আবারো প্রবাস জীবনের গল্পের ঝাঁপি খুলে বসলাম। থাকছে মজার কিছু গল্প এবং বিদেশীদের দৃষ্টিতে আমাদের কিছু ছবি!
আগের সিরিজ: কানাডার স্কুলে একদিন (এক থেকে বাইশ): পর্ব বাইশ । পর্ব বাইশে অন্য সকল পর্বের লিংক রয়েছে!
আগের পর্ব: কানাডার স্কুলে একেকটি দিন (পর্ব ১) - বাংলাদেশীদের যেসব বিষয় বিদেশীরা অদ্ভুত মনে করে!
তখন কানাডার হাইস্কুলে নতুন নতুন। ইংলিশ ভালো পারি না বলে বন্ধুবান্ধব তো দূরের কথা দুটো কথা বলার মানুষও নেই স্কুলে। কিন্তু সেটা নিয়ে বেশি দুঃখিত হবার সুযোগ আমার নেই কেননা তার চেয়ে বড় সমস্যা মাথায় ছিল। পড়াশোনা! হ্যা কানাডিয়ান এডুকেশন সিস্টেম বাংলাদেশের চেয়ে এত বেশি আলাদা যে আমি কোন কূল কিনারা করতে পারছিলাম না। খুব খাটতাম, পুরো বই পড়ে শেষ, কিন্তু পরীক্ষায় তেমন ভালো মার্ক পাচ্ছিলাম না! এক প্রশ্ন ডাইরেক্টলি আসেনা, আর অন্য ভাষা হওয়ার কারনে ধরতে পারতাম না ঠিক কি চাচ্ছে? বাংলাদেশে তো গাইড বইয়ে অনেক প্রশ্ন থাকত, সেগুলো মুখস্থ্য করে পরীক্ষার খাতায় ঝেড়ে দিতাম। কানাডায় কোন গাইড বই থাকেনা।
আমার কানাডিয়ান জীবনের প্রথম সোশাল স্টাডিস ক্লাসের কথাই বলি। টিচার প্রতি ক্লাসে ওয়ার্কশিট দিতেন যাতে বইয়ের একটি চ্যাপ্টার নিয়ে প্রশ্ন থাকত। বই থেকে সেসব প্রশ্নের উত্তর বের করে লিখে টিচারকে দেখাতে হবে, ক্লাসটাইমে শেষ করতে না পারলে হোমওয়ার্ক হিসেবে পরেরদিন দেখাতে হবে। এর ওপরে কোর্সের ১৫% মার্ক আছে। এভাবে ছাত্রছাত্রীরা যেন নিজেরই একটা গাইডবুক তৈরি করে ফেলে! সপ্তাহখানেকের মধ্যে টেস্ট থাকে সেই চ্যাপ্টারের ওপরে। ভাষা না বুঝলেও বইসংক্রান্ত এসাইনমেন্টগুলো মাস কয়েকের মধ্যে আয়ত্বে এনেছিলাম। ডিকশনারি থেকে শব্দগুলো শিখে বারবার পড়ে অনেক কষ্টে বুঝতাম, তবুও বুঝতাম তো! কিন্তু কানাডিয়ান এডুকেশন সিস্টেমে বই কোর্সের ৪০%। বাকি ৬০% বইয়ের বাইরের একটিভিটিস। একটা উদাহরন দিচ্ছি।
একদিন টিচার এসে বললেন মুভি এসাইনমেন্ট করতে হবে আমাদেরকে। মুভি দেখে টিচারের দেওয়া ওয়ার্কশিট থেকে প্রশ্নগুলোর উত্তর লিখতে হবে! আর মুভি শেষেই জমা দিতে হবে। বাপরে! আমি কি করে করব? এমনকিছু তো কোনদিন করিনি! তাও চেষ্টা তো করতে হবে, মার্ক আছে এসাইনমেন্টটিতে। আমি খাতা কলম সাজিয়ে বসে আছি। দু একটা পয়েন্ট তুলতে পারি যদি কোনভাবে, তারপরে বইয়ের হেল্প নিয়ে কিছু একটা দাড় করিয়ে ফেলব।
মুভি শুরু হল। কানাডায় ফ্রেঞ্চদের উপনিবেশ এবং আদিবাসীদের সাথে সম্পর্ক এসব নিয়ে মুভিটি ছিল। তখন আমি কানাডিয়ান একসেন্ট সবে বুঝতে শুরু করেছি, পুরোপুরি বুঝিনা। সেই সময়ে ফ্রেঞ্চ এবং এবোরিজিনাল ইংলিশ একসেন্টের একটা শব্দও আমার বোঝার কথা না এবং আমি বুঝিও নি। সাবটাইটেলও ছিলনা। প্রথম আধা ঘন্টা চেষ্টা করার পরে হতাশ হয়ে আলতো করে পেনটা ছুড়ে মারলাম পেপারের ওপরে। আমার এখনো মনে আছে পুরো ৫৫ মিনিট কি ভীষন এক অসহায়ত্বে কাটিয়েছিলাম! সবাই বুঝতে পারছে শুধু আমি ছাড়া! আশেপাশে কানাডিয়ান স্টুডেন্টরা অতি উৎসাহে মজা করে গল্প করতে করতে লিখে যাচ্ছে। খুব একা মনে হচ্ছিল নিজেকে। ছলছল চোখে বসে ছিলাম। ভাগ্য ভালো রুমটা অন্ধকার করা ছিল মুভির জন্যে নাহলে সবাই হয়ত কাঁদো কাঁদো আমাকে দেখেই ফেলত।
সবাই যখন লিখছে, আমাকেও তো কিছু লেখার ভান করতে হয়! আমি ওয়ার্কশিট থেকে প্রশ্নগুলোই আবারো তুলছিলাম যাতে কেউ বুঝতে না পারে আমি কিছু পারিনা! এভাবে করে ক্লাসটা শেষ হল। সবাই যাওয়ার পরে টিচারের কাছে গিয়ে লিখলাম যে আমি বুঝতে পারিনি ভাষা। জ্বি পাঠক বলা না লেখা! সেই টিচার আমার কথার একটা শব্দ বুঝতেন না, এজন্যে আমাকে লিখতে হত। উনি স্কুলের সবচেয়ে কড়া, বোরিং, অপছন্দনীয় টিচার ছিলেন। একজন কানাডিয়ান, শুভ্র চুলের বয়স্ক পুরুষ। ভীষন রুক্ষ ছিলেন, কখনো ওনাকে হাসতে দেখিনি আমি। অন্যসব টিচার বুদ্ধি করে আমার ভাঙ্গা ইংলিশও কিভাবে যেন বুঝে নিতেন কিন্তু উনি একদমই পারতেন না। তাই লিখে লিখে কথা বলতে হত, আমি ওনার কথা মোটামুটি বুঝতাম। তো আমি লিখতাম, উনি বলতেন।
উনি বললেন যা লিখেছ জমা দিয়ে দেও। আমি মন খারাপ করে সাদা খাতা জমা দিলাম। পরের দিন সবাইকে মার্কড এসাইনমেন্ট ফেরত দিলেন। আমারটায় কোন মার্ক ছিলনা। আমি ওনার কাছে গেলে উনি বললেন, "তোমার জন্যে আমি এসাইনমেন্টটা চেন্জ করে দিচ্ছি। তুমি এই প্রশ্নগুলোর উত্তর বইয়ে পুরোপুরি পাবে না। মুভি বুঝবে না। তাই নেট সার্চ করে রিসার্চ করে লিখবে। সেটার মার্ক দিয়ে আমি মুভি এসাইনমেন্টের মার্ক রিপ্লেস করে দেব।" আমি অবাক হয়ে গেলাম! ওনার মতো কড়া মানুষের কাছ থেকে এমন হেল্প আশাই করিনি।
তো এমনই ছিলেন কানাডিয়ান শিক্ষকেরা। সব স্টুডেন্টকে টু দ্যা লিমিট পুশ করতেন। কত কঠিন সব এসাইনমেন্ট করে ফেলেছি তাদের "করতেই হবে" শুনে! ওনাদের অনুপ্রেরনায় ৯০% এসাইনমেন্টই ভালভাবে করতে পেরেছি। যেই ১০% সময়ে অসফল হয়েছি, তারা কোন না কোন অলটারনেটিভ ভেবে আমাকে সাহায্য করেছেন। সেটি আমার ওভারঅল মার্ক খুব একটা এফেক্ট হয়ত করত না। কিন্তু আমার মনে একটা বিশ্বাস থাকত যে অসম্ভব কিছু আমার টিচারেরা আমাকে করতে বলবেন না। কঠিন যেকোন কিছু করতে বলবেন, কিন্তু অসম্ভব হলে তার পাশে আছেন! সেই বিশ্বাসেই আমি মানিয়ে নিয়েছি, নিতে পেরেছি!
যাই হোক, ওপরে যে কাহিনী বললাম, তেমন কিছু না কিছু প্রতি ক্লাসে প্রতিদিন লেগে থাকত। প্রতিদিন! উদ্ভট সব এসাইনমেন্ট দিত। যেমন কাগজের রুবিকস কিউব বানিয়ে তার মধ্যে শেক্সপিয়ারের ম্যাকবেথ নিয়ে ছবি আঁকো ও লেখ। টিচারকে রাজা ভেবে নিজে প্রজার মতো করে তৎকালীন সব সমস্যা তোমার জীবনে কি প্রভাব ফেলছে তা নিয়ে স্ক্রিপ্ট লেখো এবং অভিনয় করে দেখাও। ঘরের তৈরি জিনিসপত্র দিয়ে খেলনা গাড়ি তৈরি করো এবং ফিজিক্সের সূত্র সেটি তৈরিতে কি প্রভাব ফেলেছে তা বর্ণনা করো! আমাদের দেশে এত রং বেরং এর এসাইনমেন্ট করার অভ্যাস ছিলনা আমার। মুখস্থ্য করে যেতাম অন্যসবার মতো। তাই ক্রিয়েটিভ কিছু করতে অসুবিধা বোধ করতাম। আমি বুঝতেই পারতাম না ইংলিশে আঁকাআঁকি, সোশাল স্টাডিসে অভিনয় স্কিলস এর পরীক্ষা নিয়ে কেন এরা আমার মাথা খারাপ করে দিচ্ছে? ভীষণ অস্বস্তি বোধ হতো এমন সব এসাইনমেন্টে।
এসব এসাইনমেন্ট শুনতে খুব মজার শোনায়। মনে হয় খেলতে খেলতে ওরা শেখে! কিন্তু ক্রিয়েটিভ কিছু করারও নিজস্ব চ্যালেন্জ রয়েছে। সেটা আমি সহ অন্যান্য কানাডিয়ান স্টুডেন্টদের জন্যেও সত্য। তবে অবশ্যই আমার জন্যে বেশি কঠিন ছিল যেহেতু আমি অন্য ধরণের এডুকেশন সিস্টেমে পড়াশোনা করেছি। এসব জিনিসের ঠিক ভুল নেই। মার্ক ভালো পাব না খারাপ তা পুরোপুরি টিচারের রুচির ওপরে নির্ভর করে। টিচার আসলে কি চান সেটা জানতে হবে। কিন্তু টিচার কি চান তাই বা জানব কি করে? খটমটে কানাডিয়ান একসেন্ট তো সহজে বুঝিই না! সবমিলে অদ্ভুত এক অসহায় অবস্থায় দিন কাটাতাম। তবুও শেষ পর্যন্ত ফাইনাল রেসাল্ট দেখলে আমার স্ট্র্যাগল বোঝা যেত না। প্রতি সেমিস্টারে শুরুতে যতোই স্ট্র্যাগল করিনা কেন শেষে মানিয়ে নিতাম। আমার চেষ্টা পাশাপাশি টিচারদের সহযোগিতা তার একটি বড় কারণ ছিল।
তো আমি চেষ্টা করে যাচ্ছিলাম কানাডিয়ান এডুকেশন সিস্টেম নামক পাজলটি সলভ করার। একদিন লাঞ্চে ম্যাথ ক্লাস রুমে বসে একটা এসাইনমেন্ট করছি। টিচার সেই রুমেই ছিলেন, লাঞ্চ করতে করতে কিছু মার্ক করছিলেন। উনি জানতে চাইলেন আমার কাছে, "কেমন আছি?" আমি বললাম ভালো। আমার ভালো বলার মধ্যে নিশ্চই ক্লান্তি মিশে ছিল, উনি ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে চোখের ইশারায় জানতে চাইলেন কি ব্যাপার? ওনার জিগ্যেস করার ভংগিতে হেসে ফেললাম। বললাম, "এই সোশাল স্টাডিস এসাইনমেন্টটা কি করে করব বুঝতে পারছিনা, অনেক কঠিন।" তিনি বললেন, "এত স্ট্রেসড হয়ো না পড়াশোনা নিয়ে। ইউ আর ডুয়িং ফাইন। স্টাডি ইজ নট এভরিথিং। ইন সাম পার্টস অফ দ্যা ওয়ার্লড ইট ইস, বাট নট ইন ক্যানাডা। ইউ গেট টু বি আ কিড অনলি ওয়ানস ইন লাইফ! এনজয় ইট!" একদম ওয়ার্ড টু ওয়ার্ড এই কথাগুলোই বলেছিলেন।
আমি থ হয়ে গেলাম। টিচার বলছেন পড়াশোনা সব নয়? আনন্দ করো? শুধু উনিই নয়, এই কথাগুলো ওখানে প্রায় সব টিচারকেই বলতে শুনেছি আমাকে এবং বিশেষ করে জাপান/চায়না/কোরিয়ার স্টুডেন্টদের। পড়াশোনায় সিরিয়াসনেসে ওরা আরেক কাঠি। আমরা বাংলা মিডিয়ামেও যতটা ইংরেজি শিখি, ওরা তার কিছুই শেখে না। এমন অনেক জাপানিজ স্টুডেন্ট দেখেছি E.S.L. ক্লাসে যারা ইংলিশ বড় হাতের লেখা লিখতে পারত কিন্তু ছোট হাতের না! কিন্তু অবাক ব্যাপার, একটা ভাষা প্রায় না জেনেই শুধুমাত্র কঠোর পরিশ্রম ও মনের জোরে ভালো রেসাল্ট করত এরা! আমি মনের জোর পেতাম এদের দেখে, যে আমি যত ইংলিশ জানি ওরা তো তাও জানে না। তবুও তো ভালো করছে।
আমাদের সেই ম্যাথ টিচার চায়নায় শিক্ষকতা করেছিলেন দু বছর। সবসময় গল্প করতেন সেখানকার নানা অভিজ্ঞতার। একদিন সেই ক্লাসে অনেক লম্বা, অদ্ভুত হেয়ারস্টাইলের একটা ছেলে টিচারকে জিগ্যেস করছে, "আচ্ছা আমি শুনেছি এশিয়ান বাচ্চারা আমাদের চেয়ে অনেক স্মার্ট, এটা কি ঠিক? আর উই কানাডিয়ান কিডস ডামব?" বেশ সরল ভাবেই প্রশ্নটা করল।
টিচার বললেন, "হ্যাএএ এশিয়ান বাচ্চারা আসলেই অনেক স্মার্ট। হেই গাইজ ডু ইউ নো, আমি যখন চায়নায় পড়াতাম, দেখতাম ওখানে বাচ্চারা স্কুলের পরে আবার অন্য একটা ইনিন্সটিটিউশনে যেত এক্সট্রা পড়ার জন্যে! আমি মনে মনে ভাবছিলাম, আমাদের দেশের কোচিং সেন্টার! এসব বলে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, "ইন ব্যাংলাদেশ এজ ওয়েল, রাইট?" আমি হ্যা সূচক মাথা নাড়লাম। উনি বলে গেলেন, "বাচ্চারা স্কুলের হোমওয়ার্ক তো করেই। আবার সেই এক্সট্রা ইনিন্সটিটিউশনেও হোমওয়ার্ক করে! ওদেরকে সকাল থেকে রাত পড়তেই দেখবে। অন্যকিছু করার সময় সেভাবে পায় না। বাট, হেই ইয়াং ম্যান, কানাডিয়ান কিডস আর নট ডামব! আমাদেরও অনেক স্মার্ট ছেলেমেয়ে আছে! তোমার মতো! তুমি আমাকে সেদিন বাস্কেটবলে হারিয়ে দিয়েছ! ইউ আর স্মার্ট এট বাস্কেটবল!" বলে চোখ টিপলেন। ছেলেটা হাসল, উনি হাসলেন।
আমি মনে মনে ভাবছি এই পাংক ছেলে যার দিনের অর্ধেকটাই হেয়ারস্টাইল ঠিক করতে কেটে যায়, প্রত্যেকটা এসাইনমেন্টই লেইটে জমা দেয়, তাকে স্মার্ট বলার মানে কি? আর বাস্কেটবল? দ্যাট কাউন্টস ফর স্মার্টনেস? আর টিচার স্টুডেন্ট মিলে কেন খেলবে? এসব ভাবতে ভাবতে মাথা ঘুরতে শুরু করল। কানাডার ক্লাসগুলো এমনই হতো। টিচার পড়াতে শুরু করার আগেই, গল্পে গল্পে আমার মাথা ঘুরিয়ে দিতেন!
একদিন, ইংলিশ ক্লাসে লাঞ্চ ব্রেইকে পড়া বুঝতে গিয়েছি। ক্লাস চলাকালিন সময়ে টিচারের অনেক কথা বুঝতাম না। আর প্রশ্নও করতে পারতাম না বারবার। কেননা এতবার প্রশ্ন করে করে একসেন্ট বোঝার চেষ্টা করলে অন্য স্টুডেন্টদের সময় নষ্ট হবে। আমি একা থাকলে টিচারেরা আরেকটু স্লো বলতে পারতেন। এজন্যে বেশিরভাগ দিনই ব্রেইকে আমি টিচারের কাছে ছুটে যেতাম পড়া বোঝার জন্যে। এটা এখানে কানাডিয়ান স্টুডেন্টরাও করে। যদি কোন কিছু ক্লাসে না বোঝে তবে ব্রেইকে আসলে টিচার আগ্রহ নিয়ে বুঝিয়ে দেয়। বেশিরভাগ টিচার, দু একজন যদিও ব্রেইকে পড়া দেখাতেন না।
সেদিন লাঞ্চে ইং নামের এক কোরিয়ান মেয়ে আমার খানিক আগে ক্লাসে ঢুকেছে। ইং আমার E.S.L. ক্লাসের এক কোরিয়ান সহপাঠীর বান্ধবী ছিল। তিন বছর ধরে কানাডায়, ইংলিশ অনেক ভালো পারত। আমার চেয়ে এক গ্রেইড ওপরে পরত। সে লাঞ্চ বক্স টেবিলে রাখল। সিটে বসে এয়ারফোন লাগালো কানে। ব্যাগ থেকে বই বের করবে। তখনই টিচার বললেন, "ইং যাও, বাইরে যাও। লাঞ্চ করো অন্যদের সাথে, সোশালাইজ করো।" ও তখন মুখ বিগড়ালো, মানে যাবে না, পড়বে। উনি মিষ্টি হেসে বললেন, "নো, দিজ ইজ নট স্টাডি টাইম। আউট! আউট অফ মাই ক্লাস!" ও রাজ্যের যতো বিরক্তি আর অনীহা নিয়ে বের হলো। আর টিচার হো হো করে হেসে দিলেন ওর করুণ অবস্থা দেখে!
এই সিন দেখে তো আমি ভয় পেয়ে গেলাম। আমার পড়া দেখিয়ে দেবেন তো? পরীক্ষা আছে কয়েক ক্লাস পরেই! ওনাকে প্রশ্নটি জিগ্যেস করতে গেলাম। ওনার রহম হলো অন্তত আমার ওপরে, বুঝিয়ে দিলেন বিষয়টি। আমি বুঝে আর ওখানে থাকলাম না। ক্লাসের বাইরে আসতে আসতে ভাবছিলাম আমাদের মফস্বলে কোন স্টুডেন্ট লাঞ্চেও পড়লে টিচার তাকে নিয়ে গদগদ হয়ে যাবে। বাবা মাকে ডেকে প্রশংসা করবে। বাচ্চারা বেশি আড্ডাবাজি করলে সেটাকে খারাপ মনে করেন তারা। আর এখানে প্রত্যেকটা টিচার সোশালাইজিং এর ওপরে ভীষন জোর দেয়। শান্ত বাচ্চাদের জোর করে পাঠায় যেন তারা বন্ধু বানায়, মানুষের সাথে মেশে! কি আজব দেশ!
কানাডিয়ান বাচ্চা এবং বড়দের চোখে এশিয়ান বাচ্চাদের নিয়ে নানা ধরণের দর্শন রয়েছে। বাচ্চারা অবাক হয়ে ভাবে এশিয়ান বাচ্চারা এত স্মার্ট কি করে? সবাই ভালো মার্ক পাচ্ছে! আমাদের এডুকেশন সিস্টেম অনেক টাফ এটা ওরা জানে এবং বেশ সম্মানের চোখে দেখে। ওদের ভাব এমন, "ইশশ! আমাদের এডুকেশন সিস্টেম যদি কঠিন হতো, আমরাও ওদের মতো স্মার্ট হতাম!" হাহাহা।
কিন্তু বড়দের ভাবনা অন্যরকম। তারা মনে করেন আমরা আনহেলদী এডুকেশন সিস্টেমে আনহেদলী ওয়েতে মানুষ হচ্ছি। ওনাদের ভাব দেখে মনে হতো, বেচারা এশিয়ান বাচ্চারা নিজের দেশে জীবনকে এনজয় করতে শেখেনি। তাদের পরম দায়িত্ব আমাদেরকে রিয়েল বাচ্চাদের মতো বিহেভ করতে শেখানো। এজন্যেই আমি সহ অন্যান্য এশিয়ান বাচ্চাদের পেছনে ওনারা সবসময় লেগে থাকতেন। বন্ধু বানাও, খেলাধূলা করো, ক্লাব জয়েন করো, স্টাডিইং ইজ নট দ্যা এন্ড অফ দ্যা ওয়ার্লড! আমার বিরক্তি ধরে যেত। দেশে তো শুধু পড়াশোনায় জোর করে, এখানে সবকিছুতেই! মনে মনে বলতাম, তোমাদের ওয়ার্ল্ড আর আমার ওয়ার্ল্ড এক না। পড়ালেখায় খারাপ করলে আমার ওয়ার্ল্ডের সবাই মিলে মাশরাফি ভাইয়ের ভাষায় আমাকে "ধরে দেবানি!"
বিশেষ কথা: তখন এসব নিয়ে মনে মনে হাসাহাসি করলেও এখন বুঝি যে কানাডিয়ান টিচারদের কথা কত ঠিক ও স্বাভাবিক ছিল। আসলেই তো প্রত্যেকটা বাচ্চা নিজের নিজের ট্যালেন্ট নিয়ে জন্মায়। কানাডায় বাচ্চারা যদি পড়াশোনায় ভালো নাহয় টিচার বলেন, তুমি তো অন্যকিছুতে ভালো। কোন বাচ্চা যেন নিজেকে নিয়ে হীনমন্নতায় না ভোগে সেটা নিয়ে বিশেষভাবে সচেতন থাকেন। পড়াশোনা ভীষণ জরুরি, তবে একটি বাচ্চার জীবনে তো আরো অনেককিছু থাকবে। একটি বড় মাঠ, অনেক খেলার সাথী, বুক ভরে নেবার মতো বিশুদ্ধ নিঃশ্বাস এবং আনন্দময় একটি ছেলেবেলা। এই ছোট্ট জিনিসটি আমরা আমাদের বাচ্চাদের দিতে পারিনা। এই কঠিন সত্যিটা কানাডিয়ানরা বাইরে থেকেই এতটা রিয়ালাইজ করেন। তো আমরা বাংলাদেশীরা কতটা রিয়ালাইজ করি সেটা বলাই বাহুল্য। বাবা মা, শিক্ষকেরাও যেন অসহায়। ১০ বছরের বাচ্চার কাঁধে ৩০ টি বই দেখে। চশমা পড়া নির্লিপ্ত সিরিয়াস ফেইসগুলো দেখে। যে চোখে রংগিন স্বপ্ন, হাসির ঝিলিক থাকার কথা তাতে রাজ্যের দুশ্চিন্তা! আমাদের দেশের বাচ্চারা ছেলেবেলাকে এনজয় করে না। ব্যাস অপেক্ষা করে, ছেলেবেলা কবে শেষ হবে সেই অপেক্ষা!
এমন নয় যে আমাদের বাচ্চাদের কিছুই নেই। পরিবারের সবার অনেক আদর মমতায় বড় হচ্ছে। যেটার অভাব দেখেছি এখানে। কিন্তু শিক্ষা ব্যবস্থায় অনেক ত্রুটি রয়েছে যা বাচ্চাদের ছেলেবেলাকে মেরে ফেলছে লিটারেলি। এখনো কানে বাজে সেই কানাডিয়ান টিচারের কথাটি, "ইউ গেট টু বি আ কিড অনলি ওয়ানস ইন লাইফ!" আমরা সবাই এই সহজ কথাটি কবে বুঝব?
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই জুন, ২০১৭ সকাল ৮:৫৫