তাদের অপরাধ-তারা ইসলাম গ্রহণ করেছেন। তাদের অঞ্চল ও গোষ্ঠীর বেশিরভাগ লোক এতদিন খ্রিস্টান মিশনারীদের আহবান, প্রলোভন ও সেবায় সাড়া দিয়ে গ্রহণ করেছে খিস্টীয়ধর্ম। একা-একা, সপরিবারে এবং দলে দলে খিস্টান হয়েছে তারা। কোনো সমস্যা হয়নি। নিজেদের এলাকার গির্জায়, চার্চে গিয়েছে, মিশনারীদের আশ্রমে নারী-শিশুরা ভিড় করেছে, কেউ বাধা দেয়নি। নিজ এলাকা ছেড়ে অনেকেই ঢাকায় এসে নাখালপাড়া ও মনিপুরিপাড়ার খিস্টানদের মেসে এসে উঠেছে। কেউ তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করেনি। তল্লাশি করেনি। এই বাংলাদেশে তারা কোনো বাধার মুখে পড়েনি। কিন্তু ওই গোষ্ঠীরই ক’জন মানুষ এই দেশে ইসলাম গ্রহণ করে বিপদে পড়ে গেছেন। আইন-পুলিশ, থানা-মামলা, ভোগান্তির শেষ নেই। এ এক অদ্ভুৎ অবস্থা! তাদেরকে পেরেশান করার লোকের অভাব নেই। অথচ উদ্ধার করার যেন কেউ নেই।
৮ ও ১০ জানুয়ারি ঢাকার একটি পত্রিকার খবরে তাদের দুরবস্থার কথা প্রথমে সংবাদপত্র-পাঠকদের সামনে আসে। ওই খবরে বলা হয়েছে, পার্বত্য চট্টগ্রামে নির্মম নির্যাতনের শিকার ক্ষুদ্রজাতি গোষ্ঠীর (উপজাতীয়) মুসলমানরা ঢাকায় এসে বিভিন্ন মসজিদ ও মাদরাসায় আশ্রয় নিয়েও রেহাই পাচ্ছেন না। পাবর্ত্য অঞ্চলের খিস্টান মিশনারীদের সরবরাহ করা তালিকা অনুযায়ী রাজধানীর বিভিন্ন মসজিদ ও মাদরাসা কমপ্লেক্সে হানা দিচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর খিস্টান সদস্যরা। গত ২ জানুয়ারি বাসাবো এলাকার একটি মাদরাসায় হানা দিয়ে পুলিশ ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর ৫ মুসলিম এবং তাদের ১১ সন্তানকে আটক করে থানায় সোপর্দ করেছে। আরও ৫ জনকে আটক করে তেজগাঁও থানা ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে পাঠিয়ে দিয়েছে। এর আগে গত জুলাই মাসে গাজীপুরের একটি মাদরাসা থেকে ৮ জন ও ঢাকার অপর একটি মাদরাসা থেকে ৩ মুসলিম ছাত্রকে আটক করে থানায় নিয়ে গেছে পুলিশ। এ ঘটনার কয়েক দিন পর ইসলাম গ্রহণের এফিডেভিটের কাগজপত্র দেখে ১১
সন্তানসহ ৫ অভিভাবককে থানা থেকে ছাড়া হলেও অপর ৫ জনের বন্দিদশা চলতে থাকে ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে। পরবর্তীতে সুদূর পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে তাদের অভিভাবকরা এলে ক্লান্তিকর টানাহেঁচড়ার পর প্রথমে তাদের তুলে দেওয়া হয়, ‘ত্রিপুরা কল্যাণ সংসদ’ নামের খ্রিস্টান একটি সংস্থার কাছে। সেখান থেকে ভয়-ভীতি দেখিয়ে ও হুমকি-ধমকি দিয়ে তাদের গ্রামের বাড়িতে পাঠানো হয়।
এরই মধ্যে আটক মুসলিম এসব নওমুসলিম শিশু ও তাদের অভিভাবকদের নিয়ে একটি ‘এক্সক্লুসিভ’ রিপোর্ট সম্প্রচার করে ঢাকার একটি টিভি চ্যানেল। চরম বিদ্বেষপূর্ণ, নেতিবাচক ও মিথ্যাচারের ধোঁয়াশা সৃষ্টিকারী ওই রিপোর্টটি কিছু ফলোআপসহ একাধিক দিন সম্প্রচার করা হয়। জনসাধারণের হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাটের অপরাধে ব্যাপক আলোচিত একটি এমএলএম কোম্পানির মালিকানাধীন ওই চ্যানেলের খবরে বিভিন্ন সাক্ষাৎকারের মধ্য দিয়ে তুলে ধরার চেষ্টা করা হয় যে, উপজাতীয় এসব মুসলিম পরিবারের শিশুদেরকে ঢাকার বিভিন্ন মাদরাসায় এনে জঙ্গি বানানো হচ্ছে। খিস্টান মিশনারি সমর্থিত ‘ত্রিপুরা কল্যাণ সংসদ’ নামীয় প্রতিষ্ঠানের উপজাতীয় কয়েকজন নেতা টিভি ক্যামেরার সামনে এসে ‘জঙ্গি প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে’ বলে বার বার অভিযোগ করতে থাকে। নিষ্পাপ ওই শিশুদের মাথায় ‘জঙ্গিবাদের অভিযোগ’ তুলে দিয়ে সরলপ্রাণ-উপজাতীয় মুসলিম ভাই- বোনদের মাঝে ভীতি ও অনীহা ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এসব ঘটনায় উপজাতীয় মুসলমানদের স্পষ্টতই বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে, হলে খ্রিস্টান হও, মুসলমান হলে রক্ষা নেই। থানা-পুলিশ তো হবেই, সাত বছরের শিশুকেও জঙ্গি বানিয়ে ছেড়ে দেওয়া হবে। থানা-পুলিশ, মিডিয়া, মুসলমানদের পাশে দাঁড়াবে না। তারা চলবে ক্যাথলিক চার্চের কথায়। চলবে মিশনারী সংস্থাগুলোর ইশারায়।
পুরো ব্যাপারটি তলিয়ে দেখলে এবং ভাবলে গা শিউরে উঠে। ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী বা উপজাতীয় কিছু মানুষ স্বেচ্ছায় স্ব-উদ্যোগে ইসলাম গ্রহণ করেছেন। এরপর তারা তাদের
সন্তানদের দ্বীনী শিক্ষায় শিক্ষিত করার জন্য কষ্ট করে রাজধানীতে নিয়ে এসেছেন। সেসব সন্তানরা মনোযোগ দিয়ে লেখাপড়াও করছে। দ্বীন শিখছে, ইসলামের শিক্ষা গ্রহণ করছে। নামায পড়ছে, কুরআন শরীফ তেলাওয়াত করতে পারছে। এ বিষয়টিই একটি মহলের অন্তরে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। যেসব সংস্থা ও মহল উপজাতীয় জনগণকে একটি ধর্মের জন্য বরাদ্দকৃত ও বুক্ড বলে মনে করতো তারা আঁতকে উঠেছে। এরপর নবদীক্ষিত উপজাতীয় মুসলিমদের হয়রানি করতে এবং তাদের যারা সামান্য সহযোগিতা করছে তাদের নাজেহাল করতে উঠেপড়ে লেগেছে। একদিকে মিডিয়ার একটি অংশ অপরদিকে আইনশৃঙ্খলায় নিয়োজিত কছিু ব্যক্তিকে পরিকল্পনা মতো তারা ব্যবহার করছে। সমাজে নির্বিকার, প্রতিক্রিয়াহীন, ঐক্যবোধশূন্য মুসলমানদের সামনেই তারা সফল হয়ে যাচ্ছে। উপজাতীয় ভাইদের জন্য ইসলাম গ্রহণকে একটি ঝুঁকি ও আতংকের ব্যাপারে পরিণত করতে তারা অনেকটা সক্ষমও হয়েছে। ইসলাম গ্রহণকে অপরাধ হিসেবে দেখানো হচ্ছে।
অথচ এদেশে গত অর্ধ শতাব্দীকাল যাবত খ্রিস্টান মিশনারি সংস্থাগুলো নির্বিঘ্নে কাজ করছে। বিভিন্ন সীমান্ত অঞ্চলে মিশনারীদের এক রকম রাজত্বই চলছে।
এরই মধ্যে লাখ লাখ উপজাতীয় ও অনগ্রসর মানুষকে তারা খ্রিস্টান ধর্মে দীক্ষিত করেছে। বিভিন্ন শহরে এনে তাদেরকে খ্রিস্টান মেস ও কলোনিতে জায়গা করে দিচ্ছে। উঁচু প্রাচীরে ঘেরা দুর্গের মতো চার্চ ও গির্জায় নিয়ে নবদীক্ষিত খ্রিস্টান তরুণদের
নানা বিষয়ে প্রশিক্ষণও দিচ্ছে। কেউ কোনো প্রশ্ন তুলছে না। কোথাও কোনো তল্লাশি ও অনুসন্ধান কার্যক্রম চালানো হচ্ছে না। নবী দীক্ষিত খ্রিস্টান-লাখ লাখ চাকমা, গারো, হাজং, ত্রিপুরা, খাসিয়া, মার্মা তরুণদের তারা কোনো মারমুখি, আগ্রাসী কিংবা সশস্ত্র প্রশিক্ষণ দিচ্ছে কি না সেটাও তলিয়ে দেখা হচ্ছে না। অথচ একজন-দুজন ইসলাম গ্রহণ করে মক্তব-মাদরাসায় পড়তে এলেই তাকে টেনে নেওয়া হচ্ছে হাজতখানায়।
এর লক্ষ্য ও পরিণাম কী-সব পর্যায়ের মুসলিম জনতার একটু ভেবে দেখা দরকার।
উন্নয়ন ও নিরাপত্তা গবেষকদের কেউ কেউ বলেন, এ দেশে খ্রিস্টান মিশনারীদের ধর্ম প্রচার আর টার্গেট গ্রুপের (উপজাতীয় সম্প্রদায়, পার্বত্য ও সীমান্ত অঞ্চলের বাসিন্দা) কেউ ইসলাম গ্রহণ করলে তাদের আঁতকে উঠার বিষয়টি থেকে অনুমিত হয় যে, বর্তমানে তাদের পরিকল্পনা ও লক্ষ্য শুধু ধর্মপ্রচার ও সেবায় সীমাবদ্ধ নেই। তারা নিজেদের জণ্য দেশের মধ্যে একটি বিরাট জনগোষ্ঠী ও একটি বিরাট অঞ্চল ‘নির্বিঘ্ন বরাদ্দ’ রূপে পরিণত করতে চায়। তাদের চেখে সবুজ বাংলাদেশের মধ্যে একটি ধুসর ‘পূর্ব তিমুরের’ ছবি আঁকা আছে।
তারা এখন সে ছবিটাকে আরও স্পষ্ট করে দেখতে আগ্রহী। এ কারণেই কয়েকজন উপজাতীয় নবদীক্ষিত মুসলিমকে নিয়ে তাদের সক্রিয় টানাহেঁচড়ার ঘটনার মধ্যে গোটা দেশের জন্যই একটি নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা মেসেজ বিদ্যমান। তাই বিষয়টিকে মসজিদ, মাদরাসা, মক্তব আর দাওয়াত-তাবলীগের প্রচলিত বিবেচনায় সীমাবদ্ধ মনে না করে জাতীয় নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট সব মেধা ও প্রতিষ্ঠানের এ দিকে পূর্ণ মনোযোগ দেওয়া উচিত।’
আমরা তাদের এই উদ্বেগটাকে খাটো করে দেখা ঠিক হবে বলে মনে করি না। ষ