আবির শাটল ট্রেনের জানালা দিয়ে বাইরের তাকিয়ে আছে, আজ 'ফুল মুন' মানে 'পূর্ণিমা' ...!
দেখো," চাঁদটা আমাদের সাথে যাচ্ছে, চিৎকার করে বলতে গিয়েও থেমে গেলো।"
কারণ, আজ তার সাথে নাবিলা নেই, নাবিলার সাথে 'ফুল মুন' দেখার আনন্দই আলাদা ছিল।
নাবিলা যেমন চুপ চাপ, আবির ছিলো এর উল্টোটা।
মাছের মত সারাক্ষণ ছটফট করতো, আর বকবক করে নাবিলার কান ঝালাপালা করে ফেলতো।
প্রতিদিন ভার্সিটির ক্লাশ শেষ করে আবির প্রাইভেট পড়াতে শাটল ট্রেনে করে শহরে যেতো, ক্যাম্পাসে ফিরতে রাত হয়ে যেতো।
ইদানিং প্রতিদিন শাটল ট্রেনের পিছনের সিটে একটা মেয়েকে গুটিশুটি মেরে বসে থাকতে দেখে, মনে হয় সেও চট্টগ্রাম শহরে প্রাইভেট পড়াতে যায় ।
আবির ভালো লাগা নিয়ে আড় চোখে মেয়েটাকে দেখতো ,মেয়েটা মুখ ফিরিয়ে রাখলেও আবির বুঝতো কি যেনো এক ভালো লাগায় মেয়েটাও তাকে দেখতো কিন্তু বুঝতে দিতো না ।
আবির একদিন প্রচন্ড বৃষ্টিতে ক্যাম্পাসে ফিরতে শাটল ট্রেনে উঠে দেখে, বৃষ্টিতে কাক ভেজা হয়ে মেয়েটি অসহায়ের মতো জড়ো সড় হয়ে, ট্রেনের পিছনের সিটে বসে আছে।
দেখে আবিরের কেমন যেন মায়া হলো, ইচ্ছা করে আবির পাশের সিটে বসে গায়ে পড়ে কথা বললো,
"আপনি একদম ভিজে গেছেন, ঠান্ডা লাগবে দিয়ে কথা শুরু।"
নাম কি? নাবিলা।
কিসে পড়ে? আনার্স ফাষ্ট ইয়ার।
কোথায় থাকে ? মেয়েদের হলে।
কোথায় প্রাইভেট পড়াতে যায়? চট্টগ্রামের বহদ্দরহাটে একটা 'এসএসসি' পরীক্ষার্থী কে প্রাইভেট পড়ায়।
বাড়ি কোথায়? দিনাজপুর।
আবির নিমেষে সব জিজ্ঞেস করে ফেলে, এত কিছু বকবকানির পর আবির বলে," বিরক্ত হয়েছেন..!"
নাহ, "নাবিলা ছোট্ট করে উত্তর দেয় ।"
আবিরকে ভাল লাগে বলেই এত প্রশ্নের উত্তর দেয়া, নয়তো অপরিচিত একজনকে এত কিছু বলতো না।
এবার ছোট্ট করে বলে, "আপনি..?"
এবার আবির শুরু হয়ে যায় নিজের বৃত্তান্তে,
"আমি আবির, মাষ্টার্স ফাইনাল ইয়ার, বাড়ি সরাইল, থাকি হলে, হালি শহরে 'এইচএসসি' পরিক্ষার্থীকে প্রাইভেট পড়াই।
সেদিনের পর থেকে যে আগে ট্রেনে উঠে, তার পাশের সিটে ব্যাগ রাখা হয়।
একজন আরেক জনের জন্য জায়গা রাখে, প্রথম প্রথম অন্যরা ব্যাগ সরিয়ে বসতে যেতো।
এখন সবাই বুঝে গেছে কেউ আর ব্যাগ সরিয়ে বসতে চায় না...!
প্রানবন্ত আবির এক দন্ডও চুপ থাকতে পারতো না, প্রায়ই আবির গান বাজনা করতো। তার গানের গলা খুব সুন্দর ছিলো, আবিরের সাথে গানে সবাই গলা মিলালেও নাবিলা চুপ করে থাকতো।
একদিন আবির জিজ্ঞেস করলো, "আচ্ছা তুমি এত চুপচাপ বিষন্ন থাকো কেনো..?"
নাবিলা ছলছলে চোখে বললো," বাড়িতে বাবা অসুস্থ দু'ভাইবোন, বাবার পেনশনের টাকা দিয়ে সংসার চলে। নাবিলা প্রাইভেট পড়িয়ে নিজের পড়ার টাকা যোগাড় করে, ছোট ভাইটাও স্কুলে পড়ে। যে কোন সময় নাবিলার পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যেতে পারে..!"
আবির নাবিলার মন খারাপটা বাড়িয়ে দিয়ে কথা ঘোরানোর জন্য জানালার বাইরে তাকিয়ে চিৎকার করে বললো," দেখো, "আজ 'ফুল মুন' 'পূর্ণিমার' চাঁদটাও আমাদের সাথে সাথে যাচ্ছে..!"
আবির প্রায়ই এদিক সেদিক নাবিলাকে খুঁজে কিন্তু শামুকের মত নিজের ভেতর গুটিয়ে থাকা নাবিলাকে পায় না, শুধু ক্যাম্পাস থেকে শাটল ট্রেনে আসা যাওয়ার পথেই দেখা হয়।
নাবিলার গল্পের বই পড়ার খুব শখ, ট্রেনে উঠেই যে কোন একটা বইয়ে মুখ ডুবিয়ে রাখতো। আবির বকবক করলে হু হা করে উত্তর দিতো।
একদিন নাবিলাকে 'এ্যানা ফ্রাংকের ডাইরী' পড়তে দেখে আবির বলে, "বইটা পড়া হলে আমাকে দিও, আমিও পড়বো।"
আজ আবির শাটল ট্রেনে উঠে পাশের সিটে ব্যাগ রেখে নাবিলার অপেক্ষায় থাকে, তবে নাবিলা এলো না।নাবিলার এক বান্ধবী আবিরের দিকে 'এ্যানা ফ্রাংকের ডাইরী' এগিয়ে দিলো।
আবির অবাক হয়ে যায়, "বইটা তো নাবিলা নিজেই দিতে পারতো..?"
বইয়ের প্রথম পৃষ্ঠা উল্টে আবিরের চোখ আটকে যায়। নাবিলার লেখা কালো অক্ষর গুলো আবিরের চোখ ঝাপসা করে ফেলছে।
নাবিলা লিখেছে " বাড়ি থেকে ফোন এসেছে বাবার অবস্থা খারাপ, বাবার শেষ ইচ্ছা হিসাবে গ্রামের মাতব্বরের প্রবাসী 'এসএসসি' পাস ছেলের সাথে আগামীকাল আমার বিয়ে।
পড়াশোনা পাগল আমি অনেক কষ্টে চট্টগ্রাম ভার্সিটিতে পড়ার সুযোগ পেয়েছিলাম, পড়াশোনা নিয়ে আমার অনেক উচ্চাশা ছিলো।
মানুষের সব আশা পূরণ হয় না, কিছু অপূর্ণতা থেকে যায়।
পড়াশোনা নিয়ে আমার উচ্চাশাও এখানেই থেমে গেলো।
বাবা অসুস্থ হওয়ার আগে আমিও আপনার মতো উচ্ছল ছিলাম, তাই আপনার উচ্ছলতা আমার ভালো লাগতো।
আপনার গানের গলাও খুব সুন্দর..!
আমি জানি আসা যাওয়ার পথে আমার কথা আপনার মনে পড়বে, আমার কথা মনে পড়লে শাটল ট্রেনের জানালা দিয়ে চাঁদটা দেখবেন। আমি আকাশের চাঁদটার মত আপনার সাথে সাথে যাবো।
সব সময় উচ্ছল থাকবেন, আমার মত বিষন্নতা আপনাকে স্পর্শ না করুক,ভাল থাকবেন..।"
"শাটল ট্রেনে একটা ভালো লাগার শুরু, শাটল ট্রেনেই শেষ হয়ে গেলো....!"
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে জানুয়ারি, ২০১৯ দুপুর ১:১৫