অনেকদিন কানাডার স্কুলে একদিন সিরিজের কোন পর্ব লেখা হয়নি। যারা সিরিজটির রেগুলার পাঠক ছিলেন, তাদের কাছে ক্ষমাপ্রার্থী যে নানা কারণে পোষ্ট দিতে পারিনি। তবে এখন আবার শুরু করছি। এই শুরুটাকে একটি নতুন শুরুও বলা যায়। কেননা এতদিন আপনারা পড়েছেন; মফস্বলের সাধারণ দু বেনী করা স্কুল গোয়িং কিশোরি মেয়েটি একদিন বৈদেশের পথে পাড়ি দিল। নিজের ছোট্ট মফস্বল যার দুনিয়া ছিল, তাকে টেনে হিচড়ে সত্যিকারের দুনিয়ায় ছুড়ে ফেলা হলো। সেখানে আসলেই পুরো দুনিয়ার নানা প্রান্তের মানুষের মেলা বসে। তার দুনিয়া পাল্টালেও তাকে পাল্টাতে হয়নি। সব দেশের বিনয়ী বন্ধুভাবাপন্ন মানুষ, অসম্ভব হেল্পফুল শিক্ষকেরা সবসময় তাকে সাহায্য করেছে। কদাচিৎ কিছু মানুষ বিব্রতও করেছে। মেয়েটি কৈশোরের বালাই বয়সে, ভিন্ন ভাষা, জাতি ও সংস্কৃতির সম্মুখে পদে পদে হোঁচট খেয়েছে, কেঁদেছে, হেসেছে, পড়েছে, সামলেছে। যারা পড়েননি সিরিজটির কোন পর্ব তাদের জন্যে একটি সামারি দিলাম। মোরাল অফ দ্যা সামারি: আমি নিজের অনুভূতির, দৃষ্টিভংগির কথাই বেশি বলেছি।
কানাডার স্কুলে একদিন (এক থেকে বাইশ): Click This Link পর্ব বাইশে অন্য সকল পর্বের লিংক রয়েছে!
নাও, লেটস টার্ন দ্যা টেবিল আদার ওয়ে এরাউন্ড ! এখন বলব, বিদেশীরা কিভাবে বাংলাদেশের মানুষ ও সংস্কৃতিকে দেখে! আমাদের সংস্কৃতি ওদেরকে কিভাবে ধাক্কা দেয়? ওরা কিইবা ভাবে আমাদেরকে নিয়ে? এছাড়াও, অন্য নানা দেশের মানুষ কানাডায় কতটা কালচার শক পায় সেটিও বলব। মানে আমার নিজের চেয়ে বেশি অন্যদের দৃষ্টিভংগি লেখার চেষ্টা থাকবে। তবে ফাঁকে ফাঁকে আমার নিজের ভাবনা চিন্তা অবশ্যই আসবে যেহেতু আমার জীবনেরই ডায়েরি!
শুরু করার আগে বলি, বাংলাদেশ ও দেশের সংস্কৃতিকে আলাদা করে অনেকেই জানেনা। ইন্ডিয়া, চায়নার মতো এশিয়ান দেশগুলোর ব্যাপারে জানে, এবং সেই স্টেরিওটাইপ নিয়ে বাংলাদেশীদেরও দেখে। যেমন আমরা ওয়েস্টার্ন কালচারকে এক দৃষ্টিতে দেখি। আমেরিকা, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, ডেনমার্ক, ইংল্যান্ড সব একই মনে হয় আমাদের কাছে। ছোটবেলার সেই ভাবনার মতো, পৃথিবীতে শুধু দুটো দেশ, ১) বাংলাদেশ; ২) বিদেশ! কানাডিয়ানরাও এশিয়া মানে এশিয়াই ভাবে, বাংলাদেশ, ইন্ডিয়া, জাপান, চায়না আলাদা করে ভাবার সময় অনেকেই পায়না। আমাদের কালচার এবং এশিয়ার অন্যান্য দেশের কালচার সবক্ষেত্রে এক নয়। আমি সেসব বিষয়ে বলব, যেসব ক্ষেত্রে কালচার এক। আবার অন্য এশিয়ান দেশগুলোর কারণে আমাদেরকেও কিছু ভুল স্টেরিওটাইপ নিয়ে দেখা হয়। সেগুলো নিয়েও বলব।
-------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
কানাডায় স্কুলে যাওয়ার পথটুকু খুব এনজয় করতাম। আমার বাড়ি থেকে স্কুল প্রায় পনেরো মিনিটের পায়ে হাঁটার পথ ছিল। বাংলাদেশে গাড়িতে বাবার সাথে স্কুলে যেতাম স্কুল দূরে হওয়ায়। কানাডায় একা নিজে হেঁটে হেঁটে স্কুলে যেতে অন্যরকম স্বাধীনতা বোধ করতাম। পাহাড়ি এলাকা ছিল। স্কুলের চারিপাশ সাড়ি সাড়ি পাহাড়ের বেড়াজালে আটকানো। সেই পাহাড়গুলোর ওপরে ছাদ হয়ে আছে ঝকঝকে স্বচ্ছ নীল আকাশ! নানা মাঠ, ঢালু, শ্যামলিমা পেরিয়ে ছবির মতো দৃশ্যবালিতে বাস্তবে পা রেখে স্কুলে যেতাম।
তখন কানাডায় আমার এক বছর হয়েছে। মোটামুটি এডজাস্ট করতে শুরু করেছি। এক গ্রীষ্মে এসেছিলাম, আর এখন নানা ঋতু পেরিয়ে পুনরায় গ্রীষ্ম আসি আসি করছে। বরফ পুরোপুরি গলে সবুজ সতেজ ঘাস এবং তার বুকে রং বেরং এর ফুল উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে। মাঝেমাঝে বৃষ্টি হচ্ছে। তখন খুব শীত শীত করছে। আবার সূর্য খেলে যাচ্ছে পরম ঔজ্জ্বল্যে! তীব্র রোদে চারিদিক ছেয়ে যাচ্ছে। ওয়েদারের কোন ঠিক ঠিকানাই নেই। এই মেঘ তো এই রোদ! ভীষন রোদের মধ্যে হুট করে বিজলি চমকে উঠছে। একদিন পুরো রাত জুড়ে বৃষ্টি হলো। আমি সকালে ক্লাসে যাচ্ছি হেঁটে হেঁটে। পাহাড়ি এলাকায় বৃষ্টি আরো কি ভীষন সৌন্দর্য ও কোমলতা যোগ করে তা বলে বোঝানো যাবে না। কি ভীষন স্নিগ্ধ একটা সকাল! ঘাসে জমে থাকা বৃষ্টির পানিতে আমার পায়ের পাতা ভিজে গিয়েছে অনেকটা। আমার বাড়ি থেকে স্কুলে যাবার সময় একটা ঢালু মতো জায়গা ছিল। তার কিছু আগে একটা বিশাল গাছ পরত। সেদিন আমি লাফিয়ে গাছটার একটা বড় ডাল ধরে ঝাঁকালাম নিজের মাথার ওপরে। গাছের পাতায় জমে থাকা বৃষ্টির পানি টপটপ করে পরে, মাথা, মুখ পুরো ভিজে গেল! আমি হাসতে হাসতে ওড়না দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে স্কুলের পথে হাঁটা ধরলাম আবার!
স্কুলে গিয়েই লাইব্রেরীতে গেলাম, ব্যাগটা লাইব্রেরীর তাকে রেখে লাইব্রেরিয়ানের ডেস্কে আসলাম। আমি স্কুল লাইব্রেরীতে প্রচুর সময় কাটাতাম। ভাষা সমস্যায় তেমন বন্ধু ছিলনা বলে লাইব্রেরীতে বসে বই পড়তাম। এসাইনমেন্ট করতাম। লাইব্রেরীর নিয়ম কানুন খুব কড়া ছিলনা। আমাদের লাইব্রেরিয়ান অনেক হাসিখুশি, সুইট একজন মহিলা ছিলেন। আমি সুযোগ পেলে তার সাথে অনেক গল্প করতাম। একবার আমার এই প্রিয় মানুষটি কয়দিনের জন্যে এলেন না। ওনার জায়গায় মিসেস টি. কে দেখলাম। তিনিও বেশ ভালো মহিলা ছিলেন। আমাদের কম্পিউটার এক্সপার্ট, লাইব্রেরীর ভেতরের ছোট্ট একটি অফিসেই কাজ করতেন। লাইব্রেরিয়ান কিছু কাজে অনুপস্থিত ছিলেন বিধায় ওনার জায়গা নিয়েছিলেন।
একদিন আমাদের ইংলিশ ক্লাসের সবাইকে শিক্ষক লাইব্রেরীতে নিয়ে এলেন। কেননা লাইব্রেরীতে অনেক কম্পিউটার ছিল, আর আমাদের একটা এসাইনমেন্ট কম্পিউটারে করতে হতো। একটার পাশে একটা কম্পিউটার গোল হয়ে সেট আপ করা। আমি প্রথম কম্পিউটারটিতে বসে, আমার পাশের চেয়ারগুলোতে আরো স্টুডেন্টরা বসা। সবাই কাজ করছে। আমি তখন ইংলিশ ভালো পারিনা, আর আমাকে বলা হয়েছে ইংলিশে শর্ট স্টোরি লেখো! বেশ কঠিন এসাইনমেন্ট আমার জন্যে। ভীষন মনোযোগ দিয়ে করছি। এমন সময়ে কানের কাছে আসল মিসেস: টি বলছেন: "দিজ টাইপ অফ ক্লোদিং ইজ নট এপ্রোপ্রিয়েট ফর স্কুল!" শুনে আমি চমকে উঠলাম!
কানাডিয়ানরা আমার কালচার নিয়ে কখনোই কিছু বলেনি। ওদেরকে যতোটা জেনেছি, ভীষন বিনয়ী একটি জাতি। কারো পোশাক আশাক নিয়ে মন্তব্য করার মতো মানুষই না এরা! আমি ওনার দিকে থ হয়ে তাকালাম কম্পিউটার থেকে চোখ সরিয়ে। দেখি ওনার চোখ আমার দিকে না, আমার পাশের কানাডিয়ান মেয়েগুলোর দিকে! তিনি বলছেন, "গাইস দিস ইজ আ স্কুল, নট আ বিচ! ওপর এবং নিচের থেকে আরেকটু বাড়াও, থাই যেনো ঢাকা থাকে!" আমি তখন খেয়াল করলাম ওরা অনেক ছোট ড্রেস পরে আছে। উনি স্কুলে সেটা এপ্রোপ্রিয়েট না এটিই বোঝাচ্ছিলেন। আমি কম্পিউটারে চোখ থাকায় বুঝিনি আমাকে বলছেন না, আর আমার পাশে দাড়িয়েই বলছিলেন যেহেতু আমি লাইনের সামনে ছিলাম। মেয়েগুলো তখন প্রায় একসাথে বলল, "বাট ইটস টু হটটটটট মিসেট টিইইই!" উনি কোমল গলায় বললেন, "আমি বুঝি, তবে স্কুলের নিয়ম আছে কিছু। ভাইস প্রিন্সিপাল এসবের দিকে খেয়াল রাখতে বলেছেন আমাদের! চোখ টিপে আবারো বললেন, ফর বিচ, নট ফর স্কুল!" ওরা হা হুতাশ করা শুরু করে দিলো। কানাডিয়ানরা গরমে অনেক হাঁফিয়ে ওঠে। আর গরমে পোশাক পরার ব্যাপারটি বুঝতেই পারে না। ছেলেরা হালকা টি শার্ট ও হাফ প্যান্ট পরে স্কুলে আসত, আর মেয়েরা ছোট টপস, এন্ড মিনি শর্টস অর স্কার্ট। শুধু সেদিনই নয়, এরপরেও প্রায় দিনই ছেলেমেয়েদের (বিশেষ করে মেয়েদের) বেশী রিভিলিং কাপড় পরিধানের জন্যে শিক্ষকদের কাছ থেকে ওয়ার্নিং পেতে দেখেছি!
আমি মনে মনে নিজের বোকামিতে হেসে ফেললাম। কোন কানাডিয়ান আমাকে এমন কিছু বলতে পারে না সেটা এতদিনে বোঝা উচিৎ ছিল। আর সেই মেয়েগুলোর ন্যাকামিতেও হাসি পাচ্ছিল। মনে মনে বলছিলাম, হট না ছাই! গরমের দেশেই মানুষ বোরখা, কামিজ পরে কূল পায় না। আর শীতের দেশের মানুষের ন্যাকামি দেখো! নিজের সাথে ফাজলামি করে এসব ভাবছি আর মুচকি হাসতে হাসতে কাজ করছি!
এমন সময়ে পাশে বসে থাকা কানাডিয়ান মেয়েগুলো আমার নাম ধরে ডেকে বলল, আচ্ছা, তোমার গরম লাগে না এমন পোশাকে (সালোয়ার কামিজে)? আমি বললাম না। ওরা যে কি ভীষননন অবাক হলো! এই প্রশ্নটি পুরো গ্রীষ্মজুড়ে আরো অনেকের কাছে নানা ভাবে শুনলাম। আমি না বললেই, ওরা বলত কিভাবে?! ওদের চোখ কপালে উঠে যেতো। শুধু তাই নয়, প্রথমদিনেই দুজন ব্রাজিলিয়ান মেয়ে জিগ্যেস করেছিল, তোমদের দেশে বিচেও এই পোশাক পরো? আমি কয়েকবার হ্যা বললাম, কিন্তু ওরা অবাক হয়ে বেশ কয়েকবার জিগ্যেস করেই গেল, বিচেও?!
না না, এটাকে রেসিজম মনে করবেন না। ওরা জেনুইনলি শকড হতো। একদম কৌতুহল থেকেই জানতে চাইতো। ওরা শুধু ফেসটিভালেই আমাদের এদিকের মানুষদের সালোয়ার কামিজ, শাড়ি পরতে দেখতো। আমি রেগুলারলি সব ঋতুতে পরতাম বলে, ওদের মনে এই প্রশ্ন আসত। ওরা ছোট কাপড়েও যে গরমে কাবু হয়ে যাচ্ছে, আমার কিছুই হচ্ছে না কি করে?
আমার বেশ মজা লাগত এসব শুনে। দেশে শুধু শুনতাম, ঠান্ডার দেশের মানুষ সব ছোট ছোট পোশাক পরে কি করে? একটু লজ্জাও তো লাগার কথা! আর এখানে ওরা ভাবে আমরা গরমের দেশের মানুষ শরীর এতটা ঢাকি কি করে? হাহাহা।
ওহ, আরেকটি মজার জিনিস বলি। কাপড় শুকানো! আমাদের দেশে তো কাপড় যেখানে সেখানে শুকানো হয়। প্রত্যেক বাড়ির মহিলাদের প্রতিদিনের যাবতীয় নানা কাজের একটি কাজ ছাদে/বারান্দায় কাপড় শুকাতে দেওয়া এবং শুকালে উঠিয়ে নেওয়া। বৃষ্টি পরলে তো আরো বাড়তি কাজ। ঘরের মধ্যে বেডরুমে, ড্রয়িং রুমে দড়ি টানিয়ে পর্যন্ত কাপড় শুকানো হয়!
আমি তখন প্রথমবার টিএ হলাম স্কুলে E.S.L. ক্লাসে এক জার্মান টিচার এর আন্ডারে। তিনি অনেক ছোট বয়স থেকে কানাডায় মুভ করেছিলেন। তিনি বয়স্কা, মোটাশোটা, কেয়ারিং স্বভাবের ছিলেন। প্রথমবার টিএ হিসেবে অতি উৎসাহে ক্লাসের সবাইকে অনেক হেল্প করতাম এবং সবাই আমার ওপরে অনেক নির্ভর করত। টিচার আমার ওপরে খুবই খুশি ছিলেন এজন্যে।
যাই হোক, একবার উনি গল্প করছেন যে থাইল্যান্ডে গিয়েছিলেন বেড়াতে। ওখানে দেখেছেন কাপড় ঝুলিয়ে রাখা হয় বারান্দায় ড্রাই করার জন্যে। ওনার ভাষায় কথাগুলো ছিল, "আমি ওখানে একদিন রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে খেয়াল করে দেখি যে প্রতিটি এপার্টমেন্টের বারান্দায় কাপড় ঝুলিয়ে রাখা। নট প্রিটি গাইস, নট প্রিটি!" এটা বলে মুখ বিগড়ালেন। যেন এরচেয়ে অসুন্দর আর কিছু হতে পারে না! আমি দাড়িয়ে ছিলাম, কোন একটা কাজ করছিলাম। ওনার কথা শুনে কানাডায় প্রথম দিন আসার ফ্ল্যাশব্যাকে চলে গেলাম।
আমাদের এপার্টমেন্টের ওনার বা মালিক কানাডিয়ান ছিলেন। বেশ গুরুগম্ভীর একজন বয়স্ক মানুষ। প্রথমদিনেই আমাদেরকে নানা নিয়ম কানুন বলে দিয়েছিলেন। যার একটি ছিল, বারান্দায় যেন কাপড় না শুকানো হয়। কাঠের ফ্লোর, পানি পড়লেই ড্যামেজ হয়ে যাবে। আমরা তাই বারান্দায় কাপড় শুকাতাম না। মা এটা নিয়ে অনেক কথা বলত, "আজব দেশ। বারান্দায় না শুকালে আর কোথায় কাপড় শুকাবো? এইটুকু ব্যাপারে মেশিন ব্যাবহার করে টাকা নষ্ট!"
একদিন দেখি কি আমাদের একদম সামনের এপার্টমেন্টে নতুন এশিয়ান ভাড়াটিয়া এসেছেন। চেহারা দেখে মনে হলো চায়না/কোরিয়ার হবে। একজন ২৮/৩০ বছরের মহিলা, পরম সুখে কাপড় শুকাতে দিচ্ছিলেন বারান্দায়। মাকে ডেকে এনে দেখালাম, মা বলল, "ওমা, বাড়িওয়ালা ওদেরকে বলেনি? এখানে মানা? দেখিস এর কপালে দুঃখ আছে।" আসলেই, মাত্র আধা বা এক ঘন্টার মধ্যে দেখি কাপড়গুলো আর নেই বারান্দায়, নিশ্চই ওয়ার্নিং পেয়ে গিয়েছিল!
টিচার এর কথা শুনে আমার কেন যেন মনে হলো, আমাদেরকে বাড়িওয়ালা প্রথমদিনেই কাপড় শুকাতে মানা করেছিলেন আমরা এশিয়ান বলে। ওরা জানে যে আমরা বারান্দায় কাপড় শুকাই!
সেই স্মৃতি মনে করতে করতে কানে এলো টিচার এর আওয়াজ, "ব্যাংলাদেশেও তাই করা হয় না?" আমি কি বলব? হ্যা বললে উনি বিরক্ত মুখে তাকাবেন আবার। নিজের দেশ নিয়ে কাউকে তেমন ফেইস করতে দেখতে কারোরই ভালো লাগবে না। আর এতো দেশের মানুষ থাকে E.S.L. ক্লাসে, ৩০ টা স্টুডেন্ট মিলে ছোটখাট একটি দুনিয়া! সেখানে নিজের দেশকে ছোট হতে দেখলে আরো খারাপ লাগে। না বললেও মিথ্যে হবে! ধরা পরে যাবার মতো মিথ্যে!
আমি বললাম, আমাদের পরিবারে বারান্দায় শুকাত না কাপড়! উনি বললেন, ওহ আচ্ছা আচ্ছা। ভেবেছিলাম উনি আরো প্রশ্ন করবেন যে কোথায় শুকাত, দেশে অন্যরা কি করে, এই সেই। কিন্তু না, পড়ানোয় মনোযোগ দিলেন। আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম।
আমি পরিবারের কাঁধে বন্দুক দিয়ে দিলাম। আর মিথ্যে তো বলিনি। বারান্দায় না আমাদের ছাদে কাপড় শুকাতে দেওয়া হতো!
কানাডিয়ানরা বেশ শৌখিন এবং সৌন্দর্য সচেতন। বেশিরভাগ উঠান এবং বারান্দা নানা রং বেরং এর ফুল দিয়ে সাজানো থাকে। বারান্দায় ছোটখাট বারবিকিউব মেশিন, দুটো চেয়ার, ছোট্ট টেবিল, তার ওপরে কিছু ডেকোরেশিন পিসও দেখা যায়। উঠানে তো এলাহি কারবার করে রাখে। নানা ফলমূলের বাগান করে গরমের দিনে। উঠান যত ছোটই হোক না কেন গাছ লাগাবেই। ঘাস ছোট ছোট করে ছেঁটে রাখবে। নানা টব, টেবিল, সোফা ও কুশন সহ বসার সুন্দর পরিপাটি ব্যবস্থা, বারবিকিউব মেশিন এসব থাকে। বন্ধুরা আসলে মজা করে বারবিকিউব করতে করতে আড্ডা দেয়। গরমের দিনে এসব করে। আর শীতের দিনে উঠানের বরফ পরিষ্কার করে রাখে নিয়মিত। বেশ পরিচ্ছন্ন ও সাজিয়ে রাখে সবকিছু। যারা একটু কম শৌখিন তাদের বারান্দা/উঠান খালি থাকে বড়জোর। কিন্তু সেখানে কাপড় শুকানোর কথা ওরা ভাবতেই পারে না!
এমন ছোট ছোট বিষয়ও যে ওদের চোখে পরে, সেটি ভেবেই অবাক হতাম। আমাদের কাছে যেকোন ওয়েদারেই পরিপূর্ণ কাপড় পরিধান করা জরুরি। আমরা ভাবতেই পারিনা যে গরম অনেক, তাই শর্টস পরে কলেজে চলে যাব বা বিকিনি পরে সমুদ্রে ঝাপ দেব! আর কাপড় শুকাতে দেওয়া খুবই কমন একটা ব্যাপার। এটা নিয়েও ওদের এত ভাবনা! সত্যিই, আমরা যেমন ওদেরকে অনেক রীতিনীতি আজব ভাবি, ওরাও তাই ভাবে। আমার খুবই হাসি পেত ওদের কৌতুহল ও চমকে যাওয়া দেখে। মনে মনে বলতাম, ওয়েলকাম টু মাই ওয়ার্ল্ড গাইজ! হাহা।
-------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আজকের পর্বটি ভূমিকা ছিল নতুন শুরুর! এজন্যেই পর্বের নাম এক! হালকা টপিক দিয়ে শুরু করেছি, আস্তে আস্তে গুরুত্বপূর্ণ স্টেইরিওটাইপগুলোর দিকে এগিয়ে যাব! আশা করি বরাবরের মতোই পাশে পাব আপনাদের।
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই জুন, ২০১৭ বিকাল ৫:০৫