কানাডা সিরিজের এত পর্বে স্কুলের ভেতরে থাকতে পাঠক নিশ্চই বোরড হয়ে গিয়েছিলেন। এজন্যে লাস্ট পর্বে সবাইকে স্কুলের বাইরে নিয়ে গিয়েছিলাম! আজকে সেই ভ্রমণের বাকি অংশটুকু বলে দেব!
আগের সিরিজ: কানাডার স্কুলে একদিন (এক থেকে বাইশ): পর্ব বাইশ । পর্ব বাইশে অন্য সকল পর্বের লিংক রয়েছে!
আগের পর্ব: কানাডার স্কুলে একেকটি দিন (পর্ব ১) - বাংলাদেশীদের যেসব বিষয় বিদেশীরা অদ্ভুত মনে করে!
কানাডার স্কুলে একেকটি দিন (পর্ব ২) - মফস্বলের কন্যের বৈদেশে শিক্ষাগ্রহন; ঘটন অঘটন এবং আমাদের নিয়ে বৈদেশীদের দর্শন!
কানাডার স্কুলে একেকটি দিন (পর্ব ৩) - মফস্বলের কন্যের বৈদেশ ভ্রমণ; চলন ও বলন, এবং ভিনদেশ নিয়ে বৈদেশীদের দর্শন!
অসম্ভব সুন্দর ও বৃহৎ লাইব্রেরীটি ঘুরে আমরা বেরিয়ে আসছিলাম। টিচার বাইরে দাড়িয়ে ছিলেন। বেরিয়ে ওনার কাছে দাড়ানোর পরে আমাকে বললেন, "তুমি কিছু ভুলে গিয়েছ! শিখিয়েছিলাম তোমাদেরকে!" হাসতে হাসতে বললেও উনি যে অসন্তুষ্ট সেটা বেশ বুঝলাম। মনে মনে ভাবছি, আমি আবার কি করলাম? কি ভুলেছি? বেশ নার্ভাস হয়ে ভাবছি অজান্তে মারাত্মক কোন কিছু করে ফেলিনি তো?
ওনার দিয়ে কনফিউজড তাকিয়ে, উনি তখন বললেন, "ইউ ফরগট টু হোল্ড দ্যা ডোর ফর আদারস হানি!" আমার তখন মনে হলো, ওহো, তাইতো! বেশ কিছুদিন আগে উনি বলেছিলেন, কানাডায় কোন দরজা দিয়ে বের হলে পেছনের মানুষটির জন্যে দরজা ধরে থাকতে হয়। সে থ্যাংকস বলে, আর সামনের মানুষটি ওয়েলকাম, ইয়াহ এসব বলে! এটা যেকোন মানুষের জন্যে যেকোন জায়গায় করতে হয়। অফিস, মার্কেট, স্কুল যেখানেই হোক না কেন। আর এমনও হয় যে পেছনের অপরিচিত মানুষটি এখনো দরজা পর্যন্ত এসে পৌঁছায়নি, একটু দূরে। তবে সামনের মানুষটি কিছুক্ষন অপেক্ষা করে দরজা ধরে দাড়িয়ে থাকবে! কাউকে অপেক্ষা করতে দেখলে পেছনের মানুষটি জোরে হেঁটে দরজা ধরতে আসবে। থ্যাংকস বলবে!
এই সাধারণ কাজটিকে না করা ওরা লিটারেলি ক্রাইম মনে করে! কানাডিয়ানরা কতটা সিরিয়াস এ বিষয়ে সেটা বোঝাতে একটু সামনে চলে যাই। তখন কানাডায় দেড় বছর হয়েছে। মোটামুটি মানিয়ে নিয়েছি। আমার সবচেয়ে ক্লোজ কানাডিয়ান বান্ধবী ছিল বি। সাদামাটা চেহারার, চিকন চাকন, লম্বা একটি মেয়ে। একবার ও এক আত্মীয়ের বিয়েতে আমেরিকায় যায়। ফিরে আসার পরে আমি জিজ্ঞেস করি, ট্রিপ কেমন ছিল? সে বলে, "নট দ্যাট গুড। আমেরিকানস আর সো রুড!" এটা অনেক কানাডিয়ানের কাছেই শুনেছি। আমি জানতে চাইলাম, কি রুড আচরন করেছে তোমার সাথে? ও বলল, "দে ডোন্ট হোল্ড ডোর ফর পিপল!" এটা বলে এমন বিরক্তির এক্সপ্রেশন দিল যেন এর চেয়ে জঘন্য কাজ আর হতে পারে না! আমি ভাবছি এই ব্যাপার? ওহ আল্লাহ! এই মেয়ে তো বাংলাদেশে গেলে আমাদেরকেও রুড ভাববে! আমাকে অনেকবার বলেছে যে আমার দেশে যাবে! আমি ওকে বোঝাতে শুরু করে দিলাম যে একেক দেশের একেক কালচার। ডোর না ধরলে রুড হয়না! ও শুনছে আর অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। হয়ত ভাবছে আমি আমেরিকার সাফাই গাইছি কেন? আমি তো মনে মনে জানি আসলে কোন দেশের সাফাই গাইছি! হাহাহা।
স্টাডি ট্যুরে ফিরে আসি। আমি টিচারকে সরি বললাম। উনি হেসে বললেন, "ইটস ওকে। পরেরবার থেকে খেয়াল রেখো!" টিচার বলার পরেও এমন ভুল কেন করলাম সেটা ভেবে মন খারাপ হয়ে গেল। মুখ গোমড়া করে বাসে উঠলাম আবার। এবারের গন্তব্য রেস্টুরেন্ট।
যেতে যেতে বাসের জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখছিলাম সবকিছু। আশেপাশের স্থাপত্যকর্ম দেখে অবাক হচ্ছিলাম। মনোরম, চোখে ধাঁধা লাগিয়ে দেওয়া ডিজাইনের একেকটি টাওয়ার। দেখতে গেলে চারিপাশে অনেক বিল্ডিং, মার্কেট, রেস্টুরেন্ট। কিন্তু ঘিঞ্জি মনে হয় না। সবকিছু এত পরিকল্পিত এবং সুবিন্যস্ত যে চোখে না দেখলে বিশ্বাস হয় না! সবকিছুর মধ্যেই পর্যাপ্ত দূরত্ব। প্রশস্ত রাস্তা এবং ফুটপাত! মনে হচ্ছিল রাস্তায় গাড়ির জ্যামও প্ল্যানড! যেন ঠিক করে রাখা হয়েছে এই গাড়িটার পরে এই গাড়িটা থাকবে! কোন বিশৃংক্ষলতা নেই কিছুতেই। আর সবকিছুকে ছাপিয়ে যখন আকাশ পাহাড় উঁকি দিয়ে ওঠে মনে হয় পুরোটাই শিল্পীর তুলির আঁচড়! এভাবে লোকালয় দেখতে দেখতে বাস রেস্টুরেন্টের কাছাকাছি এলো।
টিচারকে অনুসরণ করে রাস্তায় নেমে ফুটপাত দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি সবাই রেস্টুরেন্টের দিকে। হুট করে কানে গিটারের মধুর সুর ভেসে এলো। দেখি এক মধ্যবয়স্ক পুরুষ, গাল কিছুটা ভাংঙা ফুটপাতের একপাশে দাড়িয়ে গিটার বাজাচ্ছে। লম্বা, সুদর্শন, কাউবয় হ্যাট পরা, হাসিমুখ। তার শান্ত গিটারের সুর ব্যস্ত নগরীতে ছন্দপতন ঘটিয়ে অন্যরকম এক আবহ তৈরি করছিল! হঠাৎ দেখি আমাদের টিচার কয়েন নিয়ে ওনার পাশে রাখা বাক্সে ফেলে দিলেন। বক্সের ওপরে কাগজ এঁটে লেখা: "হোমলেস ফর ফোর মানথস। হ্যাভ টু কিডস। প্লিজ হেল্প!" মানে এ ভিক্ষুক? হায় হায়! এত বড়লোক দেশেও ভিক্ষুক থাকে? আর তার দাড়ানোর ভংগি, মুখে হাসি তো দেখো! রক স্টার মনে হচ্ছে! টিচার টাকা দেবার পরে তিনি হেসে বললেন, "থ্যাংক্স ম্যাম। হ্যাভ আ ওয়ান্ডারফুল ডে!" আমি মনে মনে ভাবলাম বাবাহ! কি দেশ! ভিক্ষুকও ইংলিশ বলে! এটা ভাবার সাথে সাথে আমার মনে হলো, ওদের তো মাতৃভাষাই ইংলিশ! এত ভীষন হাসি পেল নিজের বোকামিপূর্ণ ভাবনায়! মনে মনে কতক্ষন হেসে ছিলাম আমি! উফফ! এক ব্রাজিলিয়ান ছেলে আমার দিকে চোখ নাচিয়ে ইশারায় জিগ্যেস করল হাসছি কেন? আমি মাথা নেড়ে বললাম কিছু না!
কানাডায় গিয়ে হোমলেসদের দেখে ভীষন অবাক হতাম। এদেশে এত সম্পদ। তবুও রাস্তায় গরীব মানুষদের পরে থাকতে দেখি! গারবেইজ বিনগুলো থেকে কুড়িয়ে ক্যান বা বেচা যায় এমন জিনিস বের করতে দেখি অনেককে। আমাদের দেশের মতো অতো নাহলেও আছে। এতো সুযোগ সুবিধার দেশে কেউ কিভাবে একদম রাস্তায় নেমে যায় তা বুঝতেই পারতাম না। পরে আসল কারণটা বুঝতে পারি। দেশটির নানা প্রদেশই প্রাকৃতিক সম্পদের ওপরে চলে। কোন কারণে সেই রিসোর্চের বিজনেস ডাউন হলে হাজার মানুষ মুহূর্তেই জব হারায়। আর ওরা আমাদের মতো সঞ্চয় করেনা। যখন যা কামাই করে আনন্দে খরচ করে ফেলে। পার্টি, শপিং ইত্যাদিতে মনখুলে টাকা ওড়ায়। জীবনের প্রতিটি দিনকে এনজয় করতে চায়। যে কাল আসেনি তার কথা ভেবে কি হবে এমন ভাব অনেকেরই। আর বাড়ি, গাড়ি সব লোনে কেনা। প্রতিমাসে ব্যাংকে টাকা পরিশোধ করতে না পারলেই সব গেল! এজন্যে যেই ইনকাম বন্ধ হয়ে যায়, সেটা কয়েক মাসের জন্যে হলেও অনেকেই পথে নেমে আসে!
কিছুটা হেঁটেই আমরা রেস্টুরেন্টে পৌঁছে গেলাম। ছোটখাট ছিমছাপ একটা রেস্টুরেন্ট। টিচার সবাইকে বসতে বললেন। আমার পাশে একজন তাইওয়ানের মেয়ে আর সামনে দুজন ব্রাজিলিয়ান ছেলে বসে। কাছাকাছি টেবিলে অন্য স্টুডেন্টরা বসা। টিচার বসলেন বাস ড্রাইভারের সাথে। তারা হেসে হেসে গল্প করছিলেন। দেখে মনে হলো বেশ পরিচিত ও বন্ধু! কি সুন্দর একটি দৃশ্য! পেশা ও টাকার ওপরে ভিত্তি করে মানুষে মানুষে কোন ভেদাভেদ নেই!
সবাই যে যার যার মতো বসে যাবার পরে টিচার আমাদের কাছাকাছি এসে আস্তে আস্তে বললেন, "সবার জন্যে নুডুলস আর কোল্ড ড্রিংকস অর্ডার করছি নিজের তরফ থেকে। তার খরচ স্কুল থেকে যাবে। তোমরা যদি নিজেরা অন্যকিছু খেতে চাও তবে নিজের খরচে কিনতে হবে!" আমি ভাবছি না বুঝে কি না কি অর্ডার করব। এদের খাবার দাবার তো চিনিই না! কত দাম হবে কে জানে! টিচার যা অর্ডার করেছেন তাই ভালো! চুপচাপ বসে খাবারের ওয়েট করছি। বাকি তিনজন ফোনে কি যেন করছিল। আমার ফোন ছিলনা, মাথা নিচু করে বসে ছিলাম। একটু পরে নুডুলস আসল সবার জন্যে। দেখি, এর মধ্যে মিট আছে! মাংস, সবজি নানা কিছু দিয়ে তৈরি! মা বাইরের মাংস খেতে নিষেধ করেছে হালাল না বলে। এখন কি করি? ভাবতে ভাবতে টিচারের কাছে গেলাম। ওনাকে বললাম, "আমি মাংস খাইনা। আমি কি বাড়ি থেকে আনা খাবার খেতে পারি? উনি বললেন, "ওহো! দাড়াও, আমি ম্যানেজারকে জিজ্ঞেস করি!" কিছুক্ষন পরে এসে বললেন, "সমস্যা নেই। কানে কানে ফিসফিসিয়ে আরো বললেন, "কিছু রেস্টুরেন্টে স্ট্রিক্ট রুল থাকে যে ওদের খাবার ছাড়া খাওয়া যাবেনা। এজন্যে জেনে নিলাম। তুমি কিছু মনে করোনা!" আমি ভীষন মুগ্ধ হলাম ওনার ব্যবহারে! সাহায্য করছেন আবার সরিও বলছেন! এত বিনয় মানুষের থাকে কি করে? আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। ভাগ্যিস মা জোর করে নাস্তা দিয়েছিল, নাহলে এখন সমস্যায় পরতাম!
সেদিন টিচারকে মাংস খাইনা বলার কারণ ছিল হালাল এবং হারাম মাংসের ইংলিশ আমি জানতাম না। আসল সমস্যাটি বোঝানোর মতো ইংলিশ জ্ঞান আমার তখন ছিল না। পরে অবশ্য জেনেছি, কানাডিয়ানরা হালাল হারাম শব্দ দুটোকে এভাবেই জানে। আরবি শব্দ দুটো নানা দেশের মুসলমানদের কল্যাণে ভালোই বিখ্যাত! বিদেশীদের আরবি উচ্চারণগুলো অদ্ভুত। যেমন মুসলিম কে বলে মোজলিম, হালাল কে বলে হ্যালাল! এগুলো শুনে হাসি পেত আর ভাবতাম ওরা তো আমার উদ্ভট ইংলিশ উচ্চারণে হাসে না! এটা ভেবে নিজে হাসি কন্ট্রোল করতাম!
তখন দুপুর প্রায়। এত ঘোরাঘুরির পরে খুব ক্ষিদে লাগার কথা। আমি খাবার বের করে দুবার আগ্রহে নিলাম। কিন্তু তারপরে আর নিতে পারলাম না। জীবনে যদি নিজের মন খারাপের পারদ বুঝতে হয় তবে খাবার চেষ্টা করা উচিৎ। আমার যে সারাদিনে সবার মধ্যে থেকেও একা ঘুরে ঘুরে কত মন খারাপ ছিল তা খেতে গিয়ে আরো ভালভাবে বুঝলাম! পুরোটা পথ একা একা নিজ মনে গল্প করে চলেছি। এত গুলো মানুষের মাঝে প্রাণখুলে কথার বলার মতো একটি মানুষও আমার নেই! শব্দ জ্ঞানের অভাবে মনের সব কথার বলতে না পারার অসহায়ত্ব আমাকে কি ভীষন ক্লান্ত করে দিত তা আমি বোঝাতে পারব না! বাকশক্তি থাকার পরেও বোবা মনে হতো নিজেকে। বারবার মনে হতো যা হবার হবে, আমি বাংলায় কথা বলা শুরু করে দেব। দেশে যেমন প্রানখুলে বকবক করতাম সেভাবে। কেউ বুঝুক আর না বুঝুক, আই ডোন্ট কেয়ার! ভাবতে ভাবতে আবেগে গলা আরোই আটকে আসল। ঠিকমতো খেতে পারিনি আমি সেদিন এবং সেদিনের মতো আরো অনেকদিনে!
আমার আশেপাশের মানুষেরা বেশ আনন্দ করে খেল। সবার লাঞ্চ শেষ হবার পরে বেরিয়ে পরলাম আবার। বাসের দিকে যেতে যেতে একটা বয়স্ক হ্যাট পরা মহিলা আমাদের দলটির দিকে তাকিয়ে বললেন, "লাভলি ওয়েদার হেই!" আর এই লাভলি ওয়েদার বলাটা পুরো ট্রিপে ১৬ তম বারের মতো হলো। সিরিয়াসলি। কানাডায় অপরিচিত মানুষেরা হুটহাট একে অপরের দিকে তাকিয়ে "হেই! হ্যাভ আ গ্রেইট ডে! লাভলি ওয়েদার!" এসব বলা শুরু করে দেয়। আমি এই বিষয়টাতে অভ্যস্ত হতে অনেক টাইম নিয়েছিলাম। হয়ত নিজের মনে রাস্তায় হেঁটে যাচ্ছি, পেছন থেকে কেউ বলে উঠল, "লাভলি আউটফিট!" আমার সালোয়ার কামিজটাকে বলত আরকি। একটু চমকে উঠতাম। নিজেকে সামলে হেসে ধন্যবাদ দিতাম।
স্কুলে যাবার উদ্দেশ্যে বাসে উঠলাম সবাই। পুরোটা সময়েই টিচারের পাশে বসে ছিলাম আমি বাসে। আবারো তিনি গল্প করতে লাগলেন। এবারে পোষ্য নিয়ে বলা শুরু করলেন! মোবাইলে সেগুলোর ছবি দেখালেন পরম আগ্রহে। আমার এমন কোন কানাডিয়ান টিচার, ও বন্ধু বোধহয় নেই যারা কোন না কোন সময়ে তাদের বেবি (কুকুর, বিড়াল) এর ছবি আমাকে দেখায়নি। আর যখন দেখায় ওদের চোখ জ্বলজ্বল করে ওঠে। মনে হয় যে এর চেয়ে ভালোবাসার কিছু ওদের জীবনে আর নেই! কানাডায় এমন পরিবার কমই আছে যাদের পেট নেই। শুদ্ধভাবে বললে এমন পরিবার কমই আছে যাদের পুরো একটা চিড়িয়াখানা নেই। আমার এই টিচারেরই যেমন চারটি কুকুর ও দুটি বিড়াল ছিল। এই ভয়ংকর দর্শন বিশাল কুকুরগুলোকে কোন সাহসে কেউ বাড়িতে রাখে ভেবেই আমি অবাক হচ্ছিলাম। উনি ভীষন দুঃখ করে নিজের একটি মরে যাওয়া কুকুরের গল্প বলছিলেন। ওহ, পোষ্যের মৃত্যুতে ওরা শোক অনুষ্ঠানও করে। পোষ্য নিয়ে ওরা কি করে আর না করে বলে আসলে শেষ করতে পারবনা।
ওনার গল্প শুনতে শুনতে বাংলাদেশের কথা ভাবছিলাম। জানালা দিয়ে বা উঠানের গ্রিল দিয়ে বিড়াল বাড়িতে ঢুকে পরলে কি যে হাঙ্গামা হতো! বিড়াল তাড়াও অভিযানে মুহূর্তেই সবাই নেমে পরত। দাদী বিরক্তিভরে বলতেন, "আজ মাছ রান্না হয়েছে না? গন্ধ পেয়ে ঠিকই চলে এসেছে বদের বদ!" আমরা ছোটরা উত্তেজনা, মজায় চিল্লাচিল্লি, দৌড়াদৌড়ি শুরু করে দিতাম। বিড়াল পালিয়ে পালিয়ে বেড়ায়। অনেক কসরত করে বিড়াল তাড়িয়ে ঘর পরিষ্কার করা হতো। নোংরা পায়ে বিছানায় উঠে গেলে চাদর ধোয়া হতো। মানে সে এক এলাহি ব্যাপার স্যাপার! সেসব স্মৃতি মনে করে মুচকি হাসি খেলে গেল ঠোঁটে।
বাংলাদেশের কথা ভাবতে ভাবতেই টিচারের কথা কানে আসল, "ব্যাংলাদেশে মানুষজন পেট তেমন রাখে না তাই না?" আমি বললাম, হুম। এখানকার মতো অতোটা না। তবে অনেকে রাখে। উনি বললেন, "ইয়েস আই ফিগারড! এক্সপেন্সের ব্যাপার আছে তো! এসবে অনেক খরচ!" ওনার এক্সপ্রেশনে বুঝলাম, বলতে চাইছেন যে, আমাদের দেশটা গরীব, নিজেদেরই খরচ জোগাতে পারিনা, আর বাড়তি পোষ্য তো দূরের! কথাটি খারাপ লেগেছিল। মুখের ওপরে বলতে পারিনি তবে মনে মনে বলেছিলাম, তোমাদের মতো একাকীত্বের ভারে পোষ্যের সাহায্য নিতে হয়না আমাদের। কিছু না বলে চুপ হয়ে রইলাম।
এইসব উচ্চবিত্ত দেশের মানুষেরা সরল মনে অনেককিছু বলে ফেলে। ওদের এসব কথা যে আমাদের আবেগে লাগে সেটা যদি ওরা বুঝত!
যাই হোক, গল্প করতে করতে বাস স্কুলে এসে গেলো। স্কুলের মূল প্রবেশদ্বারে সবাই জড়ো হলাম। স্কুলে পা রাখামাত্র আমার মনে হলো আমি আমার নিজ আঙিনায় দাড়িয়ে! এই স্কুলের মতো আপন জায়গা আমার আর নেই! এতদিন যে স্কুল আমার কাছে অস্বস্তির অন্য নাম ছিল, সেদিন সেই স্কুলকে স্বর্গ মনে হলো। সত্যিই। বাইরের সে পরিবেশটা এত অকওয়ার্ড ছিল আমার জন্যে যে বুঝে গেলাম এই নতুন দেশে আমরা সবচেয়ে নিরাপদ ও আপন জায়গা এই স্কুল। এখানের যেকোন টিচার, কাউন্সিলর এর কাছে আমি যেকোন সমস্যা মন খুলে বলতে পারব! বাইরের দুনিয়ায় সেটা পারব না।
টিচার সবাইকে ফরমাল কিছু কথা বলে ছুটি দিলেন। অদ্ভুত একটা প্রশান্তি সেদিন আমার মনকে ছুঁয়ে গিয়েছিল। নিজ দেশ হতে এতদূরে আমার একটা ঠিকানা আছে সেই অনুভবে। হাজারটা নাই নাইয়ের মধ্যে কিছু একটা থাকার বিশ্বাসে। কানাডার স্কুল কঠিন ছিল আমার জন্যে প্রথম প্রথম। মানিয়ে নিতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছিলাম। একাকীত্বে গুমড়ে কেঁদে উঠত মন। এতকিছুর পরেও কোনদিন স্কুল মিস করিনি। প্রতিদিন গিয়েছি স্কুলে। দেশে বা কানাডার বাচ্চারাও পরিচিত পরিবেশে স্কুলে না যাবার জন্যে বাহানা করে। আমি ওখানের এতো কঠিন পরিবেশেও তা করতাম না। পিছে ফিরে তাকিয়ে এর কারণ খুঁজতে গেলে সেই দিনটির কথাই মনে পরে। আসলে সেই স্কুলটি প্রথম থেকেই আমাকে মায়ার বাঁধনে আকড়ে ধরেছিল। বাড়ি থেকে স্কুলের সেই পথ ও স্কুলটিই আমার দুনিয়া হয়ে গিয়েছিল অল্প সময়েই। এজন্যে এতো বৈরী পরিবেশেও আমি স্কুলে না যাবার কথা কখনো ভাবিনি। নিজের বাড়ির ফুঁটো ছাদ দিয়ে বৃষ্টির পানি পরলেও সেই বাড়িকেই সবচেয়ে শান্তির নীড় মনে হয়! কানাডিয়ান হাই স্কুল আমার জীবনে সেই মাথার ছাদ বা পরম আশ্রয় ছিল। যা আমাকে আগলে রাখত সবসময়। স্কুলটি আমার জ্ঞান ও ভাবনার ভিতকে মজবুত করে আত্মবিশ্বাসী মানুষ হিসেবে গড়ে তুলেছে।
সেই স্কুল এবং মানুষগুলোর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে আজকের পর্ব শেষ করছি। পরের পর্বে অন্য কোন টপিক নিয়ে হাজির হবো। ভালো থাকুন সবাই!
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে ডিসেম্বর, ২০১৭ রাত ৮:৩০