গোলাম মোর্তোজা
গত প্রায় ১৫ বছর ধরে আমরা বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ নিয়ে আলোচনা করছি। যখন জঙ্গিরা একটি ঘটনা ঘটায়, আলোচনা তখন সামনে আসে। প্রতিবারের আলোচনায় মনে হয় আমরা নতুন করে শুরু করি। আলোচনার ধরনটা এমন থাকে যে, আজ থেকে জঙ্গিবাদ শুরু হলো। পেছনের কথা বলি, রাজনৈতিক অবস্থান থেকে। যতটুকু যেভাবে বললে রাজনৈতিকভাবে সুবিধা লাভের সম্ভাবনা থাকে ততটুকু বলি, সেইভাবে বলি। এই বলার বিপজ্জনক দিকটি উপলব্ধিতে আনিনা। না আনার পরিণতিতেই আজকে জঙ্গিবাদের কবলে আটকা পড়ে গেছি। আটকা পড়েও যে সঠিক উপলব্ধিতে আছি, বিষয়টি তেমন নয়। বিষয়টি তবে কেমন? কঠিন এবং জটিল প্রশ্ন। সংক্ষিপ্ত আলোচনায় আংশিক বিশ্লেষণের প্রচেষ্টা।
১. ২০০৩ সালে বাংলাভাইদের প্রথম গ্রেফতার করা হয়েছিল জয়পুরহাটে। জঙ্গি হিসেবে মামলাও হয়েছিল। কোনও শাস্তি হয়নি। তখনকার প্রশাসন তাদের বের করে আনার পক্ষে ছিল। ২০০৫ সালে তাদের দানবে পরিণত হওয়ার ইতিহাস সবারই জানা। যে এসআই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বাংলাভাই, শায়খ আবদুর রহমানদের গ্রেফতার করেছিলেন, পরবর্তীতে তার চাকরি চলে গেছে। এই একটি ঘটনা বাংলাদেশের জঙ্গিবাদের রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা ও বিস্তার সম্পর্কে অনেক কিছু প্রমাণ করে।
জাতীয় - আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে সেই সময়ের বিএনপি সরকার জেএমবি নিষিদ্ধ করেছে, বাংলাভাইদের গ্রেফতার করেছে, বিচার-শাস্তি হয়েছে। সরকার পরিবর্তন হয়েছে। জঙ্গিবাদের প্রশাসনিক পৃষ্ঠপোষকতার পরিবর্তন হয়নি।
২. ২০০৭ সালে তত্ত্ববধায়ক সরকার ক্ষমতায় এসেছে। কোনও রাজনৈতিক দল মিছিল মিটিং করতে পারেনি। ঢাকায় রাস্তায় ব্যানার নিয়ে দিনের পর দিন মিছিল করেছে ‘হিযবুত তাহরীর’। ‘হিযবুত তাহরীর’ তখন জঙ্গি সংগঠন হিসেবে পরিচিত। পরবর্তীতে আওয়ামী লীগ সরকার জঙ্গি সংগঠন হিসেবে তাদের নিষিদ্ধ করেছে।
সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় হিযবুত তাহরীর মিছিল করেছে, অস্তিত্বের জানান দিয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকার নিষিদ্ধ করেছে, হিজবুতের জঙ্গিদের গ্রেফতার করেছে। জঙ্গি হিসেবে মামলা বা বিচার করেনি। তারা সবাই জামিনে বেরিয়ে গেছে। নিষিদ্ধ সংগঠন হয়েও হিযবুত তাহরীর অনলাইনে সম্মেলন করেছে। সরাসরি তা সম্প্রচার করেছে। তাদের সম্মেলনে বাধা দেওয়া বা সম্মেলনকারীদের গ্রেফতার করা হয়নি। হিযবুত তাহরীর সরকার এবং দেশবিরোধী পোস্টার লাগিয়েছে ঢাকার রাজপথে। বিশাল আকারের পোস্টার। যা চার জনে না ধরে লাগানো সম্ভব নয়। একবার নয়, একাধিকবার তারা এমন পোস্টার লাগিয়েছে। ঢাকার দেওয়ালে লাগানো সেই পোস্টারের ছবি প্রকাশ করায় ডেইলি স্টারের বিরুদ্ধে সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়কেও সোচ্চার হতে দেখা গেছে। এত বড় পোস্টার কেমন করে লাগানো হলো, কোথায় ছাপা হলো, পুলিশ গোয়েন্দা কেউ কিছু জানল না কেন, সে বিষয়ে সরকারের কাউকে কথা বলতে শোনা যায়নি।
উল্লেখ্য এই জঙ্গি সংগঠন হিজবুত তাহরীরের জন্ম হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএ থেকে। গঠনমূলক কোনও তদন্ত আজও হয়নি। এখন জামায়াত- হেফাজত সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ উঠেছে ডেভলপমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের বিরুদ্ধে। এই বিভাগের কোটি কোটি অনুদানের টাকার তথ্য চেয়ে পাওয়া যায়নি। এক্ষেত্রেও জঙ্গি অর্থায়নের বিষয়টি খতিয়ে দেখা দরকার।
৩. আজকের জঙ্গিবাদের আলোচনা প্রসঙ্গে পেছনের ইতিহাস সামনে আনা অপ্রাসঙ্গিক নয়। জঙ্গিবাদ আসে, যায় না। জঙ্গিবাদ আনা যায়, তাড়ানো যায় না। জঙ্গিবাদের আন্তর্জাতিক রাজনীতি তো দৃশ্যমান, না জানার কারণ নেই। কারণ নেই, না বোঝারও। আমেরিকা তার আধিপত্য বিস্তারের প্রয়োজনে জঙ্গিবাদ তৈরি করেছে, কম-বেশি সবারই তা জানা-বোঝা। যে সব দেশ আমেরিকার কূটকৌশল বুঝতে পারেনি, তারা মূল্য দিয়েছে। বাংলাদেশের জঙ্গিবাদ নিয়ে রাজনীতি করার পরিণতি ভয়াবহ হতে পারে, বহু আগে থেকেই তেমন সতর্কতামূলক আলোচনা হয়েছে। নীতি-নির্ধারক পর্যায়ে তা গুরুত্ব পায়নি। নীতি নেওয়া হয়েছে ‘নিয়ন্ত্রিত জঙ্গিবাদ’ রেখে রাজনৈতিক সুবিধা নেওয়ার। বহুবার আলোচনা করেছি, জঙ্গিরা কখনও নিয়ন্ত্রণে থাকে না।
৪. যে সমাজে অন্যায্যতা চূড়ান্ত আকার ধারণ করে, সেই সমাজে অরাজকতা অনিবার্য। অরাজকতারই একটি রূপ জঙ্গিবাদ। এখন বাংলাদেশ জাতি রাষ্ট্রের সর্বত্র অন্যাযতা। কোথাও এমন কোনও আদর্শ নেই, যা দেখে মানুষ অনুপ্রাণিত হতে পারে। রাজনীতি অনুপস্থিত, আছে স্বেচ্ছাচারিতা। চলছে সরকারি ছাত্র সংগঠনের নৈরাজ্যকর অসুস্থ ধারার একক আধিপত্য। যা দেখে তরুণরা তো বটেই, সমাজের প্রায় সব মানুষ ক্ষিপ্ত-বিরক্ত। মন্ত্রীরা জনগণের বিরুদ্ধে ধর্মঘট ডাকে। জনগণের অর্থ ব্যাংক থেকে লুট হয়ে যায়। ‘উন্নয়ন’র নামে চলে লুটপাট। রিজার্ভ চুরি হয়ে যায়, টাকা পাচার হয়ে যায়। ব্যবস্থা নেওয়ার নজির প্রায় উঠেই গেছে। হতাশ-ক্ষিপ্ত জনগোষ্ঠীর একটি অংশ জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়ছে। তাদের জঙ্গিবাদের ভয়ঙ্কর পথ থেকে ফেরানোর কোনও উদ্যোগ দৃশ্যমান নয়। জঙ্গিবাদের বিপরীতে সামাজিক-রাজনৈতিক কোনও উদ্যোগ নেই। কেন গরিব-ধনীর সন্তানরা জঙ্গিবাদের আদর্শে মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে, আজ পর্যন্ত তেমন একটি গবেষণা হয়নি। গবেষণা হয়নি, সরকারি-বেসরকারি কোনও উদ্যোগে।
৫. জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর অভিযান চলছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযান অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। তা সত্ত্বেও বিষয়টি আমাদের উপলব্ধিতে থাকা দরকার যে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অবস্থান থেকে এক একটি অভিযান বড় মাপের সাফল্য। সামগ্রিকভাবে দেশের প্রেক্ষিতে বিবেচনা করলে এসব অভিযান খুব বড় বিষয় নয়। অভিযানকে খাটো করছি না, কম গুরুত্ব দিয়েও দেখছি না। কল্যাণপুর থেকে শিববাড়ি- মৌলভীবাজার ... জঙ্গি আস্তানা শনাক্ত হবে, অভিযান চলবে। সাফল্য আসবে, তাতে জঙ্গিবাদের শক্তি বা সামর্থ্য কমবে, এমন কথা বলা যায় না। জঙ্গি ১২০ বা ১৩০ জন, আত্মঘাতী জঙ্গি ১৫ জন বা ৩০ জন এসব ভিত্তিহীন গল্প, বিভ্রান্তিকর সাংবাদিকতা।
এগুলো বিশ্বাসযোগ্য কোনও গবেষণার তথ্য নয়। কোনও কোনও জঙ্গির স্বীকারোক্তি। একথা ভুলে গেলে চলবে না যে, জঙ্গিরা কিছু স্বীকার করে না, স্বীকার করলেও সঠিক তথ্য দেয় না। জঙ্গির সংখ্যা আমাদের কাছে অজানা। জঙ্গিদের কোমর ভেঙে দেওয়ার গল্পগুলোও যে তথ্যভিত্তিক বা বাস্তবভিত্তিক নয়, একের পর এক জঙ্গি আস্তানা তা প্রমাণ করছে।
৬. রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে চরম মাত্রার অনৈক্য জঙ্গিবাদের জন্য সহায়ক। আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর একেকটি উইংয়ের ভেতরে সমন্বয়হীনতা অনৈক্য বা দূরত্ব, কার্যকর উদ্যোগের অন্তরায়। বাহিনীগুলোর প্রতি জনআস্থা, প্রতিষ্ঠার জন্যে কিছু দৃশ্যমান উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। তদন্তে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর দুই উইং দুই রকম তথ্য পেতেই পারে। সমন্বয়ের মধ্য দিয়ে জনসম্মুখে আসা উচিত এক রকম তথ্যই। তা যখন হয় না তখন পারস্পরিক মতপার্থক্য এবং দূরত্বের বিষয়টি প্রকটভাবে ধরা পড়ে। একথা মেনে নিতে হবে যে, বন্দুকযুদ্ধ বা ক্রসফায়ারের গল্প মানুষ বিশ্বাস করেন না। এবং অবিশ্বাস্য গল্প থেকে বের হয়ে না এলে জনআস্থা ফেরানো যাবে না।
৭. জঙ্গিবাদের শিকার শুধু সাধারণ মানুষ নয়। জঙ্গিবাদের শিকার পুলিশ, র্যাব-সেনা সদস্য। নাটক-সিনেমা বলে রসিকতা করার মতো জায়গায় বাংলাদেশের জঙ্গিবাদ নেই। নেই রাজনৈতিক সুবিধা নেওয়ার মতো জায়গাতেও। অতীতের প্রসঙ্গ শুরুতে এনেছি এই কারণে যে, অতীতে এমনটা করা হয়েছে। সিদ্ধান্ত নিতে হবে আজ পর্যন্ত যা করেছি ভবিষ্যতে আর তা করবো না। গল্প তৈরি হওয়ার মতো প্রেক্ষাপট যাতে তৈরি না হয়, সতর্ক থাকা দরকার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্তা এবং রাজনীতিবিদদের। চার দিনের সেনা অভিযান, এত প্রাণহানির পর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী যখন বলেন, ‘এসব ঘটনা সিরিয়াস কিছু না’ ‘জঙ্গিরা নিয়ন্ত্রণে আছে'- গল্প কেন তৈরি হয়, কারা তৈরি করেন, ভেবে দেখা দরকার নীতি নির্ধারকদের।
যে জঙ্গিবাদ আন্তর্জাতিক রাজনীতি জন্ম দিয়েছে, জাতীয় রাজনীতিতে সুবিধার প্রত্যাশায় আমরা যে জঙ্গিবাদ লালন-পালন করেছি, তা পুরোপুরি নির্মূল করা সম্ভব নয়। জঙ্গিদের নিয়ন্ত্রণে রাখাও প্রায় অসম্ভব। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী চাইলে জঙ্গিদের চাপে রাখতে পারবে। জঙ্গিবাদের বিস্তার বোধে সামাজিক-রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের বিকল্প নেই। তা করতে হবে রাজনীতিবিদদের। ‘জঙ্গিবিরোধী অভিযান আরও জোরদার করা হবে’ প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্য সমর্থন করি। তা করা দরকার, করা হোক।
মনে রাখতে হবে অভিযানের সাফল্য সাময়িক। দীর্ঘমেয়াদি সাফল্য পেতে হলে, সম্মিলিত-সর্বসম্মত রাজনৈতিক উদ্যোগ নিতেই হবে। প্রতিরক্ষা চুক্তিতে জঙ্গিবাদ থেকে মুক্তি মিলবে না। জঙ্গিবাদ মোকাবিলায় আমাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী সম্পূর্ণরূপে সক্ষম। প্রয়োজনে আছে সামরিক বাহিনী। ঘাটতি আছে রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিগত উদ্যোগে। রাজনীতিবিদরা চাইলে নিজেদের সমস্যা নিজেরা সমাধান করতে পারবেন। বাইরের কেউ আসলে, কাউকে ডাকলে জটিলতার ভয়ঙ্কর দিকটি শুধু বাড়বে, কমবে না।
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে মার্চ, ২০১৭ রাত ৯:৪৭