নূর মোহাম্মদ নূরু
আমরা কিছু সামু পাগল আছি যাদের সামুতে না লিখলে কিছুই ভালো লাগে না। নুরুভাইয়া মনে হয় ছিলেন সেই দলে। প্রথমদিকে উনাকে ফুল ফল ও মনিষীদের জীবন নিয়েই লিখতে দেখেছি। কিছুদিন হলো ছড়া লিখতেন। আমি জানি আমরা যারা লিখতে ভালোবাসি লিখতে না পারলে যেন পেটের ভাত হজম হয় না। নুরুভাইয়াও ছিলেন তেমনই একজন। প্রায় প্রতিদিনই তার কিছু না কিছু লেখা থাকতো ব্লগের পাতায়। হঠাৎ সেটা থমকে গেলো। শুনলাম ভাইয়া অসুস্থ্য। ২৭ শে সেপ্টেম্বর, ২০২২ রাত ১১:৪৫টায় লিখেছেন তিনি তার শেষ পোস্ট। তারপর পরই তিনি অসুস্থ্য হয়ে পড়েন এবং অক্টোবরের ১০ থেকে শুরু হয় উনার চিকিৎসা। এমনই জানতে পেরেছি ভাইয়ার মেয়ে নাফিসা থেকে। গত কয়েকদিন ভাইয়ার এমন দীর্ঘ অনুপস্থিতি দেখে অনেকেই উদ্বিঘ্ন হয়ে উঠেছিলেন। কেউ কোনো খোঁজ পাচ্ছিলেন না। তাই আজ উনার মেয়েকে খুঁজে বের করে জানতে পেলাম ভাইয়া অনেকদিন আগেই আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। আমরা তার কোনো খবর পাইনি। মনটা ব্যথায় ভরে উঠলো। আল্লাহ ভাইয়াকে বেহেস্ত নসিব করুন।
যাইহোক ভাইয়ার মেয়ে নাফিসার সাথে যা কথা হয়েছে তা তুলে দিচ্ছি।
আমি: তুমি কি নুরু ভাইয়ার মেয়ে?
নাফিসা বিনতে্ নূর:
জ্বী, আমিই ওনার মেয়ে
আব্বু গত ২৯শে অক্টোবর, আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন
আমি তো আব্বুর ২ আইডিতেই ট্যাগ করে, পোস্ট করে জানিয়েছিলাম তার মৃত্যু সংবাদ
আমি: আমরা জানিনা।
নাফিসা বিনতে্ নূর
``আসসালাম ওয়ালাইকুম।
আমি নাফিসা ওরফে অরিণ , সদ্য প্রয়াত
জনাব নূর মোহাম্মদ বালী - এর কন্যা।
আপনারা সবাই অবগত আছেন যে, আমার আব্বু গত ২৯ শে অক্টোবর, ২০২২ ভোর আনুমানিক ২.৩০ টার দিকে গত হয়েছেন।
শেষ বয়সে, তার ডায়াবেটিস, কিডনী ডিজিস, ইনফেকশন, প্রোস্টেট ডিজিস সহ নানান ধরনের শারীরিক জটিলতা ধরা পরছিল, আর ক্রমশ তিনি মানসিক ভাবে ভেঙে পরছিলেন। আমি আমার আব্বু কে, জীবনের শেষ ১ মাস জান প্রাণ দিয়ে চেষ্টা করেছি, আল্লাহ যেন তাকে একটু আরাম দান করেন... কিন্তু, খাওয়া-দাওয়া, ঘুৃম, অষুধ এসবের অনিয়ম এর কারনে তিনি আর সুস্থ জীবনে ফিরে আসতে পারেন নি। আমার আব্বু কে ঢাকায় ও গ্রামের বাড়ী, আলহামদুলিল্লাহ সবাই একজন নম্রভাষী-ভদ্র-ভালো মানুষ হিসাবে পরিচিত ছিলেন , এমন কাউকে আমি পাই নি যে আমার বাবার নামে ২ লাইন গালমন্দ করেছেন..
ব্যক্তিজীবনে, আমরা ছোটবেলায় তাকে রাগী বাবা হিসাবেই জানতাম। কিন্তু যত বড় হয়েছি, আব্বুকেও শিশু হয়ে যেতে দেখেছি...
বড় অভিমানি ছিলেন, কেউ তাকে একটু কিছু খবর না জানালে মন খারাপ করতেন, কষ্ট পেতেন। কথা বলতেন না... মানুষ ভাবতো, রাগ করেছেন। কিন্তু, বস্তুত সে মনোকষ্ট নিয়ে যাপন করতেন। আমার আব্বু, শেষ জীবনে চিকিৎসায় অনেক অবহেলা করেছিলেন তার ব্যক্তিগত কিছু আর্থিক সংকটের কারনে... ভবিষৎতের দুঃচিন্তা তাকে সর্বত্র গ্রাস করে ছিল। কিন্তু আফসোস, সে আমাদের সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়ে, নিজেই অতিতের খাতায় নাম লেখালেন।
আমিও বেশ অনুতপ্ত, কেনো আরেকটু আগে জোর করে চিকিৎসা শুরু করালাম না, কেন আরেকটু সময় তাকে দিলাম না... কেনো একটু জলদিই আমাকে একা করে দিয়ে, আমাকে ফাঁকি দিয়ে আব্বু চলে গেলো...!!?? কেনো? আমি ফ্লোরে, আব্বু বিছানায়... আমাকে একটু ডাকার কী শক্তি কী যে যোগাতে পারেনি? মারা যাওয়ার সময়, আমার আব্বু অসহনীয় মৃত্যু যন্ত্রণায় ভোগ করেছেন।
তার ২ টো কিডনী তেই নল লাগানো ছিল (PCN), আর সামনে ছিল ক্যাথেটার। যেদিন প্রথম ডায়ালাইসিস হলো, সেটুকু সময় দেখলাম তাকে একটু ঘুমুতে। সন্ধ্যারাত টায় একটু সুজি খাওয়ার পরই করে দিলেন বমি! এরপরই শুরু হলো বিপত্তি! মধ্যরাত টা কেটে যাওয়ার পর পরই, তার কষ্ট শুরু হয়েছিল। না শুতে পারছিলেন, না বসতে পারছিলেন, না দাড়াতে পারছিলেন... ওদিকে ইউরিন-স্টুলিং বন্ধ হয়ে গিয়েছিল.... এরপর শুরু হলো শ্বাসকষ্ট! অক্সিজেনেও তার দম আটকে যায়... এই চোখ এসব কিছুই ভূলতে পারে না!
এদিকে, ৩ দিনের টানা পরিশ্রমে, আমি কোনভাবেই আর বসে/দাড়িয়ে থাকতেই পারছিলাম না। কিন্তু তারপরেও, সে রাতে আমার আব্বুর থেকে দূরে থাকতে আমার মন টানছিলো না, আমার বরের হাজার অনিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও... থেকে গেলাম! আর সাক্ষী হয়ে রইলাম, আব্বুর তীব্র মৃত্যু যন্ত্রণার! তবুও, রক্ত মাংসের শরীর... আব্বুর চোখ টা ২ মিনিটের জন্য বন্ধ হতেই, হাসপাতালের মেঝেতে যেয়ে শুয়ে পরি, ভাবি আধা ঘণ্টা পরে এসে দেখবো আবার.... আল্লাহর প্ল্যান তো!
ঘুম ভাঙে, প্রায় ৩.০০ অথবা ৩.৩০ টায়!
দৌড়ে গিয়ে দেখী আব্বু চুপ! আব্বুর শরীর ঠান্ডা! আব্বুর হার্টবিট চুপ! আব্বুরে.. বা রে, ও বাবা... আমার বাবা রে... কত কিছুই বলি না কেন, আব্বু আর সাড়া দিলেন না!.... ডাক্তারও সাহস পান নাই... আমিই জিগাসা করলাম, "উনি কী আছেন.... না নাই? আমি শক্ত আছি, আমাকে বলেন প্লীজ...." তারপরও তারা চুপ... আমি কী বাসার মানুষদের খবর দিবো?"
"দেন।" জানলাম, আমি আমৃত্যু "আব্বুরে " ডাকার অধিকার থেকে বঞ্চিত হলাম! তারপর আর কী.... আমার কলিজা ছিড়ে নিয়ে.... আব্বু কোথায় যেন চলে গেল....। নানান শোকপালন- নিজ বাড়ী গমন - আনুষ্ঠানিকতা - জানাজা শেষে... আমার দাদা-দাদীর কোলে, তাদের ছেলে শুইয়ে দিয়ে আসলাম।
আপনাদের সাথে, আব্বুর যন্ত্রণাদায়ক মৃত্যুর কাহিনি টা শেয়ার করলাম কেন জানেন??"বয়স হয়েছে, মরে গেছে!" - এই কথা টা যেন বলতে না পারেন। আমার আব্বু কার কার কথায়, কার দেয়া কতখানী কষ্ট নিয়ে ওই আধাঁর কবরে শুয়ে আছেন... সেসব শুধু আমার কানে আসতেছে।আমার আব্বু অসহনীয় কষ্ট সহ্য করে মারা গেছেন, আমরা তো না ই, তিনি নিজেও জানতেন না এত তারাতাড়ি তার ডাক আসবে... আমি ভেবেছিলাম, আমার কষ্টের প্রতিদান আল্লাহ দিবেনই! দেন নি.... সেটুকুর বিনিময়েও, আল্লাহ যেন তাকে জান্নাতবাসীদের অন্তর্ভুক্ত করে নেন!
আপনারা, যারা আব্বুর অতি প্রিয়জন কিন্তু, তার জানাজায় শরীক হতে পারেন নি, তাদের কাছে আমি ক্ষমাপ্রার্থী। বিশেষ করে, ইলাহ্ আংকেল, প্লাবন আংকেল, শামীম আংকেল, হারুন আংকেন, সোহেল আংকেল.... আমাকে ক্ষমা করে দিবেন।আব্বুর মৃত্যু পরবর্তী কষ্ট লাঘবের উদ্দেশ্যেই আমাদের যত জলদি প্রস্থান। এটুকু জেনে খুশি হবেন যে, আপনারা না থাকলেও আলহামদুলিল্লাহ, গ্রামে আব্বুর জানাজায় প্রায় ৫০০ থেকে ৬০০ মানুষ উপস্থিত ছিলেন। সবার দোয়া আল্লাহ কবুল করবেন ইন শা আল্লাহ!
আর, যাদের মনোকষ্টের কারন আব্বু... ( আমার জানা মতে নাই) তাদের কাছেও, আমি তার মেয়ে হয়ে আপনাদের কাছে হাতজোর করে ক্ষমা চাচ্ছি। যদি তিনি কোনও ভূল করেও থাকেন জীবনে, তার শাস্তি তিনি মৃত্যুর সময়ে ভোগ করে গেছেন.... এটা মনে করেই ক্ষমা করে দিবেন! আপনারা শুধু একটু মন থেকে দুয়া করে দিয়েন তার জন্য....
এমন মৃত্যু তো আপনার/আমারও হতে পারে, সবাই না হয় সবার জন্য দোয়া করে, নিজেদের কষ্ট একটু লাঘব করি!সবাই ভালো থাকবেন, কবরবাসীদের জন্য দোয়া করবেন! আল্লাহ তাদের জান্নাতুল ফেরদৌস দান করুন! আমিন!
আমি: কি হয়েছিলো উনার?
নাফিসা: আব্বুর প্রায় ১০ বছর ধরে ডায়াবেটিস ছিলো।
১/১.৫ বছর আগে প্রোস্টেট ডিজিস ধরা পরে, বড় হয়ে গিয়েছিল।
ডাক্তার তখনই বলেছিলেন অপারেশন করার কথা৷ কিন্তু, সংশয় এবং কিছু আর্থিক সংকট থাকার কারনে তিনি সে সময় অপারেশন টা করার নি। তার কিছুদিনের মধ্যেই , তার কিডনী সমস্যা ধরা পরে। ১ বছর ধরেই তা প্রকট হচ্ছিল... প্রোস্টেট এর কারনেই ক্রিয়েটিনিন বেড়েই যাচ্ছিলো... অক্টোবর এর ১০ তারিখ থেকে তার চিকিৎসা শুরু করা হয়।
ক্যাথেটার, পিসিএন, মুখে খাবার ঔষধ... সব চলছিল। কিন্তু ২৩শে অক্টোবর, পিসিএন (কিডনীর পানি বের করার জন্য, পিঠে ফুটো করে অতিরিক্ত পানি বের করার জন্য নল লাগানো) করার পর থেকে তার অসহ্য ব্যথা, কষ্ট, যন্ত্রণা শুরু হয়ে যায়... ২৬ তারিখে আমরা তাকে ঢাকা মেডিকেল এ ভর্তি করি৷ তারপর তার অবস্থার উন্নতি না হওয়ায়, ডাক্তার তাকে ডায়ালাইসিস করানোর উপদেশ দেন।
কিন্তু ঢাকা মেডিকেল এর দীর্ঘ প্রক্রিয়ার কারনে, তাকে ১ দিন বিলম্বে ডায়ালাইসিস করানো হয়। সেই মাঝের একদিন এই, তার ডায়াবেটিস নীল হয়ে উল্টোপাল্টা বকতে থাকা, না খাওয়া, স্ট্রোক এর রোগীর মত আচরন করা... এসবের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়।
পরের দিন ২৮শে অক্টোবর, সন্ধ্যায় তাকে ডায়ালাইসিস দেওয়া হয়। কিন্তু, এর পরে তাকে কোনভাবেই খাওয়ানো যায়নি, জোর করলেও বমি করে দিয়েছেন। অষুধ খেয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করলেও, তাকে আর শান্তিতে ঘুম পাড়ানো যায় নি। রাতের ১০.৩০/১১.০০ টা থেকে তার মৃত্যু যন্ত্রণা শুরু হয়ে যায়... এরপরই সেরকম একটা অবস্থায়ই আনুমানিক ২.০০-৩.০০ টার মধ্যে তার মৃত্যু হয়।
আব্বুর মৃত্যু সম্পর্কিত যাবতীয় তথ্য আমি দিয়ে দিলাম। এরপরও কিছু জানার থাকলে অবশ্যই কল দিবেন।
বাবা অনেক কষ্ট পেয়ে মারা গেছেন, আমার বাবার জন্য একটু দোয়া রাখবেন আপু।
আল্লাহ ভাইয়াকে বেহেস্ত নসিব করুন। ভালো থাকুক ভাইয়া ওপারের দেশে। আজ প্রায় এক মাস হতে চললো জানতে পারিনি আমরা ভাইয়া যে আর নেই। আমরাও একদিন নীরব হয়ে যাবো এই ব্লগের পাতায়। হয়ত কেউ জানবে হয়ত জানবে না।
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে নভেম্বর, ২০২২ রাত ২:২৩