সামু ব্লগের প্রতি পাতায় নানা ধরণের লেখা দেখা যায়। তবে আজকাল যে টাইপের লেখা সবচেয়ে বেশি দেখা যায় তা হচ্ছে কবিতা। কোন কোন দিন খেয়াল করে দেখি প্রথম পাতার প্রায় সব লেখাই কবিতায় ভরা! কাব্য চর্চা খারাপ কিছু নয়। বরং লেখাখির ভীষন কঠিন একটি মাধ্যম হচ্ছে কবিতা। তবে ব্লগে আরো নানা বৈচিত্রপূর্ণ লেখা তো আশা করাই যায়। তা যাই হোক, ব্লগে অনেক ধরণের কবি রয়েছেন যারা কবিতায় ব্লগ মাতিয়ে রাখার চেষ্টা করছেন। তাদের নিয়ে না লিখলে অন্যায় হয়ে যাবে। সেই ভাবনা থেকেই আজকের পোস্টের উদয়! কথা না বাড়িয়ে চলে যাই কবি বিশ্লেষনে!
১) দাঁতভাংঙ্গানি কবি: এই ধরনের কবিদের লেখা আবৃত্তি করতে গেলে আপনার ৩২ টির মধ্যে অন্তত ৩০ টি দাঁত ভেংঙ্গে পরে যাবে। এরা যে কবিতা লেখেন তা পাঠকেরা তো দূরের কবি নিজেও বুঝতে পারেন না! বাংলা অভিধান থেকে একেকটি সহজ শব্দের কঠিন সমার্থক শব্দ খুঁজে খুঁজে কবিতায় বসিয়ে দেন! কঠিন শব্দ ব্যবহার করিলেই রবি ঠাকুর হওয়া যায় এই তত্ত্ব কে আবিষ্কার করিয়াছে তা দাঁত হারানোর শোকে বিহব্বল, উত্তেজিত পাঠক জাতি জানিতে চায়।
মাধ্যাহ্নিক ঔজ্জ্বলের স্রোতাবেগে ভাসমান
তব প্রেম ইন্দ্রজাল রক্তকণিকায় বহমান!
ধ্যাত্তারি কি লিখলাম নিজেই তো বুঝলাম না! ঐযে বললাম কবি নিজেও বোঝে না!
২) অকবি: অকবি শব্দটি অনেক শোনা যায় ব্লগে আজকাল। এরা হচ্ছেন ব্লগের উঠতি কবি, পরিচিতি পেতে শুরু করেছেন এমন। অকবিরা বেশ ভালো মানের কবিতা লিখে থাকেন। কেউ কবিতা ভালো বলুন আর খারাপ নিজেই নিজেকে কবি স্বীকৃতি দিতে পারেন না। হতে পারে তা আত্মবিশ্বাসের অভাব অথবা বেশি প্রশংসার লোভ! কোন পাঠক যদি বলে, "কবিতা ভালো লেগেছে", তারা বলে উঠবেন, "ধুর এগুলো কবিতা নাকি? আমার মতো অকবি কি কবিতা লিখতে পারে?!" তখন সামনের জন বলবে, "কি যে বলেন ভাইয়া! আপনার মতো কবি হতে পারলে জীবন ধন্য হয়ে যেত! আপনি যদি কবি না হন তো কে কবি? কোথাকার কোন রবি ঠাকুর?!" পাবলিক তেল দিয়ে আনন্দিত, কবি তেল মেখে!
৩) সামুর কারণে কবি: এই কবিরা, বা ব্লগারেরা সামু ব্লগে শখ করে একাউন্ট খুলে ফেলেন। লেখালেখির অভিজ্ঞতা তেমন একটা থাকেনা। ব্লগে এসে মাথা চুলকান, কি লেখা যায়? কি লেখা যায়? ইয়েস! পেয়েছি! কবিতা! অন্যকিছু লেখার অভ্যাস থাকুক না থাকুক কৈশোরে প্রেমের চিঠিতে এক আধখানা কবিতা তো সবাই লিখে থাকেন। সেসব ভেবে পরিচিত জনরায় ব্যাক করেন।
ফলাফল দু প্রকার হতে পারে। এক তারা লিখতে লিখতে অসাধারন কবি হয়ে যান। আর কিছু নিজেকে গাধা ভেবে পেটাতেই থাকেন কবি হবার জন্যে, তবে ঘোড়া থুক্কু কবি আর হননা! তাদের কবিতা এমন হয়:
রক্তলাল সূর্য উঠেছে পূর্বদিকে
আমি ভালোবাসি শুধুই তোমাকে!
৪) আঁতেল কবি: এনারা জটিল সব বিষয় নিয়ে কঠিন শব্দের ব্যবহারে এমন কবিতা লেখেন যে বারবার পড়ার পরেও পাঠক মর্মদ্ধার করতে পারেন না। পাঠক বিনয়ের সাথে বলে যান, "ভাই/আপা মাথার ওপর দিয়ে গেল। কবিতা বুঝিনা।" কিছু না বুঝে কবিকে উঁচুদরের মনে করে পাঠক শেষমেষ একটি লাইকও দিয়ে দেন। বিনয়ে কবিও কম যান না। মুখে বলেন, "না বোঝাতে পারা আমার ব্যর্থতা। ক্ষমা করে দেবেন!" আর মনে মনে ভাবেন, "আমার কবিতা বুঝতে হইলে তোদের মতো ম্যাংগো পিপলকে আবার জন্মাইতে হইবে!" লাইক, কমেন্টের বন্যায় ভেসে কবি পূর্বের চেয়ে আরো কঠিন কবিতা লেখায় মনোনিবেশ করেন। বেচারা পাঠক এক হাতে মাথা চুলকান আর অভ্যাসবশত আরেক হাতে লাইক দিতে থাকেন!
৫) বিজ্ঞানী কবি: একের ভেতর দুই! বিরল প্রতিভা! বাংলা ভাষার শয়ে শয়ে অভিধান খুঁজেও যে শব্দ পাবেন না, তারা তা বানিয়ে ফেলেন মনের মাধুরী মিশিয়ে। নিজের সুবিধামতো ছন্দ মেলাতে শব্দ আবিষ্কার করে ফেলেন! আর বানান জ্ঞান তো এত অসাধারণ, যে না চাইলেও একেকটি কবিতা একেকটি নতুন শব্দের ডিকশনারি হয়ে যায়!
সাখী পূব আকাশের রকত লাল সূর্যম
শুধু তোমাকেই বাসি ভালো প্রিয়তম!
৬) প্রতীকী কবি: এই কবিতাগুলোয় কবিতার চেয়ে লেখক পাঠকের কমেন্টগুলো বেশি বিনোদনের! কবিতায় প্রতীকীর ব্যবহার তো সাহিত্যে যুগ যুগ ধরে হয়ে এসেছে। তবে তার আধিক্য ব্লগে মাঝেমাঝেই দেখা যায়। প্রতিটি শব্দই যখন ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে লেখা হয় পাঠকের কাজ বহুগুণে বেড়ে যায়। তারা অনেক সময় ও মেধা ব্যয় করে বিজ্ঞের মতো রচনা লিখে ফেলেন কবিতাটির প্রতি লাইন বিশ্লেষন করে। ১৬ লাইনের কবিতার জন্যে কমেন্ট করে ফেলেন ১৬০০ শব্দের! কেউ বলেন কবিতাটি প্রেমের, কেউ বলেন প্রকৃতির, কেউ বলেন ধর্মীয় তো কেউ বলেন দেশাত্মবোধক। আর কবি নিজে সবাইকেই অভিনন্দন জানান কবিতার সঠিক মর্মদ্ধারে। পাঠকের বিচার, বিশ্লেষনে নাকি তার মুগ্ধতার অন্ত নেই! মাই কিউরিয়াস মাইন্ড ওয়ান্টস টু নো, একের ভেতরে এতকিছু লিখতে পারার মতো কবি সামুতে থাকতে, সাহিত্যে প্রতি বছর ডজন খানিক নোবেল বাংলাদেশে আসা ঠেকায় কেডা? ভাইসব! এ নিশ্চই বিরোধীদলীয় চক্রান্ত!
৭) বিরহী (ছ্যাকা) কবি: এই ধরণের কবিরা জীবনে প্রেমঘটিত বিষয়ে চরম ব্যর্থতার মুখোমুখি হন। প্রাক্তন ভালোবাসার মানুষটিকে মনে করে একটার পর একটা কবিতা লিখতে থাকেন এবং ব্লগে পোস্টাইতে থাকেন। আগ্রহী এবং অভিজ্ঞ পাঠক তাদেরকে নানা উপদেশ দিয়ে যান বিরহ থেকে উত্তোরণের। কেউ কেউ এও বলে দেন প্রেমের জ্বালা বড় জ্বালা, এ কষ্ট থেকে পরিত্রাণের কোন উপায় নেই! এই সুবাদে নিজেদেরও প্রেমঘটিত কষ্টের স্মৃতিগুলো শেয়ার করে যান। একেকটি কমেন্ট একেকটি বিনোদন! তবে যিনি আসলে বিরহের কবিতা লিখলেন তিনি সোজাসোজি বলে দেন, "পুরো কবিতাটিই কাল্পনিক। বাস্তব জীবনের সাথে কোনই মিল নেই!" তিনি সত্যি বলুন আর মিথ্যে, বিশ্বাস করার মতো পাঠক খুঁজেও পাওয়া যায় না!
বিরহে ডুবিয়ে একাকী করে গেলে তুমি
পেছনে যদি তাকাও কভু,
দেখবে দাড়িয়ে প্রতিক্ষায় এই আমি!
৮) চোর কবি: এই জাতীয় কবিদের চেনে না এমন ব্লগার সামুতে নেই। আসলে এদের কবি বলাও কবি শব্দের অপমান! এরা ফেইসবুক থেকে চুরি করে সেই কবিতা ব্লগে পোস্ট করে। অথবা ব্লগ থেকে ফেইসবুকে কবিতা নিয়ে যায়। যাই হোক না কেন চোর তো চোর। তবে এদের সাহস এত বেশি যে সামুর কোন ব্লগারের কবিতা বা যেকোন লেখা আবার সামু ব্লগেই প্রকাশ করে! দু একটি শব্দ পরিবর্তন করে ব্যাস। আরেহ চোর বলে কি তাদের লজ্জা নেই নাকি? যদি পরে কেউ ধরে, তখন কিছু বলতে হবে তো! তারা বলে, "দেখেন, আপনার দ্বিতীয় লাইনের তৃতীয় শব্দের পরে একটি কমা আছে, আমারটাতে কিন্তু নেই! এই দুটো কবিতার মিল কাকতাল ছাড়া আর কিছুই নয়!" কবিতার আসল কবি তখন মিলগুলো তুলে ধরেন। সে অমিল দেখায়। দুজনের ঝগড়া তো কখনো দুজনে থাকে না। কে আসল কে নকল পক্ষে বিপক্ষে অন্য ব্লগারদের মধ্যেও ভাগাভাগি হয়ে যায়। কমেন্ট চালাচালিতেই সীমাবদ্ধ থাকে না তা। পোস্ট দেওয়া দেওয়ি শুরু হয়ে যায় পক্ষে বিপক্ষে। আর কিছু হোক না হোক শেষ পর্যন্ত নকল কবিটির ভাগেও অনেক হিট ঠিকই পরে যায়! আর কষ্ট করে যিনি কবিতাটি লিখেছিলেন তিনি ব্লগে লেখা দেওয়া বন্ধ করে দেন ভয়ে। ব্যাস কমেন্ট করে ব্লগার হবার দায়িত্ব পূরণ করেন! অথবা ব্লগ ছেড়ে চলেই যান অভিমানে। ভাবেন, যেই ব্লগ আমার কবিতার বা যেকোন লেখার নিরাপত্তা দিতে পারে না সেখানে থেকে কি হবে?
সামু কর্তৃপক্ষের প্রতি দাবী: সামু ব্লগের প্রতি একটি অনুরোধ সকল ব্লগার বারবার জানিয়ে যাচ্ছেন। আজকে আবারো আমি সবার তরফ থেকে করছি। দয়া করে ব্লগ থেকে কপি পেস্ট করার অ-সুবিধাটি উঠিয়ে নিন। এই সহজ উদ্যোগটি নিলে লেখা চুরির হার অনেক কমে যাবে। এছাড়াও লেখা চোরদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণসহ একটি লেখাকে সুরক্ষিত করতে আর যা যা করা যায় তা জরুরি ভিত্তিতে করুন। আপনারা হয়ত খেয়াল করেছেন অনেক সুলেখক/লেখিকা ব্লগে নতুন লেখা প্রকাশ করছেন না ভয়ে, আর কেউ কেউ ব্লগ ছেড়ে চলেই যাচ্ছেন! ব্লগটাকে ব্লগাররাই তো কোন পারিশ্রমিক ছাড়া এতদূর এনেছেন। সামু ব্লগের প্রতিটি লেখকের লেখার সুরক্ষা, নিরাপত্তার দায়িত্ব সামু কর্তৃপক্ষের। এই দায়িত্বে যদি আপনারা অবহেলা করেন তবে ব্লগে না টিকবে গুনী ব্লগাররা আর না টিকবে সামু ব্লগ!
আর ব্লগারদের প্রতি অনুরোধ ভয়ে পিছু পা হবেন না। এতে করে চোরদেরই জয় হবে। টিকে থাকুন সংগ্রাম করে!
ব্লগের কবিগুরুরা কেউ দয়া করে মাইন্ড করবেন না। শেষের অংশটি ছাড়া লেখাটি মজা করেই লেখা হয়েছে। যেসব কবির ছোঁয়ায় সামু ব্লগ জমজমাট হয়ে ওঠে, তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে শেষ করছি!
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে জুন, ২০১৭ রাত ৮:০২