এবারে আমার সামার ভ্যাকেশনটা ছিলো পুরোটাই একেবারেই সত্যিকারেরই ভ্যাকেশন যাকে বলে সেটাই। সেই ২০ তারিখে ছুটির পরদিন থেকেই চলছিলো আমার নানা অনুষ্ঠান। প্রথমে ছিলো কিছু আত্মীয় স্বজন বন্ধুবান্ধবের বিয়ে-শাদী, হলুদ, বৌভাত। তারপর এলো ঈদ এবং তার সাথে সাথেই চলে এলো আমার একটার পর একটা ভ্রমন বিলাসের গল্পকথা। ঈদের দিন দুপুরেই রওয়ানা হয়েছিলাম যশোর, মাগুরা, ঝিনাইদহের উদ্দেশ্যে। সাথে বাড়তি পাওনা ছিলো পদ্মা সেতু ভ্রমন। তবে পদ্মা সেতুর উপর দিয়ে ছুটে চলার সময় আমি কিন্তু পদ্মা সেতুর চাইতে রিয়েল পদ্মার রুপ দেখেই মুগ্ধ হয়েছি বেশি। কারণ এই পদ্মায় ফেরী পারাপার আমি আমার জীবনে বেশ কয়েকবার করলেও এমন উপর থেকে পদ্মার এই বিশালতা দেখবার সৌভাগ্য আমার এবারেই প্রথম। তবে না, আমি আজ আমার পদ্মা ভ্রমন কিংবা যশোর মাগুরার ভ্রমন ইতিহাস লিখবো না। সেখানে আমার জড়িয়ে আছে আবেগ এবং ভালোবাসা যা আমি সময় নিয়ে লিখতে চাই এবং তা কিছুদিন পরে, আরেকটু অবসরে।
আমার প্রিয় সাম্পানগুলো
সে যাইহোক, বলছিলাম আমার একের পর এক ভ্রমনময় এই সামার ভ্যাকেশন কাটিয়ে ফেলার গল্পটা। যশোর মাগুরা ঘুরে এসে তারপর আমরা কয়েকজন কলিগ মিলে ছুটেছিলাম সিলেট, রাতারগুল, সাদা পাথর, জাফলং এ । সে গল্প আমি আমার এর আগের লেখার লিখেছি। এবারের লিখছি তার পরের ভ্রমনের কথা। হ্যাঁ, সিলেট থেকে ফেরার পর আমার কাজিনদের বিদেশ থেকে স্বদেশ ভ্রমনের একটা অংশ ছিলো তারা ফ্যামিলীর সবাই মিলে কক্সেসবাজার যাবে। সেথায় যাবার আগে আমার বাড়িতে এলো তারা নেমন্তন্ন খেতে আর এসেই একদম ছাই দিয়ে চেপে ধরলো আমাকে। আমি গেলে নাকি অনেক মজা হবে। কারণ সবাই মনে করে আমি এমনই আনন্দময়ী মানুষ যে আমার আনন্দের ছিটেফোটা লেগেও তারা ধন্য হয়ে যায়। হা হা যাইহোক এত সমাদর, এত আসো আসো করা তাই সিলেট ঘুরে নেচে গেয়ে টায়ার্ড হয়ে যাওয়া আমি রাজীই হয়ে গেলাম শেষমেশ।
আমার মন কেমন করে, আমার মন কেমন করে, কে জানে, কে জানে, কে জানে কাহার তরে!
হাতে ছিলো মাত্র একদিন। একটা ব্যাগপ্যাকে জামা কাপড় ভরে নিলাম কারণ সাগরের তীরে কি কি পরে সুন্দর সুন্দর ছবি তোলা যায় ভেবে নিয়ে। যাইহোক আবারও সেই আমার প্রিয় হয়ে যাওয়া গ্রীন লাইন বাস আর তাতে রাতের ভ্রমন। সবার আগে গিয়ে আমিই হাজির হলাম বাসস্ট্যান্ডে। তারপর একে একে হই হই করে এসে জড়ো হলো আমাকেসহ মোটমাট ২৩ জন। সবাই মিলে আবারও হই হই করে গিয়ে উঠলাম বাসে। সারারাত এক ফোটাও চোখের পাতা এক করিনি। খানা দানা গল্পে গাল্পেই প্রায় কেটে গেলো সারা রাত্রী। এর মাঝে যদিও দু একজন নাক ডেকে ঘুমিয়ে নিলো।
এরপর যথারীতি জানালায় জেগে ওঠা সেই শুভ্র সুন্দর ভোর! আমার চোখ জুড়ালো প্রান ভরালো!
ভাসছে জাহাজ ভোরের জলে
কক্সেসবাজারে পৌছেই আমরা সবাই চলে গেলাম আমাদের নির্ধারিত হোটেলে। তখন কক্সেসবাজারের সকালবেলা। সেই সুসজ্জিত হোটেলরুম আর তার লাগোয়া বারান্দায় ছড়িয়ে ছিলো মায়া। এই মায়াটা আমাকে নিয়ে যায় আমার ছেলেবেলার কোনো সুদূর অতীতে যা আমার আর আজকাল প্রায় মনেই পড়ে না। কোথায় কখন যেন হারিয়ে ফেলেছি সেই মায়াটা আমি। যাইহোক একটু গোছগাছ করেই খেতে ছুটলাম আমরা। হোটেলের সকালের ব্রেকফাস্ট তখন প্রায় শেষ। আমরা গেলাম স্টার কাবাব নামের এক খাবারের দোকানে। সেখানে তখন শুধুই ডাল, ভাজি আর পরোটা ছিলো। সেই খেয়েই তড়িঘড়ি ছুটলাম আমরা প্রায় ভর দুপুরে সাগরে। তখন জোয়ার চলছিলো। আমরা সবাই হুটোপুটি করে নেমে গেলাম সাগরের জলে। এই দলে বাচ্চা বুড়ো সবাই ছিলো। কিন্তু আমরা সবাই তখন যেন বয়স ভুলে যাওয়া এক দূরন্ত শিশুর দল। আমাদের পাগলামী দেখে ছুটে এলো ঘোড়াওয়ালা, গাড়িওয়ালা এমনকি জেটস্কিওয়ালা তো বটেই। আমাদের দলের মেয়েরা ছিলো তখনও বেশ ভীতুর ডিম। কাজেই আমাকেই সাহস জোগাতে উঠতে হলো তাতে। ব্যস তারপর আর পায় কে আমার সাহসে সাহসী হয়ে সকলেই চললো সাগর পাড়ি দিতে।
বিকালে আমাদের নিমন্ত্রন ছিলো কক্সেসবাজার এয়ার বেজে। ১৩ তলা বিল্ডিং এ উঠে সবাই সাগর দেখছিলো আর আমি দেখেছিলাম ঝাউবনে দোল খেয়ে যাওয়া আশ্চর্য্য সুন্দর নরম কোমল ঝিরঝিরে পাতার দোলা। কি মায়াময়। চোখ জুড়িয়ে যায়!
ঝাউবনে পাতাগুলো দুলছে
এরপর আমরা গেলাম তাদের প্রাইভেট সী বিচে। সেখানে আর কেউ ছিলো না শুধুই আমরা। দিগন্ত বিস্তৃত সমুদ্র আর সৈকতের মাঝে সাজানো ছিলো এক নক্সাদার সাম্পান! আর আমাকে পায় কে? সাম্পানে উঠে গান জুড়ে দিলাম ওরে সাম্পানওয়ালা। হা হা সাথে সাথেই আমার কাজিন সাম্পানওয়ালা হয়ে হাজির। আমাদের সাথে উঠলো আরও আরও অনেকেই সেই সাম্পানে। আমরা সবাই সেদিন প্লান করে লাল পরেছিলাম। লালে লাল বোঝাই হয়ে উঠলো সাম্পানের সেই নক্সাদার নাও। সাথে চললো আমাদের অভিনয়। আমরা তখন শাবানা ববিতা আলমগীর হা হা ।
আমার কাজিন ডক্টর আর আমার অভিনীত সাম্পানওয়ালা সিনেমার দৃশ্য
ময়ুরপঙ্খী ভিড়িয়ে দিয়ে সেথা দেখে এলেম তারে, সাত সাগরের পারে
পরদিন ছিলো আমাদের চান্দের গাড়ি করে মেরিন ড্রাইভে ছুটে যাবার পালা। কলাতলী থেকে আমরা রওয়ানা দিয়ে সোজা টেকনাফ। পথে যেতে যেতে হুডখোলা গাড়িতে নৈস্বর্গিক সৌন্দর্য্যে আহা মরি মরি। রাস্তার দুই দিকে দুই সৌন্দর্য্য। একদিনে সবুজে ঘেরা পাহাড়ি প্রকৃতি আরেক দিনে সীমাহীন সৌন্দর্য্য নিয়ে কল্লোল তুলছে সাগর। তার পাড়ে বড় বড় সাম্পান দাঁড়ি্যে। আমি তো মুগ্ধের উপর মুগ্ধ।
মেরিনড্রাইভে চান্দের গাড়িতে ছুটে চলার সময় তোলা ছবি তড়িঘড়ি
যাইহোক মাথিনের কুপে গেলাম আমরা। মন খারাপ করা এক ভালোবাসার ইতিহাস নিয়ে জেগে রয়েছে সেই কুপ। সংক্ষেপে সেই সত্য ঘটনা- বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকের ঘটনা, কলকাতার সুদর্শন কর্মকর্তা ধীরাজ ভট্টাচার্য অতি ভয়ংকর ও দুর্গম এলাকা টেকনাফ থানায় বদলি হয়ে আসেন। সবুজ পাহাড়ে ঘেরা টেকনাফ থানায় তার তেমন কোনো কাজকর্ম ছিল না। অনেকটা এখানে সেখানে ঘুরেফিরে সময় কাটাতেন। থাকতেন থানার আধপাকা ঘরের একটি কক্ষে। একদিন একাধিক নারী কণ্ঠের অস্পষ্ট মৃদু গুঞ্জনে ধীরাজের ঘুম ভেঙে যায়। থানার ছোট বারান্দায় এসে দেখলেন রং-বেরঙের ফতুয়া পরিহিতা ৫০/৬০ জন মগী রাখাইন তরুণী পাত কুয়ার চারদিকে জড়ো হয়ে হাসিগল্পে মশগুল। তাদের সুউচ্চ কলহাস্যে থানার প্রাঙ্গণ মুখরিত। এটাই ছিল সমগ্র টেকনাফে একটি মাত্র কুয়া। প্রতিদিন তরুণীরা পাত কুয়ায় জল নিতে আসতেন। আর ধীরাজ থানার বারান্দায় চেয়ারে বসে তরুণীদের জল তোলার দৃশ্য দেখতেন।
একদিন ধীরাজের নজরে পড়ে সম্পূর্ণ নতুন সাজে সজ্জিত আরেক তরুণীকে, সুন্দরী এই তরুণীর নাক-চোখ-মুখ বাঙালির মেয়েদের মতো। নাম তার মাথিন। টেকনাফের জমিদার ওয়ান থিনের একমাত্র মেয়ে। প্রথম দর্শনেই মেয়েটিকে তার ভালো লেগে যায়। প্রতিদিন ভোর হওয়ার আগেই ধীরাজ ভট্টাচার্য থানার বারান্দায় চেয়ারে গিয়ে বসতেন এবং মাথিনের আগমনের প্রতীক্ষা করতেন। মাথিন যখন কলসি কাঁখে তার সুউচ্চ গ্রীবা দুলিয়ে থানা প্রাঙ্গণ দিয়ে হেঁটে আসতেন, ধীরাজ তন্ময় হয়ে সে দৃশ্য উপভোগ করতেন। অন্যান্য তরুণী আসার আগেই মাথিন পাতকুয়ায় আসতেন এবং জল নিয়ে ফিরতেন। ভোরের স্নিগ্ধ আলোয় নীরব নিস্তব্ধ পরিবেশে তারা একে অপরের সঙ্গে গভীর প্রেম ও মোহবেশে আচ্ছন্ন হয়ে থাকতেন।
দিন গড়াতে থাকে। একদিন-দুদিন এভাবে। ইতোমধ্যে দুজনের প্রেমের কথা সবাই জেনে যায়। নানা বাধা সত্ত্বেও দুজনের মধ্যে বিয়ের কথা পাকাপাকি হয়। এরই মাঝে কলকাতা থেকে বাবার চিঠি আসে ধীরাজের কাছে। ধীরাজকে কলকাতা যেতে হবে এক মাসের ছুটি নিয়ে। ছুটি না মিললে চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে হলেও যেতে হবে। ধীরাজ সিদ্ধান্ত নেন কলকাতা যাবেন। সিদ্ধান্তের কথা মাথিনকে জানানো হলো। মাথিন রাজি হলেন না। তাই অনেকটা বাধ্য হয়ে ধীরাজ এক সন্ধ্যায় টেকনাফ ছাড়ে পালিয়ে গেলেন। ধীরাজের এভাবে চলে যাওয়াকে প্রেমিকা মাথিন সহজভাবে মেনে নিতে পারেননি। মাথিনের মনে হলো, বাবার অসুখের কারণ দেখিয়ে ধীরাজ বরং বিয়ে করার ভয়েই পালিয়েছে। ধীরাজকে হারিয়ে মাথিন অন্নজল ত্যাগ করে হন শয্যাশায়ী।
জমিদার বাবা ওয়ান থিনসহ পরিবারের সদস্যরা শত চেষ্টা করেও মাথিনকে অন্নজল ছোঁয়াতে পারেননি। তার এককথা, ধীরাজকে চাই। প্রেমের এই বিচ্ছেদ এবং অতিকষ্টে একদিন মাথিন মারা যান। এ কারণে প্রেমের সাক্ষী মাথিনের কূপ দেখে এখনো হাজারো প্রেমিক-প্রেমিকা তাদের ঐতিহাসিক প্রেমের কথা স্মরণ করে আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়ে। মাথিনের কুপ
এই সেই মাথিনের কুপ
আর এই সেই মাথিনের প্রেমিক প্রবর
এরপর জিরো পয়েন্ট, সাবরাং ট্যুরিজম পার্ক, সাম্পান পয়েন্ট, ইনানী বিচ এবং সী মাউন্ট বিচ রেস্টুরেন্টে কিছু বিশ্রাম নিয়ে চললাম মিনি বান্দরবানে। সী মাউন্ট রেস্টুরেন্টে ক্রিম অব চিকেন মাশরুম স্যুপ আর গার্লিক ব্রেডটোস্ট খুবই মজাদার ছিলো। আমদের সাথীরা অবশ্য ভাত মাছ ডাল সবই খেলো হালুম হুলুম।
সি মাউন্ট রেস্টুরেন্ট
ক্রিম অব চিকেন মাশরুম স্যুপ এন্ড গার্লিক ব্রেড
সি মাউন্ট রেস্টুরেন্টে ক্লান্ত শ্রান্ত বিধস্ত ছবি
সী মাউন্ট বিচ রেস্টুরেন্টে আরেকটা ঢং ঢাং ছবি
এরপর সোজা মিনি বান্দরবান। ভর দুপুরে মিনিবান্দরবানে পাহাড়ের ঢালে এসে থামলো আমাদের গাড়ি। উঠবার মুখেই চোখে পড়ে গেলো ছোট ছোট বাচ্চারা সবুজ গোলাকার এক রকমের ফল বিক্রি করছে।সবাই বললো খুব মজার ফল। কাঁঠি দিয়ে মশলা মাখিয়ে খেতে দেওয়া হয়। সবাই খুব মজা মজা বলছিলো আসলে সেটা ছিলো এক আশ্চর্য্য ভয়ংকর টক ফল। তার নাম নাকি আনারকলি। এমন এক টক ফলের নাম সুন্দরী বাই আনারকলির নামে! কে দিলো আল্লাহই জানে। সবাই অবশ্য সেই টকটকে টক আনারকলি চেটে পুটে খেয়েছে। সেই ফলগুলো বিক্রি করছিলো ছোট ছেলেমেয়েরা। কিন্তু আমি এক চামচ খেয়েই ভো দৌড়!
আনারকলি ভয়ংকর এক টকফলের জনপ্রিয় খানাপিনা
এরপর আমরা গেলাম হিমছড়ি। সারাদিন এই ঝকঝকে রোদে ঘুরে কালী ভূত হয়ে ক্লান্ত শ্রান্ত এই আমাদের আর পা চলছিলো না। হোটেলে ফিরে একটু রেস্ট নিয়ে চললাম আমরা রাতের সাগরে। রাত সাড়ে আটটা থেকে ১ টা পর্যন্ত সাগরের ধারে কেটে গেলো আশ্চর্য্য সুন্দর কিছু সময় গানে গানে, গল্পে কথায়। রাতের সাগরের উত্তাল জোয়ারের জলে আলো ঝিকিমিকি ঢেউ। এত সুন্দর যার সাথে অন্য কিছুরই তুলনা চলে না। এত রাত ছিলো তবুও সৈকত তখনও ছিলো সরগরম। ফিশ বারবিকিউ চলছিলো। আমরা খেলাম কোরাল আর স্নাপার মাছের বারবিকিউ। এই পোস্টে আর খানাপিনার ছবি দিলাম না আর রা্তের সেই আলোঝিলিমিলি সাগরের ঢেউ এর ছবি শুধু ভিডিওতেই আছে।
আমাদের দলের মেয়েদের শপিং দেখে আমি শপালহোলিক মানুষেরও চক্ষু চড়কগাছ। আচার, ব্যাগ, জামা কাপড় শুটকি কিনে কিনে ঘর বোঝাই করলো তারা। আমি শুধু কয়েকটা বড় ঝিনুক, শঙ্খ আর প্রবাল কিনলাম আমার একুরিয়ামের একুয়াস্কেপিং সজ্জার জন্য। পরদিন ছিলো যেমন খুশি তেমন সাজোর মত যেমন খুশি তেমন ঘোরো। মানে যে যার মতই সেদিন দিনটাকে পাস করবে। কোনো গ্রুপ গেলো মটর সাইকেল ড্রাইভিং এ কোনো গ্রুপ গেলো শপিং এ আর আমি একেবারেই যেমন খুশি তেমন ঘোরো বাদ দিয়ে যেমন খুশি তেমন সাজো সজে চললাম সী বিচে। আমার সেই সাজ দেখেই বুঝে গেলো ফটোগ্রাফারেরা যে আমি আসলে ফটোশ্যুট করতেই এসেছি। দৌড়ে এলো ঘোড়া, দৌড়ে এলো গাড়ি। আর আমি তাই ঘোড়া ছুটিয়ে গাড়ি চালিয়ে এক্কেবারে যেমন খুশি তেমন ছোটো তখন। আর চললো ফটোগ্রাফারের ক্লিক ক্লিক!
এই ছবির নাম সবাই দিয়েছে ধীরে ধীরে চল ঘোড়া, সাথী বড় আনকোরা....... হা হা
এই ছবির নাম আমিই দিয়েছি এই পথ যদি না শেষ হয় তবে কেমন হত তুমি বলোতো?
এই ছবিটা মিররমনির জন্য ...
সাগরের তীর থেকে মিষ্টি কিছু হাওয়া এনে কাহার কপালে ছোঁয়াবো গো ভাবি মনে মনে!!!
দুপুরে আমরা খেলাম কড়াই নামে এক রেস্টুরেন্টে। ভেবেছিলাম এত সুন্দর দেখতে একটা রেস্টুরেন্ট খানাও নিশ্চয় মজাই হবে। কিন্তু কখনও কখনও খানা খেয়ে মানুষ বাবার নাম ভোলে শুনেছি আমি তো সেই খানা খেয়ে আমার নানার নামও ভুলে গেলাম। যাইহোক আবার ছুটলাম হোটেলে। সাজসজ্জা পাল্টে আবারও সী বিচের ঝাউবনে, চকচকে পানিতে সাগরের জলে ফটোশ্যুটিং। হা হা ফটোগ্রাফারের নাম ছিলো জুবায়ের। সে কিন্তু সত্যিই সুন্দর ছবি তোলে। আমাকে ছবিতে আমার চেয়েও সুন্দর করে দিয়েছে কোনো এডিটিং ছাড়াই।
এই দেখো আমার প্রজাপতি স্কার্টটা কিন্তু আবারও পরেছি...
আমাদের চারদিনের সফরের শেষ দিনে আমাদের ফ্লাইট ছিলো বিকেলে কাজেই সকালটাতো হেলায় কাটানো যায় না। আমরা মেয়েদের দল খুব ভোরে উঠে চলে গেলাম সী বিচে। দুপুর, বিকেল, সন্ধ্যা, রাতের সী বিচ দেখার পর এই ভোরটাই দেখা বাকী ছিলো। সত্যি বলতে ভোরের সমুদ্দুর, সে যেন এক অন্য রকম স্নিগ্ধতা। বুক ভোরে শ্বাস টেনে নিলাম। আমরা একটা বেড নিয়ে বসে রইলাম তিনজন মূর্ত মানবী আমি, আমার কাজিন আর তার ননদ শিরিন। ভোরের আলো ফুটে ওঠা ভেজা চকচকে বালিতে প্রতিচ্ছবি নিয়ে দুলকী চালে চলছিলো স্বর্ণালী ঘোড়া বাহাদূর, তার সঙ্গিনী ঘোটকী মহারাণী এবং তাদের রাজকুমার সম্রাট বারাকাহ। কি যে সুন্দর লাগছিলো সেই ছবি! অনেকেই ভোরের সাগরে অবগাহন করছিলো। অনেকেই দুই চোখে মেখে নিচ্ছিলো সাগরের ছবি।
ভোরের সাগর শান্ত জলে
এর মাঝে আশ্চর্য্য এক দৃশ্যে চোখ আটকে গেলো আমার! এক বৃদ্ধা হুইল চেয়ারে করে সমুদ্র দর্শনে এসেছেন। তার সাথে বেশ কয়েকজন ছেলে মেয়ে নাতি পুতিও। সকলের মধ্যমনি তিনি। তাকে ঘিরে চলেছে তার মায়াময় পরিবারের বাকী সদস্যেরা! কি সুন্দর সেই ছবি! সবাই সমুদ্র দর্শনে যাবে আর তিনি হতে পারেন বৃদ্ধা, হতে পারেন অচল। তবুও তাকে ছাড়া পরিবারের লোকজন কিছুতেই শান্তি পাবে না এই সাগরের সৌন্দর্য্য অবলোকনে। আর তাই এই ব্যবস্থা!
মায়াময় এই ধরিত্রীর বুকে অসাধারণ এক মায়াময় সুখী পরিবারের ছবি!
এমন এক সফল জীবনের পর ঐ বৃদ্ধার বুঝি আর কিছুই চাইবার থাকে না........
হোটেলে ফিরে ব্রেকফাস্ট আর তারপর বাকী সময়টুকুর সফল ইউটিলাইজেশনে আমরা আবার বেরিয়ে পড়লাম বৌদ্ধ মন্দির দর্শনে। অটো করে চললাম সেখানে। গেইটের গায়ে লেখা ছিলো অগ্গমেধা ক্যাং। আমি মনে মনে ধরেই নিলাম এই মুনী অজ্ঞ ছিলেন নিশ্চয়। কিন্তু গাইড জানালো আগে ভাগেই অনেক কিছু প্রেডিক্ট করতে পারতেন তিনি তাই এমন নাম উনার। যাইহোক সেখান থেকে স্থানীয় মার্কেটে কিছু কেনাকাটা করে আমরা গেলাম কিছু খানা পিনা করতে। যদিও রাতের ফিস বারবিকিউ ছাড়া আমাদের কোনো খানাই এইখানে পছন্দ হয়নি কিন্তু পৌষী নামে সেই হোটেলের কোরাল ভর্তা, সব্জী, ঘন ডাল আর কালাভূনা খুবই মজা ছিলো।
অগ্গমেধা ক্যাং
এরপর ফেরার পালা। আল্লাহ আল্লাহ করতে করতে, আয়াতুল কূরসী পড়তে পড়তে চোখ বুজে চেপে বসলাম ইউ এস বাংলার উড়াল যানে। পাইলট ছিলেন অর্ণব। ইউ এস বাংলার কোনো ফ্লাইটের উপরেই জীবনে বিশ্বাস ছিলো না কিন্তু পাইলট অর্নবের সুদক্ষ প্লেন ড্রাইভিং এ আমি তার ফ্যান হয়ে গেলাম। ইউ এস বাংলার সেদিনের পাইলট অর্নব জানবে কি জানবে না আমি জানিনা কিন্তু তার জন্য অনেক দোয়া আমাকে এত ভয়ংকর অবিশ্বাসের মাঝ দিয়ে সুন্দর ভাবে ধরিত্রীতে অবতরন করিয়ে দেবার জন্য।
যদিও ফিরে আসতে মন চাইছিলো না। তাই ফিরে আসার আগের দিন গোধুলীবেলা একা একা সাগরপাড়ে একটা মন খারাপের ছবি তুলে নিলাম।
দিনশেষে আসে গোধূলির বেলা ধূসর রক্তরাগে
ঘরের কোণায় দীপ জ্বালাবার আগে;
নীড়ে-ফেরা কাক দিয়ে শেষ ডাক উড়িল আকাশতলে,
শেষ-আলো-আভা মিলায় নদীর জলে।
হাওয়া থেমে যায় বনের শাখায় আঁধার জড়ায়ে ধরে;
নির্জন ছায়া কাঁপে ঝিল্লির স্বরে।
তখন একাকী সব কাজ রাখি প্রাসাদ-ছাদের ধারে
দাঁড়াও যখন নীরব অন্ধকারে
জানি না তখন কী যে নাম তব, চেনা তুমি নহ আর,
কোনো বন্ধনে নহ তুমি বাঁধিবার।
সেই ক্ষণকাল তব সঙ্গিনী সুদূর সন্ধ্যাতারা,
সেই ক্ষণকাল তুমি পরিচয়হারা।
দিবসরাতির সীমা মিলে যায়; নেমে এস তার পরে,
ঘরের প্রদীপ আবার জ্বালাও ঘরে।
একখানা রবিঠাকুরের কবিতাও জুড়ে দিলাম। দেখি কে বলতে পারে এটা কোন কবিতা?
শেষ হলো আমার কক্সেসবাজার ভ্রমনের আনন্দময় স্মৃতি রোমোন্থন। সবার জন্য এক সাগর ভালোবাসা।