই! একটা বিল্ডিং ধসে পরল, সব ইঞ্জিনিয়ার ঘুষখোর! পুলিশেরা সৎ না, শিক্ষকেরা কর্তব্যপরায়ন না। ইত্যাদি ইত্যাদি হাজারো অভিযোগ! সব বাংলাদেশী খারাপ! সবাই!
না! অনেকেই আছেন যারা ভালো কাজও করছেন। রাতের পর রাত জেগে রোগীর সেবা করছেন, ব্রিজ বানাচ্ছেন, বিনামূল্যে ছাত্র পড়াচ্ছেন, উৎসবে পরিবারের থেকে দূরে থেকে দেশের নিরাপত্তা নিশ্চিত করছেন। আমাদের ভালো গুণগুলো আমাদের অর্জিত, এবং খারাপ দোষগুলো পরস্থিতির শিকার হয়ে আমাদের মধ্যে বিদ্যমান। এতে লজ্জাবোধের কিছুই নেই। আমরা এই পৃথিবীর প্রথম আর শেষ জাতি না যারা পারফেক্ট না। বরং আমরা অন্যসব জাতির মতো ইনপারফেক্ট! আমাদের মধ্যে এমন অনেক ভালো গুণও আছে যা অন্য জাতির মধ্যে দেখা যায়না। আমি বলছিনা যে নিজেদের নিয়ে আত্মতুষ্টিতে ভুগে দোষত্রুটি গুলো এড়িয়ে যেতে। তবে অতিরিক্ত হতাশ না হয়ে, একটি সুন্দর আগামীর স্বপ্ন দেখতে হবে! নিজেদেকে নিয়ে লজ্জা বোধ না করে গর্বের সাথে আরো উন্নত জাতিতে পরিণত হতে হবে। মনে রাখতে হবে, ভালো মন্দ সবকিছু মিলে আমরা একটি দেশ! হাজার স্বপ্নের বাংলাদেশ!
শেষ কথা: পশ্চিমিদের আমরা যতটা উদ্ভট মনে করি ওরাও কিন্তু তাই মনে করে আমাদের। নিজ চোখে ওদের সংস্কৃতি দেখা যতটা আনন্দের, ওদের চোখে নিজ সংস্কৃতি দেখাটা তার চেয়েও অনেক মজার। বিদেশীদের এমন হাজারো স্টেরিওটাইপ ও দর্শন রয়েছে আমাদের নিয়ে। সেসব নিয়ে দেখা হবে অন্য কোন পর্বে......
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই আগস্ট, ২০১৭ সন্ধ্যা ৭:৪৭