আজকের পর্বটি একটু আলাদা! এত পর্বে স্কুলের ভেতরে থাকতে পাঠক নিশ্চই বোরড, তাই আজকে স্কুলের বাইরে নিয়ে যাব সবাইকে!
আগের সিরিজ: কানাডার স্কুলে একদিন (এক থেকে বাইশ): পর্ব বাইশ । পর্ব বাইশে অন্য সকল পর্বের লিংক রয়েছে!
আগের পর্ব: কানাডার স্কুলে একেকটি দিন (পর্ব ১) - বাংলাদেশীদের যেসব বিষয় বিদেশীরা অদ্ভুত মনে করে!
কানাডার স্কুলে একেকটি দিন (পর্ব ২) - মফস্বলের কন্যের বৈদেশে শিক্ষাগ্রহন; ঘটন অঘটন এবং আমাদের নিয়ে বৈদেশীদের দর্শন!
তখন কানাডায় একদমই নতুন নতুন। কয়েক সপ্তাহই হয়েছে কেবল। সকাল সকাল উঠে স্কুলে যাবার সময়ে মনে হতো যুদ্ধক্ষেত্রে যাচ্ছি! ভয়ে ভয়ে গুটি গুটি পায়ে এক ক্লাস থেকে অন্য ক্লাসে আসা যাওয়া করি। ভাষা নিয়ে ভীষনই সমস্যায় পরলাম। আমি ওদের একসেন্ট বুঝিনা, আর ওরা আমারটা। এক কথা বুঝতে ও বোঝাতে দশবার রিপিট করতে গিয়ে বিরক্ত বোধ করি! কোন বন্ধু বান্ধব নেই। পড়াশোনায় থৈ খুঁজে পাচ্ছিনা। পদে পদে নানা কালচার শকে বেহাল অবস্থা। প্রতিদিনই নার্ভাস হয়ে স্কুলে যাই, আজকে আবার আজব দেশের কি আজব দৃশ্য দেখতে হবে ভেবে। আর দেশ ছাড়ার কষ্ট তো বর্ণনাতীত। মানিয়ে নেবার, মেনে নেবার চেষ্টায় ব্যস্ত আমি!
এমন সময়ে একদিন আমার E.S.L. ক্লাসের টিচার মিসেস ডি এসে বললেন আমরা স্টাডি ট্যুরে যাব। শহরের সবচেয়ে বড় লাইব্রেরীটা দেখাবেন আমাদেরকে। আর রেস্টুরেন্টে লাঞ্চ করবে সবাই। কানাডিয়ান এক্সপেরিয়েন্স হবে সবার। কানাডিয়ানদের সাথে কথা বলা, ওঠাবসা এসব শেখানো হবে। এসব বলে তিনি আমাদেরকে দুইটি ফর্ম দিলেন। একটি ফর্ম অন্য ক্লাসের টিচারদের দিয়ে সাইন করাতে হবে, কেননা তাদের ক্লাসটা আমার মিস করব। আরেকটি ফর্ম পরিবার সাইন করবে।
এই টিচারটিকে নিয়ে একটু বলি। চশমা চোখে, ভীষন খাড়া নাক ও ববকাট চুলের অধিকারী একজন কানাডিয়ান বয়স্কা নারী। সবমিলিয়ে কেমন যেন একটা বুদ্ধিমত্তার ঝিলিক ছিল চেহারায়। তবে টিচার হিসেবে ভীষনই বোরিং ছিলেন। উনি যা আউটলাইনে আছে তা না পড়িয়ে নিজের জীবনের গল্প বলে যেতেন ক্লাসের অর্ধেকটা সময়! বলতেন যে তিনি ৬৭ টা দেশে ভ্রমন করেছেন! আসলে ৬৭ র বেশি, তবে ৬৭ টা দেশ ভ্রমন করার পরে গোনাই বন্ধ করে দিয়েছেন। বিয়ের আগে ট্রাভেলিং পছন্দ করতেন না। হাসব্যান্ড এর প্রভাবে এখন নিজেরও ভালো লাগে। ওনার স্বামী, ছেলে, ছেলের গার্লফ্রেন্ড নিয়ে হাজার সব গল্প করতে করতে ক্লাস পার করতেন! ক্লাসে বেশিকিছু শেখাতেন না বলে আমাদেরকে বাড়িতে বেশি পরিশ্রম করে পড়তে হতো। ওনার গল্প মন দিয়ে না শুনলে ভীষন অসন্তুষ্ট হতেন। বলতেন, "ইউ গাইজ আর নট এপ্রিশিয়েটিং মাই প্রেসেন্স!" আমার পাশে একজন কোরিয়ান মেয়ে বসত, সে বিড়বিড়িয়ে বলত, "ইউ গট দ্যাট রাইট!" হাহা। আমি সেই গল্পগুলো প্রথমবার শুনছিলাম বলে খুব খারাপ লাগত না। তবে যারা সেই কোরিয়ান মেয়েটির মতো পুরোন ছিল, এবং বেশ কবছর ধরে ওনার গল্প শুনে আসছে তাদের বিরক্তি দেখার মতো ছিল।
যাই হোক, ট্যুরের কথা শুনে আমি প্রথমে বেশ খুশি হলাম। কেননা দেশে কখনো যাইনি স্টাডি ট্যুরে। বিদেশে থাকা আত্মীয়দের কাছে শুনতাম যে এদেশে স্টাডি ট্যুর হয়। স্কুল টাইমে সবাই বেড়াতে যায়! স্বপ্নীল চোখে শুনতাম আর কল্পনা করতাম। এখন আমি নিজেই সেই পজিশনে কিন্তু কি ভীষন এক অস্বস্তি জড়িয়ে! কানাডায় যেয়ে তখনো ততটা বাইরে যাওয়া হয়নি। ভীষন নার্ভাস ছিলাম। স্কুলেই অস্বস্তি বোধ করি, বাইরের পরিবেশে কিভাবে থাকব তা ভেবে ভয় করছিল। আবার আনন্দও লাগছিল।
দেখতে দেখতে ট্যুরের দিনটি চলে এলো! মেইন এনট্রেনসে সবাই জড়ো হলাম। টিচার এলেন। আমাদেরকে স্কুল বাসে নিয়ে গেলেন। বাসের প্রথম জানালার পাশের সিটে বসে পরলাম। আমার পাশে কেউ নেই। কেননা ক্লাসে সবারই নিজের নিজের দেশের মানুষ রয়েছে। আর ইংলিশ ভালো না হওয়ায় অন্য দেশের মানুষের সাথে সবাই কম কথা বলে। নিজেদের মধ্যে নিজেদের ভাষায় কথা বলে। আর যারা পুরনো তাদের তো বেশ ভালো বন্ধুত্বও রয়েছে একে অপরের সাথে। দূর্ভাগ্যবসত কোন বাংলাদেশী না থাকায় এবং নতুন হওয়ায় আমি একাই ছিলাম। সবাই নিজের দেশের মানুষের সাথে গল্প করতে করতে পাশাপাশি দল বেঁধে বসে পরল। একে অপরের সাথে হাসি ঠাট্টা করছে। চিপস, ড্রিংকস এসব শেয়ার করছে। আর আমি একা চুপচাপ বসে! একাকী ঘরে একাকীত্ব কঠিন, তবে ভীরে একাকীত্বটা বড্ড বেশি কাঁটার মতো বিঁধে!
সময়ে অসময়ে কানাডা আমাকে একাকীত্বের হাজার রং দেখিয়েছে! নতুনকালে বন্ধুহীন অবস্থায় কিছুটা, আর পুরোন হয়ে যাবার পরে বন্ধুসহ অবস্থায় হয়ত তার চেয়েও বেশি!!!
যাই হোক, গল্পে ফিরি। আমার পাশে খালি সিট থাকলেও অতোটা সমস্যা হতো না। আমার পাশে টিচার নিজেই বসে পরলেন! আমি জড়তা নিয়ে বসে আছি। টিচার পাশে বসা! কি করি, না করি! উনি বকবক শুরু করে দিলেন। কতদিন কানাডায় আছি, একা এসেছি না পরিবারের সাথে, কেমন লাগছে এসব হাজার প্রশ্ন। আমি ভাঙ্গা ইংলিশে সব জবাব দিয়ে যাচ্ছিলাম। বেশ অনেকক্ষন কথা বলতে বলতে চুপ হয়ে গেলেন। একটু হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করলেন। তখন আমি জানালা দিয়ে বাইরে তাকালাম।
আর বুকে ধক করে লাগল প্রকৃতি মায়ের অকল্পনীয় সৌন্দর্য! সারি সারি পাহাড়ের মেলা বসেছে চারিদিকে! স্বচ্ছ ঝকঝকে নীল আকাশের নিচে মাথা উঁচু করে দাড়িয়ে ছোট বড় নানা পাহাড়! আকাশে যেন পাহাড়ের প্রতিফলন দেখতে পাচ্ছিলাম! দেখে মনে হচ্ছিল পাহাড়ের চূড়ায় দাড়ালেই আকাশ ছোঁয়া যাবে! মেঘের পালে ভেসে যাওয়া যাবে! পাহাড়ের ভাজে ভাজে স্বপ্নের মতো সুন্দর সব বাড়ি ঘর! হঠাৎ দেখি পাহাড় তল ঘেষে একটা সরু নদী বয়ে চলেছে। আর তার চারিপাশে রং বেরং এর বুনো ফুল। নদীর সেই পানি এত স্বচ্ছ ছিল যে ফুলগুলোর ছায়ায় মনে হচ্ছিল সেগুলো নদীতেই ফুটে আছে! খুব ইচ্ছে করছিল বাস থেকে নেমে নদীর পানি ছুঁয়ে দিতে, ঘন্টার পর ঘন্টা সেখানেই বসে থাকতে! দূর থেকে পাহাড়, আকাশ, নদী, ফুল সবকিছুর সৌন্দর্য চোখে ধাঁধা লাগিয়ে দিচ্ছিল বারবার। এসব কি সত্যিই জানালার ওপাশে আছে নাকি কোন ভিডিও চলছে আমি আসলেই বুঝতে পারিনি অনেকক্ষন! মুগ্ধ হয়ে তাকিয়েই ছিলাম।
এভাবে জানালার কাঁচ দিয়ে প্রকৃতি দেখতে দেখতে অন্যমনস্ক হয়ে গেলাম। মনে হলো, এত সুন্দর প্রকৃতি, এত দেশের নানা মানুষের মাঝে কি ভীষন একা আমি! দেশে এতকিছু ছিলনা, কিন্তু সহজ সরল কিছু বান্ধবী ছিল। তাদের পাশে বসে কড়া শিক্ষকের কঠিন ক্লাসটাও হাসতে হাসতে পার করেছি। আর আজকে পুরো ক্লাস বেড়াতে এসেও আমার মনে আনন্দ নেই! মফস্বলের প্রজাপতির মতো চঞ্চলভাবে উড়ে বেড়ানো আমার জীবন কত রঙ্গিন ছিল! সব টিচার, বন্ধু, আত্মীয়দের ভীষণ আদরের আমি কত জড়তা নিয়ে একা বসে আছি আজ! মাসখানেক আগেও তো জীবন অন্যরকম ছিল! দেশের নানা সুখস্মৃতি বাসের জানালায় ভাসতে লাগল, আর আমার চোখ ঝাপসা হয়ে এলো। আমি ঝট করে চোখের আলগা পানি মুছে নিলাম টপকে পরার আগেই। নিজের মনকে ডাইভার্ট করতে হবে। দেশের কথা ভেবে কাঁদা যাবে না সবার সামনে!
এসব ভাবতে ভাবতে হুট করে সাফোকেশন ফিল করতে শুরু করলাম। কানাডার বাসগুলোর জানালা খোলা যায় না বলে কেমন যেন বদ্ধ লাগে। পাহাড়ি এলাকায় যখন বাস ওপরের দিকে যেতে থাকে দম আরোই আটকে আসে। তখনো পর্যন্ত এত লম্বা জার্নি করিনি আমি সেই এলাকায়। অনভ্যস্ততায় নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল। সালোয়ার কামিজের ওপরে পাতলা সোয়েটার পরে ছিলাম, সেটা খুলে ফেললাম। চুলগুলো হর্সটেইল করা ছিল, এবং জার্নিতে একটু এলোমেলো হয়ে গিয়েছিল। আমি খুলে বেনী করে নিলাম টাইট করে। পানি খেলাম। একটু পরে বেটার ফিল করতে লাগলাম। টিচার আমাকে জিগ্যেস করলেন, "এখন ভালো লাগছে?" আমি হেসে ফেললাম। মানে উনি আমাকে দেখছিলেন পুরোটা সময়। আমি ধাতস্থ হবার আগ পর্যন্ত কিছু বলেননি! বললাম, "হ্যা!" উনি বললেন, "তোমার চুল কত লম্বা! আমি অবাক হয়ে তোমাকে চুল বাঁধতে দেখছিলাম! এত লম্বা চুল কত তাড়াতাড়ি বেঁধে ফেললে! ব্যাংলাদেশে কি সবাই লম্বা চুল রাখে? তোমরাও কি ইন্ডিয়ানদের মতো রিলিজিয়াস কারণে চুল কাটো না?" আমি বললাম, না না, আমাদের তেমন কোন নিয়ম নেই। আমাদের দেশে ছোট, বড়, মাঝারি সব লেন্থের চুলের মানুষই রয়েছে। যে যার ইচ্ছে মতো চুল রাখে। উনি বললেন, "ওয়াও কুল!"
একটু বলে রাখি, কানাডায় ইমিগ্র্যান্টদের একটি বড় অংশই ভারতীয় পাঞ্জাবি। ইন্ডিয়ান কালচার বুঝতে তাই ওরা পাঞ্জাবি কালচারকেই বোঝে। ইভেন সাউথ এশিয়ান কালচার বুঝতেও ওরা পাঞ্জাবি কালচারকেই বোঝে!
একসময় বাস থেমে গেল। টিচার বললেন সবাইকে নামতে। নামার সময়ে বাস ড্রাইভারকে থ্যাংক ইউ বললেন। অন্যরাও বলল। আমরা নেমে টিচারকে ফলো করতে করতে ফুটপাত দিয়ে হাঁটতে লাগলাম। এখানে রাস্তাঘাট দেখে ছোটবেলায় খেলা ভিডিও গেইমস এর এনিমেটেড পরিচ্ছন্ন ছবির মতো রাস্তার কথা মনে হত। বিদেশীদের তৈরি সেসব গেইমের বিল্ডিং, পার্ক সহ আশেপাশের পরিবেশ এখানকার আদলে নির্মিত হতো। তাই ভিডিও গেইমস খেলতে খেলতে এর মধ্যে এসে পরলাম কিনা সেই ভাবনা মনে উঁকি দিত!
রাস্তা পার হবার সময়ে মিসেস ডি আমাদেরকে নিয়ম কানুন বলে দিলেন। দেখালেন যে, "pedestrian (পথচারী) ক্রসিং সিগন্যালস" কিভাবে কাজ করে। রাস্তার একপাশে লম্বা পোলে সুইচ থাকে। সেই সুইচ টিপে অপেক্ষা করতে হয়। রাস্তার অন্যপাশে ছোট স্ক্রিনে "চলন্ত মানুষ" সাইন দেখতে পেলে রাস্তা পার হতে হবে। একটা রাস্তায় কোন পথচারি সাইন ছিলনা। দেখি কি, চলন্ত গাড়ির ড্রাইভার আমাদের কাছাকাছি এসে গাড়ি স্লো করে থামিয়ে দিল। টিচার তার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলেন, তিনিও হাসলেন। আমরা রাস্তা পার হলাম। আমি মনে মনে ভাবছি, "টিচারের পরিচিত নাকি? ওহ না, নিশ্চই স্টুডেন্টদের সাথে দেখে বুঝেছে উনি টিচার, এজন্যে সম্মান করে থামিয়েছে গাড়ি!" এসব হাবিজাবি ভাবছি।
টিচার তখন বুঝিয়ে বললেন, কানাডার রাস্তায় পথচারী যানবাহনের চেয়ে বেশি গুরুত্ব পায়। এটাই এখানে নিয়ম। কোন রাস্তায় সিগন্যাল না থাকলে, ড্রাইভার নিজেই গাড়ি থামিয়ে দেবে। যেকোন পথচারীর জন্যেই। আমাদেরকে এও শিখিয়ে দিলেন, তখন ড্রাইভারের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসতে হবে যার মানে থ্যাংক ইউ!। উনি আরো বললেন, "তোমাদের জন্যে এটি নিশ্চই নতুন! সব দেশের ট্রাফিক রুলস এক নয়। এখানে রাস্তাঘাট তুলনামূলক ভাবে অনেক শান্ত না?" এশিয়ান বাচ্চারা হ্যা সূচক মাথা নাড়ল। ব্রাজিলিয়ান ছেলেমেয়েরা সবচেয়ে বেশি ইংলিশ পারত। ওরা বেশ ডিটেইলে বলল, ওদের দেশ অনেক বেশি ক্রাউডি। জ্যাম থাকে বেশি এসব।
আমিও মনে মনে ভাবছিলাম যে দেশে রাস্তায় কত শব্দ থাকত! গাড়ি, সিএনজি, বাসের প্যা পু হর্ণ, রিকশার টুং টাং শব্দ, সিডির দোকানে জোরে বাজতে থাকা গান, চায়ের দোকানে তুমূল আলোচনার ঝড়, রাস্তার ধারে নানা জিনিস বেঁচতে থাকা ক্রেতা বিক্রেতার দরদাম; সবমিলিয়ে রাস্তায় থাকলে বোঝা যায় যে রাস্তায় আছি! এখানে, মোটামুটি বিজি রোডেই হাঁটছি সবাই, কিন্তু তেমন কোন আওয়াজ নেই। ভিড় দেশের মতো অতোটা কোনভাবেই নয়। আর যতটা আছে তাও আশ্চর্য রকম নীরব!
এসব ভাবতে ভাবতে টিচারের কথা কানে এলো, আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, "ইন ব্যাংলাদেশ, হাও ইজ ইট? ক্রাউডি এন্ড নয়েজি রাইট? পিপল ইয়েলিং, রিকশা রিকশা?" বলে হো হো করে হেসে নীরব রাস্তায় প্রানসঞ্চার করে ফেললেন। ওনার মুখে স্পষ্ট রিকশা উচ্চারন শুনে, এবং আমাদের মতো ডাকার ভংগিতে আমি ভীষনভাবে চমকে উঠলাম। পরে মনে হলো, ইন্ডিয়া ভ্রমণের ফল!
উনি বলছিলেন, "কিছু কালচারে খুব জোরে কথা বলে। যেমন আমার এক কলম্বিয়ান বান্ধবী হাসব্যান্ডের সাথে নরমাল আলোচনা করছিল। কিন্তু আমি ভেবেছিলাম ওরা নির্ঘাত ডিভোর্সের কথা বলছে! হাহা। ওদের ডায়ালগটা এমনই লাউড! কিন্তু কানাডায় খুব সফটলি, পোলাইটলি মানুষ কথা বলে!" আমার মনে হলো আসলেই তাইতো! কানাডিয়ানরা এমনভাবে কথা বলে যেন বেশি জোরে বললে কথা ব্যাথা পাবে! দেশের চিল্লাচিল্লি ভীষন মিস করছিলাম। মনে হচ্ছিল কেউ যদি আমাকে সেই শব্দগুলো রেকর্ড করে শোনাত তাকে লাখ টাকা দিতাম!
এভাবে হাঁটতে হাঁটতে লাইব্রেরী পৌঁছালাম সবাই। সে এক দেখার মতো লাইব্রেরী। বিল্ডিং বাইরে থেকে দেখেই থ! আর ভেতরে ঢুকে চমৎকার ইন্টেরিয়ার ডেকোরেশন দেখে আরোই অবাক। চারিদিক আর্টিফিশিয়াল গাছ দিয়ে সাজানো। গ্লাসের তৈরি লম্বা লম্বা জানালা। জায়গায় জায়গায় এত সুন্দর ও আরামদায়ক সব সোফা আর বসায় জায়গা! আমার মনে হচ্ছিল এখানে মানুষ বই পড়তে আসে না ঘুমাতে?
লাইব্রেরীর ভেতর দিয়ে সিড়ি চলে যায়। সেই সিড়ি দিয়ে সবাইকে তিন তলায় আনলেন মিসেস ডি। প্রতি তলায় সুসজ্জিত ভাবে বই সাজানো নানা তাকে। অজস্র বই। সবগুলো তালা মিলে কত বই আল্লাহই জানেন! জায়গায় জায়গায় টেবিল, চেয়ার, কম্পিউটারস। মিসেস ডি আমাদেরকে এক জায়গায় দাড় করিয়ে বললেন, "একটি নভেল ক্লাসে করানো হবে। এটি আমরা লাইব্রেরিয়ানের কাছে একে একে চাইব। চাইবার সময়ে প্লিজ বলতে হবে, এবং পাবার পরে থ্যাংক ইউ বলতে হবে।" শেখাতে শেখাতে আরো বললেন, "পৃথিবীর অনেক দেশে মানুষজন এসবের ধার ধারে না। কিন্তু এটা আমাদের কালচারে ভীষনই জরুরি।!" ওনার কথা শোনার পরে আমরা লাইন ধরে বই নিচ্ছি। হংকং এর একটা ছেলে প্লিজ বলতে ভুলে গিয়েছিল, টিচার ওকে মনে করিয়ে দিলেন, "সে প্লিজ!" তখন লাইব্রেরিয়ান মুচকি হাসতে লাগল। আমরা যে অন্যদেশের মানুষ, আর আমাদেরকে কথা বলা শেখানো হচ্ছে সেটা বুঝতে পেরে। টিচারের শেখানো নিয়মে ঠিক ইংলিশ বাক্যে চাইবার আগ পর্যন্ত বই পাওয়া যাবেনা। চেষ্টা করে যেতে হবে! কেউ কেউ একটু টাইম নিল। আর কেউ কেউ সহজেই বলে ফেলল। আমিও মনে করে ঠিকভাবে প্লিজ থ্যাংক ইউ সব বলে বই নিলাম।
কানাডিয়ানরা ভীষনই বিনয়ী একটি জাতি। কানাডার রাস্তায় কয়েক কদম হাঁটলেই সেটা টের পাওয়া যায়! বাস ড্রাইভারের কাছ থেকে টিকিট নেবার সময় যদি থ্যাংক ইউ বলতে ভুলে যান তবে তারা মনে করিয়ে দেবে! বাসের পিছের দরজা দিয়ে কেউ নামলে, চিৎকার করে থ্যাংক ইউ বলে। যাতে সামনে বসে থাকা ড্রাইভারের কানে যায়। এসব এখানে ধর্মের মতো মানা হয়। আর ওরা এটাও জানে যে পৃথিবীর বেশিরভাগ দেশে এসব কঠোরভাবে মানা হয়না। তাই এসব বিনয় কোন ভিনদেশী ভুলে গেলে মুচকি হেসে এমনভাবে তাকাবে যে, "তোমাদের দেশে অন্য নিয়ম থাকতে পারে। কিন্তু আমাদের দেশে এসব চলবে না! এটা কানাডা। এখানে প্লিজ, থ্যাংক ইউ, সরি ছাড়া কিছু হয়না!" হাহা। কানাডিয়ানরা অন্যদেশের সাজপোশাক, খাবার দাবার, উৎসব, গান মুভি সহ সবকিছুকে মারাত্মক সম্মান করে। সেসব নিয়ে কানাডায় চলা কোন ব্যাপারই না। ওরা বরং এনজয় করে যে নানা দেশের মানুষের সংস্কৃতি ওদের দেশকে রঙ্গিন করে তুলেছে। কিন্তু কিছু কিছু ব্যাপারে একদমই কম্প্রোমাইজ করবে না। বিনয় এমনই একটা ব্যাপার! বিনয় নানা দেশে যে রূপেই থাকুক, কানাডায় ওদের মতো করেই মানতে হবে!
যাই হোক, অসম্ভব সুন্দর ও বৃহৎ লাইব্রেরীটি ঘুরে আমরা বেরিয়ে আসছিলাম। টিচার বাইরে দাড়িয়ে ছিলেন। বেরিয়ে ওনার কাছে দাড়ানোর পরে আমাকে বললেন, "তুমি কিছু ভুলে গিয়েছ! শিখিয়েছিলাম তোমাদেরকে!" হাসতে হাসতে বললেও উনি যে অসন্তুষ্ট সেটা বেশ বুঝলাম। আমি ভাবলাম আমি আবার কি করলাম? কি ভুলেছি?
পরের পর্বে ভ্রমণ চলতে থাকবে...............
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে জুন, ২০১৭ রাত ১:১৮